পল্লী সড়ক: প্রবৃদ্ধির কেন্দ্র

ড. মোহাম্মদ আবদুল মজিদ

‘কে যাসরে ভাটির গাং বাইয়া

আমার ভাইধনরে কইও নায়র নিত বইলা 

তোরা কে যাস কে যাস 

বছরখানি ঘুইরা গেল গেল রে 

ভাইয়ের দেখা পাইলাম না পাইলাম না...’

নদীমাতৃক গ্রামপ্রধান বাংলাদেশে পল্লী বধূর নাইওরে যাওয়ার আকুতি ছিল এমনই, বেশিদিন আগেও না। আমার নানাবাড়ি ছিল বড়জোর মাইল দশেক দূরে। মনে আছে নৌকায় নায়রে যেতেন মা আমাদের নিয়ে। সকালে নৌকায় চেপে নানাবাড়ির ঘাটে পৌঁছতে সন্ধ্যা পেরিয়ে যেত। আর এখন পিচঢালা পথে ব্যাটারিচালিত ভ্যানে নসিমনে মাত্র ২০-২৫ মিনিটে যাওয়া যায় সেখানে। এই তো সেদিনের কথা, ১৯৬৮ সালে জুনিয়র বৃত্তি পরীক্ষা দিতে তখনকার মহকুমা শহর সাতক্ষীরায় যেতে একদিন এবং এক রাত লেগেছিল নৌকায়। আর এখন মোটরযানে ১ ঘণ্টায় পৌঁছানো যায় জেলা শহরে। ছয়-সাত দশকের ব্যবধানে গ্রামীণ যাতায়াত যোগাযোগ পরিবহন ব্যবস্থায় যে অভূতপূর্ব পরিবর্তন সূচিত হয়েছে তা বিস্ময়কর বৈকি! রাজধানী ঢাকা শহর থেকে মোটরযানে গড়ে ৬-৭ ঘণ্টায় এখন বাংলাদেশের যেকোনো প্রত্যন্ত প্রান্তে পৌঁছানো যায়। খাল-বিল, নদী-নালায় ভরপুর গ্রামীণ বাংলা এখন পাকা সড়ক সেতুতে, সহজ যোগাযোগে, প্রভূত পরিবহন বহরে বেগবান, বহমান। এ সুবাদে বাংলাদেশের গ্রামীণ অর্থনীতি এখন উৎপাদনশীলতায়, জীবন-জীবিকার পথ-পদ্ধতি উদ্ভাবনে-সৃজনশীলতায় সমর্পিত। এটিই জাতীয় অর্থনীতির সলিলা শক্তির (রেজিলিয়েন্ট পাওয়ার) প্রেরণা ও জিডিপি প্রবৃদ্ধির উপাদেয় উপাদান। 

পল্লীতে দারিদ্র্যের হ্রাসমান হার, কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধি, শিক্ষাসহ সামাজিক নানা সূচকে বাংলাদেশ যে সাফল্য দেখিয়েছে, তাতে গ্রামীণ সড়ক সেতু যোগাযোগ ও পরিবহন অবকাঠামোর রয়েছে অনবদ্য অবদান। বাংলাদেশে আশির দশকের মাঝামাঝি সময় থেকে পল্লী অবকাঠামো (সড়ক সেতু পরিবহন হাটবাজার) নির্মাণের মাধ্যমে গ্রামীণ দারিদ্র্য কমানো ও স্বয়ম্ভরতা অর্জনের দর্শন ও ভাবনা নিয়ে কাজ শুরু করে প্রয়াত প্রকৌশলী কামরুল ইসলাম সিদ্দিকের (১৯৪৫-২০০৮) দূরদর্শী নেতৃত্বে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর (এলজিইডি)। উপজেলা সড়ক, ইউনিয়ন সড়ক, গ্রাম সড়ক (ক শ্রেণী) ও গ্রাম সড়ক (খ শ্রেণী) এ চারটি শ্রেণীর সড়ক পল্লী সড়ক হিসেবে চিহ্নিত। এ চার শ্রেণী মিলিয়ে এখন পল্লী সড়কের দৈর্ঘ্য ৩ লাখ ৯ হাজার ৯১৬ কিলোমিটার। এর মধ্যে দুই ধরনের গ্রাম সড়ক প্রায় ১ লাখ ৮০ হাজার কিলোমিটার। এর পুরোটাই মাটির রাস্তা আর ১ লাখ ২৮ হাজার ৫২৮ কিলোমিটার সড়ক পাকা। যেসব এলাকায় এসব সড়ক হয়েছে, সেখানে দারিদ্র্য অন্য এলাকার তুলনায় উল্লেখযোগ্য হারে কমেছে তো বটেই, বেড়েছে জীবন-জীবিকার মান। বস্তুত পল্লী সড়ক গ্রামকে গতিশীল করেছে। গ্রামে নানা সুবিধা পৌঁছেছে। সড়ক নির্মাণের ফলে গ্রামে শিক্ষার হার বেড়েছে, ঝরে পড়া কমেছে। সড়কের সুবিধা পাওয়া গ্রামে সুবিধাহীন গ্রামের তুলনায় প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তির হার তিন ভাগ এবং মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে সাত ভাগ বেশি। আবার মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে ঝরে পড়ার হার কমে গেছে ১৪ শতাংশ। বাজার-ঘাট বেড়েছে। সব মিলিয়ে মানুষের সক্ষমতা বেড়েছে। গ্রামীণ অবকাঠামো নির্মাণ, গ্রামীণ পরিবহন ও যোগাযোগ এবং ব্যবসা-বাণিজ্য প্রসার পাওয়ায় গ্রামীণ জনপদে বিনিয়োগ বেড়েই চলছে। এক্ষেত্রে গ্রামীণ পরিবারগুলোর আয় ও কর্মসংস্থান বাড়াতে অকৃষি খাতের অবদানও বাড়ার তথ্য পরিসংখ্যান পাঁজি পুঁথিতে মিলছে। খানা আয়-ব্যয় জরিপ ২০১০-এর তথ্য মতে, গ্রামীণ জনগণের আয়ের খাতভিত্তিক অবস্থান ছিল কৃষি (শস্য) ২৭.৮%, কৃষি (অন্যান্য) ৫.৬%, শিল্প উৎপাদন ৮.৯%, নির্মাণ ৩.০%, বাণিজ্য ১১.২%, যাতায়াত ৫.৫%, সেবা ৭.২%, রেমিট্যান্স ১৬.৯%, অন্যান্য ১৩.৯% মোট ১০০.। গ্রামে সড়ক ও যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নের ফলে স্থানীয় ব্যবসা-বাণিজ্যের সুযোগ বেড়েছে ৬৭ শতাংশ। পরিবহন কাজের সুবিধা বেড়েছে ৬৫ শতাংশ। হাট-বাজারের উন্নতি হয়েছে ৬১ শতাংশ। নারীদের কাজের সুযোগ বেড়েছে ৫৬ শতাংশ। হাঁস-মুরগির খামার ৪১ শতাংশ বেড়েছে। ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পের প্রসার ঘটেছে ৪০ শতাংশ। একই সঙ্গে মত্স্য চাষ বেড়েছে ২৫ শতাংশ।

বাংলাদেশে প্রতিটি দশকে পল্লী সড়ক বেড়েছে। ১৯৯০ সালে গ্রামীণ পাকা সড়ক ছিল ৮ হাজার ৬৭০ কিলোমিটার। ২০১০ সালে বেড়ে দাঁড়ায় ৭২ হাজার ৪৬০ কিলোমিটারে আর বর্তমানে ১ লাখ ২৮ হাজার ৫২৮ কিলোমিটার। এভাবে সড়ক বেড়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পেছনের দশকগুলোজুড়ে থাকা দরিদ্র মানুষ সচ্ছল হতে শুরু করেছে। খানা আয়-ব্যয় জরিপ অনুযায়ী, দারিদ্র্যসীমার নিচে পল্লী দারিদ্র্যের পরিমাণ ২০০৫ সালে ২৮ দশমিক ৬ শতাংশ থাকলেও ২০১০ সালে তা কমে ২১ দশমিক ১ শতাংশে নেমে আসে। এ সময়ে নগর দারিদ্র্য পল্লী দারিদ্র্য হারের চেয়ে কম হারে কমেছে। 

বিশেষভাবে উল্লেখ্য, বেশির ভাগ অনুন্নত হলেও এশিয়ার উন্নয়নশীল দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের পল্লী সড়ক ব্যবস্থার ঘনত্ব বেশি নিবিড়। প্রতি ১০০ বর্গকিলোমিটার এলাকায় ২১০ কিলোমিটার পল্লী সড়ক আছে। বিশ্বব্যাংকের হিসাবে ভারতে এটা ১৩৬, পাকিস্তানে ৩৫ ও নেপালে ১৪ কিলোমিটার। এলজিইডির সূত্রে জানা যায়, ‘বিভিন্ন সময় দাতারা সরকারি নানা প্রকল্পে অর্থায়ন বন্ধ করলেও পল্লী সড়ক প্রকল্পে নিরবচ্ছিন্নভাবে সহায়তা করেছে। গ্রামীণ অর্থনীতিতে সার্বিক উন্নয়নে এর প্রভাব দেখেই দাতারা কখনো সরে যায়নি। পল্লী সড়ক নির্মাণের দুই-তৃতীয়াংশ ব্যয় ২০০০ সাল পর্যন্ত করেছে ঋণদাতা সংস্থাগুলো, এক-তৃতীয়াংশ ছিল বাংলাদেশ সরকারের। ২০০০ সালের পর থেকে দুই-তৃতীয়াংশ করে সরকার, বাকিটা বিদেশী অর্থে।

বিশ্বব্যাংকসহ দুটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান কর্তৃক পরিচালিত পল্লীসড়কের তিনটি প্রকল্প এলাকায় এর প্রভাবসংক্রান্ত গবেষণা থেকে জানা যায়, জাপান ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশন এজেন্সি (জাইকা) অর্থায়নে ২০০৬ থেকে ২০১১ সালে সিলেট ও চট্টগ্রাম বিভাগে চলা ইস্টার্ন বাংলাদেশ রুরাল ইনফ্রাস্ট্রাকচার ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্ট (ইবিআরআইডিপি) শেষ হওয়ার পর প্রকল্পভুক্ত এলাকায় পরিবারের আয় বেড়েছে সিলেটে শতকরা ৯৬ ভাগ এবং চট্টগ্রাম বিভাগে ৯৫ ভাগ। মানুষের জন্য নতুন কাজ সৃষ্টি হয়েছে সিলেটে শতকরা ৫৯ ভাগ, চট্টগ্রামে শতকরা ৭০ ভাগ। সড়ক হওয়ায় পরিবহন ব্যয় কমে যায় এবং কৃষি-অকৃষি পণ্যের দাম বেড়ে যায়। এতে আয় ও নতুন কাজ সৃষ্টি হয়। যার প্রভাবে কমে যায় দারিদ্র্য। বিশ্বব্যাংক অর্থায়িত পল্লী সড়ক ও বাজার উন্নয়ন ও রক্ষণাবেক্ষণ প্রকল্প (আরআরএমআইএমপি) এবং পল্লী উন্নয়ন প্রকল্পের (আরডিপি) ওপর বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান (বিআইডিএস) কর্তৃক রংপুর, রাজশাহী, দিনাজপুর ও মানিকগঞ্জ জেলায় পরিচালিত গবেষণায় দেখা যায়, আরডিপি প্রকল্পভুক্ত গ্রামগুলোতে প্রকল্প শুরুর সময় মাঝারি মানের দরিদ্রের সংখ্যা ছিল শতকরা ৫৭ ভাগ। প্রকল্প শেষে তা ৪৮ ভাগে নেমে আসে। আবার তীব্র দরিদ্র মানুষের সংখ্যা ৩৫ থেকে ২৯ ভাগে নেমে আসে। প্রকল্প এলাকার পরিবারে সঞ্চয়ের পরিমাণ প্রকল্পের বাইরের গ্রামগুলোর চেয়ে বেড়ে ৩৬ থেকে ৩৮ ভাগে উন্নীত হয়েছে কিন্তু প্রকল্পের বাইরে থাকা গ্রামগুলোতে ওই সময়ে তেমন কোনো ইতিবাচক পরিবর্তন দৃশ্যগোচর হয়নি। 

ঢাকা-ময়মনসিংহ চার লেনের মহাসড়ক হওয়ার পর ওই এলাকায় কী ধরনের পরিবর্তন এসেছে, সেটি নিয়ে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন, পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগ (আইএমইডি) ও এক গবেষণায় উঠে এসেছে, সড়কটি চার লেনে উন্নীত হওয়ার আগে সেখানকার মানুষের মাসিক গড় আয় ছিল ৫ হাজার থেকে ১০ হাজার টাকার মধ্যে। এখন সেটি বেড়ে ২৫ হাজার টাকায় উন্নীত হয়েছে। কৃষিপণ্য পরিবহনে আগে মারাত্মক ভোগান্তিতে পড়তেন কৃষকরা, সেই ভোগান্তি থেকে মুক্তি মিলেছে তাদের। পণ্য পরিবহনে খরচও কমেছে। মিলেছে কর্মসংস্থানের সুযোগ, চিকিৎসাসেবায় এসেছে সহজলভ্যতা। সড়ক দুর্ঘটনা কমে গেছে। রাস্তার পাশে বেড়েছে জমির দাম। দিন দিন বাড়ছে শিল্প-কারখানা, বিভিন্ন অফিসের শাখাও তৈরি হচ্ছে। মহাসড়কটি গাজীপুর, শ্রীপুর, ভালুকা, ত্রিশাল ও ময়মনসিংহ সদরের মানুষের জীবনমান পুরোপুরি বদলে দিয়েছে বলে আইএমইডির ওই গবেষণায় উঠে এসেছে।

প্রসঙ্গত যে একটি মেগা প্রকল্পে শুধু প্রত্যক্ষ উপকারই হয় না, পরোক্ষ অনেক ইতিবাচক প্রভাব তৈরি হয়। একটি প্রকল্পকে ঘিরে বহুমুখী অন্তর্জাল তৈরি হয়। সমাজ ও অর্থনীতিতে বড় ধরনের পরিবর্তন আসে। একটি প্রকল্পের সঙ্গে অনেক বিষয় জড়িত থাকে। সড়ক কিংবা ভবন নির্মাণ সংক্রান্ত প্রকল্প হলে সেখানে প্রচুর নির্মাণ শ্রমিকের কাজের সুযোগ তৈরি হয়। সড়ক নির্মাণ করতে রড, সিমেন্ট, বালুসহ অন্যান্য উপকরণের প্রয়োজন হয়। মানুষের কর্মসংস্থান হয়। এর মাধ্যমে টাকার লেনদেন হয়। বছর শেষে ইতিবাচক প্রভাব পড়ে মোট দেশজ উৎপাদন বা জিডিপির প্রবৃদ্ধিতে।

তবে অর্থনীতিতে ব্যাপক ভূমিকা রাখলেও বিশাল আয়তনের পল্লী সড়কের কিছু নেতিবাচক দিকও আছে। এর মধ্যে পরিবেশ, বিশেষ করে জলাভূমি ও ছোট ছোট খালের গতিপথ সংকুচিত হয়েছে। আবার বেড়েছে দুর্ঘটনার ঝুঁকিও। পল্লী এলাকায় ভটভটি বা নছিমন নামের নতুন যানের সৃষ্টি হয়েছে। পল্লী সড়কে অনিবন্ধিত এসব যান চালায় অদক্ষ চালক। এতে গ্রামাঞ্চলে দুর্ঘটনার ঝুঁকি বেড়ে গেছে। দাতা সংস্থার টাকায় পল্লী সড়ক নির্মিত হলেও এসব সড়ক মেরামত ও সংস্কারের দায়িত্ব সরকারের। আশি-নব্বই দশকে নির্মিত সড়ক এরই মধ্যে দুবার এবং ২০০০ থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত নির্মিত পল্লী সড়ক একবার মেরামত ও সংস্কারের আওতায় এলেও পরবর্তীকালে অধিকাংশ সড়কই অর্থ বরাদ্দের অপ্রতুলতা ও নানা পর্যায়ে দুর্নীতি ও দায়িত্বহীনতার কারণে যথাযোগ্য মেরামত ও সংস্কার না হওয়ায় সড়কগুলোর বেহাল অবস্থার করুণ চিত্র ফুটে উঠছে। সড়কগুলোর ধারণ ক্ষমতার চেয়ে ভারী যান ও মালামাল পরিবহনে নিষেধাজ্ঞা দেয়ার ও দেখার যেন কেউ নেই। অসাধু বালু, মাটি, ইট, লোহা-লক্কড় পরিবহন সিন্ডিকেটের কাছে স্থানীয় প্রশাসন ও জনপ্রতিনিধিরা হয় অসহায় অথবা আত্মসমর্পিত প্রতীয়মান হয়। অতি সম্প্রতি (২৩ অক্টোবর ২০২০) প্রধানমন্ত্রী ‘পল্লী সড়ক আরো মজবুত করে নির্মাণ এবং এর ধারণ ক্ষমতা বৃদ্ধি’র ব্যবস্থা করার নির্দেশনা দিয়েছেন। 

‘গ্রামীণ সড়ক রক্ষণাবেক্ষণ মাস, অক্টোবর ২০২০’ পালিত হচ্ছে। পরিলক্ষিত হচ্ছে ২০১০ সালের পরে নির্মিত পল্লী সড়কের কাজের গুণগত মান অতীতের তুলনায় নিম্নমানের। প্রকৌশলী কামরুল ইসলাম সিদ্দিক প্রতি জেলা সদরে এলজিইডির যে অফিস কাম রেস্ট হাউজ তৈরি করেছিলেন, সে অফিসের নিচতলায় পল্লী সড়ক সেতু হাটবাজার অবকাঠামো নির্মাণ সামগ্রীর গুণগত মান কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ ও পরীক্ষাকল্পে ল্যাব টেস্টের ব্যবস্থা ছিল। প্রকৌশলী সিদ্দিকের পর বেশ কয়েক বছর তার যোগ্য উত্তরসূরিরা এলজিইডির ভাবমূর্তি বজায় রাখতে সক্ষম হলেও বিগত এক দশক ধরে সে অবস্থা নানাবিধ কারণে ভঙ্গুর হয়ে পড়েছে। সড়ক নির্মাণের ক্ষেত্রে এলজিইডির নিজস্ব ডিজাইন স্ট্যান্ডার্ড রয়েছে। স্ট্যান্ডার্ড অনুযায়ী, এলজিইডির নির্মিত সড়কের আয়ুষ্কাল ১০ বছর। সড়কের ভার বহনের ক্ষমতা গাড়িপ্রতি এক্সেলে ৮ দশমিক ২ টন। আগে একটা সড়ক ন্যূনতম পাঁচ-সাত বছর ভালোভাবে টিকে থাকলেও এখন নির্মাণ ত্রুটির কারণে রাস্তা তার চেয়েও অল্প সময়ের মধ্যে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। তিন-চার বছরের মধ্যে সড়কের বেহাল অবস্থা চোখে পড়ে। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে এলজিইডির নেটওয়ার্কের মধ্যে ভালো ও চলনসই অবস্থায় ছিল ৪৯ শতাংশ সড়ক। এক বছরের ব্যবধানে ২ শতাংশ কমে এ সড়কের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৪৭ শতাংশে। বাকি ৫৩ শতাংশ সড়কই খারাপ। অর্থাৎ সংস্থাটির প্রায় ৬২ হাজার কিলোমিটার সড়ক খারাপ বা বেহাল অবস্থায় রয়েছে। এর মধ্যে গত এক বছরে নতুন করে বেহাল দশায় গেছে ২ হাজার ৩০০ কিলোমিটার সড়ক। বিশেষজ্ঞরাও এলজিইডির সড়কের বেহাল দশার কিছু কারণ চিহ্নিত করেছেন। এসবের মধ্যে রয়েছে বন্যা, নিম্নমানের কাজ ও নির্মাণ উপকরণ, অনিয়ম-দুর্নীতি, অদক্ষ ঠিকাদার, রক্ষণাবেক্ষণের অভাব, নকশার ত্রুটি ও অপ্রতুল বরাদ্দ। 

এ প্রেক্ষাপটে বহুপক্ষীয় দাতা সংস্থা থেকে ঋণে পাওয়া গ্রামীণ সেতু নির্মাণ, সংস্কার ও গ্রামীণ পরিবহনের সর্বশেষ (২০১৯-২০) উল্লেখযোগ্য দুই প্রকল্পের একটি ‘গ্রামীণ সেতু নির্মাণ প্রকল্পে’ ৪২ কোটি ৫০ লাখ ডলার পাওয়া গেছে। এ প্রকল্পটির মাধ্যমে ১৯টি উপকূলীয় জেলায় ২৯ হাজার মিটার সেতুর সংস্কার এবং ৬১ জেলায় নতুন করে ২০ হাজার মিটার সেতু নির্মাণ করবে সরকার। প্রকল্পটি বাস্তবায়নে দেশের ৫৫ লাখ মানুষের কর্মসংস্থানও তৈরি হবে। দ্বিতীয় ঋণ চুক্তি হয়েছে ‘দ্বিতীয় গ্রামীণ পরিবহন উন্নয়ন প্রকল্পে’ ১০ কোটি ডলারের। এর মাধ্যমে উপজেলা ও ইউনিয়ন পর্যায়ে ২০১৭ সালে প্রবল বৃষ্টিপাতে ক্ষতিগ্রস্ত ১ হাজার ৪৩৩ কিলোমিটার সড়ক সংস্কার করা হবে। এছাড়া ২৬টি জেলার ছয় হাজার কিলোমিটার গ্রামীণ সড়কের রক্ষণাবেক্ষণও এ প্রকল্পের আওতায় করা হবে। দাতা সংস্থার মতে, ‘প্রকল্প দুটি বাস্তবায়ন করা হলে দেশের ১০ কোটি মানুষ উপকৃত হবে। গ্রামীণ সেতুগুলো দেশের উন্নয়নের চালিকাশক্তি হিসেবে কাজ করছে। এভাবে যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন গ্রামীণ জীবনমান উন্নয়নে ব্যাপক অবদান রাখছে। দুটি প্রকল্পের মাধ্যমেই দেশের গ্রামীণ যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নে কাজ করা হবে।’ 

গ্রামীণ অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির একটি শক্তিশালী উৎস, যা টেকসই দারিদ্র্য নিরসনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। গ্রামীণ উন্নয়নে যে নীরব গতিশীলতা এসেছে, তা যেন এক বৈপ্লবিক পরিবর্তন করেছে। খাদ্যশস্য উৎপাদন, রফতানি, রেমিট্যান্স, অর্থনৈতিক ডিজিটালাইজেশনে এ সাফল্য আসছে। ‘আমার গ্রাম আমার শহর’ এ স্লোগানে গ্রামকে উন্নয়ন ও সমৃদ্ধির কেন্দ্রীয় দর্শন হিসেবে বিবেচনাযোগ্য। সংবিধানের ১৬ অনুচ্ছেদে নগর ও গ্রামের বৈষম্য ক্রমাগতভাবে দূর করার কথা বলা হয়েছে। এ লক্ষ্যে কৃষিবিপ্লবের বিকাশ, গ্রামাঞ্চলে বৈদ্যুতিকীকরণের ব্যবস্থা, কুটিরশিল্প অন্যান্য শিল্পের বিকাশ এবং শিক্ষা, যোগাযোগ-ব্যবস্থা ও জনস্বাস্থ্যের উন্নয়নের মাধ্যমে গ্রামাঞ্চলের আমূল রূপান্তর সম্ভব হতে পারে। উন্নত রাস্তাঘাট, যোগাযোগ, সুপেয় পানি, আধুনিক স্বাস্থ্যসেবা ও সুচিকিৎসা, মানসম্মত শিক্ষা, উন্নত পয়ঃনিষ্কাশন ও বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি সরবরাহ বৃদ্ধি, কম্পিউটার ও দ্রুতগতি সম্পন্ন ইন্টারনেট সুবিধা, বৈদ্যুতিক সরঞ্জামসহ মানসম্পন্ন ভোগ্যপণ্যের বাজার সম্প্রসারণের মাধ্যমে প্রতিটি গ্রামকে আধুনিক শহরের সব সুবিধাদি দেয়ার ব্যবস্থা হতে পারে। 

গত এক দশকে গ্রামীণ রাস্তাঘাট, সেতু, কালভার্ট নির্মাণের কারণে গ্রামীণ অর্থনীতিতে বড় ধরনের ইতিবাচক প্রভাব পড়েছে। সরকার ২০০৯ সালে প্রত্যেক সংসদ সদস্যকে তার নিজ নিজ এলাকার উন্নয়নে ১৫ কোটি টাকা করে বরাদ্দ দিয়েছিল। ২০১৪ সালের জাতীয় নির্বাচনের পর ফের সংসদ সদস্যদের নিজ নিজ এলাকার অবকাঠামো উন্নয়নে ১৫ কোটি টাকা করে দেয়া হয়। গত বছর ২০১৯ সালে আবারো প্রত্যেক সংসদ সদস্যকে ২০ কোটি টাকা করে বরাদ্দ দেয়া হয়েছে, তাদের নিজ নিজ এলাকার অবকাঠামো উন্নয়নের জন্য। বর্তমানে অগ্রাধিকারভিত্তিতে গুরুত্বপূর্ণ ‘পল্লী অবকাঠামো উন্নয়ন প্রকল্প-৩’ শীর্ষক প্রকল্পের আওতায় ২৮০ এমপি বরাদ্দ পাবেন। ২০২০ সালের জুলাই থেকে ২০২৪ সালের জুন মেয়াদে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করবে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর।

প্রকল্পটি বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে প্রত্যন্ত পল্লী অঞ্চলেও আধুনিক নগর সুবিধা সম্প্রসারিত হবে। সংসদ সদস্যরা তৃতীয়বারের মতো প্রত্যেকে ২০ কোটি টাকা বরাদ্দ পাবেন। এ টাকা দিয়ে তারা এলাকার রাস্তা, ব্রিজ, কালভার্ট, হাটবাজার ও বিভিন্ন অবকাঠামো উন্নয়ন করতে পারবেন। তবে একবারে নয়, চার ভাগে প্রতি বছর ৫ কোটি টাকা করে এ টাকা বরাদ্দ পাবেন তারা। প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হলে করোনা সংকট মোকাবেলায় অবদান রাখবে। সাধারণত গ্রামীণ এলাকায় প্রকল্পের কাজ হবে। তৃতীয় দফার এ প্রকল্পের আওতায় নতুন করে ৩০৫ কিলোমিটার উপজেলা সড়ক, ৩৬০ কিলোমিটার ইউনিয়ন সড়ক উন্নয়ন, ৫ হাজার ৭৫ কিলোমিটার গ্রাম সড়ক উন্নয়ন, ১ হাজার ৯০ কিলামিটার গ্রামীণ সড়ক রক্ষণাবেক্ষণ, ৭ হাজার ৯৯২ মিটার গ্রামীণ সড়কে (১০০ মিটারের কম দৈর্ঘ্যের) সেতু ও কালভার্ট নির্মাণের পরিকল্পনা প্রকল্প দলিলে দেখানো হয়েছে। 

সময়ের প্রেক্ষাপটে গ্রামীণ অর্থনীতিকে আরো চাঙ্গা ও টেকসই করতে হলে নতুন প্রযুক্তিনির্ভর, ক্রমবর্ধমান পুঁজি ও শ্রম নিয়োজনকারী শিল্পকে উৎসাহিত করার বিষয়টিকে সামনে আনতে হবে। এ শিল্পগুলো হবে গ্রামের কাছাকাছি তবে কোনো পাকা সড়ক সংলগ্ন, তা সেটা কোনো গ্রাম হোক বা নগর হিসেবে চিহ্নিত হোক। পাকা সড়কের কাছাকাছি হতে হবে, যাতে পণ্য পরিবহন সহজ হয়। সড়ক জাল গ্রামাঞ্চলে যথেষ্ট প্রসারিত বলেই সেখানে শ্রমসুলভ হবে—কারণ আশপাশের গ্রাম থেকে তারা আসবে, তেমন যাতায়াত ব্যয় হবে না, নতুনভাবে বসবাসের ব্যয় হবে না। অবকাঠামো অগ্রগতি দ্রুততর হলে দূরবর্তী এলাকায় শিল্প স্থাপনে আগ্রহ বাড়বে। গত পাঁচ-ছয় বছরে সামগ্রিকভাবে দেশে শিল্প খাতে কর্মসংস্থান স্তিমিত হয়েছে। এ প্রবণতার কারণ হচ্ছে শিল্প খাতে পুঁজিঘনত্ব বৃদ্ধি। শ্রম অসন্তোষ, মজুরি ব্যয় বৃদ্ধি এবং পণ্যের মানোন্নয়নের ফলে কমছে কর্মসংস্থান ও পুঁজির অনুপাত। উদ্ধৃত শ্রমের দেশে এ প্রবণতাটির ফলে বেকারত্ব হার বেড়েই চলছে। 

সে কারণে করোনা-উত্তর পরিবেশ পরিস্থিতিতে গ্রামাঞ্চলে শিল্পোন্নয়ন হলে দ্রুততর হারে কর্মসংস্থান হতে পারে। শিল্পের সঙ্গে সঙ্গে ইন্টারনেটভিত্তিক বিভিন্ন সেবা খাতেরও একটি বিশাল ভূমিকা থাকতে পারে এ রকম বিস্তৃতভাবে কর্মসংস্থান তৈরিতে। তবে তরুণদের জন্য উপযুক্ত শিল্প ও সেবা খাতে কর্মসংস্থান বা আধুনিক সেবা খাতে স্বনিয়োজন, এসবের জন্য চাই মানসম্মত শিক্ষা এবং উদ্যোক্তা তৈরির জন্য উপযুক্ত সহায়তা (দক্ষতা ট্রেনিং, উপকরণ, ব্যবসা-নীতিজ্ঞান)। বাংলাদেশে গত দু’তিন দশকে যে শিক্ষার প্রসার হয়েছে, সেই শিক্ষার মান যে দুর্বল এবং ক্রমে আরো অবনতি হচ্ছে, তা বহু গবেষণা ও আলোচনায় উঠে এসেছে। এ দুর্বলতা গ্রামাঞ্চলে আরো বেশি প্রকট।

গ্রামীণ অর্থনীতিতে সড়ক সেতু যোগাযোগ পরিবহন খাতে বিগত দশকগুলোতে যে অবকাঠামো গড়ে উঠেছে, তা টেকসই হওয়া বা করা প্রথম জরুরি। কেননা এসবের দ্বারা গ্রামীণ অর্থনীতিতে যে ইতিবাচক প্রবণতা বা অগ্রগতি সাধিত হয়েছে, যে প্রাণচাঞ্চল্য তৈরি হয়েছে তাকে নেতিবাচকতার দিকে যেতে দেয়া হবে আত্মঘাতী, বরং সে উৎসাহকে সামনের দিকে অগ্রসরমাণ রাখতে হলে বিদ্যমান অবকাঠামোগুলোর মেরামত ও সংস্কার দ্রুত করতে হবে, শ্রমঘন শিল্প প্রতিষ্ঠায় প্রণোদনা দিতে হবে, ইন্টারনেটভিত্তিক বিভিন্ন সেবা খাতের উন্নয়ন ঘটাতে হবে, নিশ্চিত করতে হবে মানসম্মত শিক্ষা এবং উদ্যোক্তা তৈরির জন্য পর্যাপ্ত সহায়তা। গ্রামীণ অর্থনীতিকে উন্নয়ন বৃক্ষে উঠিয়ে দিয়ে, দুর্নীতি, অদক্ষতা অব্যবস্থাপনার ঘেরাটোপে মই সরানো সমীচীন হবে না। ২০৪১ সালের মধ্যে দেশকে উন্নত দেশের কাতারে নিয়ে যেতে আধুনিক, নিরাপদ এবং পরিবেশবান্ধব পরিবহন ও যোগাযোগ অবকাঠামোর ওপর জোর দেয়ার বিকল্প নেই। 


ড. মোহাম্মদ আবদুল মজিদ: সরকারের সাবেক সচিব, পরিকল্পনা কমিশনের ভৌত অবকাঠামো বিভাগের সাবেক সদস্য এবং এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান 

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন