অনলাইন বৈঠক

ভূমিতে নারীদের অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে হবে

১৫ অক্টোবর ২০২০ ‘গ্রামীণ নারী দিবস’ উপলক্ষে নিজেরা করি ও বণিক বার্তার যৌথ উদ্যোগে ‘অর্থনীতিতে প্রান্তিক গ্রামীণ নারীদের ভূমিকা’ শীর্ষক একটি অনলাইন বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। অনুষ্ঠানে অংশ নেয়া আলোচকদের বক্তব্যের গুরুত্বপূর্ণ অংশ নিয়ে এ ক্রোড়পত্র প্রকাশ হলো

দেওয়ান হানিফ মাহমুদ
সম্পাদক
বণিক বার্তা

গ্রামীণ নারী দিবস সম্পর্কে আমরা অনেকেই জানি না। এটি বিশেষ একটি দিন। গ্রামীণ অর্থনীতি, গ্রামীণ রূপান্তর প্রভৃতি বিষয়ে আমরা বরাবরই বিশেষভাবে আগ্রহী। এজন্য এ-সম্পর্কিত প্রতিবেদন ও নিবন্ধ গুরুত্ব দিয়ে প্রকাশ করে বণিক বার্তা। বণিক বার্তার ৯ বছর পূর্তি উপলক্ষে আমরা এবার বণিক বার্তার প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী সংখ্যাও করছি গ্রামীণ পরিবর্তন নিয়ে। কৃষি, অকৃষি, অবকাঠামো ও সামাজিক খাতে গত ৫০ বছরে গ্রামে কী ধরনের পরিবর্তন এসেছে, সেগুলো নিয়েই চার পর্বের আমাদের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী সংখ্যা সাজিয়েছি। এরই মধ্যে আমরা দুটি সংখ্যা (কৃষি ও অকৃষি খাত) প্রকাশ করেছি। এসব সংখ্যা করতে গিয়েই আমরা দেখেছি, গ্রামীণ এ রূপান্তর যাত্রায় বড় ধরনের ভূমিকা পালন করেছেন গ্রামীণ নারীরা, বিশেষ করে প্রান্তিক নারীরা। আমন্ত্রিত আলোচকরা নিশ্চয়ই বিষয়গুলো ধরে ধরে বিস্তারিতভাবে আলোচনা করবেন। এটি বিস্তৃত আলোচনার দাবি রাখে এজন্য যে একেক জায়গায় নারীদের সংগ্রাম ও সম্পৃক্ততার ধরন একেক রকম। উপকূলীয় অঞ্চলে নারীদের সংগ্রাম এক রকম, উত্তরাঞ্চলে আরেক রকম। পাহাড়ি অঞ্চলের নারীদের সংগ্রাম আবার আরেক রকম। এসব জায়গায় কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি, কৃষি খাতে তাদের অংশগ্রহণ, অকৃষি খাতে তাদের অংশগ্রহণে প্রভূত ভিন্নতা, চ্যালেঞ্জ ও সম্ভাবনা লক্ষণীয়। বর্তমানে গ্রামীণ প্রান্তিক নারীর একটা অংশ দেশের বাইরেও কাজে যাচ্ছে। প্রয়োজনীয় দক্ষতা অর্জন ছাড়া, যথাযথ নিরাপত্তা নিশ্চিত না করে বাইরের শ্রমবাজারে তাদের যুক্ত হওয়া নিয়ে নানা তর্ক-বিতর্কও আছে। এটি নিয়ে সংশ্লিষ্টরা নিশ্চয়ই বলবেন। আমি শুধু এটুকু বলতে চাই, একটি বিশেষ দিনকে সামনে রেখে নিজেরা করি এবং অন্যরা মিলে যে উদ্যোগ নিয়েছে, তা সাধুবাদ প্রাপ্য। মিডিয়া সহযোগী হিসেবে থাকতে পেরে আমরাও গর্বিত। ভবিষ্যতে এ দিনকে ঘিরে আরো বড় পরিসরে আলোচনার উদ্যোগ আশা করি। কারণ বাংলাদেশে এখনো বেশির ভাগ মানুষ গ্রামীণ অর্থনৈতিক কাঠামোর মধ্যে বসবাস করে। এখানে অংশগ্রহণ ও বঞ্চনার জায়গাগুলো যেমন অনেক সুনির্দিষ্ট, তেমনি অনেক বেশি কাজ করার সুযোগও এখানে আছে। সেসব ক্ষেত্র নিয়ে যত আলোচনা হবে, যত সচেতনতা সৃষ্টি হবে, ততই আসলে অর্থনীতিতে কাজের সুযোগ বাড়বে।

খুশি কবীর
সমন্বয়কারী
নিজেরা করি

অনেকেই জানে না যে জাতিসংঘ ঘোষিত ১৫ অক্টোবর গ্রামীণ নারী দিবস। জাতিসংঘের দুটি সংস্থা এক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি ভূমিকা রাখে। একটি হলো ইউএন উইমেন এবং আরেকটি হলো আইএলও (আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা)। তারা দিবসটিকে বড় পরিসরে পালন করে। কিন্তু আমাদের দেশে এখনো বেশির ভাগ মানুষ গ্রামে বসবাসের পাশাপাশি গ্রামীণ অর্থনীতির সঙ্গে সরাসরি যুক্ত হলেও দিবসটি সম্পর্কে সচেতনতার ঘাটতি রয়ে গেছে। প্রচার-প্রচারণার মাধ্যমে এ ঘাটতি দূর করতে হবে। আবার নারীরা যে এখন অর্থনীতিতে বড় ভূমিকা রাখছেন, সে সম্পর্কেও আমাদের খুব একটা ধারণা নেই। সুতরাং সচেতনতা বাড়াতেই বেইজিং সম্মেলনের পরে এসব বিষয়ে আরো বেশি আলোচনা শুরু হয়েছে এবং গ্রামীণ নারী দিবসের বিষয়টি সামনে এসেছে।

আমরা জানি যে পুরো বিশ্ব জনসংখ্যার (৭০০ কোটি) প্রায় চার ভাগের এক ভাগ গ্রামীণ নারী। তার মানে ২৫ শতাংশ গ্রামীণ নারী। এর অর্থ হলো, এখনো নারীরা গ্রামে বেশি বাস করছেন এবং কাজও করছেন সেখানে। গ্রামে তারা কৃষক হিসেবে, কৃষি শ্রমিক হিসেবে, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী হিসেবে, পাশাপাশি গৃহ ব্যবস্থাপক হিসেবে কাজ করছেন। তবে বিভিন্নভাবে কাজ করলেও ভূমিতে তাদের নিয়ন্ত্রণ খুবই কম। মোট ভূমি মালিকানায় নারীদের অংশ ২০ শতাংশেরও কম। আবার গ্রামীণ কৃষিতে যেসব নারী কৃষি শ্রমিক হিসেবে কাজ করছেন তাদের সঙ্গে পুরুষের মজুরিতে বিরাট ব্যবধান আছে। এটি দূর করতে হবে।

এসডিজিতে বলা হয়েছে, শ্রমবাজারে নারীদের ব্যবধান আরো ২৫ শতাংশ কমানো গেলে আমাদের জিডিপি ৪ শতাংশের মতো বেড়ে যেতে পারে। নারীদের উৎপাদন যন্ত্রের মালিকানা, শিক্ষা, বাজারে অভিগম্যতা থাকলে কৃষি উৎপাদন লক্ষণীয় মাত্রায় বাড়ানো সম্ভব। তেমনটি হলে ক্ষুধার্ত জনগোষ্ঠীর সংখ্যা অনেক কমে যাবে, যা এসডিজির অন্যতম অভীষ্ট।

বাংলাদেশসহ সারা বিশ্বে চলতি বছর দিবসটির প্রতিপাদ্য হলো কভিড-১৯-এর পরিপ্রেক্ষিতে গ্রামীণ নারীদের ভূমিকার স্থায়িত্বশীলতা নিশ্চিত করা। আমরা আমাদের মতো করে এক্ষেত্রে সম্পৃক্ত হওয়ার চেষ্টা করেছি। এরই মধ্যে আমরা কিছু সেমিনার আয়োজন করেছি আর গ্রামীণ নারীদের নিয়ে কিছু কাজ শুরু করেছি। তারই একটি অংশ আজকের এ আয়োজন। আজকে আমরা বিষয় নির্ধারণ করেছি অর্থনীতিতে প্রান্তিক গ্রামীণ নারীর ভূমিকা। আমরা গ্রামীণ নারীদের কথা বলছি, কিন্তু আমার মনে হয় প্রান্তিক নারীদের ভূমিকা আমাদের আরো বেশি বোঝা দরকার। এজন্য গ্রামীণ নারীর অর্থনৈতিক জীবন হোক, গ্রামীণ নারীর কাজের ব্যাপার হোক, শ্রমবাজারে নারীদের অংশগ্রহণের বিষয় হোক, এমন ব্যক্তিদের নিয়ে আসতে চেয়েছি যেন আরো বড় পরিসরে কাজ করা যায়, আমাদের বোঝাপড়া যেন আরো শাণিত হয়। আমরা মনে করি, গ্রামীণ নারীর বিষয়টি অবশ্যই সামনের কাতারে নিয়ে আসতে হবে। নারীর ক্ষমতায়ন নিশ্চিত করতে হলে গ্রামের প্রান্তিক নারীদের কথা ভুললে চলবে না।

অঞ্জলি দাশ
প্রান্তিক নারী
ডুমুরিয়া, খুলনা

আমি একজন কৃষি শ্রমিক। নিজের কোনো বসতবাড়ি নেই। পরের জমি বর্গায় চাষ করে জীবিকার সংস্থান করি। যে মজুরিতে আমরা কাজ করি, তাতে আমাদের সংসার চলে না। তার পরও কষ্ট করে সংসার চালাতে হয়। তদুপরি নিজের সংসারেও কাজ করি। কিন্তু এর কোনো আর্থিক মূল্য পাই না, কষ্টের কোনো মূল্যায়ন পাই না। অন্যদিকে পরের জমিতে কাজ করলেও বেতনটা ঠিকমতো পাই না। নারী-পুরুষ একসঙ্গে কাজ করলে পুরুষকে দেয়া হয় ৩০০ টাকা আর নারীকে দেয়া হয় ২০০ টাকা। কাজ কিন্তু সমানই হয়। আমরা যে কৃষিকাজ করি, তার স্বীকৃতিটাও পাই না। এর একটা সমাধান জরুরি।

অঞ্জলি মিঞ্জির
প্রান্তিক নারী
পায়রাবন্দ, মিঠাপুকুর রংপুর

আমি বারো মাস কৃষি শ্রমিক হিসেবে কাজ করি। কর্মক্ষেত্রে আমরা মজুরিবৈষম্যের শিকার। পুরুষদের মজুরি বেশি, আমাদের কম। বর্ণ ও আচরণগত বৈষম্যও রয়েছে। আদিবাসী হওয়ায় আমাদের ছেলেমেয়ে স্কুলে নানাভাবে হেনস্তা হয়। এজন্য আমরা ভূমিহীন সমিতি গঠন করেছি এসব বৈষম্যের প্রতিবাদ করার জন্য। করোনার ছয় মাস আমাদের অনেক কষ্টে গেছে। অন্যরা পেয়েছে ১০ কেজি চাল। আমরা পেয়েছি একটি মিষ্টি কুমড়া ও একটি সাবান। আমাদের দিকে সরকার তাকিয়েই দেখেনি। করোনার সময় অন্যরা কাজ না করলেও আমরা মাঠে থেকেছি, কাজ করেছি। কাজ না করে আমরা থাকতে পারি না। বিভিন্ন ঝুঁকি নিয়ে আমাদের কাজ করতে হয়। কৃষিকে টিকিয়ে রাখতে হয়। অথচ আমাদের দিকে কেউ তাকায় না। থানা-পুলিশের কাছে, চেয়ারম্যান-মেম্বরের কাছে এবং বিচার ব্যবস্থায়ও আমরা বঞ্চনার শিকার। বয়স্ক ভাতাসহ ভিজিডি, ভিজিএফ, রেশন কার্ড এসবে আমাদের অন্তর্ভুক্তি নেই। রোদে পুড়ে, বৃষ্টিতে ভিজে, উপোস থেকে আমরা কাজ করি। এভাবে আর চলতে পারে না। আমরা খাদ্য চাই, শিক্ষা চাই, বাসস্থান চাই। সর্বোপরি এ দেশের মানুষ হিসেবে পূর্ণ মর্যাদা চাই।

মাহমুদা বেগম
মাছচাষী
পাঁচগাছী, রংপুর

দেশে অনেক খাসজমি আছে। এ-সংক্রান্ত নীতিমালা আছে। কিন্তু খাসজমি যারা পাওয়ার যোগ্য, তারা পাচ্ছে না। অনেক সচ্ছল লোক, বড় লোক এখনো খাসজমি দখল করে আছে। এটি নিয়ে আমরা এসিল্যান্ড অফিসে গিয়েছি। দরখাস্ত জমা দিয়েছি। কৃষক দিন দিন কৃষি থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন। আমার কথাই বলা যাক। কৃষি উৎপাদন করে আমি কোনো লাভ পাই না। কোম্পানিগুলো যে বীজ দেয় তা দিয়ে ধান উৎপাদন করতে হয়। আগে আমরা বীজ নিজেরাই সংরক্ষণ করতাম। তা দিয়ে চাষাবাদ করতাম। কত সুন্দর ফসল হতো! সারও দেয়া লাগত না, কীটনাশকেরও প্রয়োজন পড়ত না। আজকে বন্ধ্যা বীজের জন্য যা দাম দাবি করে বাধ্য হয়ে সেই দামে কেনা লাগে। সেটি দিয়ে উৎপাদন করি, দ্বিতীয়বারের জন্য ওই বীজ রাখতে পারি না। কীটনাশক, বাজারি বীজ এসে আমাদের দেশী মাছ বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে। পোকামাকড়, পশু-পাখি, পরিবেশ ধ্বংস হচ্ছে। সকালে উঠে পাখির কলকাকলি শোনার দিন আর নেই। এগুলো দিন দিন বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে। এখন মানুষের কত ধরনের রোগবালাই হচ্ছে তার ইয়ত্তা নেই। সরকারের কাছে আবেদন, রাসায়নিক সার ও কীটনাশক না দিয়ে কীভাবে উৎপাদন করা যায়, তার ব্যবস্থা করা। কোম্পানিগুলো যেভাবে এগোচ্ছে তাতে কৃষিজমি দিন দিন হাতছাড়া হয়ে যাচ্ছে। কৃষিজমি পরের হাতে চলে যাচ্ছে। নিজেদের জমিতে কী চাষ করব তার সিদ্ধান্তও আমরা নিতে পারি না। কোম্পানিগুলো এক্ষেত্রে সিদ্ধান্ত নেয়। তারা এসে বলে, গম চাষ করো, ভুট্টা আবাদ করো, সয়াবিন চাষ করো, তুলা চাষ করো। কৃষিকাজে এখন প্রচুর খরচ। কৃষি উৎপাদনে আগের মতো লাভ নেই। যতই কোটিপতি হোক গোলায় ধান ওঠে না। বেড়ে চলা খরচ মেটাতে জমি বন্ধক দিতে হয়, উচ্চসুদে এনজিওর কাছ থেকে ঋণ নিতে হয়, ঋণগ্রস্ত হতে হয়। কেউ কেউ ঋণের দায়ে ঢাকায় চলে যায়। এত কষ্টের পরও আমরা কৃষির হাল ধরে রেখেছি। জমিতে সারা দিন কাজ করে বাড়ির রান্নাবান্না ও স্বামী-সন্তান সামলাতে হয়। স্বামী একটি কাজ করলেই তার পরিচয় কৃষক। আর দশ ধরনের কাজ করলেও আমাদের কাজের স্বীকৃতি নেই। সরকারও কোনো কার্ড দেয় না যে আমরা নারী কৃষক। এখনো আমাদের পরিচয় গৃহিণী। নারীদের আমরা কৃষক হিসেবে মর্যাদা চাই।

শেফালী বেগম
কৃষি শ্রমিক
ধনবাড়ী, টাঙ্গাইল

নারীর কাজের মূল্যায়ন নেই। আমি চাই সরকার এমন কিছু আইন করুক, যাতে নারী-পুরুষ নির্বিশেষে কাজের মূল্যের সমান মর্যাদা থাকে। জমির মালিকানায়ও নারীরা বঞ্চনার শিকার। কৃষক ধানের দাম পান না। নারী কৃষকের দুঃখ-দুর্দশা আরো বেশি। আজকে কৃষক নিচের দিকে ধাবিত। এ অবস্থায় কৃষকের হাল ধরে রাখা কঠিন। আমরা কোনোমতে কৃষিকাজ চালিয়ে যাচ্ছি। উৎপাদন খরচ অনেক বেড়ে গেছে। সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা না পেলে বেশি দিন টিকে থাকা মুশকিল। কৃষির প্রতি কৃষকের উৎসাহ ধরে রাখতে সরকারের সঠিক নীতিসহায়তা জরুরি।

সালেহা আক্তার
চান্দিনা, কুমিল্লা

আমি কৃষিকাজ করি। স্বামী ছেড়ে যাওয়ার পর থেকে কৃষিকাজে নিযুক্ত হয়েছি। নিজের আয়ে কষ্টেসৃষ্টে সন্তানদের বড় করছি। কিন্তু সমান কাজ করলেও মজুরি পুরুষের চেয়ে কম পাই। আমার দাবি, নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সবার সমান মজুরি নিশ্চিত করা হোক। আমাদের ঘর নেই। আমাদের মাথা গোঁজার ঠাঁই দিক সরকার। অনেক বছর ধরে বর্গাচাষ করলেও আমি সরকারের কাছ থেকে কোনো উপকরণ সহায়তা কিংবা সেবা পাই না। একটা কৃষি কার্ডও নেই যে তা দিয়ে কৃষিঋণ পাই। সংশ্লিষ্টদের এসব বিষয় বিবেচনায় নেয়ার অনুরোধ জানাই।

শামসুল হুদা
নির্বাহী পরিচালক এএলআরডি

২০১৯ সাল থেকে জাতিসংঘের ঘোষণায় ‘পারিবারিক কৃষির’ দশক পালিত হচ্ছে। এ পারিবারিক কৃষিতে মূলত প্রান্তিক, ক্ষুদ্র কৃষকদের কথাই বলা হচ্ছে। তাদের অনেকেই বর্গাচাষী হিসেবেও কাজ করেন। তাদের সামান্য কিছু জমি আছে কিংবা কোনো জমিই নেই। আজকের আলোচনায় কৃষি মজুরির বিষয়টিও উঠে এসেছে। কৃষি মজুরিতে নারীদের প্রতি যে বৈষম্য, সেটিও বহুকাল থেকে চলে আসছে। এখনো বহাল আছে। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) তথ্যানুযায়ী বিশ্বের খাদ্য চাহিদার প্রায় ৮০ ভাগ পারিবারিক কৃষি থেকে মেটে। অর্থাৎ প্রান্তিক কৃষকরা জোগান দেন। কৃষক বলতে নারী-পুরুষ উভয়কেই বোঝাচ্ছি। সাম্প্রতিক গবেষণায় উঠে এসেছে, কৃষিতে নারীর অবদান ৬৭ শতাংশেরও বেশি। আর গৃহে তাদের অবদান প্রায় শতভাগ। সব মিলিয়ে অর্থনীতিতে নারীর অবদান ৭৫ শতাংশের কম হবে না। কারণ গৃহের যে কাজ তারও একটা অর্থমূল্য আছে; যদিও তার অর্থমূল্য আমরা কখনো হিসাব করি না। উল্টোদিকে তাদের কাজের স্বীকৃতি, মূল্যায়ন, মর্যাদা ও অধিকারের ক্ষেত্রে বড় রকমের ফাঁক রয়ে গেছে। নারীদের কাজ মূল্যায়িত না হওয়ার পেছনে দুটো কারণ বিদ্যমান। এক. প্রান্তিক নারীরা সংগঠিত নন। তাদের সংগঠিত করতে হবে। দুই. নীতি, আইন ও আমাদের সামাজিক প্রথা নারীবান্ধব নয়। আমাদের শাসন ব্যবস্থার দর্শন সম্পূর্ণ পুরুষতান্ত্রিক। যদিও আমাদের নারী প্রধানমন্ত্রী, নারী স্পিকার ও উঁচু পদে আরো অনেকেই আছেন। নারীদের এগিয়ে নিতে হলে তাদের জোরালো ভূমিকা রাখতে হবে। সর্বোপরি আমাদের মানসিকতা পরিবর্তন করতে হবে।

সুরাইয়া বেগম
উপপরিচালক
রিসার্চ ইনিশিয়েটিভ বাংলাদেশ

২০০৫-০৬ সালের শ্রমশক্তি জরিপ অনুযায়ী দেশে মোট কৃষি শ্রমিকের ৭৭ শতাংশই নারী। একইভাবে মোট কৃষি শ্রমের ৪৫ দশমিক ৬ শতাংশ বিনা মূল্যে নারী শ্রম এবং ৫৪ দশমিক ৪ শতাংশ অর্থের বিনিময়ে কেনা হয়। এটি খুবই তাত্পর্যপূর্ণ বিষয় যে নারীর শ্রম জিডিপিতে অন্তর্ভুক্ত হচ্ছে না। তদুপরি দেখা যায়, জমির মালিকানায় ৮১ শতাংশই পুরুষ এবং এক্ষেত্রে নারীর মালিকানা মাত্র ১৯ শতাংশ। আরো হতাশার বিষয় হলো, জমি থাকার পরও তারা কৃষক হিসেবে স্বীকৃত নন। এদিকে ২০১৮ সালে সিপিডির এক গবেষণায় দেখা গেছে, নারী শ্রমের আর্থিক মূল্য আনুমানিক ১০ লাখ ৩৭ হাজার ৫০৬ কোটি টাকা, যেটি ওই বছর মোট জিডিপির প্রায় ৭৮ শতাংশ। অর্থনীতিতে নারীর এ নীরব অবদানটা আমাদের অবশ্যই মনে রাখতে হবে।

আগে গেরস্তালি কাজের পাশাপাশি ঘরে থেকে কৃষিকাজ করলেও কৃষিতে ব্যাপক পরিবর্তনের কারণে এখন নারীদের বাইরেও কাজ করতে হচ্ছে। জিডিপির ৭৮ শতাংশ সমমূল্যের শ্রমটা মূলত নারীদের ওপরই বেশি চলে এসেছে। ঘটে চলা পরিবর্তনগুলো নারীদের অনুকূলে যাচ্ছে না। ফলে নারীদের কাজের বোঝা বেড়েছে। তাদের শারীরিক সক্ষমতার ক্ষেত্রেও অনেক সমস্যা সৃষ্টি হয়েছে। পুরুষরা শহরে কিংবা বিদেশে যাওয়ায় কৃষিতে পুরুষের চেয়ে নারীদের বেশি শ্রম দিতে হচ্ছে। অনেকেই আবার স্বামী পরিত্যক্তা। স্বামী তাদের ছেড়ে চলে গেছেন। ফলে মজুরির ভিত্তিতে তারা কৃষি শ্রমিক হিসেবে কাজ করায় বাধ্য হচ্ছেন। একই কারণে মজুরির ক্ষেত্রে তাদের দরকষাকষির ক্ষমতা নেই। এতে তারা মজুরিবৈষম্যের শিকার হচ্ছেন।

প্রাকৃতিক থেকে রাসায়নিকনির্ভর চাষাবাদের কারণে কৃষিতে নারী তার নিয়ন্ত্রণ হারিয়েছেন। চাষাবাদ বা বীজ সংরক্ষণে তার ঐতিহ্যিক জ্ঞানও কাজে লাগাতে পারছেন না, এটি নারীর স্বাবলম্বনের পথে বড় বাধা। এসব সমস্যার সমাধান করতে হলে নিজেদের মধ্যে আলোচনা করতে হবে, সামষ্টিকতার বোধ জাগ্রত করতে হবে। পাশাপাশি নারীর শিক্ষাটাও খুবই জরুরি। প্রযুক্তি অনেক এগিয়ে গেছে। তার সঙ্গে তাল মেলাতে নারীকে প্রযুক্তিগত জ্ঞান দিতে হবে। আমি মনে করি, কৃষি সম্পর্কে নারীকে আধুনিক জ্ঞান আরো বেশি করে দিতে হবে, প্রযুক্তি সম্পর্কে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। একই সঙ্গে তারা যে অর্থনীতিতে অবদান রাখছেন সে সম্পর্কেও তাদের সচেতনতার বোধ তৈরি করতে হবে, তাদের ক্ষমতায়ন করতে হবে, যাতে তারা ক্রমেই সামনের দিকে এগিয়ে যেতে পারেন।

ড. সাদেকা হালিম
ডিন

সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদ

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

সমাজবিজ্ঞানী হিসেবে আমি কয়েকটা বিষয় উল্লেখ করতে চাই। সমগ্র দক্ষিণ এশিয়ায় যে খাদ্য উৎপাদন হয় তার ৮০ শতাংশই নারীরা উৎপাদন করছেন। বাংলাদেশের গ্রামীণ নারীরা কিন্তু এখন আর গ্রামের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই, তারা শহরেও বিভিন্ন শিল্পের সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়েছেন। পোশাক, চিংড়ি প্রক্রিয়াজাত শিল্প থেকে শুরু করে তারা চা বাগানে কাজ করছেন। কিন্তু এসব শিল্পে নারীদের অবদানকে উঁচু মানের নয়, কম করে দেখানো হচ্ছে, মাত্র ৮৩ শতাংশ। বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধার প্রতি নারীদের যে অভিগম্যতা থাকা প্রয়োজন তার পরিমাণ ৪৪ শতাংশ। তাছাড়া ৯৩ শতাংশ নারীর কোনো ধরনের সম্পদ নেই। তবে প্রাকৃতিক-সামাজিক-রাজনৈতিক দুর্যোগে গ্রামীণ নারীদের ঘুরে দাঁড়ানোর পরিমাণ ৭২ শতাংশ। আজ (১৫ অক্টোবর) আমরা গ্রামীণ নারী দিবস পালন করছি, কিন্তু রাষ্ট্রীয় পর্যায় থেকে কোনো ধরনের পদক্ষেপ নিতে দেখছি না। এটা নেয়া প্রয়োজন। ধর্ষণের সর্বোচ্চ শাস্তি হিসেবে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের সঙ্গে মৃত্যুদণ্ড করা হয়েছে। গ্রামে নারীরা আসলে কতটুকু নিরাপদে আছেন এটা বিবেচ্য। অ্যাসিড সন্ত্রাস, ধর্ষণ, ঠিকমতো রান্না করতে না পারলে পারিবারিক সহিংসতা-নির্যাতন এত কিছুর মধ্যেও তারা ঘুরে দাঁড়াচ্ছেন। বাংলাদেশে পারিবারিক সহিংসতা অনেক বেশি। পারিবারিক সহিংসতার শিকার নারীকে গ্রাম্য সালিশের মাধ্যমে মিটমাট করে স্বামীর বাড়ি ফেরত পাঠানো হয়। এ নারীরা মনস্তাত্ত্বিক ও শারীরিকভাবে অশান্তিতে থাকেন। তাছাড়া নারীর কাজ বেড়েছে। মাঠের পাশাপাশি তাকে ঘরে কাজ করতে হয়। তাছাড়া নারী হিসেবে তাকে বাড়তি কতগুলো কাজও করতে হয়। কেননা নারী-পুরুষের সামাজিক শ্রম বিভাজন রয়েছে। আমরা ধরেই নিই—পুুরুষ কেন রান্না করবে! নারীর ওপর প্রবল চাপ তৈরি হচ্ছে এবং সেটা তাকে বহন করতে হচ্ছে। সয়াবিন, বাদাম, রাবার চাষ থেকে শুরু করে তারা বিভিন্ন বাণিজ্যিক শস্য চাষে চলে গেছেন। দ্রুত উৎপাদন ও ক্যাশ ইকোনমিতে যাওয়ার জন্য বাণিজ্যিকীকরণের নামে আমরা বাংলাদেশের অর্থনীতিতে কোনো ভারসাম্য স্থাপন করিনি। ভবিষ্যৎ প্রজন্ম সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, অটিস্টিক শিশু জন্ম নিচ্ছে। এটা নিয়ে গবেষণা হওয়া উচিত যে, গ্রামের মেয়েরা যখন সন্তানসম্ভবা হচ্ছেন তখন তারা কী ধরনের সন্তানের জন্ম দিচ্ছেন। এদিকে সম্পত্তি ক্রয়-বিক্রয়ের অধিকার নারীদের নেই। সে দলিত, ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী, হিন্দু কিংবা মুসলিম হোক না কেন। বাংলাদেশে ৯৬ শতাংশ জমির মালিক পুরুষ এবং ৪ শতাংশ নারী। জমির মালিক হলেও তার ওই জমির দেখাশোনা কিন্তু করছেন না। মুসলিম অভিজাত পরিবারেও এটা হচ্ছে, হিন্দু অভিজাত পরিবারেও তা হচ্ছে। কাজের বিনিময়ে খাদ্য কর্মসূচিতেও নারীরা কাজ করছেন। গ্রামে যখন বিদ্যুতের লাইন টানা হয় তখন সেখানে পরিবারের ছেলে সদস্যদের নাম দেয়া হয়। আবার খাসজমি বণ্টনের ক্ষেত্রে পরিবারে ছেলে সদস্য থাকলে তার নামে করা হয়। এ বিষয়গুলোতে সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে হবে। কৃষিতে অনেক নারী দৃশ্যমান হচ্ছে, কিন্তু যে ধরনের সুযোগ-সুবিধাগুলো পাওয়ার তার অধিকার আছে কিন্তু তা পাচ্ছেন না। কৃষিতে নারীরাই কিন্তু এখন ফ্রন্টলাইন যোদ্ধা হয়ে দাঁড়িয়েছেন। এটা আমরা অস্বীকার করতে পারব না। নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে এ বিষয়ে আলোচনা হওয়া উচিত। কভিড-১৯-এর প্রভাবে দলিত, ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী ও পাহাড়ের নারীরা ভিন্ন ভিন্ন মাত্রায় সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছেন। অসংখ্য মধ্যবিত্ত ও নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবার ঢাকা ছেড়ে গ্রামে চলে যেতে বাধ্য হয়েছে। ৪৩ শতাংশের বেশি দারিদ্র্যসীমার নিচে চলে যাচ্ছে। গার্মেন্ট, বিউটি পার্লারে কাজ করতেন এমন অনেক নারী ছাঁটাই হয়েছেন। সরকারকে এক্ষেত্রে অন্যভাবে চিন্তা করে প্রণোদনা প্যাকেজগুলো নিয়ে আসতে হবে।

আমিনুল ইসলাম গোলাপ
সাধারণ সম্পাদক বাংলাদেশ কৃষক সমিতি

কভিড-১৯ পরিস্থিতির মধ্য দিয়েও আমরা এগিয়ে চলছি। আমি মাঠ পর্যায়ে কাজ করি। আমাদের সংগঠন কাজ করে খাসজমি ও খাস জলা নিয়ে। ১৯৯০ সাল থেকে এ পর্যন্ত আইনি লড়াইয়ের মধ্য দিয়ে আমরা পাঁচ হাজার একর জমিতে ভূমিহীনদের অধিকার প্রতিষ্ঠা করেছি। এ কাজগুলো করতে গিয়ে অনেক জয়গায় আমাদের সংঘর্ষের মুখোমুখি হতে হয়েছে। খাসজমি, জলাধারের দাবিতে আমরা যে সভাগুলো করি সেখানে নারীদের উপস্থিতি কিন্তু পুরুষের তুলনায় অনেক বেশি। খাসজমির লড়াইটা ঝুঁকিপূর্ণ। অনেকের প্রাণ গেছে, অনেককে জেলখানায় যেতে হয়েছে, অনেকের বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেয়া হয়েছে। একটা পর্যায়ে ভূমিহীন সমিতির সঙ্গে আমাদের পরিচয় হয়। পরস্পরকে অনেক জায়গায় আমরা সহযোগিতা করি। আমরা যা চাই তা আজও অর্জিত হয়নি। কারণ মূল জায়গাটা আমরা আজও কেউ ধরতে পারিনি। মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশের গরিব মানুষ, কৃষকের সন্তান, নারীরা যে ভূমিকা রেখেছেন সে অনুযায়ী সমাজে তারা মর্যাদা পাননি। আজকের বাংলাদেশে বড় বড় পুঁজিপতির উত্থান ঘটেছে। যদি আমরা একাত্তরের মূল ইস্যু ধরে অগ্রসর হতে পারতাম তাহলে আজকের বাংলাদেশের চেহারা এমন হতো না। কৃষকেরাই সত্যিকারের নায়ক হতেন। নারী নির্যাতন, ধর্ষণের পেছনে রাজনৈতিক সমর্থনটা অপরাধীদের শক্তিশালী করে তোলে। আমরা যদি সত্যিকার অর্থে নারীদের কল্যাণে কাজ করতে চাই তাহলে গ্রামাঞ্চলের ভূমিহীন নারী, প্রান্তিক নারীদের নিয়ে কাজ করতে হবে। তাহলে বাংলাদেশের আরো অগ্রগতি হবে। ১৯৭১ সালে আমাদের খাদ্য উৎপাদনের পরিমাণ ছিল ১ কোটি ১৫ লাখ টন। বর্তমানে আমাদের ধান উৎপাদনের পরিমাণ ৩ কোটি ৮৫ লাখ টন। আমাদের জনসংখ্যা বেড়েছে দ্বিগুণ। সে তুলনায় খাদ্য উৎপাদনের পরিমাণ বেড়েছে তিন গুণ। এর নেপথ্যে প্রধান অবদান রেখেছেন প্রান্তিক কৃষক ও প্রান্তিক নারীরা। এরাই ইতিহাসের নায়ক। এরাই ইতিহাস রচনা করছেন। আমাদের এ বিষয়গুলোকে তুলে ধরা দরকার। এটা রাজনৈতিক এজেন্ডা, তাই একে রাজনৈতিকভাবে সমাধান করতে হবে। কভিড পরিস্থিতিতে আমরা দেখেছি, ভূমিহীন দরিদ্র এসব মানুষের কাজ নেই, খাওয়া নেই। সরকারের সাহায্য ওই ১০ কেজি চাল, কেউ হয়তো পেয়েছেন আবার কেউ পাননি। এমনভাবেই সমাজ এগিয়ে চলছে, মানুষ চলছে। সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য যারা কাজ করছেন, যারা ভূমিহীন কৃষকদের নিয়ে কাজ করছেন, তারা সবাই যদি পরস্পরকে সহযোগিতা করি, তাহলে আমরা যে লক্ষ্য নির্ধারণ করেছি, সে লক্ষ্যে পৌঁছতে পারব। আমরা যদি আমাদের শক্তির ভিতটা দরিদ্র, প্রান্তিক শ্রেণীকে নিয়ে গড়ে তুলতে না পারি, যারা সমাজের শতকরা ৬০-৬৫ শতাংশ মানুষ, তাহলে আমরা যে বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখছি সে বাংলাদেশের স্বপ্ন পূরণ হবে না। আমরা যতক্ষণ পর্যন্ত প্রান্তিক জনগোষ্ঠীকে সংগঠিত শক্তিতে রূপান্তর করতে না পারব ততক্ষণ অবস্থার উন্নতি করা সম্ভব হবে না, সামাজিক বিধি বদলাতে পারব না।

ড. ফাহমিদা খাতুন
নির্বাহী পরিচালক সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)

গ্রামীণ নারীরা বিভিন্নভাবে অর্থনীতিতে ভূমিকা রাখেন। কৃষি, খাদ্যনিরাপত্তা, জমি, প্রাকৃতিক সম্পদের ব্যবস্থাপনা, গ্রামীণ ব্যবসা-বাণিজ্যেও তারা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছেন এবং দেশের শ্রমশক্তিতে নারীর অংশগ্রহণের হার ৩৬ শতাংশ। যদিও এতে আমরা খুশি না। কারণ বাংলাদেশের জনসংখ্যার অর্ধেকই নারী। তাই অর্থনীতিতে নারীর ভূমিকা রাখতে হলে তাদের সবাইকে শ্রমশক্তিতে ও উৎপাদনশীল কাজে অংশগ্রহণ করতে হবে। আরেকটি বিষয় হচ্ছে, যারা অংশগ্রহণ করছেন তারা আবার আনুষ্ঠানিক খাতে কাজ করছেন না, অনানুষ্ঠানিক খাতে করছেন। ৯১ দশমিক ৮ শতাংশ নারী আনুষ্ঠানিক খাতে কাজ করছেন। ফলে তাদের আয় কম, তাদের কাজের নিশ্চয়তা কম। কৃষিতে ঐতিহ্যগতভাবে নারীর কাজে অংশগ্রহণের কোনো মাত্রা নেই। এর বিস্তৃতি এত বেশি যা গণনার মধ্যে আনাটাও কষ্টকর। কৃষিতে নারীরা ৩৫-৪০ ধরনের কাজ করেন। কিন্তু এসব কাজের কোনো স্বীকৃতি আমরা দেখি না। যেহেতু নারীদের জমির ওপর কোনো অধিকার নেই, তাই কৃষক নারী হিসেবে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃতি পাচ্ছেন না, সুযোগ-সুবিধাগুলোও পাচ্ছেন না। আবার নারীর মালিকানাধীন জমিগুলো নিয়ন্ত্রণ করছেন পরিবারের পুরুষ সদস্যরা। এ কারণে তারা সত্যিকারের কৃষক হয়ে উঠতে পারছেন না। কৃষিতে আঙ্গাঙ্গিভাবে নারীরা জড়িত থাকার পরও তাদের পুষ্টির চাহিদা পূরণ হচ্ছে না। নিজেদের খাদ্যনিরাপত্তার সমস্যা রয়ে গেছে। নারীরা কিন্তু নিজেদের উৎপাদিত শস্য নিজেরা বাজারে বিক্রি করতে যান না। এ কারণে অর্থটা তার হাতে আসে না। নারীদের উৎপাদিত পণ্য বাজার পর্যন্ত গিয়ে তা ন্যায্যমূল্যে বিক্রি করা একটি গুরুত্বপূর্ণ চ্যালেঞ্জ। কৃষির বাইরে যারা কুটির শিল্প বা ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা হিসেবে কাজ করছেন তাদের পণ্যগুলো বিক্রির ক্ষেত্রেও বিরাট একটি চ্যালেঞ্জ রয়েছে। নারী উদ্যোক্তাদের যে সংগঠন রয়েছে তাদেরও বড় ধরনের ভূমিকা রয়েছে। শহরের সুপার মার্কেটগুলোতে এ নারী উদ্যোক্তাদের পণ্য থাকে না। নারীরা তাদের প্রচলিত কাজের বাইরে গিয়ে বৈচিত্র্যময় কাজ করতে ও দক্ষতা অর্জন করতে পারলে তাদের সংসারে আয় বাড়বে এবং তারা অগ্রসর হবেন। গ্রামীণ অর্থনীতিতে কৃষির বাইরেও আয় ও কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হচ্ছে। নারীরা যাতে সেই সুযোগগুলো পান, সে ব্যবস্থা করতে হবে। উদ্যোক্তা হতে গেলে নারীদের প্রথমে যে সমস্যার মুখোমুখি হতে হয় তা হচ্ছে অর্থের অভাব। তবে ক্ষুদ্রঋণের মাধ্যমে নারীদের ব্যবসা প্রসারের ঘটনাও রয়েছে। অনেক সময় ক্ষুদ্রঋণের তহবিলের সীমবদ্ধতার কারণে সবাইকে অর্থ দেয়া সম্ভব হয় না। নারীদের জন্য যে স্কিমগুলো রয়েছে সেখানে আমরা দেখি, তারাই ঋণ পাবেন যাদের ব্যাংকের সঙ্গে লেনদেনের সম্পর্ক রয়েছে। যে নারী ব্যবসা শুরুই করেননি তিনি কীভাবে তার রেকর্ড দেখাবেন। কাগজে-কলমে যতই বলা হোক না কেন আমরা কিন্তু বাস্তবে সেটা দেখছি না। গ্রামের বেশির ভাগ নারীই সরকারের প্রণোদনা প্যাকেজ সম্পর্কে জানেন না। ১৫ শতাংশ নারীর ঋণ সহায়তার কথা থাকলেও দেখা যায়, ৫ শতংশের বেশি নারী এটা পান না। গ্রামীণ নারীদের কাছে তথ্য পৌঁছে দিতে হবে এবং তাদের ব্যাংকের দোরগোড়ায় নিয়ে গিয়ে ঋণ পাওয়ার সুযোগ করে দিতে হবে। কভিডের পরিপ্রেক্ষিতে নারীদের জন্য নতুন করে চ্যালেঞ্জ সৃষ্টি হয়েছে। গ্রামীণ প্রান্তিক নারীদের ক্ষেত্রে এটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। স্কুল-কলেজ বন্ধ থাকার কারণে বাল্যবিবাহের সংখ্যা বাড়ছে। এতে মাতৃমৃত্যু, শিশুমৃত্যুর হার কমিয়ে আনার মতো অর্জনগুলোকে পিছিয়ে দেবে, যা টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনেও চ্যালেঞ্জ সৃষ্টি করবে। এজন্য নীতিগত দিক থেকে সম্পদ ও জমির ওপর নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠা, অর্থপ্রাপ্তির সুবিধা, নারী সংবেদনশীল সমতাভিক্তিক বৈষম্যহীন নারীবান্ধব বিনিয়োগ নিশ্চিত করতে হবে।

এম এম মুসা: আজকের আয়োজনে অংশ নেয়ায় আপনাদের সবাইকে ধন্যবাদ। অর্থনীতিতে প্রান্তিক নারীদের অবদান অনেক হলেও তাদের স্বীকৃতি নেই। এটি হতাশাজনক। আশা করি, আজকের আলোচনা থেকে উঠে আসা সুপারিশগুলো নীতিনির্ধারক ও সরকার সক্রিয়ভাবে বিবেচনায় নিয়ে পরিকল্পনা প্রণয়ন ও তার বাস্তবায়ন করবে। আজকের আয়োজনের জন্য নিজেরা করি ও ইকো কো-অপারেশনকে ধন্যবাদ জানাচ্ছি।

শ্রতলিখন: হুমায়ুন কবির ও রুহিনা ফেরদৌস

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন