পল্লী পরিবহন: আর্থসামাজিক বিকাশের উদাহরণ

ড. নাজিয়া তাবাসসুম , ড. মো. রমিজ উদ্দিন

পরিবহন যেকোনো দেশের অর্থনীতির একটি গুরুত্বপূর্ণ বাহক। পরিবহন মানুষ ও পণ্যকে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় স্থানান্তর করে। এটা একটি দেশের খাদ্য, স্বাস্থ্যসেবা, শিক্ষাগত সুযোগ ও কর্মসংস্থানের প্রবেশাধিকার ঘটায়। পরিবহন বিনোদন এবং দৈনন্দিন জীবনের অন্যান্য ক্রিয়াকলাপে প্রবেশাধিকারের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশের মানুষ ও পণ্যদ্রব্য পরিবহনের মূল পদ্ধতিগুলোর মধ্যে রয়েছে বাস, ট্রেন, ট্রাক, গাড়ি, বাইসাইকেল, মোটরসাইকেল, নৌকা, লঞ্চ, স্টিমার, পথচারীদের ট্রাফিক ও অন্যান্য চালিত যানবাহন।

গ্রামীণ পরিবহন ও যোগাযোগ বাংলাদেশের পল্লী উন্নয়নের মূল উপাদান। পরিবহন প্রবেশাধিকার গ্রামীণ সম্প্রদায়ের অর্থনৈতিক উন্নয়ন, স্বাস্থ্য ও জীবনযাত্রায় ব্যাপক অবদান রাখে। এছাড়া পরিবহনের প্রবেশাধিকার এবং পরিবর্তন গ্রামীণ জীবনের বিনোদন এবং সাম্প্র্র্রদায়িক ব্যস্ততাকে উৎসাহিত করে এমন অন্যান্য ক্রিয়াকলাপে অনুপ্রাণিত করার ক্ষমতাকে বৃদ্ধি করে। তাই গ্রামীণ বাসিন্দাদের স্বাস্থ্যসেবা, ভোক্তাসেবা, কর্মসংস্থান, শিক্ষাগত সুযোগ ও সামাজিক পরিষেবা দিতে প্রবেশাধিকার পাওয়ার জন্য প্রয়োজন নির্ভরযোগ্য পরিবহন। দক্ষ ও সাশ্রয়ী পরিবহন ব্যবস্থা গ্রামীণ অঞ্চলে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির এক গুরুত্বপূর্ণ চলক, যা মানুষের পরিষেবা গ্রহণে এবং জনজীবনে অংশ নেয়া নিশ্চিত করতে সহায়তা করে। গ্রামীণ পরিবহন অর্থনৈতিক ও সামাজিক সেবা প্র্র্রচারের পাশাপাশি বর্ধিত কৃষি আয় ও উৎপাদনশীল কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখে। তাই গ্রামীণ পরিবহন পল্লী অঞ্চলে বসবাসকারী মানুষের জন্য ‘লাইফলাইন’।

বাংলাদেশের গ্রামীণ পরিবহন সংযোগের পটভূমিতে দেখা যায়, প্র্র্রাচীনকাল থেকেই বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলে দীর্ঘ দূরত্বের পরিবহন ছিল পানি পরিবহন যেমন—নৌকা, স্টিমার ইত্যাদি এবং স্বল্প দূরত্বের জন্য পায়ে হাঁটা, গরুর গাড়ি, ঘোড়ার গাড়ি, বাইসাইকেল, মোটরসাইকেল ইত্যাদি। গ্রামের বেশির ভাগ রাস্তাই ছিল কাঁচা। ব্রিটিশ আমলে গ্রামীণ স্তরে রেল নেটওয়ার্ক বিকশিত হয়েছিল ১৯৫৭ সালে। বিস্তৃত সড়ক নেটওয়ার্কের বিকাশ প্র্র্রথম অনুভূত হয়েছিল ১৯৭১ সালে স্বাধীনতার পরে। বাংলাদেশের সড়ক খাতের ব্যাপক বিকাশ শুরু হয়েছিল মধ্য আশির দশকে। গ্রামীণ পরিবহন উন্নয়ন প্রকল্পের আওতায় গ্রামীণ সংযোগ বৃদ্ধির জন্য ২০১২ সাল থেকে ৫ হাজার ২৪৮ কিলোমিটার সড়কের মধ্যে ৩ হাজার ৬০ কিলোমিটার নতুন নির্মিত বা পুনর্বাসন করা হয়েছে। এটি গ্রামীণ মানুষকে—যারা বাংলাদেশের জনসংখ্যার ৬৬ শতাংশ—শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা ও জীবিকার সুযোগের সাথে সংযুক্ত করেছে। নৌপরিবহন যাত্রী ও মালপত্র স্থানান্তরে ব্যবহূত হয়। এটি বাংলাদেশের গ্রামীণ পরিবহনের একটি প্রধান মাধ্যম। নৌপরিবহন জলপথের ৩ হাজার ২০০ থেকে ৫৫ হাজার মাইল রয়েছে। বাংলাদেশের অনেক নদী হওয়ায় ফেরি পরিবহনের একটি গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম। অভ্যন্তরীণ নৌপথগুলোর ৩ হাজার ৯০০ কিলোমিটারের নেটওয়ার্ক বাংলাদেশের ১২ শতাংশ গ্রামীণ জনগণের একমাত্র পরিবহনের মাধ্যম।

একটি গ্রামের মধ্যকার রাস্তা ও ইউনিয়ন সদর দপ্তর, স্থানীয় বাজার, খামার এবং ঘাট বা একে অন্যের সঙ্গে গ্রামগুলোকে সংযোগকারী রাস্তাই হচ্ছে গ্রামীণ রাস্তা। বাংলাদেশের গ্রামীণ সড়কের একটি বিশাল নেটওয়ার্ক রয়েছে, যার মধ্যে অনেকগুলো ইউনিয়ন পরিষদের মালিকানাধীন মাটির বেড়ি বাঁধগুলো ১৯৯০-২০১০ সালে নির্মিত হয়েছিল। এ রাস্তাগুলো অকৃষি ও কৃষিক্ষেত্রের জন্য অতীব গুরুত্বপূর্ণ। ১৯৯৬-২০১৬ সাল থেকে গ্রামীণ বাংলাদেশের অবকাঠামোগত উন্নতি হয়েছে। অগ্রগতি সত্ত্বেও গ্রামীণ যোগাযোগ, পণ্য ও পরিষেবাগুলোতে শারীরিক ও অর্থনৈতিক প্রবেশাধিকার বাধাগ্রস্ত করে। 

গ্রামীণ পরিবহনের বিশাল এ সম্পদ গত তিন দশকে নির্মিত হয়েছে। বাংলাদেশে ১ লাখ ১৩ হাজার ২০০ কিলোমিটার গ্রামীণ রাস্তা রয়েছে এবং প্রতি বছর এ নেটওয়ার্কে আরো ৬ হাজার কিলোমিটার রাস্তা যুক্ত হয়েছে। ১৯৯২-৯৩ সালে প্রথম গ্রামীণ রাস্তাগুলোর জন্য রক্ষণাবেক্ষণ তহবিল অর্থবছরের অউন্নয়ন বাজেট থেকে বরাদ্দ করা হয়েছিল। ২০১৩ প্রণীত হয়েছে গ্রামীণ সড়ক ও সেতু রক্ষণাবেক্ষণ নীতি। এলজিইডি চার ধরনের রক্ষণাবেক্ষণের কাজ করে। সেগুলি হলো (১) নিয়মিত রুটিন রক্ষণাবেক্ষণ (২) পর্যায়ক্রমিক রক্ষণাবেক্ষণ (৩) জরুরি রক্ষণাবেক্ষণ (৪) পুনর্বাসন। ২০১৯-২০ অর্থবছর পল্লী পরিবহনের জন্য সড়ক রক্ষণাবেক্ষণ বরাদ্দ ২০.১০ বিলিয়ন টাকা রাখা হয়েছিল।

গ্রামীণ বাংলাদেশ সামাজিক, অর্থনৈতিক, শারীরিক ও কাঠামোগতভাবে তার চেহারা বদলাচ্ছে। গ্রামীণ সড়ক উন্নয়ন প্রকল্পগুলো অর্থনৈতিক বৃদ্ধি এবং দারিদ্র্য হ্রাসের সুযোগ তৈরি করেছে। দোকান, রেস্তোরাঁ, ফার্মেসি, চা স্টল, সেলুন, রিকশা ও ভ্যান চালনা, সিএনজি চালনা এবং অন্যান্য কৃষি ও অকৃষি ক্রিয়াকলাপে ব্যক্তিগত বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি করেছে। জনগণের আর্থসামাজিক উন্নয়নের জন্য হাসপাতাল, স্কুল ও কলেজ, মসজিদ, অফিস-আদালত, বাজার ও কল্যাণমূলক প্রতিষ্ঠানে প্রবেশাধিকার বৃদ্ধি করছে। পরিবহনের ধরন পরিবর্তনের ফলে শ্রমিকদের চলাচল, স্থানান্তর, জনগণের সম্প্রসারিত জীবনযাপন এবং সারা বছর ধরে গ্রামীণ ও শহুরে অঞ্চলের মধ্যে প্রসারিত যোগাযোগের ফলে জমির মূল্যও উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। গত তিন দশকে গ্রামীণ রাস্তাগুলো দ্রুত বিকাশের সাথে সাথে বাংলাদেশের সড়কের ঘনত্বও উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। বিশ্বব্যাংক ২০১৬ অনুসারে, গ্রামীণ অঞ্চলে পরিবহনের পরিবর্তনের কারণে সম্প্র্র্রতি যেসব খাতে অভূতপূর্ব উন্নয়ন হয়েছে তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে নন-মোটরাইজডদের জন্য ট্রাফিকের পরিমাণ ৩০৯ শতাংশ এবং মোটরযুক্তের জন্য ১৫৬ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে, যানবাহন পরিচালন ব্যয় হ্রাস পেয়েছে ৪০ শতাংশ, ভ্রমণের সময় মোটরচালিতদের জন্য ৬০শতাংশ এবং অমোটরচালিত ক্ষেত্রে হ্রাস পেয়েছে ৪০ শতাংশ, স্বাস্থ্যসেবা ও পরিবার পরিকল্পনা সুবিধা বৃদ্ধি পেয়েছে ৩৭ শতাংশ, স্কুলে উপস্থিতি ছেলেদের ২৪ শতাংশ এবং মেয়েদের বৃদ্ধি পেয়েছে ৫৯শতাংশ, দোকান ও শিল্প-কারখানা বেড়েছে ২৪ শতাংশ, বার্ষিক ইজারার অর্থ বৃদ্ধি পেয়েছে ৩৮ শতাংশ এবং ব্যবসায়ী ১৬ শতাংশ ও ক্রেতা ২৫ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে।

এছাড়া পরিবহন পরিবর্তনের ফলে গ্রামীণ সমাজের সর্বস্তরের মানুষ, ব্যবসায়ী, শ্রমজীবী ও নীতিনির্ধারকরা বিভিন্নভাবে উপকৃত হচ্ছে। নিরাপদ ও নির্ভরযোগ্য পরিবহনের প্রবেশাধিকার গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর স্বাস্থ্য ও কল্যাণকে প্রভাবিত করে। তাই গ্রামীণ জনগণের স্বাস্থ্যসেবা প্রবেশাধিকারের জন্য পরিবহন ব্যবহারের পরিবর্তন প্রয়োজন। গ্রামীণ জনগোষ্ঠী তাদের স্বাস্থ্যসেবা প্রয়োজন মেটাতে ব্যক্তিগত যানবাহন ও গণপরিবহনের ওপর নির্ভরশীল। গ্রামীণ পরিবহনের পরিবর্তন ও উন্নতির মাধ্যমে গ্রামীণ জনগণের কর্মসংস্থানের নতুন সুযোগ তৈরি হয়। অনেক গ্রামীণ বাসিন্দার জন্য অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা কোনো কর্মস্থলে পরিবহনের নির্ভরযোগ্য মাধ্যমের ওপর নির্ভরশীল। একটি সম্প্রদায়ের শিক্ষায় প্রবেশাধিকার প্রসারিত করে এর অর্থনৈতিক প্রতিযোগিতা ও দায়বদ্ধতা উন্নত করে। সর্বস্তরের শিক্ষার প্রবেশাধিকার জন্য বিদ্যালয়গুলোতে এবং স্কুল থেকে যানবাহনের জন্য গ্রামীণ অঞ্চলে একটি উল্লেখযোগ্য প্রয়োজন রয়েছে। এছাড়া এর মাধ্যমে গ্রামের শিক্ষার্থীরা তুলনামূলকভাবে কম সময়ে শিক্ষাপ্র্র্রতিষ্ঠানে পৌঁছতে পারে, যা গ্রামাঞ্চলে শিক্ষার মানোন্নয়নে সহায়তা করে। গ্রামীণ পরিবহনের যুগোপযোগী পরিবর্তন ও সহজলভ্যতার কারণে গ্রামীণ জনগোষ্ঠী অল্প সময়ে প্রয়োজনীয় সব ধরনের সেবা গ্রহণ করতে সমর্থ হয়। গ্রামীণ এলাকায় পরিবহনের ধরন পরিবর্তনের কারণে শিশু, প্র্র্রাপ্তবয়স্ক ও বয়স্ক জনগোষ্ঠী, নিম্ন আয়ের মানুষ এবং প্র্র্রতিবন্ধী মানুষ বিভিন্নভাবে উপকৃত হচ্ছে। শিশু বা শিক্ষার্থীরা পরিবহন ব্যবহারের মাধ্যমে বিদ্যালয়, কলেজ, লাইব্রেরি, খেলাধুলা ও বিনোদনমূলক ক্রিয়াকলাপের মতো কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করতে পারছে।

গ্রামের বয়স্ক ও প্র্র্রতিবন্ধী মানুষের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। পরিবর্তিত পরিবহন ব্যবস্থা এসব মানুষের জন্য আশীর্বাদ। গ্রামের গণপরিবহন যেমন—ভ্যান, অটোরিকশা, সিএনজি ইত্যাদির মাধ্যমে নিম্ন আয়ের লোকজন অতি সহজে এবং কম খরচে এক স্থান থেকে আরেক স্থানে যেতে পারে। ভ্যান ও পিক-আপ ভ্যান, যন্ত্রচালিত অটোরিকশা ইত্যাদির ব্যবহারের কারণে কৃষিজমি থেকেও পচনশীল কৃষিপণ্য অতি সহজে এবং অল্প সময়ে স্থানান্তর করা সম্ভব হচ্ছে। এতে উৎপাদিত পণ্যে সংগ্রহোত্তর ক্ষতি কমে যাচ্ছে। উৎপাদিত কৃষিপণ্য যেমন—শাকসবজি, ফলমূল, মাছ, দানাদার শস্য ইত্যাদি অতি দ্রুত বাজারজাত করা সম্ভব হচ্ছে। ফলে কৃষক ও ব্যবসায়ীরা মুনাফা অর্জন করতে পারছে। অটোরিকশা, ভ্যান ইত্যাদি ব্যবহার করে মুদি দোকানগুলোতে বেকারি এবং প্রক্রিয়াজাতকৃত ও প্যাকেটজাত পণ্যের জোগান বাড়ছে। এমন অবস্থায় গ্রামাঞ্চলে বিভিন্ন প্যাকেটজাত খাদ্যদ্রব্যের সহজলভ্যতা বাড়ছে এবং জীবনযাত্রার মান সহজতর হয়েছে, যা দেশের জাতীয় অর্থনীতিতে বিশেষ প্র্র্রভাব রাখছে।

গ্রামীণ জনগণ নিরাপদ, সাশ্রয়ী মূল্যের এবং পরিবহনের নির্ভরযোগ্য পদ্ধতির ক্ষেত্রে বিভিন্ন ধরনের চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হয়। সীমিত পরিবহন বিকল্পগুলো গ্রামীণ বাসিন্দাদের সামাজিক পরিষেবা ও ভোক্তাদের প্রয়োজনীয় প্রবেশাধিকার থেকে বিরত রাখতে পারে। এছাড়া গ্রামের প্রত্যন্ত স্থানে নাগরিক ব্যস্ততা ও সম্প্রদায়ের জীবনে বিভিন্ন ধরনের ব্যস্ততা নিশ্চিত করার জন্য পরিবহন অপরিহার্য হতে পারে। কিন্তু বাংলাদেশের পরিবহন খাত পর্যাপ্ত অর্থায়ন পায় না। এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ নেভিগেশন চ্যানেলগুলো দুর্বল রক্ষণাবেক্ষণে ভুগছে এবং এগুলো সুরক্ষার অবকাঠামোর জন্য পর্যাপ্ত গভীরতার অভাব রয়েছে। পণ্যসম্ভার ও যাত্রীদের জন্য বেশির ভাগ নদীবন্দর সুবিধাগুলো অনিরাপদ পরিস্থিতিতে জরাজীর্ণ এবং মহিলা ও অসুস্থ জনগোষ্ঠীর জন্য অনুকূল নয়। সময়ের সাথে সাথে গ্রামীণ রাস্তাগুলোর ক্রমবর্ধমান ব্যবহারের সাথে গ্রামীণ সম্প্রদায়ের অবকাঠামোগত বিনিয়োগের অভাবও পরিবহন সুরক্ষাকে প্রভাবিত করছে। পরিবেশগত প্রতিবন্ধকতার কারণে অনেক গ্রামীণ রাস্তা নুড়ি বা ময়লা থেকে নির্মিত, যা সম্ভাব্য সুরক্ষার জন্য বাধা। 

স্বাস্থ্য, শিক্ষা, কর্মসংস্থান, বিনোদন ও জরুরি প্র্র্রয়োজনের তাগিদে প্র্র্রায় ৬৬ শতাংশ গ্রামীণ মানুষের জীবিকা নির্বাহের জন্য বাংলাদেশের গ্রামীণ সড়ক নেটওয়ার্ক প্রয়োজন। মাধ্যমিক ও তৃতীয় সড়ক নেটওয়ার্কের কিছু অংশ নিম্নমানের, নির্মাণ এবং বহন করার ক্ষমতা সাধারণ এবং বর্ষাকালীন রাস্তার বড় অংশ দুর্গম। তবুও গ্রামীণ রাস্তাগুলোর জাতীয় রক্ষণাবেক্ষণ বাজেট ঘাটতি ক্রমশ বাড়ছে। রাস্তা মেরামত দীর্ঘকালীন সময়ে ব্যয়বহুল। গ্রামাঞ্চলে বসবাসকারী অনেক লোকের জন্য দীর্ঘ দূরত্ব একটি প্রতিবন্ধক। 

বাংলাদেশের পরিকাঠামোগত উন্নয়নের দ্রুত অগ্রগতি না হওয়ায় এবং ভূমি, জল ও বায়ু পরিবহন সীমিত হওয়ায় পরিবহন প্রবেশাধিকার নিশ্চিত করার জন্য উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হওয়া দরকার। যদিও গ্রামীণ সড়ক রক্ষণাবেক্ষণ বাজেট প্রতি বছর বৃদ্ধি পেয়েছে, কিন্তু এটি রক্ষণাবেক্ষণের চাহিদা মেটাতে যথেষ্ট নয়। রক্ষণাবেক্ষণ বাজেটের বরাদ্দের বিবরণ এবং রাস্তাগুলোর পুনর্বাসন, পুনর্নির্মাণসহ আনুমানিক রক্ষণাবেক্ষণের প্রয়োজনীয়তা সন্তোষজনক নয়। ২০১২-১৮ সালে গ্রামীণ সড়কের রক্ষণাবেক্ষণ বরাদ্দের গড় বৃদ্ধি ছিল প্রতি বছর ১৫.৬ শতাংশ। এছাড়া দেশের খাদ্য শিল্পের বেশির ভাগ অংশ গ্রামীণ সড়ক ও মহাসড়কগুলোতে দীর্ঘ দূরত্বে পণ্য পরিবহনের ওপর নির্ভর করে। তাই একটি আন্তঃসংযুক্ত পরিবহন ব্যবস্থা বজায় রাখার জন্য রাস্তাগুলোর সুরক্ষা এবং কাঠামোগত অখণ্ডতা গুরুত্বপূর্ণ। গ্রামীণ পরিবহন সংযোগের পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নে সরকারি সক্ষমতা জোরদার করা দরকার।

আঞ্চলিক ও দেশীয় পরিবহন নেটওয়ার্কগুলোতে পল্লী পরিবহন সংযোগ সময়ের দাবি। এটি কেবল অর্থনৈতিক বিকাশই নয়, স্থানীয় পর্যায়ে আর্থসাংস্কৃতিক বিকাশেরও একটি দৃষ্টান্ত। এটি পরিবহন উন্নয়ন এবং খামার ও অখামার উৎপাদনের বিকাশে স্থানীয় এবং উপযুক্ত প্রযুক্তি বিনিময় করার একটি পথ। তাই গ্রামীণ পরিবহনের পরিবর্তন ও ব্যবহার গ্রামীণ রাস্তা রক্ষণাবেক্ষণ, পুনর্বাসন ও মান উন্নীতকরণের জন্য উন্নয়ন প্রকল্পগুলোতে অর্থের ব্যবস্থা; স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠান দ্বারা অর্থায়ন; রক্ষণাবেক্ষণ নীতিতে বেসরকারি খাত দ্বারা অর্থায়ন ইত্যাদিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। সারা দেশের গ্রামীণ রাস্তাগুলোর নিয়মিত মেরামত ও পুনর্বাসন দরকার। 

যেহেতু বর্তমানে গ্রামীণ জনগণ কৃষিকাজের তুলনায় অকৃষিকাজের দিকে বেশি ঝুঁকছে, তাই এদের মূলধন জোগাড় ও রক্ষণাবেক্ষণ সুবিধা প্রয়োজন। গ্রামীণ অঞ্চলের বিভিন্ন ধরনের পরিবহন পেশার শ্রমিক যেমন—অটোরিকশাচালক, ভ্যানচালক, সিএনজিচালক ও নৌকাচালকদের বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থানের জন্য বিভিন্ন অর্থনৈতিক ও কারিগরি সুবিধা প্রদান করা দরকার। রাস্তায় দুর্ঘটনা ঝুঁকি এড়ানোর জন্য পরিবহন ও পরিবহন শ্রমিকদের দরকার উপযুক্ত প্রশিক্ষণ। যেসব পরিবহন শ্রমিকদের নিজস্ব পরিবহন মালিকানা নেই, অর্থাৎ যারা পরিবহন মালিককে প্রতিদিন ভাড়া প্রদান করার নীতিতে কাজ করে তাদের জন্য দূরত্ব, সময় ও রাস্তা অনুযায়ী ভাড়া নির্ধারণের উপযুক্ত নীতিমালা থাকা জরুরি। অবশেষে দেশব্যাপী এ গ্রামীণ পরিবহনের ব্যবহারের পরিবর্তনের সুবিধাকে উৎসাহিত করার জন্য পরিবহন মালিক, পরিবহন সেবা গ্রহণকারী জনগণ, সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানসহ সমাজের সর্বস্তরের মানুষের সামাজিক ও অর্থনৈতিক সহযোগিতা নিশ্চিত করা প্রয়োজন।


ড. নাজিয়া তাবাসসুম: অধ্যাপক, কৃষি ব্যবসা ও বিপণন বিভাগ, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়

ড. মো. রমিজ উদ্দিন: অধ্যাপক, কৃষিতত্ত্ব বিভাগ, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন