জাতিগত মনস্তত্ত্বের জিঘাংসা: মৃত্যুদণ্ড ছাড়া কেন আশ্বস্ত বোধ করছি না আমরা?

জাহিদ অয়ন

বাংলাদেশে সবচেয়ে ঘৃণিত অপরাধ হিসেবে ধর্ষণকে চিহ্নিত করলেও ভুল হবে না। অথচ উদ্বেগজনকভাবে ধর্ষণই সেই অপরাধ, যা বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি সংঘটিত হয়। গত ২০১৯ সালে আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক) এর তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে ১৪১৩ জন নারী ধর্ষণের শিকার হয়েছিলেন; ২২৪ জন নারীকে ধর্ষণের প্রচেষ্টায় আক্রমণ করা হয়েছিল। ২০২০ সালের জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ধর্ষণ হয়েছে ৯৭৫টি; ২০৪টি হয়েছে ধর্ষণের চেষ্টা। এছাড়াও এ বছর যৌন নির্যাতনের শিকার হয়েছেন ১৬১ জন নারী। পরিসংখ্যান লক্ষ করার সময় আমাদের এটাও মাথায় রাখতে হবে যে শুধুমাত্র যে সকল ক্ষেত্রে নারীরা আওয়াজ তোলার সাহস করেছেন বা পরিবার থেকে আড়াল করা হয়নি, সে সকল ঘটনাগুলোই পরিসংখ্যানে নথিভুক্ত হয়েছে। এমন আরও অনেক ঘটনা রয়েছে, যেখানে ভুক্তভোগীর কণ্ঠস্বর ভয়ভীতি প্রদর্শন করে, সামাজিক চাপ তৈরি করে দমিয়ে দেয়া হয়েছে। যখন দেশে ধর্ষণ সংঘটিত হওয়ার হার ইতোমধ্যেই অনেক বেশি তখন সবকিছু ছাপিয়ে সাম্প্রত অপরাধীরা এতটাই ঔদ্ধত্যের স্পর্ধা দেখিয়েছে যে, দেশের বিভিন্ন স্থানে একনাগাড়ে বেশকিছু দলবদ্ধ ধর্ষণের ঘটনা সামনে আসতে থাকে। এর মধ্যে সিলেটের এমসি কলেজে স্বামীকে আটকে রেখে স্ত্রীকে দলবদ্ধ ধর্ষণ এবং নোয়াখালির বেগমগঞ্জে স্বামীর সামনে নারীকে বিবস্ত্র করে নির্যাতন ও ভিডিও ধারণের ঘটনা অন্যতম। এর পরিপ্রেক্ষিতে সারাদেশে ধর্ষণের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ শুরু হয়। ধর্ষণের শাস্তি বাড়িয়ে মৃত্যুদণ্ড করার জোর দাবি জানানো হয়। অবশেষে গত ১৩ অক্টোবর মঙ্গলবার, ধর্ষণের সর্বোচ্চ সাজা যাবজ্জীবন কারাদ– থেকে বাড়িয়ে মৃত্যুদণ্ড করে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন অধ্যাদেশে স্বাক্ষর করেছেন রাষ্ট্রপতি মো. আব্দুল হামিদ। 

মৃত্যুদণ্ডের বিধানে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে আইন ও সালিশ কেন্দ (আসক)। সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক) জানিয়েছে- কেবল সাজা বাড়িয়ে ধর্ষণের মতো ঘৃণ্যতম সামাজিক অপরাধ নির্মূল করা সম্ভব নয়। আসক মনে করে, বর্তমান ধর্ষণবিরোধী এ জনমতকে কাজে লাগিয়ে বরং ধর্ষণ প্রতিরোধে প্রয়োজনীয় কাঠামোগত সংস্কার আনার জন্য সরকারের পদড়্গেপ গ্রহণ করা এখন সময়ের প্রয়োজন। মূলত, যে পিতৃতান্ত্রিক মানসিকতা থেকে একজন নারীকে ধর্ষণ করা হয় এবং ধর্ষক নয়, ধর্ষণের শিকার নারীকে সামাজিকভাবে দোষী সাব্যস্ত করে তার বেঁচে থাকা দূর্বিসহ করে তোলা হয় এবং ন্যায়বিচার চাইতে গিয়ে ভুক্তভোগীকে পদে পদে যেসব প্রতিবন্ধকতার শিকার হতে হয়— সেগুলোর ওপর দৃষ্টি না দিয়ে, সেগুলো নির্মূল না করে কেবল শাস্তি বাড়িয়ে এ অপরাধ রোধ করা কোনোভাবেই সম্ভব নয়।

অপরাধবিজ্ঞানের দৃষ্টিকোণ থেকে মৃত্যুদণ্ড
জাতিগতভাবে আমরা বাংলাদেশিরা প্রতিক্রিয়াপ্রবণ। যেকোনো অপরাধের বিরুদ্ধেই আমাদের প্রথম প্রতিক্রিয়াই যেন জিঘাংসামূলক। আমাদের মিছিলের স্লোগানগুলোও তাই ‘ফাঁসি চাই, ফাঁসি চাই’ ধরনের; সেখানে ‘কারাদণ্ড চাই’ বা ‘সমাজব্যবস্থায় পরিবর্তন চাই’ ধরনের জটিল কোনো দাবি নেই। আমাদের চলচ্চিত্রেও তার প্রতিফলন লক্ষ্য করা যায়। নায়কোচিত চরিত্রটি আইন নিজের হাতে তুলে নিয়ে অপরাধীদের শাসিত্ম দেবার চেষ্টা করে এবং সেটিকেই দর্শকবৃন্দ ন্যায়সঙ্গত মনে করেন বিধায় সমর্থন জানান, অনুপ্রাণিত ও উচ্ছ্বসিত বোধ করেন। জনগণ গণপিটুনির মাধ্যমে লঘু অপরাধেও আইন হাতে তুলে নিয়ে মৃত্যুদণ্ড নিশ্চিত করার চেষ্টা করে। আবার আইন রক্ষাকারী সংস্থা যখন বিচারবহির্ভ–ত হত্যাকা– সংঘটিত করে, সেটি আমাদের নাগরিক জীবনে খুব একটা দৃষ্টিকটূ হিসেবে ধরা দেয় না; কয়েকটি মানবাধিকার সংগঠন ছাড়া সেটি নিয়ে অভিযোগও তোলা হয় না। আমাদের জাতিগত মনসত্মত্ত্বে ন্যায়বিচার ও মৃত্যুদণ্ডের ধারণা মিলেমিশে একাকার হয়ে গিয়েছে। হত্যা ছাড়া যেন ন্যায়বিচার নিশ্চিত হবে না। এই জিঘাংসা প্রভাবিত করে আমাদের আইন-প্রণয়ন প্রক্রিয়াকেও।

তবে অপরাধবিজ্ঞান প্রতিক্রিয়া প্রবণতাকে উত্সাহিত করে না; বরং বোঝার চেষ্টা করে অপরাধ সংঘটনের কারণ, সমাজে এমন অপরাধী কীভাবে তৈরী হচ্ছে এবং সর্বোপরি এমন অপরাধ সংঘটন কীভাবে কমিয়ে আনা যায় সে দিকগুলো। যে ব্যক্তি যাবজ্জীবন বা ১৪ বছরের কারাবাস ভয় না করে অপরাধ সংঘটন করেছে, সে কি আসলেই অপরাধ সংঘটনের মৃত্যুদণ্ডের ভীতি মাথায় রাখতো? এমন ভয়ডরহীন মনোভাবের কারণ কি আসলে আইনের শিথিলতা নাকি আইনের প্রায়োগিক দুর্বলতা? প্রায়োগিক দুর্বলতা যদি থেকেই থাকে, তাহলে কাগজে কলমে শাস্তি বাড়িয়ে মৃত্যুদণ্ড করলেই কি অপরাধীদের ধর্ষণ থেকে নিবৃত রাখা যাবে? অপরাধবিজ্ঞানের দৃষ্টিকোণ থেকে তাই মৃত্যুদণ্ড নিয়ে উত্থিত হয়েছে বিভিন্ন প্রশ্ন। আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতেও ধর্ষণের সর্বোচ্চ শাসিত্ম মৃত্যুদণ্ড করা হয়েছে। তবে সেটি করা হয়েছে কেবল সাত বছরের কম বয়সী কোনো শিশুকে ধর্ষণের ক্ষেত্রে।

ধর্ষণ নিঃসন্দেহে নিকৃষ্টতম একটি অপরাধ। তবে আইনে সাজা বাড়িয়ে মৃত্যুদণ্ড দেয়াই সমাধান নয়। আইনের প্রায়োগিক দিক থেকে দুর্বলতা দূর করতে হবে। সাজা যা-ই হোক না কেনো প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে। আর্থ-সামাজিক-সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপটে ধর্ষক কীভাবে গড়ে উঠছে সেটি চিহ্নিত করে সামাজিক পরিবর্তনে পদক্ষেপ নিতে হবে। নারীর প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তনের জন্য শিক্ষা ও সামাজিক কাঠামো সংস্কারে কাজ করতে হবে। অনেক ক্ষেত্রে সামাজিকভাবে নারীর দুর্বল অবস্থান তাকে প্রভাবশালী গোষ্ঠীর নির্যাতনের সামনে উন্মুক্ত করে দেয়। এধরনের ক্ষেত্রে নারীর আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন নিশ্চিত করা না গেলে নিভৃতেই ধর্ষণ এবং অন্যান্য নির্যাতন চলতে থাকবে। অধ্যাপক গ্র্যান্ট গিলমোর বলেন, ‘Law reflects but in no sense determines the moral worth of a society...The better the society, the less law there will be...In heaven there will be no law...In hell there will be nothing but law.’ এ বক্তব্য একেবারে অবান্ত্মর কিন্তু নয়। স্ক্যান্ডেনেভিয়ান দেশগুলোতে অপরাধ প্রবণতা কিন্তু খুব কম, অথচ সেখানে কঠোর আইন-কানুন নেই। নেদারল্যান্ডে মৃত্যুদণ্ড নেই; কিন্তু তাদের কারাগার ধারণক্ষমতার তুলনায় ফাঁকা থাকে বিধায় তারা অন্য দেশকে সেখানকার কারাগার ইজারা দেওয়ার কথাও ভাবতে হয়। তাই আইনের কাঠিন্য দেখে আমাদের উচ্ছ্বসিত হবার আসলে কিছু নেই। আমাদের সমাজ রূপক অর্থ হলেও হয়তো নরকসদৃশ হয়ে পড়ছে। আইন ছাপিয়ে তাই সর্বোপরি সামাজিক উন্নয়নের দিকে আমাদের মনোযোগ দিতে হবে। মৃত্যুদণ্ড শেষমেশ থাকুক বা না থাকুক সামগ্রিক সামাজিক উন্নয়ন ছাড়া এই ক্রমাগত নারকীয় ধর্ষণের ঘটনাগুলোর সমাপ্তি ঘটানো মুশকিল।

লেখক: শিক্ষার্থী, আইন ও বিচার বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন