স্বাধীনতা-পরবর্তী বাংলাদেশের গ্রামীণ স্বাস্থ্য অবকাঠামো

ড. নাসরিন সুলতানা

স্বাধীনতার পর থেকেই সীমিত সম্পদ দিয়ে বিশাল জনসংখ্যার স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিতকরণে অঙ্গীকারবদ্ধ হয়ে কাজ করছে বাংলাদেশ। যার ফলে তৃণমূল পর্যায়ে স্বাস্থ্যসেবা সম্প্রসারণসহ স্বাস্থ্য খাতের উল্লেখযোগ্য উন্নতির পাশাপাশি নির্ধারিত সময়ের আগেই বাংলাদেশ সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এমডিজি) অর্জনে অনেকটাই সফল হয়েছে। সরকার এখন ২০৩০ সালের মধ্যে সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষা (ইউএইচসি) নিশ্চিত করতে সমন্বিত প্রচেষ্টার প্রতি গুরুত্বারোপ করছে, যা টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি গোল ৩) অর্জনের ক্ষেত্রেও সুফল বয়ে আনবে বলে আশা করা যায়।

১৯৭২ সালে প্রণীত দেশের প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় (১৯৭২-১৯৭৮), যা পরবর্তী সময়ে ১৯৮০ পর্যন্ত বর্ধিত করা হয়েছিল, প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবার উন্নয়নের ওপর গুরুত্ব আরোপ করা হয়। এ পরিকল্পনা অনুযায়ী ১৯৭৬ সালে থানা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের (যা বর্তমানে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স নামে পরিচিত) বিদ্যমান শয্যা সংখ্যা ৩১-এ উন্নীত করা হয় এবং প্রতি থানায় একটি করে থানা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স নির্মাণের লক্ষ্য স্থির করা। ১৯৭৮ সালে বাংলাদেশ ‘আলমাআতা ঘোষণা’তে স্বাক্ষর করে প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা প্রদান ও সবার জন্য স্বাস্থ্য অর্জনে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়। এছাড়াও ২০০০ সালের মধ্যে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা কর্তৃক ঘোষিত ‘সবার জন্য স্বাস্থ্য’ অর্জন করার জন্য বাংলাদেশ ১৯৮০ সালে জাতীয় কৌশলপত্র ও কর্মপরিকল্পনা প্রণয়ন করে। স্বাধীনতা-পরবর্তী এসব উদ্যোগ দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার, বিশেষ করে গ্রামীণ স্বাস্থ্য ব্যবস্থার উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। দ্বিতীয় পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় (১৯৮০-৮৫) প্রতি থানায় একটি করে থানা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স এবং প্রতি ইউনিয়নে একটি করে ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্র নির্মাণের ধারাবাহিকতা চলমান রাখার ওপর গুরুত্বারোপ করা হয়। পরবর্তী সময়ে তৃতীয় ও চতুর্থ পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় (১৯৮৫-৯৫) সম্প্রসারিত টিকাদান কর্মসূচি, ডায়রিয়া নিয়ন্ত্রণ, তীব্র শ্বাস-প্রশ্বাসজনিত প্রদাহ নিয়ন্ত্রণ, রাতকানা রোগ প্রতিরোধ প্রোগ্রামসহ মা ও শিশু স্বাস্থ্য উন্নয়নের প্রতি গুরুত্ব আরোপ করা হয়। ১৯৯৭ সালে প্রণীত হেলথ পপুলেশন সেক্টর স্ট্র্যাটেজিতে এসেনশিয়াল সার্ভিস প্যাকেজ, প্রজনন স্বাস্থ্য এবং প্রতিকারমূলক স্বাস্থ্যসেবার প্রতি অগ্রাধিকার দেয়া হয়। এসব পরিকল্পনা ও স্ট্র্যাটেজিগুলোও গ্রামীণ স্বাস্থ্য ব্যবস্থার উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে । 

১৯৯৮ সালে মানুষের দোরগোড়ায় স্বাস্থ্যসেবা পৌঁছে দেয়ার জন্য সর্বপ্রথম কমিউনিটি ক্লিনিক স্থাপন করা হয়। এটি হলো গ্রাম পর্যায়ের প্রথম স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্র। দেশজুড়ে বিস্তৃত স্বাস্থ্যসেবা নেটওয়ার্কে সর্বশেষ সংযোজন ২০০৯ সালে পুনর্জীবিত প্রায় ১৪ হাজার কমিউনিটি ক্লিনিক, যার মাধমে সারা দেশের গ্রাম পর্যায়ে দৈনিক প্রায় ছয় লাখ লোককে প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা দেয়া হয়। এসব স্বাস্থ্যসেবার মধ্যে ২৯ রকমের ওষুধ বিনা মূল্যে প্রদান, স্বাভাবিক প্রসব ব্যবস্থা, টিকাদান কর্মসূচিসহ নানা ধরনের স্বাস্থ্যসেবা প্রদান করা হয়। গ্রামাঞ্চলে কমিউনিটি ক্লিনিক এখন বাংলাদেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় একটি অতি জনপ্রিয় স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্র।

বর্তমানে আমাদের গ্রামীণ স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় চার শতাধিক (৪২১) উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তর কর্তৃক পরিচালিত প্রায় চার হাজার (৩৯০০টি) ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্র, স্বাস্থ্যসেবা অধিদপ্তর কর্তৃক পরিচালিত ১৩ শতাধিক (১৩১২টি) ইউনিয়ন উপ-স্বাস্থ্যকেন্দ্র, প্রায় ১৪ হাজার কমিউনিটি ক্লিনিক রয়েছে। তাছাড়া স্যাটেলাইট ক্লিনিক এবং ইপিআই সেন্টার রয়েছে। এছাড়া বাড়ি বাড়ি গিয়ে পরিবার পরিকল্পনা সেবা দেয়া হচ্ছে । উপজেলা স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলো প্রাথমিক পর্যায়ের বহির্বিভাগ ও অন্তর্বিভাগ সেবা প্রদান করে। প্রতিটি ইউনিয়নে একটি করে ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্র বা ইউনিয়ন উপ-স্বাস্থ্যকেন্দ্র রয়েছে, যার মাধ্যমে মূলত প্রাথমিক পর্যায়ের মা ও শিশু স্বাস্থ্যসেবা, পরিবার পরিকল্পনা সেবা, সাধারণ অসুখের শুধু বহির্বিভাগ সেবা প্রদান করে। সম্প্রতি প্রায় ১৫০০টি ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্রে ২৪ ঘণ্টা নরমাল ডেলিভারি সেবা প্রদানের ব্যবস্থা করা হয়েছে। এছাড়াও বিপুলসংখ্যক বেসরকারি হাসপাতাল, ক্লিনিক, ডায়াগনস্টিক সেন্টারের মাধ্যমে গ্রামাঞ্চলে স্বাস্থ্যসেবা প্রদান করা হয়, যদিও এসব বেসরকারি হাসপাতাল, ক্লিনিক, ডায়াগনস্টিক সেন্টারের স্বাস্থ্যসেবার মান অনেকটাই প্রশ্নবিদ্ধ। 

স্বাধীনতা পরবর্তী গ্রামীণ স্বাস্থ্য ব্যবস্থার এমন ব্যাপক পরিবর্তনের ফলে বাংলাদেশে বিগত ৫০ বছরে প্রত্যাশিত গড় আয়ু বৃদ্ধি, শিশু স্বাস্থ্যের উন্নয়ন এবং মাতৃমৃত্যু হার, নবজাতক মৃত্যুর হার এবং পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুর মৃত্যুর হার কমানোসহ আরো অনেক স্বাস্থ্য সূচক উন্নয়নের ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি সাধন করেছে। ১৯৭০ সালে বাংলাদেশের মানুষের গড় আয়ু ছিল মাত্র ৪২ বছর, যা বর্তমানে বেড়ে প্রায় ৭২ বছর হয়েছে। ১৯৯০ সালে প্রতি হাজারে ১৪৬ জন পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশু মারা যেত, যা কমে বর্তমানে (২০১৭) ৩২ দশমিক ৪০ জন হয়েছে। ইনফান্ট মরটালিটি রেট ১৯৯০ সালে ছিল ৯২, যা কমে ২০১৭ সালে হয়েছে ২৬ দশমিক ৯০। আর নবজাতক মৃত্যুর হার ছিল ৬৪ দশমিক ১০, যা কমে ২০১৭ সালে হয়েছে ১৮ দশমিক ১০। অন্যদিকে ১৯৯০ সালে প্রতি লাখে যেখানে ৫৭৪ জন মা সন্তান জন্ম দিতে গিয়ে মারা যেত, সেখানে ২০১৫ সালে মাতৃমৃত্যুর হার কমে ১৭৬ হয়েছে। তাছাড়া বাংলাদেশ যক্ষ্মা ও ম্যালেরিয়া নিয়ন্ত্রণ, কালাজ্বর দূরীকরণে অসামান্য অগ্রগতি সাধন করেছে। জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রেও বাংলাদেশ অনেক সফলতা অর্জন করেছে। পাশাপাশি কমিউনিটি পর্যায়ে গঠিত কিশোর-কিশোরী ক্লাব, উঠান বৈঠক আমাদের গ্রামের মানুষকে স্বাস্থ্য সচেতন করার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। 

এছাড়া বাংলাদেশ টিকাদান কর্মসূচিতে অভূতপূর্ব উন্নতি সাধন করেছে। ১৯৯০ সালের দিকে ৫৪ শতাংশ শিশু টিকাদান কর্মসূচির আওতায় এসেছিল, যা বেড়ে ২০১৪ সালে ৮০ জন হয়েছে। শিশুর রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে বাংলাদেশে টিকাদান কর্মসূচির সফলতার জন্য গ্লোবাল অ্যালায়েন্স ফর ভ্যাকসিনেশন এবং ইমিউনাইজেশন (জিএভিআই) প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ‘ভ্যাকসিন হিরো’ সম্মাননায় ভূষিত করেছেন। তাছাড়া পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুর মৃত্যুর হার কমাতে অসামান্য অবদান রাখায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ‘UN MDG Awards 2010’ লাভ করেছেন। এছাড়া এমডিজি-৪ (শিশু মৃত্যুর হার কমানো) এবং এমডিজি-৫ (মাতৃ স্বাস্থ্যের উন্নয়ন) অর্জন করায় বাংলাদেশ South-South Award ‘Digital Health For Digital Development’ লাভ করেছে। বাংলাদেশের স্বাস্থ্য খাতের এসব অর্জনের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে আমাদের সুসংগঠিত গ্রামীণ স্বাস্থ্য ব্যবস্থা। উল্লেখ্য, আমাদের শহরে কোনো সুসংগঠিত প্রাথমিক স্বাস্থ্য ব্যবস্থা নেই। শহরের জনগোষ্ঠী, বিশেষ করে দরিদ্র জনগোষ্ঠী প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবার জন্য মূলত ৩৬টি আরবান ডিসপেনসারি, সিটি করপোরেশন পরিচালিত কিছু নগর স্বাস্থ্যকেন্দ্র, এনজিও স্বাস্থ্যকেন্দ্র, মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বহির্বিভাগের ওপর নির্ভরশীল। 

কিন্তু বাংলাদেশের স্বাস্থ্য খাতে অসামান্য অবদান রাখা এ সুগঠিত গ্রামীণ স্বাস্থ্য ব্যবস্থা আজ নানা সমস্যায় জর্জরিত। প্রয়োজনীয়সংখ্যক ডাক্তার, নার্স, মেডিকেল টেকনোলজিস্টসহ অন্যান্য স্বাস্থ্যকর্মীর সংকট, অবকাঠামোগুলোর জরাজীর্ণতা, পর্যাপ্ত ওষুধের ঘাটতি, ডাক্তারের অনুপস্থিতি, ইনপুট মিক্স ও স্কিল মিক্স সমস্যা, ডায়াগনস্টিক সুবিধার অপর্যাপ্ততা, দক্ষ জনবলের ঘাটতি, প্রশিক্ষণের ঘাটতি, মেডিকেল যন্ত্রপাতি ও সরঞ্জামাদির অকার্যকারিতা ও ঘাটতি, মান নিয়ন্ত্রণহীন বেসরকারি খাতের উত্থান ইত্যাদি সমস্যার কারণে এখনো বেশ বড় একটি গ্রামীণ জনগোষ্ঠী গুণগত স্বাস্থ্যসেবা প্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। চরাঞ্চলবাসী এবং হাওড় এলাকার লোকজনের ক্ষেত্রে স্বাস্থ্যসেবা প্রাপ্তি আরো দুরূহ বিষয়। 

এমতাবস্থায়, আমাদের সামগ্রিক স্বাস্থ্যসেবার মান উন্নয়নের জন্য আমাদের গ্রামীণ স্বাস্থ্য ব্যবস্থার উল্লেখিত সমস্যার সমাধান জরুরি ভিত্তিতে প্রয়োজন। যেহেতু আমাদের অধিকাংশ জনগণ এখনো গ্রামে বসবাস করে সেহেতু গ্রামীণ স্বাস্থ্য ব্যবস্থাকে পিছিয়ে রেখে কোনোভাবেই আমাদের পক্ষে সামগ্রিকভাবে স্বাস্থ্য ক্ষেত্রে সফলতা অর্জন করা সম্ভব নয়। তাই উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্র এবং ইউনিয়ন উপ-স্বাস্থ্যকেন্দ্রে দক্ষ জনবল নিয়োগ, পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা, ডাক্তারদের অনুপস্থিতি কমানো, প্রয়োজনীয় মেডিকেল যন্ত্রপাতি ও সরঞ্জামাদির ব্যবস্থা করা এবং অকার্যকরগুলোকে কার্যকর করাসহ সব বিদ্যমান সমস্যার সমাধানের জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা জরুরি। তাছাড়া কমিউনিটি ক্লিনিক এ সিএইচসিপির পরিবর্তে আরো দক্ষ জনবল নিয়োগ দিয়ে এবং কিছু ডিজিটাল টেস্টিং সুবিধা প্রদান করার মাধ্যমে আমাদের গ্রামীণ স্বাস্থ্য অবকাঠামোকে আরো শক্তিশালী করতে হবে। 

বাংলাদেশের স্বাস্থ্য সম্পর্কিত এসডিজি এবং সার্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষা (ইউএইচসি) অর্জন করতে হলে আমাদের প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবার প্রাণকেন্দ্র গ্রামীণ স্বাস্থ্য ব্যবস্থার কাঠামোগত উন্নয়নের পাশাপাশি গুণগত স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিতকরণের জন্য চিহ্নিত সমস্যাগুলোর জরুরি সমাধান দরকার। অন্যদিকে, শহর এলাকাতে গুণগত প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করার জন্য সুসংগঠিত প্রাথমিক স্বাস্থ্য ব্যবস্থা গড়ে তোলা প্রয়োজন। 


ড. নাসরিন সুলতানা: অধ্যাপক ও পরিচালক, স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন