তৃতীয় বিশ্বের জন্য ভ্যাকসিন বহুদূর!

বণিক বার্তা অনলাইন

করোনাভাইরাসের সম্ভাব্য ভ্যাকসিন আবিষ্কারকরা ইতিহাসের যে কোনো সময়ের চেয়ে দ্রুততার সঙ্গে চূড়ান্ত পর্যায়ের ট্রায়াল সম্পন্ন করছে। সাম্প্রতিক একটি গাণিতিক মডেল অনুসারে, আগামী বছরই বৈশ্বিক জনসংখ্যার প্রায় দ্বিগুণ অর্থাৎ ১ হাজার ৬০০ কোটি ডোজ ভ্যাকসিন উত্পাদন করা সম্ভব হবে। 

তবে গত মাসের একটি পূর্বাভাস অনুযায়ী, ভ্যাকসিন উত্পাদনে ব্যর্থতা ও বিভিন্ন বাধার কারণে এই পূর্বাভাসগুলো অর্ধেকের বেশি কমে যেতে পারে। অর্থ্যাৎ ভ্যাকসিনের উত্পাদন ৮০০ কোটিরও নিচে নেমে যেতে পারে। 

এই ভ্যাকসিন প্রাপ্তি আসলে অনেকগুলো বিষয়ের ওপর নির্ভর করছে। পরীক্ষামূলক কোন ভ্যাকসিনটি আগেভাগে অনুমোদন পাবে কিংবা কবে নাগাদ ভ্যাকসিনগুলো চূড়ান্ত ট্রায়াল শেষ করতে পারবে- তা এখনো নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না। 

এদিকে কার্যকর প্রমাণিত হওয়ার আগেই বেশ কিছু সংস্থার বিপুল পরিমাণ ভ্যকসিনের ক্রয়াদেশ দিয়ে রেখেছে ধনী দেশগুলো। আবার কিছু সংস্থা নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশগুলোতে ভ্যাকসিন সরবরাহের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। 

ভ্যাকসিন ডোজ বিতরণের জন্য বিশ্বজুড়ে ভ্যাকসিনের সরবরাহ ও অর্থ সরবরাহের বিষয়গুলো এখনো প্রক্রিয়াধীন। কিছু দেশ বলছে, মেধা সম্পদ বা ভ্যাকসিন প্রযুক্তি শেয়ার করার মাধ্যমে দ্রুত ভ্যাকসিন প্রাপ্তি নিশ্চিত করা সম্ভব। আবার অনেক দেশেরই ভ্যাকসিন তৈরি বা সরবরাহের অবকাঠামো নেই। 

স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের উদ্বেগ, এই বিষয়গুলো বিশ্বজুড়ে উত্পাদিত ভ্যাকসিনগুলোর প্রথম দিকে পাওয়া নিয়ে ব্যাপক বৈষম্য তৈরি করবে। 

ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল পর্যালোচনা করা বাংলাদেশ জাতীয় গবেষণা নীতি কমিটির সদস্য সায়েদুর রহমান বলেন, আগামী ২৪ মাসের জন্য মাস্কই বাংলাদেশের করোনাভাইরাসের ভ্যাকসিন! দামের কারণে প্রথম দিকের ভ্যাকসিনগুলো আমাদের দেশ ও অন্যান্য দরিদ্র দেশগুলো কিনতে সক্ষম না-ও হতে পারে। 

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) ফার্মাকোলজি বিভাগের অধ্যাপক সায়েদুর রহমান বলেন, ভ্যাকসিনটি আগামী ১২ থেকে ২৪ মাসের জন্য আমাদের দেশে সাশ্রয়ী মূল্যে বা বাস্তবে সহজলোভ্য হবে না। তাছাড়া এটি সহজলভ্য হলেও খুব সীমিত সংখ্যক পাওয়া যাবে। জনসংখ্যার সর্বোচ্চ ২০ শতাংশ ভ্যাকসিন পেতে পারে।

মার্কিন বহুজাতিক সংস্থা জনসন অ্যান্ড জনসন ৫০ কোটি, আরেক মার্কিন সংস্থা নভোভ্যাক্স ১০০ কোটি এবং ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউটে উত্পাদিত ব্রিটিশ-সুইডিশ সংস্থা অ্যাস্ট্রাজেনেকা ১০০ কোটি ভ্যাকসিন ডোজ স্বল্প ও মধ্যম আয়ের দেশগুলোতে দেয়ার জন্য প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হয়েছে। 

এয়ারফিনিটির তথ্য অনুযায়ী, চীনের ওষুধ প্রস্তুতকারক সংস্থাগুলোও প্রকাশ্যে কভিড-১৯ ভ্যাকসিন সরবরাহের জন্য প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হয়েছে। চীন সরকার বেশ কয়েকটি নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশের জন্য অগ্রাধিকারভিত্তিতে ভ্যাকসিন দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে।

তবে ইউরোপীয়-আমেরিকান থিঙ্ক ট্যাঙ্ক ইয়েলো হাউসের গত মাসের বিশ্লেষণ অনুযায়ী, এই সমস্ত পরিকল্পনা বিপর্যয়ের মুখে পড়তে পারে। সেপ্টেম্বরে তারা ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালে ঐতিহাসিক ব্যর্থতার হার ও উত্পাদনে সম্ভাব্য বিপর্যয়গুলো বিবেচনায় নিয়ে পূর্বাভাস দিয়েছে। তারা বলছে, আগামী বছরের শেষ অবধি উত্পাদনের জন্য ১ হাজার ২০০ কোটি প্রস্তাবিত বা পরিকল্পিত ডোজগুলোর মধ্যে এক তৃতীয়াংশ থেকে অর্ধেক বাস্তবায়িত হতে পারে। 

এমন ঝুঁকির জন্য উন্নত দেশগুলো একাধিক ভ্যাকসিন উদ্ভাবকের সঙ্গে চুক্তি করতে বাধ্য হয়েছে। এদিকে সময়মতো ও ন্যয়সঙ্গতভাবে ভ্যাকসিন পেতে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার উদ্যোগে কোভ্যাক্স প্রোগ্রামে ১৮৪টি দেশ অংশ নিয়েছে। এটির মাধ্যমে ভ্যাকসিন প্রস্তুতকারক ১০-১৫টি সংস্থার সঙ্গে চুক্তি করে আগামী বছর ২০০ কোটি ডোজ প্রাপ্তির লক্ষ্য রয়েছে। এর মধ্যে প্রায় অর্ধেক নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশ তাদের ডোজগুলোর জন্য অনুদানের ওপর নির্ভরশীল এবং ডোজ প্রতি ১ দশমিক ৬০ থেকে ২ ডলার ব্যয় বহনে সক্ষম। অন্য দেশগুলো তাদের ভ্যাকসিন ডোজগুলোর জন্য অর্থ প্রদান করবে। এই প্রোগ্রাম দেশগুলোর ২০ শতাংশ জনগণের ভ্যাকসিন প্রাপ্তির বিষয়টি নিশ্চিত করবে। এটা মহামারীর তীব্রতা কমাতে সহায়তা করতে পারে। 

সুইজারল্যান্ডভিত্তিক গ্লোবাল হেলথ কনসালট্যান্ট ইয়ভেতে মাদ্রিদ বলেন, কোভ্যাক্সের এই উচ্চাভিলাসী পরিকল্পনায় আমরা চাইবো ভগ্নাংশ নয়, তারা বেশিরভাগ জনগণের ডোজ সরবরাহ করুক। আগামী বছর যদি কয়েকশ কোটি ডোজ ভ্যাকসিন পাওয়া যায়, তবে তার বড় একটি অংশ নিজস্ব চুক্তির আওতায় ইউরোপীয় ইউনিয়ন, ব্রিটেন ও যুক্তরাষ্ট্রের মতো দেশগুলো পেতে পারে। তাছাড়া অনুন্নত দেশগুলোর স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থার মধ্যে যেমন বৈষম্য রয়েছে, তেমনি প্রয়োজনীয় রেফ্রিজারেটেড সরঞ্জামেরও অভাব রয়েছে। অর্থাৎ শিগগিরই সহজলভ্য হওয়া ভ্যাকসিনও তারা গ্রহণ করতে পারবে না। 

নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশগুলো ভ্যাকসিন প্রাপ্তির বিষয়টি নিশ্চিত করতে চলতি মাসে ভারত ও দক্ষিণ আফ্রিকা নতুন উপায়ের কথা বলেছে। তারা বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থাকে কভিড-১৯ ভ্যাকসিনের মেধা সম্পদের অধিকার উন্মুক্ত রাখার কথা বলেছে। এর ফলে দেশগুলো নিজেরাই কভিড-১৯ ভ্যাকসিন তৈরি করতে পারবে। এই প্রস্তাবটি বিশ্বজুড়ে ডব্লিওএইচও এবং ৪০০টিরও বেশি স্বাস্থ্য ও সামাজিক সংস্থা সমর্থন দিয়েছে। 

তবে কিছু দেশ এটির বিরোধিতা করে বলেছে, একই সুবিধা অন্য কৌশলের মাধ্যমে দেয়া যেতে পারে; যেমন ভ্যাকসিন তৈরি ও প্রস্তুতকারক সংস্থাগুলোর মধ্যে যৌথ চুক্তি। এরই মধ্যে এটি কভিড-১৯ ভ্যাকসিন উদ্ভাবন, পরীক্ষা ও উৎপাদন কাজে একটি কৌশল হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে।

অস্ট্রেলিয়ার লা ট্রোব বিশ্ববিদ্যালয়ের স্কুল অব সাইকোলজি অ্যান্ড পাবলিক হেলথের সিনিয়র প্রভাষক ডেবোরা গ্লিসন বলেন, কোভ্যাক্সে অংশ নেয়া দেশগুলোর জন্য এ বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ হবে। কারণ এই উদ্যোগ কেবল তাদের ২০ শতাংশ জনগণের ভ্যাকসিন প্রাপ্তি নিশ্চিত করবে। আরো বিস্তৃত জনসংখ্যার জন্য পর্যাপ্ত ডোজ পেতে মেধাসম্পদ বা ভ্যাকসিন প্রযুক্তি শেয়ারসহ অন্যান্য আইনগত বিষয় নিষ্পত্তির প্রয়োজন হবে। 

সাউথ চাইনা মনিটরিং পোস্ট অবলম্বনে

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন