বিদ্যালয় তৈরি করেছে আর্থসামাজিক ভিত্তি

মাছুম বিল্লাহ

একটি আদর্শ বিদ্যালয় স্বপ্ন তৈরির স্থান। এটি কমিউনিটি ও বিদ্যালয়ের মধ্যে এক সেতুবন্ধ তৈরি করে। স্বপ্ন দেখতে শেখায় শিক্ষার্থীদের কীভাবে তারা জাতীয় জীবনে অবদান রাখবে, কীভাবে মানবতার সেবা করবে। আর তাই এসব প্রতিষ্ঠানে শিক্ষা গ্রহণ পদ্ধতি অন্যান্য যেকোনো প্রতিষ্ঠানের চেয়ে আলাদা ধরনের, বাস্তবতার নিরিখে শিক্ষাদান করা হয়। আমাদের দেশে এ রকম বিদ্যালয় কি আছে? আমরা জানি আমাদের প্রাথমিক শিক্ষা অবৈতনিক ও বাধ্যতামূলক। পঁয়ষট্টি হাজার পাঁচশর মতো রয়েছে আমাদের সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, যেখানে পড়াশোনার মান নিয়ে রয়েছে নানা প্রশ্ন, সন্দেহ, আলোচনা, সমালোচনা। আর তাই এগুলোর বিকল্প হিসেবে এবং পাশাপাশি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে নানা ধরনের কিন্ডারগার্টেন বিদ্যালয়। কিন্তু এগুলোও কি পারছে মানসম্মত ও বাস্তব শিক্ষা প্রদান করতে? কথায় আছে ইচ্ছে থাকলে উপায় হয়। সে রকমই একটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের কথা আমরা আজ জানব। গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জ উপজেলার শিবরাম সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। এটি রংপুর থেকে পীরগাছার চৌধুরানী হয়ে কিছুদূর এগোলেই বামনডাঙ্গা রেলওয়ে স্টশন। এর পাঁচ কিলোমিটার পূর্বে গাইবান্ধার বামনডাঙ্গা-সুন্দরগঞ্জ সড়কের ছাইতানতলার ডানদিকে শিবরাম গ্রাম। গত শতাব্দীর গোড়ার দিকে তত্কালীন জমিদার সুনীতিবালা দেবী এখানে একটি প্রাথমিক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন। গ্রামের নামেই এর নাম। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭৩ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান ৩৭ হাজার প্রাথমিক বিদ্যালয়ের জাতীয়করণ করেন, সেই সঙ্গে শিবরাম প্রাথমিক বিদ্যালয়টিও জাতীয়করণ হয়। প্রাথমিক বিদ্যালয়টিই দেশব্যাপী সুনাম কুড়িয়েছে তার অনন্য কিছু বৈশিষ্ট্যের জন্য। নজর কেড়েছে অনেক বিদেশীরও। এটি আমাদের গর্বের বিদ্যালয়। চীন, ফ্রান্স, পাকিস্তান, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন, জাপান, ভারতসহ বিভিন্ন দেশের অসংখ্য প্রতিনিধি বিদ্যালয়টি পরিদর্শন করেছেন। বিশ্বব্যাংকের আবাসিক পরিচালক ফ্রেডরিক টি টেম্পল, ইন্দোনেশিয়ার মজিদ ক্যাবন জাকাতা, জাপানের শিক্ষা বিশেষজ্ঞ তুশিমা বিদ্যালয়টি পরিদর্শন করেন। বিদ্যালয়টি পরিদর্শন করে তিনি লিখেছেন, ‘বাংলাদেশে এমন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান দেখে আমি অভিভূত।’ আমরাও অভিভূত এ কারণে যে আমাদের দেশে একটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় এমন হতে পারে!

কেন তারা এটি পরিদর্শন করেছেন? কী আছে এখানে?

সরকারি উদ্যোগে বিদ্যালয়টিতে তৈরি হয়েছে একটি দোতলা পাকা ভবন। এছাড়া স্থানীয় উদ্যোগে নয়টি আধাপাকা ভবন, একটি ইটের ঘর ও একটি টিনশেড ঘর নির্মাণ করা হয়েছে। প্রধান শিক্ষক, সহকারী শিক্ষক ও অফিস কক্ষ পৃথক। প্রথম থেকে পঞ্চম শ্রেণী পর্যন্ত বিদ্যালয়ের শ্রেণীকক্ষ রয়েছে ২০টি। বিদ্যালয়ে মোট ২৫টি টয়লেট, দুটি স্টোররুম, একটি কাপড় ইস্ত্রি করার রুম, তিনটি পানির পাম্প ও পাঁচটি নলকূপ। বিদ্যুৎ না থাকলে বিদ্যালয়ের নিজস্ব জেনারেটর চলে। এ যেন প্রাইভেট কোনো বিশ্ববিদ্যালয়কেও ছাড়িয়ে গেছে। বিদ্যোৎসাহী ব্যক্তিরা এ বিদ্যালয়ের অবকাঠামো সম্প্রসারণে আর্থিক সহায়তা দিয়েছেন কিন্তু প্রধান শিক্ষককে তাদের কনভিন্স করতে হয়েছে। ছাত্র-শিক্ষকরা বিদ্যালয়কেন্দ্রিক সমবায়ী কার্যক্রমের মাধ্যমে বিদ্যালয়ের জন্য উপার্জন করেন, মনে হয় ইউরোপীয় কোনো বিদ্যালয়! প্রাথমিক বিদ্যালয় হয়েও এর রয়েছে ছাত্রাবাস, যেখানে অন্য জেলার শিক্ষার্থীরা পড়তে আসে। আবাসিক শিক্ষার্থীদের জন্য রয়েছে একটি ডাইনিং রুম। প্রতিটি টেবিলে চারটি করে চেয়ার। পর্যায়ক্রমে দশজন শিক্ষক শিশুদের সঙ্গে ছাত্রাবাসেই থাকেন। তারা খাবারও খান শিশুদের সঙ্গে। এ তো দেখছি ক্যাডেট কলেজ! ক্যাডেট কলেজের শিক্ষকরা পর্যায়ক্রমে ডিউটি অফিসার হিসেবে ক্লাসে শিক্ষাদানের বাইরে শিক্ষার্থীদের সার্বিক দায়িত্বে নিয়োজিত থাকেন এবং তাদের সঙ্গে দৈনিক যে পাঁচবার খাবার দেয়া হয় তিনিও শিক্ষার্থীদের সঙ্গে খাবার গ্রহণ করেন। এখানকার ছাত্রাবাসটির নাম দীপশিখা। আলাদা নামকরণ হয়েছে এর বিভিন্ন কক্ষেরও। প্রতিভা, বিকাশ, পল্লবী, উল্কা, মোহনা, মনোরমা বিভিন্ন কক্ষের নাম এ ধরনের আরো বিচিত্র নাম দিয়ে আকর্ষণীয় করা হয়েছে কক্ষগুলোকে। দূর-দূরান্ত থেকে শিক্ষার্থীরা এখানে পড়তে আসে এবং তাদের মন্তব্য হচ্ছে এখানে থাকতে আমাদের কোনো কষ্ট হয় না। কারণ খেলাধুলা, পড়াশোনা ও আনন্দের মধ্য দিয়ে দিনগুলো কেটে যায়। তাছাড়া আপা ও স্যাররা থাকেন সব সময় তাদের সঙ্গে।

শিশুদের উপযোগী শ্রেণীকক্ষের শিক্ষণীয় ও অর্থবহ নামরকণ বিদ্যালয়টিকে আরো একটি আলাদা বৈশিষ্ট্য দান করেছে। গানে গানে, পাতায় পাতায়, দীপের আলোকে, উর্মিমালা, নয়নের নীড়, মমতার মিলন প্রভৃতি একেকটি শ্রেণীর নামকরণ। একটি ঘরে নদ-নদী, আগ্নেয়গিরি, জলপ্রপাত, বন, মরুভূমি, শহর, বন্দর, গ্রামের প্রতিকৃতি থরে থরে সাজানো। আলোছায়ার ব্যবহারে এগুলোর বাস্তব পরিবেশ ফুটিয়ে তোলা হয়েছে অনেকখানি। বিদ্যালয়ের সব শিক্ষার্থীর প্রিয় এ কক্ষটির নাম ‘ভৌগোলিক’। পাশের উপকরণ কক্ষে আছে বাঘ, ভল্লুক, হরিণ, পাখি, গাড়ি-ঘোড়াসহ বিভিন্ন প্রাণীর মডেল ও নানা ধরনের খেলনা। এ রকম মডেল উপকরণের সংখ্যা এক হাজার। আছে ১০টি গ্লোব ও ৩০টি মানচিত্র। আছে দেশ-বিদেশের বরেণ্য কবি-সাহিত্যিক-বিজ্ঞানী-রাষ্ট্রনেতা প্রমুখের ছবি। রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, শরত্চন্দ্র বা সুকুমার সেনকে শিশুরা চিনে ফেলছে এই ছবি দেখেই। ছবি দেখে শেখা মানে তাদের মনের মন্দিরে গেঁথে থাকা। সভা, ইনডোর খেলা, চিত্রাঙ্কন, সংগীত শিক্ষা, চিকিৎসা ও প্রার্থনা করার জন্যও রয়েছে পৃথক পৃথক ঘর। একঘেয়েমি কাটানোর জন্য প্রতিদিন ক্লাসের ফাঁকে ফাঁকে শিক্ষার্থীদের একবার এসব কক্ষে নিয়ে যাওয়া হয়। ছবি ও মডেল দেখিয়ে গল্প বলে শিশুদের নানা বিষয়ে ধারণা দেয়া হয়। শিশুরা এতে ভীষণ মজা পায়। কক্ষগুলো সব শিক্ষার্থীরই খুব প্রিয়। আমাদের শিশুদের জন্য এ ধরনের শিক্ষালয়ই তো প্রয়োজন কিন্তু অন্যত্র আমরা পারছি না কেন? করছি না কেন?

বিদ্যালয়টির আর একটি অনন্য বৈশিষ্ট্য হচ্ছে মেধাবী, সাধারণ ও দুর্বল তথা সব মানের শিক্ষার্থীরই এখানে ভর্তির সুযোগ রয়েছে। আমরা দেখে থাকি যে আমাদের দেশের তথাকথিত অনেক নামকরা প্রতিষ্ঠান যেগুলোতে ভর্তি পরীক্ষার মাধ্যমে শুধু মেধাবীদের ভর্তি করা হয়, যাতে প্রতিষ্ঠান থেকে তারা ভালো করে প্রতিষ্ঠানের সুনাম অক্ষুণ্ন রাখতে পারে। এসব শিক্ষার্থীর প্রতি প্রতিষ্ঠান কিংবা কর্তৃপক্ষের অবদান কতটুকু? অথচ শিবরাম বিদ্যালয়ে দুর্বল ও সাধারণ শিক্ষার্থীরাও যাতে সমান শিক্ষা লাভ করতে পারে, সেজন্য কয়েকটি শ্রেণীকক্ষ বিশেষভাবে সাজানো হয়েছে। যেমন দুর্বল ছাত্রদের সঙ্গে এক বা দুজন ভালো ছাত্র নিয়ে চারজন ছাত্রের একটি গ্রুপ করা হয়। ভালো ছাত্রটি শিক্ষকের মতোই তার সহপাঠীদের পাঠদান করে। সবলদের সহযোগিতায় দুর্বল শিক্ষার্থীরাও পড়াশোনায় এভাবে এগিয়ে যায়। এ চমত্কার মেন্টরিং কার্যাবলি কি আমাদের খোদ রাজধানীর তথাকথিত নামকরা বিদ্যালয়গুলোয়ও আছে? নেই, এসব প্রতিষ্ঠানে শুধু পাঠ্যবই গেলানো ছাড়া আর কিছু নেই? কিন্তু একটি আদর্শ বিদ্যালয় তো তা হবে না। সেখানে থাকবে সার্বিক শিক্ষার ব্যবস্থা। এখানে দুস্থ ও গরিব শিক্ষার্থীদের কল্যাণে শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের সমন্বয়ে গঠন করা হয়েছে একটি সমবায় সমিতি। সমিতির বর্তমান তহবিলও একটি আশান্বিত পর্যায়ে অবস্থান করছে। এছাড়া রেশম চাষ, সেলাই প্রশিক্ষণ, বৃক্ষরোপণ, হাঁস-মুরগির খামার, গাভী পালন, সমবায় সমিতিসহ বিভিন্ন প্রকল্প গড়ে তোলা হয়েছে। আবাসিক ছাত্ররা নিজেদের সমবায় দোকান থেকে বই-খাতা, কলম-পেনসিল, সাবানসহ প্রয়োজনীয় জিনিস কিনে থাকে।

বিদ্যালয়টির সার্বিক কর্মপরিকল্পনা সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করা ও সাফল্যের ধারাকে আরো এগিয়ে নেয়ার জন্য বিদ্যালয় ব্যবস্থাপনা কমিটির পাশাপাশি শিক্ষক-অভিভাবক সমিতি, উপদেষ্ট পরিষদ, ছাত্রাবাস ব্যবস্থাপনা পরিষদ, নিরীক্ষা পরিষদ, কল্যাণ সমিতি ও সমবায় সমিতি পরিচালনা কমিটি রয়েছে। কমিটিগুলো বিদ্যালয় ব্যবস্থাপনা কমিটির তত্ত্বাবধানে পরিচালিত হয়।

শিক্ষার্থীদের পাঠ্য বিষয়ের বাইরেও পারিবারিক ও সামাজিক নানা বিষয়ে সচেতন করে তোলা হয়। এর মধ্যে আছে পানি বিশুদ্ধকরণ, খাবার স্যালাইন তৈরি, বাড়িতে স্যানিটেশন ব্যবস্থা, পাঁচটি ব্যাধি থেকে রক্ষায় শিশুদের টিকা গ্রহণ, শোভাযাত্রার মাধ্যমে এলাকাবাসীকে উদ্বুদ্ধকরণ প্রভৃতি। ১৫ দিন পরপর শিক্ষার্থীরা শিবরামসহ পার্শ্ববর্তী বৈদ্যনাথ ও ফতেখাঁ গ্রামে শোভাযাত্রা করে নানা বিষয় সচেতন ও উদ্বুদ্ধ করে। তারা গ্রামে গ্রামে স্যানিটেশন ও খাবার স্যালাইনের উপকারিতা নিয়ে নাটকও করে। যে কাজগুলো বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের করার কথা ছিল সেগুলো দেখছি এ অজপাড়াগাঁয়ের এক প্রাথমিক বিদ্যালয় করছে তাদের একজন স্বপ্নের কারিগর প্রধান শিক্ষক থাকার কারণে। 

শিক্ষার্থীদের উন্নয়নে ‘সমন্বয় পদ্ধতি’ বলে এখানে একটি উল্লেখযোগ্য বিষয় চালু রয়েছে। এটি হচ্ছে শিক্ষক ক্লাসে যদি বুঝতে পারেন অনেক শিক্ষার্থী পড়া বুঝতে পারছে না, তাহলে তিনি বিষয়টি ম্যানেজিং কমিটিকে জানান। তারপর শিক্ষক-পরিচালক মিলে একটি সমাধান বের করে সেভাবে শিক্ষার্থীদের পড়ানোর ব্যবস্থা করেন। সপ্তাহে একদিন বসে বৈঠকি আসর। শিশুরা ছোট ছোট দলে ভাগ হয়ে মাঠে মাদুরে বসে, পাঠ্যপুস্তকের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আড্ডার ছলে আলোচনা হয়। কবিতাগুলো গানের সুরে কিংবা অভিনয়ের মাধ্যমে উপস্থাপন করা হয়, যেন কঠিন বিষয়গুলোয়ও তারা আনন্দ পায়। যেসব শিক্ষার্থী অমনোযোগী তাদের জন্য রয়েছে আরেকটি পদ্ধতি। যেমন শিশুটি যা করতে ভালোবাসে তার মাধ্যমেই পাঠ্য বিষয়টিকে আত্মস্থ করানো হয়। এভাবে শিশুটি একসময় স্বাভাবিক পড়ালেখায় অভ্যস্ত হয়ে ওঠে। একে বলা হয় ‘আদর্শ পদ্ধতি’। শিশুদের সুপ্ত প্রতিভার বিকাশ ঘটাতে তিন মাস পরপর দীপশিখা নামের একটি দেয়াল পত্রিকা প্রকাশ করা হয়। এতে শিক্ষার্থীদের লেখা গল্প, কবিতা, কার্টুন, ছবি স্থান পায়। মাঝে মাঝে বিশেষ সংকলনও প্রকাশ করা হয়। বিশিষ্ট লেখকদের গল্প, উপন্যাস, ছড়া, জীবনী, শিক্ষামূলক বই পাঠাগারে পড়ার সুযোগ রয়েছে। কোমলমতি শিশুরা যাতে প্রকৃতির সাহচর্যে বেড়ে উঠতে পারে, সেজন্য ৮০০ ফলদ, কাঠ ও ঔষধি গাছ লাগানো হয়েছে। স্কুলটির প্রশাসনিক ভবনের সামনে রয়েছে একটি ফুলের বাগান। 

বিদ্যালয়টির অবদান

শিবরাম গ্রামের ছয় বছরের উপরে শিশুদের স্কুলে ভর্তির হার শতকরা ৯৯ ভাগ। বেশির ভাগ শিক্ষার্থীই ওই গ্রামের। বাকিরা আশপাশ কয়েকটি গ্রামের। বিভিন্ন জেলা থেকে আসা শিক্ষার্থী প্রায় দুইশর মতো, যারা ছাত্রাবাসে অবস্থান করে। এ বিদ্যালয় থেকে বের হওয়া শিক্ষার্থীরা অনেকেই ক্যাডেট কলেজসহ দেশের বিভিন্ন নামকরা প্রতিষ্ঠানে ভর্তি হওয়ার সুযোগ পায়। বিদ্যালয়টিতে সরকার অনুমোদিত এগারোজন শিক্ষকের সঙ্গে অতিরিক্ত ৫০ জন শিক্ষক-শিক্ষিকা বেসরকারিভাবে কর্মরত আছেন। কর্মচারী ২৩ জন। প্রতি মাসে বাড়তি ব্যয় লক্ষাধিক টাকা। আবাসিক শিক্ষার্থীদেরও মাসিক ফি ১ হাজার ৮০০ টাকা। এ অর্থ এবং বিভিন্ন উপার্জনমুখী প্রকল্পের আয় থেকে বেসরকারিভাবে নিয়োগকৃত শিক্ষক-কর্মচারীদের বেতন-ভাতার ব্যবস্থা হয়ে থাকে।

১৯১৬ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়। সুন্দরগঞ্জ উপজেলায় অবস্থিত এ বিদ্যালয়টি তার বিশেষ বৈশিষ্ট্যের কারণে বাংলাদেশের সর্বশ্রেষ্ঠ প্রাথমিক বিদ্যালয় হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। ১৯৮৫ সালে এ প্রতিষ্ঠানের প্রধান জাতীয় পর্যায়ে শ্রেষ্ঠ প্রধান শিক্ষক নির্বাচিত হন। ২০০২ সালে বিদ্যালয়টি জাতীয় পর্যায়ে শ্রেষ্ঠ প্রাথমিক বিদ্যালয় নির্বাচিত হয়। আবাসিক-অনাবাসিক মিলিয়ে মোট ১২৩২ জন ছাত্রছাত্রী পড়াশোনা করছে এ বিদ্যালয়ে। বিদ্যালয়টির পরিপাটি পরিবেশ, সুশৃঙ্খল পরিচালন, শিশুদের জন্য আকর্ষণীয় শিখনপদ্ধতি ও শিক্ষা উপকরণের সমাবেশ, শিক্ষার মান, পাঠক্রমের অতিরিক্ত প্রতিভা বিকাশের অনুকূল সাংস্কৃতিক-সামাজিক কার্যক্রম ইত্যাদির জন্য শুধু জাতীয় পুরস্কারই পায়নি, বিদ্যালয়টি আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থারও নজর কেড়েছে। ১৯৯০ সালে এ বিদ্যালয়টি নিয়ে ইউনিসেফ ‘আওয়ার স্কুল’ নামে এর পরিচিতি ছাপিয়ে প্রকাশ করে। এটি দেশের বিভিন্ন স্কুলে পাঠানোর পর বিভিন্ন এলাকা থেকে অভিভাবকরা এ বিদ্যালয়ে যোগাযোগ করতে থাকেন। বিদ্যালয়টির সাফল্যগাধা এখন বহির্বিশ্বেও পরিচিত। এমন এক স্বপ্ন বাস্তবায়নকারীকে জাতি হিসেবে কতটা মূল্যায়ন করেছি, সেটি আমাদের ভেবে দেখতে হবে।

প্রাথমিক শিক্ষায় অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপনকারী এ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক নুরুল আলম। ১৯৮৪ সালে এ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক হিসেবে তিনি যোগদান করেন। তার মনের মধ্যে ঘুমিয়ে থাকা স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দেয়ার কাজে লেগে পড়েন। তাঁর মেধা ও শ্রম এবং সৃষ্টিশীলতা, বিভিন্ন আধুনিক ও বিজ্ঞানসম্মত শিক্ষণ পদ্ধতির প্রয়োগে একটি অজপাড়াগাঁয়ের একেবারে সাধারণ মানের প্রাথমিক বিদ্যালয় রূপান্তরিত হয়ে সাফল্যের উচ্চ শিখরে আরোহণ করেছে। ১৯৯১ সালে ইউনিসেফ বিদ্যালয়টিকে শ্রেষ্ঠ বিদ্যালয় হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। ১৯৯৬ সালে বিদ্যালয়টি জাতীয় পর্যায়ে শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করেছে। ২০০০ সালে জাতীয় পদক লাভ করে বিদ্যালয়টির ম্যানেজিং কমিটি। বিদ্যালয়টির শিক্ষার্থীদের সমবায় সমিতিও বিভাগীয় পর্যায়ে শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করেছে। আমার একেক সময় মনে হয়, মাধ্যমিক বিদ্যালয় ও কলেজ দূরে থাক আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো কী করছে? বিশেষ করে রাষ্ট্রীয় অর্থে যেসব বিশ্ববিদ্যালয় চলে সেগুলোতেও আমরা এ ধরনের সৃষ্টিশীল কার্যাবলি খুব কমই দেখতে পাই। আমরা আরো দেখি শিক্ষা বিভাগের কত শত কর্মকর্তা বিদেশে যান বিভিন্ন নামে, বিভিন্নভাবে। কী তারা শিখে আসেন? কী করেছেন দেশের অবহেলিত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য? কত বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজের শিক্ষকরা উচ্চশিক্ষার জন্য বিদেশে যান, জানি না তারা কে কতটা অবদান রাখতে পারছেন আমাদের শিক্ষার প্রকৃত উন্নয়নে। আর এ নুরুল আলম তিনি তো বাইরের কোনো দেশ থেকে এসব দেখে এসে সেগুলো বাস্তবায়ন করেননি। নিজের মেধা, বুদ্ধি, একাগ্রতা, ঐকান্তিক প্রচেষ্টা, কঠোর পরিশ্রম ও সততার বলে আজকে একটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়কে এ পর্যায়ে নিয়ে এসেছেন। এ উদাহরণ আমরা ক’জন সৃষ্টি করতে পেরেছি?


মাছুম বিল্লাহ: ব্র্যাক শিক্ষা কর্মসূচিতে কর্মরত

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন