পর্যালোচনা

পরিসংখ্যান নয়, চাই সুখ আর সমৃদ্ধির অর্থনীতি

ডা. মাহবুব মোতানাব্বি, মামুন রশীদ

বাংলাদেশ প্যারাডক্স বলে একটা কথা আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে ব্যাপক প্রচলিত। অর্থাৎ এত প্রতিকূলতা, ব্যবস্থাপনা জটিলতার মধ্যে বাংলাদেশ এগোচ্ছে কীভাবে? বিশ্বের বড় বড় অর্থনীতি যখন করোনা ঝড়ে মুখ থুবড়ে পড়ছে, বাংলাদেশ তখনো আন্তর্জাতিক অর্থ তহবিলের হিসাবে ৩ দশমিক ৮ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছে। পাশাপাশি নিকট প্রতিবেশী ভারতের প্রবৃদ্ধি কমেছে ১০ দশমিক ৩ শতাংশ। মাথাপিছু জিডিপির হিসাবেও দেখা যাচ্ছে বাংলাদেশ অর্জন করেছে ১ হাজার ৮৮৭ ডলার আর ভারত ১ হাজার ৮৭৭ ডলার। তবে এ হিসাব নিরঙ্কুশ নয়। যখন ক্রয়ক্ষমতা সমতা বা পিপিপির (পারচেজিং পাওয়ার প্যারিটি) হিসাব করা হচ্ছে, তখন ভারতের জিডিপি ৬ হাজার ২৮৪ আর বাংলাদেশের ৫ হাজার ১৩৯ ডলার। কিন্তু তার পরও দেখা যাচ্ছে প্রাথমিক হিসাবটাকে গুরুত্বসহকারে নিয়েছেন ভারতের কিছু সাংবাদিক,  বিশেষ করে বিরোধী দল। আর বাংলাদেশের মানুষের মধ্যেও একটা চাপা উল্লাস। তবে নিকট প্রতিবেশীর সঙ্গে এ ধরনের প্রতিযোগিতামূলক তুলনা না করাই নিরাপদ। 

বাংলাদেশ বিশ্বের ৩৯তম বৃহৎ অর্থনীতি। ক্রয়ক্ষমতার সমতা বা পিপিপির হিসাব করলেও ৩০তম। কিন্তু জনগোষ্ঠীর সাধারণ মানুষের কাছে এ অর্থনীতির সুফল কীভাবে পৌঁছছে? আমাদের জিনি সহগ ক্রমে ঊর্ধ্বগামী। ইতালিয়ান পরিসংখ্যানবিদ কোরাদো জিনি ১৯১২ সালে জাতীয় আয়ের বণ্টনের সমতার যে হিসাব প্রচলন করেন, তাকে জিনি সহগ বলে। ঊর্ধ্বগামিতা অসমতাকে নির্দেশ করে। 

করোনাকালে এ বণ্টন বৈষম্য আরো চরম আকার ধারণ করেছে। আমার বাসার সামনের চালু হোটেলটা বন্ধ করোনার এই পুরো সময়। বাবুর্চি, কর্মচারীদের কী হাল জানি না। করোনায় না মরলেও অনাহারে মৃত বা অর্ধমৃত হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। আমাদের অফিসের ক্যান্টিন বন্ধ এই পুরো সময়। গ্রামের বাড়ি থেকে ক্যান্টিনের বয় অভাবে পড়ে ফোন করে। এরা কিন্তু টের পাচ্ছে না, প্রবৃদ্ধিতে আমরা ভারতকে ছাড়িয়ে গেছি। 

এজন্য প্রচলিত হয়েছে জাতীয় সুখী সূচকের ধারণা। ১৯৭২ সালে ইউরোপীয় ইউনিয়নের চতুর্থ সভাপতি সিকো ম্যানশট এ ধারণার প্রবর্তন করেন। ১৯৯০-এ ভুটানের রাজা জিগমে সিংগে ওয়াংচুক এই ধারণাকে জনপ্রিয় করেন। ২০১১-তে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদ সুখী জীবনমান অর্জনকে উন্নয়নের সমন্বিত লক্ষ্য হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। বিশ্ব সুখিতা রিপোর্ট অনুযায়ী ১৫৬ দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১২৫তম। 

সুখের ছয়টি নির্দেশক হচ্ছে আয়, স্বাধীনতা, আস্থা, স্বাস্থ্যকর প্রত্যাশিত আয়ু, সামাজিক সুরক্ষা, সহমর্মিতা। জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়ন সমাধান নেটওয়ার্ক প্রকাশিত এ সূচকগুলো আমরা কতটা উন্নত করতে পারি, তার ওপরই নির্ভর করছে প্রবৃদ্ধির সুফল।

মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধির ওপর ভর করে বলতে গেলে দ্রুতগতিতে এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ। অতিমারি করোনাকালে যেখানে বিশ্বের অধিকাংশ বড় অর্থনীতির দেশে কোনো প্রবৃদ্ধিই হচ্ছে না, সেখানে বাংলাদেশ ৮ শতাংশেরও বেশি প্রবৃদ্ধি আশা করছে। যদিও ৮ শতাংশ প্রবৃদ্ধির এমন আশা পৃথিবীর আর কোনো দেশই করছে না।

এর আগে টানা তিন মাস লকডাউনের কারণে সবকিছু বন্ধ থাকার পরও গত অর্থবছরে প্রকাশিত হিসাবে বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৫ দশমিক ২৪ শতাংশ। তার পরও গত কয়েক বছরে যে তেজি ভাব নিয়ে প্রবৃদ্ধি হচ্ছে, সে তুলনায় কর্মসংস্থান বাড়ছে না।

বাংলাদেশের দ্রুতগতিতে এগিয়ে চলা শুরু হয়েছে বেশ কিছুদিন আগে থেকেই। বিশ্বব্যাংকের হিসাবে নিম্ন আয়ের দেশ থেকে দেশটি নিম্নমধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হয়েছে ২০১৫ সালেই।

জাতিসংঘের হিসাবে বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশের (এলডিসি) তালিকা থেকে উন্নয়নশীল দেশের সিঁড়িতে পা দেবে ২০২৪ সালে। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) বলছে, ২০২০ সালে পঞ্জিকাবর্ষে মাথাপিছু মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) ভারতকে ছাড়িয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ। প্রতিষ্ঠানটি বলেছে, ২০২০ সালে বাংলাদেশের মাথাপিছু জিডিপি হবে ১ হাজার ৮৮৮ ডলার, একই সময়ে ভারতের মাথাপিছু জিডিপি হবে ১ হাজার ৮৭৭ ডলার। আইএমএফের বরাত দিয়ে মাথাপিছু জিডিপির বিষয়ে অনেকেই এরই মধ্যে বাংলাদেশের ভূয়সী প্রশংসাও করছেন।

তবে বিশ্লেষকদের মতে, বাংলাদেশকে নিয়ে বিশ্বব্যাংক যে পূর্বাভাস দিয়েছে, দেশটি সে পথেই যাবে। তাদের প্রাক্কলনে এখন খুব একটা প্রবৃদ্ধি হবে না, প্রবৃদ্ধি শুরু হবে মূলত আগামী বছরের মার্চের পর থেকে। তাদের মতে, বাংলাদেশের চিত্র বলছে, আমরা এখনো নেগেটিভ বা ঋণাত্মক জায়গায় আছি। গত ছয় মাসে কারো বেতন বাড়েনি। মানুষের আয় বাড়েনি। রফতানি খাতের উদ্যোক্তারা বলছেন, তারা নতুন অর্ডার পাচ্ছেন না। আগের অর্ডারের পণ্য রফতানি হচ্ছে এখন। রফতানি আয় প্রাপ্তি নিয়েও রয়েছে শঙ্কা। যদিও প্রবাসী আয় বেড়েছে, তবে নতুন কোনো দেশে শ্রমিক যাচ্ছেন না। নতুন করে কোনো শ্রমিক ভিসাও পাচ্ছেন না।

উল্লেখ্য, নভেল করোনাভাইরাস সংক্রমণের প্রভাবে ২০২০-২১ অর্থবছরে বাংলাদেশের মোট দেশজ উৎপাদন বা জিডিপি ১ দশমিক ৬ শতাংশ বাড়বে বলে পূর্বাভাস দিয়েছে বিশ্বব্যাংক। বিশ্বব্যাংক মনে করে, আগামী  অর্থবছর (২০২১-২২) তা বেড়ে ৩ দশমিক ৪ শতাংশে উন্নীত হতে পারে। গত সাত-আট বছরে জিডিপিতে রেমিট্যান্সের অংশ ৮ শতাংশ থেকে হ্রাস পেয়ে ৫ শতাংশের ঘরে নেমে এসেছে। একইভাবে জিডিপিতে রফতানির হার ২০ শতাংশ থেকে কমে ১৩ শতাংশে নেমে এসেছে। এ অবস্থায় প্রবৃদ্ধি যত বাড়িয়ে দেখানোই হোক না কেন, ভেতরের অবস্থা ভালো নয় বলেও অনেকে মন্তব্য করছেন। তাদের মতে,  বর্তমানে মানুষের পকেটে টাকা নেই। দেশের মানুষের আয় বাড়ছে না, অথচ জিনিসপত্রের দাম বেশি হওয়ায় ব্যয় ঠিকই বেড়ে গেছে।

সেই বিবেচনায় আইএমএফের পূর্বাভাসে উচ্ছ্বসিত হওয়ার কোনো কারণ নেই বলে মনে করছেন অনেকেই। তাদের মতে, করোনাকালে যেখানে অনেক দেশের ঋণাত্মক প্রবৃদ্ধি, সেখানে বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি হয়েছে। এটা যেমন বড় দিক, অন্যদিকে এ সময়ে মানুষের আয় বাড়ছে না, অথচ জিনিসপত্রের দাম বেড়ে গেছে। অনেকে কাজ হারিয়েছেন। অনেকে এখনো কাজ পাচ্ছেন না। দারিদ্র্যের হার বেড়েছে। বৈষম্য বেড়েছে। এগুলো ভাবার বিষয়। ফলে মাথাপিছু আয়ে বাংলাদেশ ভারতকে পেছনে ফেললেও আমাদের আত্মতৃপ্তির কিছু নেই। ভারতকে পেছনে ফেললেও শ্রীলংকা থেকে বাংলাদেশ অনেক পেছনে রয়েছে। একইভাবে মালদ্বীপ ও ভুটান থেকেও আমরা পিছিয়ে রয়েছি। তাই ভারতকে পেছনে ফেলার কথা না ভেবে বরং নিজেদের দক্ষতা-যোগ্যতা বাড়ানো যায় কীভাবে, সেটা ভেবে দেখা প্রয়োজন। ভারত একটি বৃহৎ দেশ, তার সমস্যাও বহুমাত্রিক। 

এদিকে বাংলাদেশের কর-জিডিপি হার গোটা বিশ্বের মধ্যে নিম্নতম পর্যায়েই রয়েছে। এ হার নেপাল, এমনকি যুদ্ধবিধ্বস্ত আফগানিস্তান বা পাকিস্তানের চেয়েও খারাপ অবস্থায় রয়েছে। অথচ মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) হার ঠিকই বাড়ছে। 

আগেই বলেছি, অনেকেরই ভাষ্য, মানুষের পকেটে টাকা নেই। যে কারণে সরকারের আয় কমে গেছে। কিন্তু তার পরও অনেকেই মনে করছেন, সরকার প্রবৃদ্ধি বাস্তবের চেয়ে বেশি দেখানোর চেষ্টা করছে। অন্যদিকে এটাও সত্য, প্রবৃদ্ধি বাস্তবের চেয়ে বেশি দেখালে জিডিপিতে করের অংশ কমে যায়। হচ্ছেও তাই। জিডিপির হার বাস্তবের চেয়ে বেশি দেখালে জিডিপিতে রফতানির অংশ কমে যায়। আমদানির অংশ কমে যায়। বাস্তবে সেটিই হচ্ছে।

আইএমএফের প্রতিবেদন বলছে, চলতি বছরে মাত্র ২২টি দেশের জিডিপির প্রবৃদ্ধি ইতিবাচক হবে। ওই ২২টি দেশের একটি বাংলাদেশ।

আমরা অনেকেই জানি, মাথাপিছু জিডিপি হলো দেশগুলোর সমৃদ্ধি নির্ধারণের একটি বিশ্বব্যাপী পরিমাপ এবং একটি দেশের সমৃদ্ধি বিশ্লেষণে বিশ্লেষকরা জিডিপির পাশাপাশি মাথাপিছু আয়ের প্রবৃদ্ধি ব্যবহার করে। কোনো দেশের জিডিপি দেশটির মোট জনসংখ্যার হিসাব দিয়ে ভাগ করে এটি গণনা করা হয়।

বাংলাদেশ ও ভারত উভয়ের চলতি মূল্যে জিডিপির হিসাব করা হয়েছে। আইএমএফের ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক আউটলুক (ডব্লিউইওর) প্রতিবেদন অনুযায়ী, শ্রীলংকার পরে দক্ষিণ এশিয়ায় করোনা অতিমারীর কারণে ভারত সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। প্রতিবেদন অনুযায়ী, দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে পাকিস্তান ও নেপালের মাথাপিছু জিডিপির তুলনায় এগিয়ে থাকবে ভারত। আবার বাংলাদেশ ছাড়াও ভুটান, শ্রীলংকা এবং মালদ্বীপ ভারতের চেয়ে এগিয়ে থাকবে।

তবে আইএমএফ আগামী বছরে ভারতের অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারের আভাস দিয়েছে। এতে ২০২১ সালে মাথাপিছু জিডিপিতে ভারত সামান্য ব্যবধানে বাংলাদেশকে ছাড়িয়ে যাবে। ডলারের হিসাবে ভারতের মাথাপিছু জিডিপি ২০২১ সালে ৮ দশমিক ২ শতাংশ হবে, বিপরীতে বাংলাদেশের মাথাপিছু জিডিপি হবে ৫ দশমিক ৪ শতাংশ। এতে ভারতের মাথাপিছু জিডিপি দাঁড়াবে ২ হাজার ৩০ ডলার, বাংলাদেশের হবে ১ হাজার ৯৯৯ ডলার।

এদিকে আইএমএফের পূর্বাভাস অনুযায়ী, চলতি বছরে সবচেয়ে বেশি জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জন করা বিশ্বের শীর্ষ তিন দেশের একটি হবে বাংলাদেশ। বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি হতে পারে ৩ দশমিক ৮ শতাংশ। বাংলাদেশের চেয়ে এগিয়ে থাকবে শুধু গায়ানা ও দক্ষিণ সুদান। অন্যদিকে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য অনুযায়ী, করোনায় মানুষের আয় কমেছে ২০ শতাংশ। বিবিএস বলছে, করোনার আগে গত মার্চে প্রতি পরিবারের মাসিক গড় আয় ছিল ১৯ হাজার ৪২৫ টাকা। আগস্টে কমে দাঁড়ায় ১৫ হাজার ৪৯২ টাকায়। অর্থাৎ পাঁচ মাসের ব্যবধানে পরিবারপ্রতি আয় কমেছে প্রায় ৪ হাজার টাকা। বেসরকারি দুই প্রতিষ্ঠান পাওয়ার অ্যান্ড পার্টিসিপেশন রিসার্চ সেন্টার (পিপিআরসি) ও ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব গভর্ন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (বিআইজিডি) সাম্প্রতিক এক জরিপে দেখা গেছে, করোনার প্রভাবে দেশের ৭০ শতাংশ দরিদ্র মানুষের আয় কমে গেছে। সরকারি সংস্থা বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) জরিপে দেখা গেছে, করোনাকালে দেশে নতুন করে ১ কোটি ৬৩ লাখ মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে নেমে গেছে।

জাতীয় রাজস্ব বোর্ড এনবিআরের তথ্য বলছে, আয় কমে যাওয়ার কারণে দেশের মানুষ গত বছরের মতো এবার সরকারকে খুব একটা কর দিচ্ছে না। একইভাবে ব্যবসা করে গত বছরের মতো তারা সরকারকে ভ্যাটও দিচ্ছে না। এনবিআরের তথ্যমতে, গত বছরের জুলাই ও আগস্ট এই দুই মাসে আয়কর ও ভ্রমণ কর থেকে সরকারের আয় হয়েছিল ৮ হাজার ৯০৭ কোটি টাকা। এ বছরের জুলাই ও আগস্টে সরকার এ খাত থেকে তার চেয়ে ১০৫ কোটি টাকা কম রাজস্ব আহরণ করেছে।

এনবিআরের তথ্যে জানা যায়, গত অর্থবছরের প্রথম দুই মাসের তুলনায় এই বছরের প্রথম দুই মাসে স্থানীয় পর্যায়ে মূসক বা ভ্যাট থেকেও আদায় কমেছে ২৮০ কোটি ৮৮ লাখ টাকা। এনবিআরের হিসাবে, এই অর্থবছরের প্রথম দুই মাসে ভ্যাট থেকে আদায় হয়েছে ১১ হাজার ৩৫১ কোটি ৭০ লাখ টাকা। আর গত বছরের একই সময়ে ভ্যাট থেকে আদায় হয়েছিল ১১ হাজার ৬৩২ কোটি ৫৮ লাখ টাকা।

মূলত গত মার্চ থেকে বাংলাদেশে করোনার প্রকোপ শুরু হয়। এরপর এপ্রিল ও মে মাসে বাস, ট্রাক, ট্রেন, ব্যক্তিগত গাড়িসহ সব ধরনের যান চলাচল প্রায় বন্ধ ছিল। একইভাবে ট্রলার-লঞ্চ চলাচলও বন্ধ ছিল। বিমানও চলেনি। মানুষ প্রয়োজন ছাড়া ঘরের বাইরে খুব একটা বের হয়নি। অথচ পরিসংখ্যান মতে, এ খাতের জিডিপি বেড়েছে।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান বুরো (বিবিএস) বলেছে, গত অর্থবছরের (২০১৯-২০) মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) বাস, ট্রাক, ট্রেন— এসবের মূল্য সংযোজন আগের বছরের চেয়ে ৪ হাজার ৭৯১ কোটি টাকা বেড়েছে। নৌযান চলাচলে বেড়েছে ২৪৬ কোটি টাকা। আর বিমান চলাচলে বেড়েছে ৫১ কোটি টাকা। একইভাবে ২৬ মার্চ থেকে পর্যটন এলাকায় হোটেল-মোটেল বন্ধ থাকার পরও বিবিএসের হিসাবে, বছর শেষে হোটেল-রেস্তোরাঁর অবদান জিডিপিতে বেড়েছে ৫০৯ কোটি টাকা। করোনার কারণে যদিও ওই তিন মাস নির্মাণ খাত বন্ধ ছিল। তবে বিবিএস বলেছে, বিদায়ী অর্থবছরে জিডিপিতে নির্মাণ খাতের মূল্য সংযোজন বেড়েছে ৭ হাজার ৩৫৩ কোটি টাকা। জিডিপিতে নির্মাণ খাতের অবদান প্রায় ৮ শতাংশ। গত অর্থবছরে নির্মাণ খাতের অবদান ছিল ৮৮ হাজার ৪৯১ কোটি টাকা। আবাসন খাতের ব্যবসায়ীরা বলছেন, করোনাকালে ফ্ল্যাট বিক্রি তেমন একটা হয়নি। কিন্তু বিবিএস বলেছে, আবাসন খাতের অবদান বেড়েছে ৩ হাজার কোটি টাকার বেশি।

কৃষি, শিল্প ও সেবা—এই তিনটি খাত নিয়ে জিডিপি গণনা করা হয়। করোনার কারণে সবচেয়ে বেশি প্রভাব পড়েছে শিল্প খাতে। এ খাতের প্রবৃদ্ধি অর্ধেকে নেমে গেছে। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে শিল্প খাতে প্রবৃদ্ধি হয়েছিল ১২ দশমিক ৬৮ শতাংশ। গত অর্থবছরে তা কমে ৬ দশমিক ৪৮ শতাংশ হয়েছে।  আগের  বছর যেখানে শিল্প উৎপাদনে প্রবৃদ্ধি ছিল ১৪ শতাংশের বেশি। গত অর্থবছরে তা নেমে ৫ দশমিক ৮৪ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। গত অর্থবছরে কৃষি খাতে প্রবৃদ্ধি ৩ দশমিক ৯২ শতাংশ থেকে কমে ৩ দশমিক ১১ শতাংশে নেমেছে। জিডিপিতে অর্ধেক অবদান সেবা খাতের, প্রায় ৫১ শতাংশ। এ খাতের প্রবৃদ্ধি ৬ দশমিক ৭৮ শতাংশ থেকে কমে ৫ দশমিক ৩২ শতাংশ হয়েছে।

চার বছর ধরেই জিডিপির অনুপাতে ২৩ শতাংশের ঘরেই বেসরকারি বিনিয়োগ আটকে আছে। বিবিএসের হিসাবে, জিডিপির অনুপাতে সার্বিক বিনিয়োগ এখন ৩১ দশমিক ৭৫ শতাংশ। ২০১৯ সালের জুলাই থেকে ২০২০ সালের জুন পর্যন্ত চলতি মূল্যে ৮ লাখ ৮৮ হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ হয়েছে। এর মধ্যে প্রায় ৬ লাখ ৬০ হাজার কোটি টাকা বেসরকারি বিনিয়োগ। বাকি ২ লাখ ২৮ হাজার কোটি টাকা সরকারি বিনিয়োগ।

তবে আমাদের মোদ্দাকথা হলো, শুধু পরিসংখ্যানের বিচারে মানুষের সুখ-সমৃদ্ধির বিচার করা যাবে না। সত্যিকারের সুখ-আনন্দের জন্য বায়ুদূষণ,শব্দদূষণ, প্রতিকূল পরিবেশের প্রভাব, জাতীয় সম্পদের বণ্টন-ন্যায্যতা, রাষ্ট্রের নজরদারি প্রতিষ্ঠানগুলোর সাধারণ মানুষের পক্ষ নেয়া আর মানুষে মানুষে ভেদাভেদ কমানো, নারী ও পিছিয়ে থাকা জনগোষ্ঠীর সম্মান বৃদ্ধি, ন্যূনতম শিক্ষা আর স্বাস্থ্যের দিকেও নজর দিতে হবে। তাহলে উন্নতির পরে মানুষ আর পেছন ফিরে বলবে না—‘আগে কি সোন্দর দিন কাটাইতাম।’

[লেখকদের দুজনেই ফৌজদারহাট ক্যাডেট কলেজে অধ্যয়ন করেছেন। প্রকাশিত মন্তব্য তাদের নিজেদের, প্রতিষ্ঠানের নয়]

 

ডা. মাহবুব মোতানাব্বি: বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক 

মামুন রশীদ: পিডব্লিউসি বাংলাদেশের পার্টনার

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন