বার্ড ও আখতার হামিদ খান: গ্রামীণ রূপান্তরের স্বপ্নযাত্রা

ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ

বিশ্বব্যাপী কভিড-১৯-এর মহামারীতে অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও বহুমাত্রিক সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে। বিদ্যমান সমস্যাগুলো প্রকটতর হয়েছে এবং নতুন সমস্যা যোগ হয়েছে। যেমন দারিদ্র্য বিমোচন ধীরগতিতে হয়েছে, কর্মসংস্থান কম হয়েছে, উচ্চপ্রবৃদ্ধির সুফল দরিদ্র মানুষগুলোর না পাওয়া ইত্যাদি। এ ক্ষেত্রে গ্রামের লোকজনই বেশি বঞ্চিত হয়েছে। এর মধ্যে বেকার মানুষের সংখ্যাও বেড়ে যাচ্ছে। এ প্রেক্ষাপটে আমাদের সময় এসেছে গ্রামীণ অর্থনীতি বা গ্রামীণ খাতটাকে আরো গতিশীল ও সম্প্রসারণ করে সেখানে কর্মসংস্থান বা আয়সংস্থান আরো বাড়ানো। গ্রামীণ অর্থনীতি বলতে শস্য উৎপাদন ছাড়াও মত্স্য, পশুপালন, পোলট্রি, সবজি চাষ, ফুল চাষ, আরবরিকালচারকে বোঝায়। আমাদের অর্থনীতিতে এগুলোর অবদান অনেক বেশি। জিডিপিতে এর অবদান ১৮-১৯ শতাংশ হবে। কিন্তু আমার মনে হয়, এ হিসাবে গ্রামীণ খাতের অবদানকে ছোট করে দেখা হয়। সবকিছু মিলিয়ে এসব খাতে মানুষের জড়িত থাকার অবদান জিডিপির ৫০ বা ৫৫ শতাংশ হবে। আর জিডিপিতে তাদের অবদান যা-ই হোক, বিপুল কর্মসংস্থান ও আয়ের উৎস হিসেবে গ্রামীণ অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের বিরাট অবদান রয়েছে। এখন দরকার এটাকে গতিশীল করা।

গ্রামীণ উন্নয়নের বিভিন্ন মাত্রা ও অভিযোজন রয়েছে এবং দেশ ও সময়ভেদে গ্রামীণ উন্নয়নে নেয়া পদ্ধতির ভিন্নতা থাকে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে গ্রামীণ উন্নয়ন বলতে বোঝানো হয় গ্রামীণ মানুষের সামগ্রিক সুষম ও সমানুপাতিক কল্যাণ। কীভাবে এটি কাজ করে এবং এটি কোন পদ্ধতি গ্রহণ করে, তা বেশকিছু উপাদানে নির্ধারিতও প্রভাবিত হয়।

গ্রামীণ উন্নয়নের ভিত্তি প্রতিষ্ঠিত হয় যখন ১৯৫৬ সালে কুমিল্লার কোটবাড়িতে ভি-এইড (গ্রামীণ কৃষি ও শিল্প উন্নয়ন) একাডেমি প্রতিষ্ঠা করা হয়। এর লক্ষ্য ছিল সরকার ও সাধারণ মানুষের মোট সম্পদ সমন্বয় করে গ্রামীণ জীবন পুনর্গঠনে সম্মিলিত প্রচেষ্টা চালানো। ড. আখতার হামিদ খান (একজন সাবেক আইসিএস কর্মকর্তা) ছিলেন এ একাডেমির প্রধান। তার নেতৃত্বে বাংলাদেশ একাডেমি ফর রুরাল ডেভেলপমেন্ট (বিএআরডি বা বার্ড) প্রকাশ পায় ১৯৫৯ সালে, যেটি কুমিল্লা একাডেমি হিসেবে বেশি পরিচিত। এ একাডেমি এক সেট পাইলট প্রকল্প হাতে নেয়, একটি প্যাকেজে একীভূত করে, যেটি বিস্তৃতভাবে ‘কুমিল্লা মডেল’ নামে পরিচিত। চার প্রধান উপাদান ছিল: থানা ট্রেনিং অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টসেন্টার (টিটিডিসি), রুরাল ওয়ার্কস প্রোগ্রাম (আরডব্লিউপি), থানা ইরিগেশন প্রোগ্রাম (টিআইপি) ও প্রতিটি থানায় (এখন উপজেলা) টু-টায়ার কো-অপারেটিভ সিস্টেম (কিএসএস)—এ চার উপাদান দেশজুড়ে প্রতিলিপি করা হয়েছিল।

ওই সময়ের সরকার উন্নত জাতের বিভিন্ন বীজ, সার, কীটনাশক, সেচ সুবিধা ও আধুনিক কৃষিচর্চার মাধ্যমে দ্রুত কৃষি উন্নয়নের দিকে মনোযোগী ছিল। কুমিল্লা মডেলের আওতাধীন এলাকাগুলোর উন্নতির অভিজ্ঞতার আলোকে, সরকার প্রবর্তন করে ইন্টিগ্রেটেড রুরাল ডেভেলপমেন্ট বোর্ড (বিআরডিবি)। প্রধানত টিটিডিসি ও কেএসএস উপাদানগুলো বাস্তবায়ন করার জন্য, যখন বাংলাদেশ এগ্রিকালচার ডেভেলপমেন্ট কো-অপারেশন (বিএডিসি) ও লোকাল গভর্নমেন্ট ইঞ্জিনিয়ারিং ব্যুরো (এলজিইবি, এখন এলজিইডি) গঠন করা হয় যথাক্রমে টিআইপি ও আরডব্লিউপির জন্য। আশির দশকের শুরুতে সেচ যন্ত্রপাতি, সার ও অন্যান্য উপাদান সরবরাহ বেসরকারীকরণ হয়ে যায় এবং এজন্য বিএডিসি বিলুপ্ত হয়ে যায়।

‘কুমিল্লাপল্লী উন্নয়ন মডেল’ এক আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত মডেল যার বহিঃপ্রকাশ হলো ১৯৬৩ সালে ড. আখতার হামিদ খান তার মডেলের জন্য এশিয়ার নোবেল পুরস্কার খ্যাত ‘র্যামন ম্যাগসেসাই পুরস্কার’ পান। একই পুরস্কার ১৯৭৮ সালে নারী উন্নয়নের জন্য কুমিল্লা একাডেমির তাহরুন নেসা আবদুল্লাহ এবং ১৯৮৮ সালে মুহম্মদ ইয়াসিন দিদার সমবায় সমিতির জন্য পুরস্কার পান।

সত্তরের দশকের প্রথম দিকে বাংলাদেশে চরম দারিদ্র্যের সমস্যা সরকারগুলোর নজর কেড়েছিল এবং এ সমস্যা মোকাবেলায় বিস্তারিত প্রোগ্রাম পরিকল্পনা করা হয়েছিল। ধারাবাহিক পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনাগুলো এ ইস্যু ব্যাপকভাবে মোকাবেলা করেছিল এবং বিভিন্ন পদক্ষেপ বাস্তবায়ন করার পরামর্শ দিয়েছিল। প্রথম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা (এফএফওয়াইপি ১৯৭৩-৭৮) বিভিন্ন লক্ষ্য স্থির করলেও সর্বাগ্রে জোর দেয়া হয়েছিল দারিদ্র্য দূরীকরণের ওপর। এটি উন্নয়নের জন্য উৎপাদন ও প্রাতিষ্ঠানিক উভয়ের জন্য পরিকল্পনা করেছিল। গ্রামীণ মানুষদের সংগঠিত করা, সম্পদের সঠিক ব্যবহার ও স্থানীয় পরিকল্পনা সিস্টেম উন্নয়ন সমস্যা সমাধানে প্রাতিষ্ঠানিক পুনর্গঠনের প্রয়োজনীয়তাকে সামলে তুলে ধরেছে।

বাংলাদেশ সরকারের গ্রামীণ উন্নয়ন কৌশলে জোর দেয়া হয়েছে: ক. গ্রামীণ দরিদ্র মানুষের জন্য উৎপাদন ও কর্মসংস্থান প্রোগ্রাম, খ. প্রবৃদ্ধির কেন্দ্র হিসেবে চিহ্নিত গ্রামীণ সড়ক ও বাজারের মতো প্রত্যক্ষ অবকাঠামো উন্নয়ন, গ. কৃষি সেচ নিষ্কাশন ও ক্ষুদ্র বন্যা নিয়ন্ত্রণকাজ, ঘ. মত্স্য চাষ, পশুপালন, পোলট্রি ও অন্যান্য ফসলবহির্ভূত কৃষিপণ্য উৎপাদন বাড়ানো এবং ঙ. কৃষিবহির্ভূত কর্মসংস্থান সৃষ্টি।

বাংলাদেশে বিস্তৃত গ্রামীণ উন্নয়ন প্রচেষ্টা চারটি প্রধান দৃষ্টিভঙ্গি ঘিরে পরিচালিত হয়: ক. প্রাতিষ্ঠানিক উন্নয়ন ও কাঠামোগত পরিবর্তন; খ. কৃষি, মত্স্য চাষ, পশুপালন, ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পের মতো খাতগুলোতে উৎপাদন কার্যক্রম; গ. শিক্ষা, স্বাস্থ্য, পরিবার পরিকল্পনা ও আবাসনের মতো অকৃষি উপাদান এবং ঘ. টার্গেট গ্রুপ দরিদ্র ও পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠী।

দারিদ্র্য নিরসনে দুটি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখা বিষয় হলো: ১. শ্রম আয়ের উচ্চতর প্রবৃদ্ধি, যা পরিবারের ব্যয়ক্ষমতা বাড়িয়েছে এবং ২. জনসংখ্যাগত পরিবর্তন, বিশেষ করে নিম্নতর জন্মহারের কারণে নিম্নতর নির্ভরতা অনুপাত। সরকারি ও বেসরকারি পরিবর্তনও দারিদ্র্য হ্রাসে অবদান রেখেছে।

যদিও দেশের নীতি ও কৌশল দারিদ্র্যের ব্যাপ্তির বহুমাত্রিক চরিত্র চিহ্নিত করেছে, তবে আনুষ্ঠানিক দারিদ্র্যের পরিমাপে আয় বা ব্যয়ের মাত্রা ব্যবহার করা হয়। স্বাধীনতার পর থেকে বাংলাদেশ দারিদ্র্য হ্রাসে উল্লেখযোগ্য উন্নতি করেছে। দারিদ্র্যের (দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করা জনসংখ্যা) হার ১৯৭০ দশকের ৪০ শতাংশ থেকে হ্রাস পেয়ে ২০১০ সালে হয় ৩১ দশমিক ৫ শতাংশ (বিবিএস ২০১১)। ২০১৫ সালে দারিদ্র্যের হার আনুমানিক ২৪ দশমিক ৮ শতাংশ, যখন চরম দরিদ্রের হার ১২ দশমিক ৯ শতাংশ। তবে দারিদ্র্য হ্রাসের বার্ষিক গড় কমে গেছে, এটি ২০০৫-১০ সময়ের ১ দশমিক ৭ শতাংশ থেকে কমে ২০১০-১৬ সময়ে হয়েছে ১ দশমিক ২ শতাংশ হয়েছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোর অপেক্ষাকৃত উচ্চ অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির প্রভাবে এসব উন্নতি হয়েছে বলে প্রতীয়মান হয়। তা সত্ত্বেও এখনো দারিদ্র্য বাংলাদেশের প্রধান চ্যালেঞ্জ, যেহেতু সার্বিকভাবে দারিদ্র্যের ব্যাপ্তি উচ্চমাত্রায় বজায় রয়েছে।

ইদানীং কভিড-১৯-এর নেতিবাচক প্রভাব, বিশেষ করে আয়ের উৎস ও কর্মসংস্থান কমে যাওয়ায় শহর থেকে অনেক মানুষ গ্রামে চলে যাচ্ছে। ন্যূনতম আশ্রয়টা পাওয়া যাবে—এ চিন্তায় তারা গ্রামে ফিরে যাচ্ছে। মূলত স্বল্প আয়ের মানুষই চলে যাচ্ছে। এ প্রেক্ষাপটেই গ্রাম তথা গ্রামীণ অর্থনীতির গুরুত্বটা আবারো সামনে এসেছে। বিআইডিএসের সমীক্ষা বলছে, করোনার কারণে ১৩ শতাংশ লোক নতুন করে দরিদ্র হয়ে গেছে। এর মধ্যে বিদেশ থেকে লোকজন ফেরত আসছে। তাদের অনেকেই ফেরত যেতে পারবে না। দেশে রয়েছে বিপুলসংখ্যক শিক্ষিত ও অশিক্ষিত বেকার। করোনাকালে তাদের জীবিকা নির্বাহ করা অত্যন্ত কঠিন হয়ে গেছে। সরকারের সহায়তা পর্যাপ্ত নয়। সেখানে আবার নানা রকম লিকেজ হচ্ছে, দুর্নীতি হচ্ছে। আবার এ সহায়তা দীর্ঘস্থায়ীও করা যাবে না। অতএব গ্রামীণ অর্থনীতিকে গতিশীল করাই বেশি জরুরি।

গ্রামের প্রতি মনোযোগ বাড়ানোর মধ্য দিয়ে আমাদের কাজটা শুরু করতে হবে। শুধু কৃষি উৎপাদন নয়, কৃষিপণ্য প্রক্রিয়াকরণেও মনোযোগ দিতে হবে। কৃষিপণ্যের বিপণনে জোর দিতে হবে। আমরা দেখে আসছি, দেশে কৃষিপণ্য প্রক্রিয়াকরণ খুব কম হয়। তারা শস্য বিক্রি করতে না পারলে ফেলে দেয়। অনেক সময় মধ্যস্বত্বভোগীরা কিনতে চায় না। দেশীয় ফলের দিকে তাকালে দেখতে পাই, সারা বছর আম পাওয়া যায় না। লিচুও সারা বছর পাই না। এগুলো মৌসুমি ফল এবং মৌসুমেই খাব। কিন্তু প্রক্রিয়াজাত করে রাখলে অন্য সময়ও পাওয়া যেত। থাইল্যান্ডে যেমন আম, জাম, লিচু সব ফলই প্রক্রিয়াজাত অবস্থায় পাওয়া যায়। ক্যান বা প্যাকেটে করে তারা বিক্রি করে। রফতানিও করে। আমাদের গ্রামেও এ প্রক্রিয়া চালু করা দরকার।

আমাদের গ্রামগুলোর বড় চ্যালেঞ্জ হলো কর্মসংস্থান। আমরা যদি কৃষিপণ্য প্রক্রিয়া করতে পারি, তখন শুধু কৃষি নয়, আনুষঙ্গিক অন্যান্য কাজও হবে। গ্রামে ছোট ছোট কুটির শিল্প বা সেবা খাত রয়েছে। রূপান্তরের ফলে গ্রামে লন্ড্রি দরকার, সেলুন দরকার। গ্রামে এখন অনেক বিউটি পার্লারও চালু হয়েছে; এমনকি ছোটখাটো জিমনেসিয়ামও গড়ে উঠছে। গ্রামের বাজারগুলোতে রেস্টুরেন্টের প্রয়োজন হচ্ছে। আমি চাইছি, ব্যাপক আকারে না হলেও এসব শহুরে সুযোগ-সুবিধা গ্রামে থাকলে গ্রামের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড বৃদ্ধি পাবে, কর্মসংস্থান বৃদ্ধি পাবে। সবচেয়ে বড় কথা আত্মকর্মসংস্থান বাড়বে। উদ্যোক্তা গড়ে তোলা যাবে।

আবার গ্রামে শিক্ষা ও স্বাস্থ্য ব্যবস্থা উন্নত না করলে গ্রামীণ অর্থনীতি গতিশীল করা কঠিন হবে। গ্রামের ছেলেমেয়েরা যদি শিক্ষা না পায়, শুধু বড় বড় শহরে সব পাওয়া যায়—এ পরিস্থিতি বিরাজ করলে গ্রামীণ অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড উৎসাহিত হবে না। আমাদের এখানে নগরায়ণ হয়েছে; কিন্তু বিদেশের তুলনায় আদর্শ নগরায়ণ ঘটেনি। আমাদের নগরায়ণ বিশ্বে শীর্ষে; কিন্তু নাগরিক সেবায় বিশ্বে পিছিয়ে। এ ক্ষেত্রে গ্রামীণ অর্থনীতি চাঙ্গা করতে পারলে নগরের ওপরও চাপ কমবে।

গ্রামীণ অর্থনীতি চাঙ্গা করতে হলে শুধু শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও কর্মসংস্থান যথেষ্ট হবে না। গ্রামীণ অর্থনীতি গতিশীল করার জন্য প্রথমত দরকার হবে শাসন ব্যবস্থার বিকেন্দ্রীকরণ। স্থানীয় সরকার স্তরগুলো—ইউনিয়ন পরিষদ, উপজেলা ও জেলা পরিষদকে উন্নয়নের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত করতে হবে। গ্রোথ সেন্টারগুলো হবে ইউনিয়ন পরিষদ, উপজেলা ও জেলা পরিষদ। আমাদের সংবিধানে আছে স্থানীয় সরকারকে শক্তিশালী করতে হবে। কিন্তু কোনো সরকারই স্থানীয় সরকারকে বিকেন্দ্রীকরণ করেনি। এটা অত্যন্ত দুঃখজনক। বাজেটে বরাদ্দের প্রশ্ন এলে বলা হয়, স্থানীয় সরকারে দুর্নীতি হবে। সঠিক মনিটরিং হলে সব পর্যায়েই দুর্নীতি ও অপচয় বন্ধ করা সম্ভব। যখন প্রতিষ্ঠিত হয়ে যাবে যে স্থানীয় সরকার দায়িত্ব পেয়েছে, কারিগরি ও অর্থসহায়তা পাচ্ছে, তখন তারা আরো যত্নসহকারে প্রকল্প বাস্তবায়ন করবে। বিশ্বাসযোগ্যতাও বাড়বে। তখন লোকজনের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণও থাকবে।

দ্বিতীয়ত, প্রয়োজনটা হলো অর্থায়ন। আমাদের ব্যাংকগুলো গ্রামের বিভিন্ন জায়গায় শাখা খুললেও তারা মূলত এসব শাখা খোলে অর্থের উৎস হিসেবে। তারা গ্রাম থেকে টাকা নিয়ে এসে শহরে বিনিয়োগ করে। গ্রামের মানুষ গ্রামে যতটুকু সঞ্চয় করে, সেই টাকাটা ওখানে আর থাকে না। সেখানকার কোনো কাজে লাগে না। এটাকে ট্রান্সফার অব রিসোর্সেস বলে, যেটা আমরা পূর্ব পাকিস্তান থেকে পশ্চিম পাকিস্তানে সম্পদের স্থানান্তর হতে দেখেছি।

তৃতীয় বিষয়টি হচ্ছে, প্রযুক্তিগত উন্নয়ন, যাতায়াত ও বাজার সুবিধা বৃদ্ধি। আমরা গ্রামের ওপর দিয়ে বড় বড় রাস্তাঘাট করছি, ফিডার রোড করছি। কিন্তু অনেক রাস্তাঘাট হলেও রক্ষণাবেক্ষণ ঠিকমতো হচ্ছে না। গ্রামীণ বাজারগুলোর উন্নয়নও জরুরি।

চতুর্থত, গতানুগতিক চিন্তাধারায় প্রযুক্তিনির্ভর কার্যকলাপ ও কর্মসংস্থান শুধু শহরে সম্ভব বলে অনেকে মনে করেন; সময় এসেছে গ্রামেও প্রযুক্তিনির্ভর উদ্যোক্তা সৃষ্টি এবং আউটসোর্সিংয়ের মাধ্যমে শহরের প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে গ্রামের যুবকদের কর্মসংস্থান করা।

ঐতিহাসিক বিবেচনায় দেখব, আমাদের গ্রামীণ অর্থনীতি দারিদ্র্য বিমোচনে বিরাট ভূমিকা রেখেছে। খাদ্যশস্য উৎপাদনে আমরা স্বয়ংসম্পূর্ণ না হলে আমাদের বিরাট সমস্যা হয়ে যেত। মত্স্য উৎপাদন, পোলট্রি ও গবাদি পশু পালনে যদি আমরা উন্নতি করতে না পারতাম, তাহলে তো বিশাল জনগোষ্ঠীর খাদ্যসংস্থান খুবই কঠিন হতো। সাড়ে সাত কোটি থেকে মানুষ ১৬ কোটি হয়ে গেল, এর পরও খাদ্যে সমস্যা হয়নি। আমি মনে করি, এর বড় অবদান গ্রামীণ অর্থনীতির। এ ক্ষেত্রে আমি সবচেয়ে প্রশংসা করি বা বাহবা দিই আমাদের কৃষি প্রযুক্তিবিদ, কৃষি গবেষক ও কৃষি বিশেষজ্ঞদের। তাদের অবদান কোনোক্রমেই অস্বীকার করা যাবে না। ভবিষ্যতেও তাদের সব ধরনের উৎসাহ, প্রণোদনা দিয়ে কাজে লাগাতে হবে।

আমাদের গ্রামীণ অর্থনীতির ইতিবাচক রূপান্তরের সময় এখন। গার্মেন্ট শিল্প প্রবৃদ্ধিতে বেশি অবদান রাখছে বলে আমরা অনেক কথা বলি। এখন আমাদের ভারসাম্য বা সুষম উন্নয়নের দিকে লক্ষ রাখতে হবে। এজন্য আমাদের প্রাতিষ্ঠানিক উন্নয়নও দরকার, যেটার প্রয়োজন আমরা স্বাস্থ্য খাতের জন্য অনুভব করছি। আমাদের কৃষি খাতেও প্রাতিষ্ঠানিক উন্নতি প্রয়োজন। প্রতিষ্ঠান এবং তাদের কার্যক্রমের প্রক্রিয়াগুলো যদি সুষ্ঠু ও দক্ষ না হয়, তাহলে যেকোনো প্রকল্পই বাস্তবায়ন করা দুরূহ হবে। এটা আমরা স্বচক্ষে দেখতে পাচ্ছি বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পের বাস্তবায়নের মন্থরগতির মধ্যে।

গ্রামীণ অর্থনীতির জন্য আরেকটি বিষয় হচ্ছে দরিদ্র ও পিছিয়ে পড়া মানুষের ওপর নজর দেয়া। যে সামাজিক সুরক্ষাবেষ্টনী রয়েছে, তা আরো ব্যাপক করা। এখন বয়স্ক ভাতাসহ যেসব সহায়তা দেয়া হচ্ছে, এগুলো যথেষ্ট নয়। সামাজিক সুরক্ষা মানে গ্রামে বাসকারী মানুষের আয়েরও ব্যবস্থা করতে হবে, অর্থের সংস্থান করতে হবে। প্রয়োজন হলে ঋণ দিতে হবে। লোকজনের স্বাস্থ্যের সমস্যা হলে কীভাবে ইউনিয়ন পর্যায়ে বা উপজেলা পর্যায়ে স্বাস্থ্যসেবা দেয়া যায়, সেটা করতে হবে।

আরো চারটি বিষয়ে বিশেষ নজর দেয়ার দরকার আছে। প্রথমটি হচ্ছে, আমাদের সার্বিক উন্নয়ন কৌশলের সঙ্গে গ্রামীণ উন্নয়ন পরিকল্পনাকে যুক্ত করতে হবে। বিচ্ছিন্ন কর্মসূচি নিয়ে গ্রামের উন্নয়ন হবে না। নির্দিষ্ট কিছু গ্রাম, তথাকথিত জেলা বাজেট দিয়ে চলবে না। সামগ্রিক নীতি ও পরিস্থিতির সঙ্গে এটাকে খাপ খাওয়াতে হবে। দ্বিতীয় হলো, গ্রামের অর্থনৈতিক উন্নতির জন্য লক্ষ্যমাত্রাভিত্তিক কর্মসূচি নিতে হবে। কতসংখ্যক মানুষের আত্মকর্মসংস্থান হবে, কতজনের কর্মসংস্থান হবে ইত্যাদি। তৃতীয়ত, গ্রামীণ উন্নয়নের জন্য প্রধান অংশীদারগুলো তথা সরকার, বেসরকারি খাত, ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান এবং এনজিও ও স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠানকে নিয়ে একসঙ্গে কাজ করা। চতুর্থত, গ্রামীণ অর্থনীতি ও শহরের অর্থনীতির সঙ্গে দ্বিমুখী সম্পর্ক স্থাপন করতে হবে। তবেই গ্রাম মূল স্রোত থেকে বিচ্ছিন্ন কোনো খাত না হয়ে সার্বিক অর্থনীতির অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবেই গণ্য হবে। সেই সঙ্গে গ্রামীণ অর্থনীতির সঙ্গে বৈশ্বিক উন্নয়নের উপাদানের (পণ্য, সেবা, প্রযুক্তি ইত্যাদি) মধ্যে সম্পর্ক স্থাপন করতে হবে। উদাহরণস্বরূপ চীন, কোরিয়া, ভিয়েতনাম, ফিলিপাইন দেখা গেছে গ্রামে উৎপাদিত কৃষিপণ্যসহ কুটির শিল্প, ছোট ও মাঝারি শিল্পের বিভিন্ন পণ্য সরাসরি বিদেশের বাজার ও ভোক্তার কাছে পৌঁছে যায়। সেজন্য অবশ্য বাজার, সরবরাহ এবং বাইরের দেশগুলো অনুসন্ধানে ভূমিকায় সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা এবং বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের সক্রিয় সহযোগিতা প্রয়োজন। বাংলাদেশে যেটা এখনো গড়ে ওঠেনি।


ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ: সাবেক গভর্নর, বাংলাদেশ ব্যাংক; অধ্যাপক, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন