প্রান্তিক গ্রামীণ নারী

কাজের স্বীকৃতি, মজুরিবৈষম্য দূর ও ভূমিতে অধিকার প্রতিষ্ঠিত হোক

মোট জনসংখ্যার অর্ধেক হলেও সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং রাষ্ট্রীয় পরিসরে নারীদের এখনো সমঅভিগম্যতা প্রতিষ্ঠিত হয়নি। এক্ষেত্রে প্রান্তিক গ্রামীণ নারীরা আরো পিছিয়ে। কৃষি, খাদ্যনিরাপত্তা, ভূমি, প্রাকৃতিক সম্পদের ব্যবস্থাপনা, গৃহ ব্যবস্থাপনা, ব্যবসা-বাণিজ্যসহ গ্রামীণ অর্থনীতিতে তাত্পর্যপূর্ণ ভূমিকা রাখছেন বটে, কিন্তু বিভিন্ন ক্ষেত্রে তারা আজও বঞ্চনার শিকার। বঞ্চনার অঞ্চলগত মাত্রায় হেরফের থাকলেও এর সর্বজনীন চরিত্র একই। ভূমি মালিকানায় নারীদের অভিগম্যতা কম। মোট ভূমিতে পুরুষের অংশ যেখানে ৮০ শতাংশ, সেখানে নারীদের অংশ ২০ শতাংশ মাত্র। ঐতিহ্যিকভাবেই কৃষিতে নারীরা বিভিন্ন ধরনের কাজ করে আসছেন। জীবিকার প্রয়োজনে সাম্প্রতিক সময়ে পুরুষের শহর বিদেশমুখী ঘটেছে। এতে কৃষি ক্ষেত্রে গ্রামীণ নারীর কাজের চাপ আরো বেড়েছে। ঘর-গৃহস্থালীর চৌহদ্দি পেরিয়ে এখন কেউ কাজ করছেন কৃষক হিসেবে, কেউ কাজ করছেন কৃষি শ্রমিক হিসেবে, আবার কেউবা যুক্ত হচ্ছেন ক্ষুদ্র ব্যবসায়। অথচ এসব কাজের আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি মিলছে না। সম্প্রতি অনুষ্ঠিত বণিক বার্তার এক ওয়েবিনারে আলোচকদের ভাষ্যে উঠে এসেছে, জমিতে মালিকানা না থাকায় নারীরা কৃষক হিসেবে স্বীকৃতি পাচ্ছেন না। ফলে তারা সরকারি সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। একই কারণে ব্যাংক থেকে ঋণ নেয়ার ক্ষেত্রেও তাদের ঝামেলা পোহাতে হচ্ছে। ক্ষুদ্র ব্যবসায় যুক্ত নারীদের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। উদ্যোক্তা হিসেবে পাচ্ছেন না আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি। কাজেই মিলছে না বাংলাদেশ ব্যাংকের অধীন জামানতবিহীন ঋণের সুবিধা। সমরূপভাবে, কৃষি শ্রমিক হিসেবে যারা কাজ করছেন তারাও বঞ্চনার মুখোমুখি হচ্ছেন। উল্লিখিত ওয়েবিনারে সংশ্লিষ্টদের আলোচনায় যথার্থভাবে উঠে এসেছে যে, সমান কাজ করলেও মজুরিতে বৈষম্য বিরাজমান। পুরুষ শ্রমিক যেখানে ৩০০ টাকা পান, সেখানে নারী শ্রমিক পান ২০০ টাকা। এসব বঞ্চনার অবসান জরুরি।

কভিডের পরিপ্রেক্ষিতে গ্রামীণ নারীর জন্য বাড়তি চ্যালেঞ্জ সৃষ্টি হয়েছে। পারিবারিক আয় কমায় তাদের আরো বড় মাত্রায় অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে যুক্ত হওয়ার বাস্তবতা তৈরি হয়েছে। সেক্ষেত্রে গ্রামীণ পরিসরে কৃষির বাইরেও যে আয়বর্ধন কর্মসংস্থানের সুযোগ রয়েছে, সেসব সুযোগ যাতে তারা পান, সেই ব্যবস্থা করতে হবে। তৈরি করতে হবে সহায়ক পরিবেশ। আয়বর্ধনমূলক কাজে যুক্ততার মাধ্যমে গ্রামীণ অর্থনীতিতে প্রাণসঞ্চারের উদ্দেশ্যে তাদের জন্য প্যাকেজ সুবিধা নিশ্চিতে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। ব্যাংকঋণে গ্রামীণ নারীদের অভিগম্যতা আরো বাড়ানো দরকার। প্রয়োজনে বাংলাদেশ ব্যাংক তাদের জন্য শর্ত শিথিলের দিকনির্দেশনা দিতে পারে ব্যাংকগুলোকে। ব্যাংকে প্রবেশাধিকার কম থাকায় অনেক ক্ষেত্রে তারা এনজিওগুলো থেকে উচ্চ সুদে ঋণ নিতে বাধ্য হন। সেক্ষেত্রে তাদের ব্যাংকের দোরগোড়ায় নিয়ে গিয়ে ঋণপ্রাপ্তির সুযোগ যেন করে দেয়া যায়, তার ব্যবস্থা করা জরুরি। সরকারি পর্যায়ে গ্রামীণ নারীদের জন্য কী ধরনের সুবিধা রয়েছে, সেগুলো সম্পর্কে তারা অনেক ক্ষেত্রে ওয়াকিবহাল নন। এসব তথ্য তাদের জানাতে স্থানীয় প্রশাসনের আরো সক্রিয় ভূমিকা রাখতে হবে। বিভিন্ন ধরনের কাজে গ্রামীণ নারীর সম্পৃক্তি যত বাড়বে, তত তাদের স্বাবলম্বের জায়গাটি তৈরি হবে। একই সঙ্গে তাতে গ্রামীণ অর্থনীতিতে সচলতা আরো বাড়বে, সর্বোপরি এর গুণক প্রভাব পড়বে জাতীয় অর্থনীতিতে। এসডিজিতে শ্রমবাজারে নারীর অন্তর্ভুক্তির ওপর জোর দেয়া হয়েছে। বলা হয়েছে, শ্রমবাজারে নারীদের ব্যবধান ২৫ শতাংশ কমানো গেলে জিডিপি বাড়বে শতাংশ। সুতরাং বিষয়টি বিবেচনায় অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে নারীর বৃহত্তর সম্পৃক্তি নিশ্চিতে নীতিনির্ধারকদের বিশেষ নীতি হস্তক্ষেপ কাম্য।

শিক্ষায় সার্বিকভাবে নারীদের প্রবেশ হার বাড়লেও গ্রামীণ নারীরা এক্ষেত্রে পিছিয়ে। বর্তমান জ্ঞাননির্ভর বিশ্বে তাদের এগিয়ে নিতে হলে তাদের শিক্ষার বিষয়টি খুবই জরুরি। বৈশ্বিক পরিসরে এবং দেশের ভেতরে বড় ধরনের ডিজিটাল রূপান্তর ঘটেছে। প্রযুক্তি এখন অনেক এগিয়ে গেছে। তার সঙ্গে মেলায় নারীকে প্রযুক্তিগত জ্ঞান দিতে হবে। প্রযুক্তি সম্পর্কে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। কারিগরি বিভিন্ন কাজের সুযোগ এখন অনেক বেশি। সেগুলোয় নারীদের দক্ষ করে তুলতেও প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণের উদ্যোগ নেয়া চাই। পাশাপাশি সামাজিক বাধাগুলোও দূর করা জরুরি। পুরুষতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থায় এখনো নারীদের প্রতি পুরোপুরি ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে ওঠেনি। বিরাজমান দৃষ্টিভঙ্গি বদলাতে সমাজ সচেতনতা বাড়াতে হবে। স্থানীয় প্রশাসনের সঙ্গে জনপ্রতিনিধিদের এক্ষেত্রে বড় ভূমিকা রাখতে হবে। সার্বিক একটি নারীবান্ধব পরিবেশ উন্নয়নের মাধ্যমে নানা মাত্রায় নারীর সম্পৃক্তি অবারিত হবে, এটিই প্রত্যাশা।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন