ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্র: ঝড়-জলোচ্ছ্বাসে উপকূলের সহায়

রাজু নূরুল

২০২০ সালের মে মাসের ২০ তারিখে ভারত ও বাংলাদেশের উপকূলজুড়ে মহাঘূর্ণিঝড় আম্পান আঘাত হানে। তার আগে গোটা উপকূলে ১০ নম্বর মহাবিপদ সংকেত জারি করা হয়। সরকারি ও বেসরকারি সংস্থার প্রতিনিধি এবং ঘূর্ণিঝড় প্রস্তুতি কর্মসূচি (সিপিপি) ও বাংলাদেশ রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটির স্বেচ্ছাসেবকরা আম্পান আঘাত হানার অন্তত দুই দিন আগে থেকেই সতর্ক সংকেত প্রচার শুরু করে। যেহেতু ২০০৭ সালের পর গতির দিক থেকে এটিই সবচেয়ে শক্তিশালী ঘূর্ণিঝড়, ফলে ধারণা করা হচ্ছিল, এ ঝড়ে উপকূলজুড়ে মহাবিপর্যয় নেমে আসবে। প্রাণহানি ও ক্ষতির দিক থেকে এটি সিডরকে ছাড়িয়ে যাওয়ার পূর্বাভাস পাওয়া যাচ্ছিল। কিন্তু ২০ তারিখ সন্ধ্যায় যখন বাংলাদেশের উপকূলজুড়ে ঘূর্ণিঝড় আম্পান আঘাত হানে, ততক্ষণে এটি শক্তি হারিয়ে সাধারণ ঝড়ে পরিণত হয়। ভারতের উড়িষ্যার উপকূলে আঘাত হেনে কলকাতা, উত্তর ও দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা হয়ে সুন্দরবন ভেদ করে বাংলাদেশে প্রবেশের আগেই আম্পানের শক্তি ক্ষয় হয়। সুন্দরবন তার বুক চিতিয়ে আরো একবার বাংলাদেশের মানুষের জীবন ও সম্পদ রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে এগিয়ে আসে।

পূর্বাভাস অনুযায়ী, ঘূর্ণিঝড় আম্পান বাংলাদেশের সাতক্ষীরা অঞ্চলে আঘাত হানার কথা। ফলে এ অঞ্চলের ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্রগুলোতে প্রস্তুতি জোরদার করা হয়। আমাদের স্বেচ্ছাসেবকদের বড় একটি দল সাতক্ষীরার শ্যামনগরে কাজ করছিল। শ্যামনগরের একটি দ্বীপ ইউনিয়ন গাবুরা। নদীর এপারে মুন্সীগঞ্জ। ট্রলার বা নৌকায় নদী পার হয়ে ১০ মিনিট হাঁটলেই গাবুরা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। দ্বিতল এ ভবনটিই যে কোনো ঝড়-জলোচ্ছ্বাসে গাবুরা ইউনিয়নের মানুষের জন্য ত্রাতার ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়। আম্পান আঘাত হানার দিন দুপুর থেকেই দলে দলে মানুষ এসে সেই ভবনে আশ্রয় নিচ্ছিল। স্বেচ্ছাসেবকরা নারী, শিশু, বৃদ্ধদের আশ্রয়কেন্দ্রে আসতে সহযোগিতা করছে। বিকাল হওয়ার আগেই আশ্রয়কেন্দ্রটি কানায় কানায় পূর্ণ হয়ে যায়। ৩০০ মানুষের আশ্রয়ের ব্যবস্থা থাকলেও প্রায় ২০০০ মানুষ এসে জড়ো হয়। ভবনের নিচের খোলা জায়গায় রাখা হয়েছে গবাদিপশু। মানুষ বাড়ি থেকে আসার সময় তাদের গরু, ছাগল, হাঁস-মুরগি নিয়ে এসেছে। করোনার ভীতিতে সামাজিক দূরত্ব তখন নিতান্তই ভ্রান্তি মনে হতে পারে। এছাড়া আর উপায়ও নেই। কারণ গাবুরা ইউনিয়নের মানুষের আশ্রয় নেয়ার আর তেমন কোনো নিরাপদ স্থান নেই। অধিকাংশ মানুষই দরিদ্র ও হতদরিদ্র। গোটা ইউনিয়নে পাকা ভবন নেই বললেই চলে। আর এভাবেই গত পাঁচ দশক ধরে ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্র উপকূলীয় মানুষের জীবন ও সম্পদ রক্ষায় কবচের ভূমিকা পালন করে চলেছে। 

দুর্যোগ ও বাংলাদেশ

ভৌগোলিক অবস্থান ও ভূ-প্রাকৃতিক কারণে বাংলাদেশ পৃথিবীর অন্যতম দুর্যোগপ্রবণ দেশ। উপকূলীয় দ্বীপগুলোর অবস্থান এবং বঙ্গোপসাগরের ত্রিভুজাকৃতি ফানেল উপকূলীয় অঞ্চলকে ঘূর্ণিঝড় এবং সামুদ্রিক জলোচ্ছ্বাসপ্রবণ এলাকায় পরিণত করেছে। ১৯৭০ ও ১৯৯১ সালের প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড়ে বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলে সম্পদের প্রচুর ক্ষতিসহ যথাক্রমে ৩ লাখ ও ১ লাখ ৩৮ হাজার মানুষ মারা যায়। ২০০৭ সালের ঘূর্ণিঝড় সিডর ও ২০০৯ সালের ঘূর্ণিঝড় আইলায় সম্পদের ব্যাপক ক্ষতি হলেও প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি থাকায় জীবনহানির সংখ্যা ছিল ৩ হাজার ৪০৬ ও ১৯০ জন। ৭০০ কিলোমিটার বিস্তৃত বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলের সাড়ে তিন কোটি মানুষের প্রায় ৭০ লাখ মানুষ চরম ঝুঁকির মধ্যে বসবাস করে। ফলে সিডর-আইলার মতো প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড় থেকে উপকূলের মানুষের জীবন ও সম্পদ রক্ষার জন্য সরকারি, বেসরকারিভাবে, বিভিন্ন উন্নয়ন সহযোগী দেশ ও সংস্থা বিভিন্ন সময় ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্র নির্মাণে এগিয়ে এসেছে।

১৯৭০ সালের ঘূর্ণিঝড়ে উপকূলজুড়ে প্রায় তিন লাখ মানুষ প্রাণ হারায়। এটি ২০ শতকে সারা পৃথিবীর ভয়াবহতম দুর্যোগগুলোর একটি। এরপর প্রায় প্রতি বছর বাংলাদেশে গড়ে একটি করে দুর্যোগ আঘাত হানে। এ লেখার মূল বিষয়বস্তুকে উপকূলীয় অঞ্চলে ঘূর্ণিঝড় ও তা মোকাবেলায় আশ্রয়কেন্দ্রের ভূমিকায় কেন্দ্রীভূত রাখার সুবিধার্থে বাংলাদেশে সংঘটিত হওয়া প্রধান প্রধান ঘূর্ণিঝড়ের দিকে মনোনিবেশ করা হয়েছে। নগরকেন্দ্রিক বিভিন্ন দুর্যোগ ও বন্যা, নদীভাঙন কিংবা পাহাড় ধসের মতো দুর্যোগের ঝুঁকিকে এ আলোচনা থেকে সরিয়ে রাখা হয়েছে। নিচের টেবিলে বাংলাদেশে আঘাত হানা প্রধান ঘূর্ণিঝড়গুলোর সময়, প্রাণহানির সংখ্যা ও ঘূর্ণিঝড়ে আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা উল্লেখ করা হলো। তবে জনজীবনের ক্ষতিসাধন ছাড়াও এসব ঘূর্ণিঝড়ে বাড়িঘর, সম্পদ, মত্স্য সম্পদ, ক্ষেতের ফসল ও গবাদিপশুর ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। প্রায় প্রতিটি ঘূর্ণিঝড়েই এসব ক্ষতির পরিমাণ কয়েক বিলিয়ন ডলার। 

উল্লেখিত তথ্য থেকে দেখা যায়, ঘূর্ণিঝড়ে প্রাণহানির সংখ্যা গত কয়েক দশকে উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে। গত পাঁচ দশকে বাংলাদেশের জনসংখ্যা প্রায় তিন গুণ বেড়েছে, কিন্তু ঘূর্ণিঝড়ে প্রাণহানির সংখ্যা কমেছে কয়েকশ গুণ। ১৯৯১ ও ২০০৭ সালে প্রায় একই মাত্রার ঘূর্ণিঝড় উপকূলজুড়ে আঘাত হানলেও ২০০৭ সালের সিডরে প্রাণহানির সংখ্যা কম। এর পেছনে মানুষের সচেতনতা বৃদ্ধিসহ নানা কারণ থাকলেও উপকূলজুড়ে আশ্রয়কেন্দ্র নির্মাণ কর্মসূচি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। গত পাঁচ দশকে আশ্রয়কেন্দ্রসহ টেকসই অবকাঠামো যত বেড়েছে, ঘূর্ণিঝড়ে প্রাণহানির সংখ্যাও কমে এসেছে। 

উপকূলজুড়ে আশ্রয়কেন্দ্র

পাকিস্তান আমলের শেষের দিকে উপকূলজুড়ে ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্র নির্মাণের পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়। যার ফল পাওয়া যায় ১৯৭০ ও ১৯৯১ সালের প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড়ে। বিশেষ করে ১৯৯১ সালের ঘূর্ণিঝড়ে আশ্রয়কেন্দ্র বিপুলসংখ্যক মানুষের জীবন বাঁচাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখার কারণে ঘূর্ণিঝড় মোকাবেলার প্রধান স্তম্ভ হিসেবে আশ্রয়কেন্দ্র নির্মাণ বিশেষভাবে বিবেচিত হতে থাকে। উপকূলজুড়ে মোট কতগুলো ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্র আছে, তার সঠিক হিসাব পাওয়া না গেলেও ধারণা করা হয় এ সংখ্যা প্রায় ৪ হাজার ৩০০। ২০০৭ সাল পর্যন্ত মোট ৩ হাজার ৯৭৬টি আশ্রয়কেন্দ্র নির্মাণ করা হয়। ১৯৯১ সালের মাস্টার প্ল্যান অনুয়ায়ী প্রতিটি আশ্রয়কেন্দ্র স্বাভাবিক সময়ে পাঠদান কেন্দ্র (স্কুল কাম সাইক্লোন শেল্টার) হিসেবে ব্যবহার করার সিদ্ধান্ত হয়, যার মূল উদ্দেশ্য ছিল বছরের স্বাভাবিক সময়ে ভবনের রক্ষণাবেক্ষণ নিশ্চিত করা। পরবর্তী সময়ে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় আরো ২০০০ আশ্রয়কেন্দ্র নির্মাণের ঘোষণা দেয়; এর মধ্যে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়, স্থানীয় সরকার বিভাগ ও বিভিন্ন বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ৮০৭টি আশ্রয়কেন্দ্র বাানানোর দায়িত্ব নেয়। কিন্তু উপকূলের তিন কোটি মানুষের জন্য এ সংখ্যা পর্যাপ্ত নয়।

২০০৭ সালের পর আশ্রয়কেন্দ্রের নকশায়ও কিছু পরিবর্তন আনা হয়। দ্বিতল ভবনের পরিবর্তে জলোচ্ছ্বাসের কথা বিবেচনায় বহুতল ভবন নির্মাণের প্রস্তাব আনা হয়, যার নিচতলার পুরোটা খোলা থাকবে, প্রতিটি ভবনে ৫০০ থেকে ২৫০০ মানুষের ধারণ ক্ষমতা থাকবে। ২০১১ সালে প্রণীত ‘ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্র নির্মাণ, রক্ষণাবেক্ষণ ও ব্যবস্থাপনা নীতিমালা’ অনুযায়ী তিন ধরনের ভবনকে দুর্যোগকালীন আশ্রয়কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহারের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। এর মধ্যে রয়েছে প্রাথমিক বিদ্যালয় কাম আশ্রয়কেন্দ্র, মাধ্যমিক, উচ্চমাধ্যমিক ও মাদ্রাসা কাম আশ্রয়কেন্দ্র এবং সমগ্র উপজেলায় অবস্থিত বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি পাকা ভবন। জেলা প্রশাসনকে ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্রের প্রধান সমন্বয়কারী প্রতিষ্ঠান হিসেবে দায়িত্ব দেয়া হয়। এ নীতিমালা অনুসারে, ব্যক্তি মালিকানাধীন বিভিন্ন পাকা দালান, সরকারি-বেসরকারি অফিস, বাণিজ্যিক ভবনও দুর্যোগকালীন আশ্রয়কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহার হওয়ার কথা। 

এতসব নীতিমালা ও উদ্যোগ সত্ত্বেও উপকূলজুড়ে দুর্যোগকালীন মানুষের বিপদাপন্নতা রয়ে গেছে। প্রধান কারণগুলো হলো, জনসংখ্যা বৃদ্ধি সাপেক্ষে আশ্রয়কেন্দ্রের সংখ্যা বাড়েনি, প্রান্তিক জনগোষ্ঠীকে কেন্দ্র করে আশ্রয়কেন্দ্রের অপর্যাপ্ততা, দুর্যোগের সময় জরুরি সাড়াদানকারী সংস্থাগুলোর সক্ষমতা ও তাদের মধ্যে সমন্বয়ের অভাব, সচেতনতা কার্যক্রম পরিচালনার জন্য প্রয়োজনীয় সরঞ্জামের অভাব, স্বেচ্ছাসেবকদের সক্ষমতা বাড়ানোর জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপের অভাব, সতর্ক সংকেত ব্যবস্থায় অসামঞ্জস্যতা ও দুর্যোগকালীন গবাদিপশু রক্ষায় কার্যকর উদ্যোগের অভাব ইত্যাদি। 

গবাদিপশু রক্ষায় মাটির কিল্লা

ষাটের দশকের প্রথমদিকে উপকূলীয় জনপদে দুর্যোগকালীন মানুষের আশ্রয়ের জন্য সাইক্লোন শেল্টার নির্মাণের পাশাপাশি মাটির কিল্লা নির্মাণ করা হয়। স্থানীয়ভাবে এগুলোকে টিলাও বলা হয়ে থাকে। উপকূলজুড়ে প্রায় ৫০০ মাটির কিল্লা রয়েছে। দুর্যোগের সতর্ক সংকেত প্রচারের পর জনসাধারণকে আশ্রয়কেন্দ্রে যাওয়ার জন্য উদ্বুদ্ধ করা হয়। কিন্তু অধিকাংশ পরিবার গবাদিপশু রেখে আশ্রয়কেন্দ্রে যেতে চায় না। ফলে যেসব এলাকায় মাটির কিল্লা রয়েছে, সেখানে লোকজনের আশ্রয়কেন্দ্রে যাওয়ার প্রবণতাও বেশি। যেখানে কিল্লা নেই, দুর্যোগকালীন চোর-ডাকাতের হাত থেকে গবাদিপশু রক্ষা করার উদ্দেশ্য পরিবারের অন্তত একজন সদস্য বাড়িতে থেকে যান। ফলে মানুষের প্রাণহানির সংখ্যাও বৃদ্ধি পায়। প্রায় ৩০ ফুট উঁচু একেকটি কিল্লার ওপর দুর্যোগকালে ৬০০-এর বেশি গবাদিপশু আশ্রয় নিতে পারে। জলোচ্ছ্বাসের সময় গবাদিপশুর পাশাপাশি মানুষও এসব কিল্লায় আশ্রয় নিয়ে থাকে। কিন্তু নির্মাণের পর যথাযথ রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে এসব কিল্লার চারিদিকে মাটি কেটে নেয়া শুরু করে স্থানীয় প্রভাবশালীরা। ফলে কিল্লা ঘিরে পুকুরের মতো সৃষ্টি হয়। সেসব পুকুরে কেউ কেউ মাছ চাষ করা শুরু করে, কেউবা কিল্লার উপরের মাটিতে সবজি চাষ শুরু করে। ফলে কিল্লার উচ্চতা কমে গেছে। কোথাও কোথাও উচ্চতা কমে ১০ ফুটের নিচে নেমে এসেছে। অধিকাংশ স্থানে এসব কিল্লা মাটির সঙ্গে মিশে গেছে। কিল্লা না থাকার কারণে সিডর বা আইলার মতো দুর্যোগে গবাদিপশুর ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির আশঙ্কা রয়েছে। যদিও মাটির কিল্লাকে আধুনিক রূপ দিয়ে উপকূলীয় অঞ্চলে ৫৫০টি আধুনিক কিল্লা নির্মাণ চলমান রয়েছে বলে জানিয়েছেন দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী ডা. মো. এনামুর রহমান। এছাড়া আরো এক হাজার কিল্লা নির্মাণের পরিকল্পনা রয়েছেও বলেও মন্ত্রী সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে জানিয়েছেন।

আশ্রয়কেন্দ্রের বহুমুখী ব্যবহার

মে মাসের ২০ তারিখে আঘাত হানা ঘূর্ণিঝড় আম্পানের পর বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থা ক্ষতিগ্রস্তদের মাঝে ত্রাণ ও নগদ অর্থ বিতরণ করেছে। এমন একটি সংগঠনের কাজ দেখতে দাকোপের পানখালি ইউনিয়নের পানখালি উচ্চ বিদ্যালয়ে গিয়েছিলাম। সঙ্গে ছিলেন দাকোপের উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা। এ বিদ্যালয়ের ভবনটি বহুমুখী আশ্রয়কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহূত হয়ে আসছে। ত্রাণ সংগ্রহ করতে প্রায় ২০০ দরিদ্র মানুষ জড়ো হয়েছে, করোনাকালীন স্বাস্থ্যবিধি মেনে বিপুলসংখ্যক মানুষের মাঝে ত্রাণ বিতরণের জন্য এরচেয়ে ভালো কোনো স্থান গোটা ইউনিয়নে দ্বিতীয়টি নেই। শুধু ঘূর্ণিঝড়ের সময় নিরাপদ আশ্রয় নয়; উপকূলজুড়ে আশ্রয়কেন্দ্রের বহুমুখী ব্যবহার লক্ষ করা যায়। কোথাও কোথাও এসব আশ্রয়কেন্দ্র চরের একমাত্র পাকা ভবন হওয়ায় এসব ভবনকে কেন্দ্র করে নানা ধরনের সামাজিক অনুষ্ঠান আয়োজন করা হয়ে থাকে। যেহেতু অধিকাংশ আশ্রয়কেন্দ্রই বিদ্যালয় কাম শেল্টার হিসেবে ব্যবহূত হচ্ছে, ফলে কেন্দ্রের সামনেই রয়েছে খোলা মাঠ। এসব মাঠে নানা ধরনের খেলাধুলার আয়োজন, ছুটির দিনে বিয়ের অনুষ্ঠান, আশ্রয়কেন্দ্রের নিচতলার খোলা অংশে বিভিন্ন সচেতনতামূলক নাটক, গানের অনুষ্ঠানের আয়োজন হয় নিয়মিত। বিভিন্ন উন্নয়ন সংগঠনগুলোর সচেতনতামূলক সভার মূল স্থান এসব আশ্রয়কেন্দ্র। উপকূলজুড়ে দরিদ্র ও হতদরিদ্র মানুষের সঞ্চয় দলগুলোর প্রধান কেন্দ্রও এসব আশ্রয়কেন্দ্র! 

রক্ষণাবেক্ষণই মূল চ্যালেঞ্জ

ঘূর্ণিঝড় ব্যবস্থাপনা নীতিমালা-২০১৩ অনুসারে প্রতিটি আশ্রয়কেন্দ্র রক্ষণাবেক্ষণের জন্য ৮ থেকে ১০ সদস্যের একটি কমিটি থাকবে। দুর্যোগকলীন আশ্রয়কেন্দ্র খুলে দেয়াসহ বছরের স্বাভাবিক সময়ে এ কমিটি আশ্রয়কেন্দ্রের দেখভাল করার কথা। এছাড়া যেসব আশ্রয়কেন্দ্র বিদ্যালয় হিসেবে ব্যবহূত হয়, সেগুলোর দেখভাল বিদ্যালয়সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের। কিন্তু যেসব আশ্রয়কেন্দ্র বিদ্যালয় হিসেবে ব্যবহার করা হয় না, সেগুলো সারা বছর অব্যবহূত পড়ে থাকে। ফলে রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে নানা ধরনের সমস্যা দেখা দেয়। সেক্ষেত্রে দুর্যোগকালীন এগুলো ব্যবহার প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ে। অনেক সময় আশ্রয়কেন্দ্রের চাবি খুঁজে পাওয়া যায় না। পানির কল, বিদ্যুৎ সংযোগ, পয়োনিষ্কাশন ব্যবস্থা দীর্ঘদিন অব্যবহূত থাকার কারণে অকেজো হয়ে পড়ে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে আশ্রয়কেন্দ্রের সংযোগ রাস্তা ভাঙাচোরা কিংবা অল্প বৃষ্টিতে পানিতে ডুবে থাকে। ফলে দুর্যোগকালীন আশ্রয়কেন্দ্রে পৌঁছানো কষ্টসাধ্য হয়ে পড়ে। যেসব আশ্রয়কেন্দ্র বিদ্যালয় হিসেবে ব্যবহার করা হয়, দুর্যোগের সময় সেসব কেন্দ্র খুলে দেয়ার ক্ষেত্রে গড়িমসি লক্ষ করা যায়। আবার আশ্রয়কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহার শুরু হলে সেসব বিদ্যালয় দীর্ঘদিন পাঠদানে ফিরতে পারে না। যেসব জনগণের বাড়িঘর ক্ষতিগ্রস্ত হয়, তারা সহসা আশ্রয়কেন্দ্র ছেড়ে ফিরতে চান না। ফলে শিক্ষার্থীদের পাঠ কার্যক্রম ব্যাহত হয়। আবার দুর্যোগকালীন অতি ব্যবহারের ফলে পানি ও পয়োনিষ্কাশন ব্যবস্থা ভেঙে পড়ে। যারা দীর্ঘদিন আশ্রয়কেন্দ্রে থাকতে বাধ্য হন, তারা কিছুদিন পর জ্বালানির অভাবে বিদ্যালয়ের টেবিল-চেয়ার ব্যবহার করতে শুরু করেন। সার্বিকভাবে বলা যায়, পর্যাপ্তসংখ্যক আশ্রয়কেন্দ্র নির্মাণ করলেই সমস্যার সমাধান হবে না; বরং সেসব কেন্দ্রের নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণ জরুরি। এর জন্য দরকার আশ্রয়কেন্দ্র ব্যবস্থাপনা কমিটির সক্ষমতা, দায়িত্ব বণ্টন ও সে সম্পর্কে অবহিত করা এবং নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণের জন্য প্রয়োজনীয় বাজেট বরাদ্দ। 

প্রাচীন সতর্ক সংকেত ব্যবস্থা ও পূর্বাভাসে গরমিল

ঘূর্ণিঝড়ের সময় সঠিক পূর্বাভাস ও সে অনুযায়ী পদক্ষেপ গ্রহণ ক্ষয়ক্ষতি কমাতে সহায়তা করে। যদিও বাংলাদেশ সরকার এরই মধ্যে ঘূর্ণিঝড়ের জন্য নতুন সতর্ক সংকেত ব্যবস্থা প্রণয়ন করেছে, কিন্তু প্রস্তুত করার আট বছর পরও তা মাঠ পর্যায়ে প্রয়োগ করা হয়নি। নতুন সতর্ক সংকেত ব্যবস্থা অনুযায়ী মোট আটটি সতর্ক সংকেত থাকার কথা। কিন্তু পুরনো যে পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়, সেটি সাধারণ মানুষের কাছে দুর্বোধ্য। ব্রিটিশ আমলে প্রণয়ন করা এ সংকেত ব্যবস্থায় মোট ১০টি সতর্ক সংকেত রয়েছে, যেখানে ৬ নম্বর সংকেতের পর ৮ নম্বর সংকেতে চলে যাওয়া হয়। আবার ৮ নং সংকেতের পর ১০ নম্বর মহাবিপদ সংকেত দেখানো হয়; কেননা ৯ ও ১০ নম্বরের অর্থ এক। আবার ৭ ও ৮ নম্বরের অর্থও এক। তাহলে মাঝখানে এ নম্বরগুলো থাকার প্রয়োজন কী? আবার পূর্বাভাস অনুযায়ী সঠিক সতর্ক সংকেত দেখানোও গুরুত্বপূর্ণ। ঘূর্ণিঝড় নার্গিসের সময় বাংলাদেশের উপকূলকে ১০ নম্বর মহাবিপদ সংকেত দেখানো হয়েছিল, অথচ এ ঝড়টি পূর্বাভাস অনুযায়ী মিয়ানমারের ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়ার কথা ও শেষমেশ তা-ই হয়েছে। সাম্প্রতিককালে ঘূর্ণিঝড় আম্পানের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। পূর্বাভাস অনুযায়ী এ ঝড়টি ভারতের পশ্চিমবঙ্গের উড়িষ্যায় আঘাত হেনে কলকাতা ও তার আশপাশের ওপর দিয়ে বাংলাদেশ সীমান্তে প্রবেশ করার কথা। প্রকৃতপক্ষে তা-ই হয়েছে। যে ঝড় উড়িষ্যায় আঘাত হানবে সেই ঝড় কখনই কক্সবাজার বা চট্টগ্রামকে মারাত্মক প্রভাবিত করবে না। সামান্য বৃষ্টি বা আকাশ মেঘলা হয়ে থাকার কথা। অথচ আম্পান আঘাত হানার আগমুহূর্ত পর্যন্ত কক্সবাজার ও চট্টগ্রামকে ৮ নম্বর সংকেত দেখানো হয়েছে এবং মোংলা ও পায়রা সমুদ্রবন্দরকে ১০ নম্বর মহাবিপদ সংকেত দেখানো হয়েছে। এর অর্থ হলো, সব যোগাযোগ ব্যবস্থা বন্ধ থাকবে, সাধারণ মানুষ আশ্রয়কেন্দ্রে যেতে বাধ্য থাকবে। নিজেদের সহায়-সম্বল, গবাদিপশু, বাড়ি-ঘর ফেলে আশ্রয়কেন্দ্রে যাওয়ার পর যদি ঝড় আঘাত না হানে; তবে সাধারণ মানুষের মধ্যে সতর্ক সংকেত এবং পূর্বাভাস সম্পর্কে নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। তারা পরের ঝড়ের সময় আশ্রয়কেন্দ্রে যেতে চায় না। তারা ভেবে নেয় যে, আগের ঝড়ের মতো এবারো তেমন কিছু হবে না। এতে ক্ষয়ক্ষতি বাড়ার আশঙ্কা থাকে। তাই ঘূর্ণিঝড় পূর্বাভাস ও সতর্ক সংকেত ব্যবস্থার আধুনিকায়ন ও তা বাস্তবায়নে মাঠ পর্যায়ে পদক্ষেপ নেয়া জরুরি। 

আরো যেসব বিষয়ে মনোযোগ দেয়া দরকার 

দুর্যোগকালীন জনগণকে আশ্রয়কেন্দ্রে নিয়ে আসার ক্ষেত্রে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হলো আশ্রয়কেন্দ্রে আশ্রয় নেয়া মানুষদের জন্য প্রয়োজনীয় খাবার সরবরাহ। সরেজমিনে দেখা গেছে, খাবারের অভাবে বহু মানুষ আশ্রয়কেন্দ্রে যেতে নিরুৎসাহিত হয়। নারী ও পুরুষদের জন্য আলাদা থাকার ব্যবস্থা থাকলে সর্বস্তরের মানুষ আশ্রয়কেন্দ্রে যেতে আগ্রহী হবে। কিশোরীদের নিরাপত্তার দিকে জোর দিতে হবে। দুর্যোগকালীন কিশোর-কিশোরীরা যেসব স্থানে নানা ধরনের যৌন সহিংসতার শিকার হয়, ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্র তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য। শুধু দুর্যোগের সময় নয়, ঘূর্ণিঝড় প্রস্তুতি কমিটিসহ অন্য স্বেচ্ছাসেবকদের সারা বছর ধরে সক্ষমতা বৃদ্ধিমূলক কার্যক্রম চালিয়ে যেতে হবে। সাড়াদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য প্রয়োজনীয় উদ্ধার সরঞ্জাম নিশ্চিত করতে হবে। ঘূর্ণিঝড় থেকে বাংলাদেশকে রক্ষায় সুন্দরবন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। ফলে সুন্দরবন রক্ষায় সরকারকে এগিয়ে আসতে হেবে। যেসব আশ্রয়কেন্দ্র ও মাটির কিল্লা ব্যবহার অনুপযোগী হয়ে পড়ছে, সেগুলোর রক্ষণাবেক্ষণের জন্য দ্রুত পদক্ষেপ নিতে হবে। 

শেষ কথা

সর্বোপরি গত কয়েক দশকে বাংলাদেশ ঘূর্ণিঝড়ের মতো দুর্যোগ মোকাবেলায় সক্ষমতার পরিচয় দিয়েছে। বাংলাদেশের এসব উদ্যোগ আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত হয়েছে; যেখানে সবচেয়ে বড় অবদান রেখেছে স্থানীয় জনগোষ্ঠী। অবকাঠামো উন্নয়নের পাশাপাশি জনগণের সচেতনতা বেড়েছে; ফলে দুর্যোগে ক্ষয়ক্ষতি উল্লেখযোগ্য হারে কমে এসেছে। সরকার ও বেসরকারি সংগঠন এবং জনগণের যৌথ উদ্যোগের ফলেই তা সম্ভব হয়েছে। এ ধারা অব্যাহত রাখতে হলে অবকাঠামো ও সচেতনতা বৃদ্ধি এ দুই ক্ষেত্রে সক্ষমতা আরো বাড়াতে হবে; কেননা গবেষণা বলছে, দুর্যোগ ঝুঁকি হ্রাসে ১ ডলার বিনিয়োগ করলে দুর্যোগকালীন তা ৮ ডলার সমপরিমাণ সম্পদ রক্ষায় অবদান রাখে।


রাজু নূরুল: পরিচালক, ওয়ার্ল্ড ভিশন বাংলাদেশ

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন