সরকারি অর্থায়নের কাজে স্থানীয় দরিদ্র মানুষের অংশগ্রহণ

শরমিন্দ নীলোর্মি

বাংলাদেশের স্বাধীনতার সাথে সাথে উন্নয়ন প্রক্রিয়ার মূল চ্যালেঞ্জটি দাঁড়িয়ে গেল দেশটির সর্বব্যাপী দারিদ্র্য ও দরিদ্র-কর্মহীন মানুষের জন্য কর্মসৃজন। ১৯৭৩-৭৮ সময়ে বাংলাদেশের জনসংখ্যার ৯২ শতাংশই ছিল দারিদ্র্যসীমার নিচে (প্রথম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা, ১৯৭৩-৭৮, বাংলাদেশ পরিকল্পনা কমিশন)। সে কারণেই পুরো ৭০-৮০-এর দশকজুড়ে দরিদ্র মানুষের কর্মসৃজন কৌশল আমাদের উন্নয়ন পরিকল্পনার অন্যতম মনোযোগের বিষয় ছিল। স্বাধীনতার অব্যবহিত পরই মুক্তিযুদ্ধে ধ্বংস হয়ে যাওয়া স্থাপনাগুলোর পুনর্নির্মাণসহ বন্যা নিয়ন্ত্রণ, সেচ প্রকল্প, রাস্তাঘাট, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও অন্যান্য স্থাপনা নির্মাণ এবং সেবা খাতের সম্প্রসারণ এ কাজগুলোর মাধ্যমে দরিদ্র মানুষের কাজের সুযোগ করে দেয়ার পরিকল্পনা এবং তার বাস্তবায়ন শুরু হয়। সাধারণ মানুষের অংশগ্রহণ সরকারি বহুমুখী কাজের আওতায় ‘কাজের বিনিময়ে খাদ্য’ আর ‘কাজের বিনিময়ে টাকা’ কর্মসূচি তখনকার বাস্তবতায় দারিদ্র্য মোকাবেলায় কার্যকর প্রক্রিয়া হিসেবে বিবেচিত হতে থাকে।

গত পাঁচ দশকে অর্থনৈতিক ও সামাজিক সূচকে বিভিন্ন ধনাত্মক পরিবর্তন হয়েছে। বাংলাদেশ ‘মধ্যম আয়ের দেশ’ হিসেবে উত্তরণের প্রায় সব প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছে, ২০৩০-এর টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্যমাত্রায় পৌঁছার জন্যও চেষ্টা করছে। কিন্তু এখনো এ দেশেই টেকসই উন্নয়নের জন্য সবচেয়ে বড় বাধা হিসেবে বিবেচিত হয় ‘কর্মসংস্থানের অপ্রতুলতা’, উন্নয়নের ধারাক্রমে ‘কর্মসংস্থানের যথেষ্ট সুযোগ তৈরি করতে না পারা’, ‘ডিসেন্ট কাজের সুযোগ যথেষ্ট তৈরি না হওয়া’, ‘অনানুষ্ঠানিক শ্রমের উচ্চহার’, ‘যথেষ্ট দক্ষ শ্রমিক তৈরি না হওয়া’, ‘বিদেশে দক্ষ জনশক্তি রফতানির প্রতিবন্ধকতা’ সবকিছুই। তাই আজও গ্রামীণ দারিদ্র্য এবং তাদের শ্রমবাজারে অংশগ্রহণ আমাদের উন্নয়ন আলোচানায় খুবই গুরুত্বের সাথে বিবেচিত হতে হবে।

গ্রামীণ অর্থনীতিতে কৃষি ও কৃষক সবচেয়ে উচ্চারিত বিষয়। একসময় যিনি বা যে পরিবার শুধু ‘কৃষক’ বা কৃষি পরিবার হিসেবে বেঁচে থাকতে পারতেন, আজকে সেই পরিচয় এককভাবে রাখা সম্ভব হচ্ছে না। এখন যিনি ‘কৃষক’ তিনিই বছর কখনো কখনো কৃষি শ্রমিক, ‘অভিবাসী শ্রমিক’ দোকানদার-রিকশাচালক একই পরিবারে ভিন্ন ভিন্ন পেশার মানুষের সম্মিলন ঘটেছে।

এখন পর্যন্ত গবেষণালব্ধ তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশের দারিদ্র্য নিরসনের ক্ষেত্রে কৃষি খাতে শ্রমিকপ্রতি জিডিপির প্রবৃদ্ধি অকৃষি খাতে শ্রমিকপ্রতি জিডিপির প্রবৃদ্ধির তুলনায় প্রায় তিন গুণ বেশি কার্যকর (মাহবুব হোসেন, আব্দুল বায়েস ও এসএম ফখরুল ইসালাম, ব্র্যাক ওয়ার্কিং পেপার, ২০১৩)। যদিও বর্তমানে জিডিপিতে কৃষি খাতের অবদান মাত্রই ১৪ শতাংশ (উন্নয়নশীল দেশগুলোর উন্নয়ন পরিক্রমায় কৃষির অবদান কমতে থাকে, এটিই অভিজ্ঞতালব্ধ দেশের জ্ঞান), মনে রাখতে হবে যে আমাদের মোট কর্মসংস্থানের প্রায় ৪৪ শতাংশই কৃষি থেকে আসে। নারীর কর্মসংস্থান ধরলে এ দেশে এখনো ৭০ শতাংশের উপরে নারীর কর্মসংস্থান আসে কৃষি ও গ্রামীণ অর্থনৈতিক খাত থেকে। শ্রম বা ধার হলেও বিভিন্নমুখী সেবা খাতের প্রবেশগম্যতার বিবেচনায় গ্রামীণ দারিদ্র্য বাংলাদেশের টেকসই উন্নয়নের ক্ষেত্রে বড় ধরনের চ্যালেঞ্জ। এ চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় গ্রামীণ অর্থনৈতিক খাতে নারী-পুরুষের কর্মসংস্থানের সুযোগ বৃদ্ধির অন্য কোনো বিকল্প নেই।

‘পাবলিক প্রকিউরমেন্ট বিধিমালা, ২০০৮’ (পাবলিক প্রকিউরমেন্ট অর্থ সরকারি তহবিল দ্বারা ক্রয়) অনুযায়ী ছোট কাজের জন্য (অল্প টাকায় যেসব কাজে অদক্ষ শ্রমিক নিয়োগ করা যায়, বিশেষত মাটির কাজ) সরকারি সংস্থা স্থানীয় (যেখানে কাজ হবে) জনগণের সাথে সরাসরি চুক্তি করতে পারে (এক্ষেত্রে উন্মুক্ত দরপত্র দেয়ার দরকার হয় না)। এক্ষেত্রে প্রচলিত নিয়ম হচ্ছে, স্থানীয় দরিদ্র জনগণ মিলিত হয়ে একটি চুক্তিবদ্ধ শ্রমিক দল (Labor contracting socity, LCS) তৈরি করবে এবং তাদের সঙ্গে সরকারি সংস্থাটির (যেটি কাজ করাবে) একটি চুক্তিনামা হবে। এ চুক্তিনামা অনুযায়ী সরকারি সংস্থার দেখভালের আওতায় সেই চুক্তিবদ্ধ শ্রমিক দলটি নির্দিষ্ট সময়ে কাজটি মানসম্মতভাবে শেষ করবে। এ বিধিমালার উদ্দেশ্যে মূলত দুটি। প্রথমত, স্থানীয় দরিদ্র মানুষের জন্য স্বল্পকালীন কাজ তৈরি করে। তাদের দারিদ্র্য নিরসনে সহায়ক ভূমিকা পালন করা এবং দ্বিতীয়ত, স্থানীয় স্থাপনাটির ওপর (হতে পারে বাঁধ, রাস্তা ইত্যাদি) স্থানীয় মানুষের অধিকারবোধ জন্মানো। পানি ব্যবস্থাপনা নীতিমালায় সাধারণ স্থানীয় মানুষের অংশগ্রহণ। পানিসংক্রান্ত স্থাপনাগুলো রক্ষণাবেক্ষণে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে তুলে ধরা হয়েছে।

পানি উন্নয়ন বোর্ড, স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর (এলজিইডি), দুর্যোগ ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়সহ বিভিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠান চুক্তিবদ্ধ শ্রমিক দল বা এলসিএসএর মাধ্যমে ছোট ছোট নির্মাণ বা পুনর্নির্মাণের কাজ করে। সত্তরের দশকের ‘employment generation scheme’ বা কর্মসংস্থান তৈরির লক্ষ্যে গৃহীত প্রকল্পগুলোর চরিত্র নব্বইয়ের দশকের শেষার্ধে এ দেশের অর্থনৈতিক গতিপ্রকৃতি বদলে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পরিবর্তিত হতে থাকে। ‘কাবিখা’ মূলত সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতায় সীমিত আকারে স্থানীয় সরকারের মাধ্যমে পরিচালিত হতে থাকে। এক্ষেত্রে সরকারি সংস্থাগুলো নিয়োজনের প্রচলন নির্মাণে এলসিএসকে নিয়োজনের প্রচলন পূর্ণ মাত্রায় শুরু করে। এলসিএসের সদস্য নির্বাচনে দরিদ্র স্থানীয় জনগণ, বিশেষত দরিদ্র নারীকে অগ্রাধিকার দেয়া হয় (শারীরিক সক্ষমতাকেও বিবেচনায় রাখা হয়), নানা ধরনের দুর্নীতি সত্ত্বেও মাঠের গবেষণা থেকে জানা যায় যে এ সদস্য নির্বাচন অনেকাংশেই স্থানীয় দরিদ্র মানুষের অংশগ্রহণকে নিশ্চিত করে। এর প্রধান কারণ দুটি। একটি হলো এ কাজের মজুরির হার খুব একটা আকর্ষণীয় নয় (যদিও দরিদ্র মানুষের জন্য সেটি কার্যকর) এবং আরেকটি হলো এর কাজের ধরন। সাধারণত মাটির গ্রামীণ রাস্তা, মাটির বাঁধ নির্মাণ পুনর্নির্মাণ, খাল পুনঃখনন ইত্যাদি শ্রমসাধ্য কাজেই এলসিএসকে নিয়োজিত করা হয়। এ ধরনের কাজগুলো একটু খেয়েপরে বেঁচে থাকার নিশ্চয়তা আছে এমন পরিবারের সদস্যরা করতে চান না।

তিন দশকের প্রাতিষ্ঠানিক চর্চার কারণে এলসিএসের অংশগ্রহণেরও একটি প্রাতিষ্ঠানিক প্রচলিত কাঠামো দাঁড়িয়েছে। তবে সব সংস্থা একইভাবে এ চর্চা করে না, যদিও শ্রমের মজুরি, কাজের ইউনিটপ্রতি সরকার ঘোষিত শিডিউল রেট অনুযায়ীই নির্ধারিত হয়। এক্ষেত্রে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর কর্তৃক প্রচলিত প্রক্রিয়াটি উল্লেখযোগ্য। এলজিইডি কাজ চলাকালীন শ্রমিকদের মজুরির একটি অংশ তাদের সঞ্চয় হিসেবে জমা রাখে এবং কাজ শেষে এ সঞ্চয়ের অর্থটি প্রতিজন সদস্যকে বুঝিয়ে দেয়া হয়। এ হিসাব সংরক্ষণ করেন এলসিএসের সদস্যরা। তবে তাদের হিসাব জ্ঞানকে দক্ষ করে তুলতে এলজিইডি সহায়তা করে। এলসিএসের কাজগুলো মূলত হয় স্বল্পমেয়াদি। দেখা যায়, একটি মাটির রাস্তায় ৩০ জনের এলসিএস দল কাজ করলে একেকজনের হাতে ৩০-৪৫ কর্মদিবসের কাজ এর মধ্যে থাকে। প্রকল্পভেদে যদিওবা মজুরির নির্ধারিত হার সমান থাকে, কিন্তু তার সঞ্চয়ের হারে পার্থক্য থাকে। সঞ্চয়ের হারটিও এলসিএস সদস্যদের সম্মতিক্রমেই নির্ধারিত হয়। মাঠের গবেষণা থেকে দেখা গেছে যে কাজ চলাকালে মজুরির একটা অংশ পাওয়া ছাড়াও কাজ শেষে একজন এলসিএস সদস্য প্রায় ৩ হাজার হাজার টাকা পর্যন্ত সঞ্চয় হিসেবে ফেরত পান, অনেকেই যেটা দিয়ে কর্মসূচির কোনো কাজের চেষ্টা করেন। কেউ ছোট দোকান দেন, কেউ ছাগল, মুরগি কেনেন, কেউবা সেলাই মেশিন কেনেন। এতে তারা দারিদ্র্যসীমার বাইরে বের হতে পেরেছেন কিনা তেমন সামাজিক গবেষণা এখনো তেমন হয়নি। পানি উন্নয়ন বোর্ডের চর্চায় এলসিএসদের মজুরির একটি অংশ সঞ্চয় ও হিসাবে রাখার চর্চা নেই (যেটি এলজিইডি করে)। তবে পানি উন্নয়ন বোর্ডের আওতায় ডাচ সরকারের অর্থায়নে ব্লু গোল্ড প্রকল্পটির একটি মূল্যায়ন কাজে লেখকের নিজের সম্পৃক্তি থেকে এ কথা বলা যায় যে প্রকল্প এলাকায় এলসিএস সদস্যদের আর্থিক পরিস্থিতির ইতিবাচক পরিবর্তন হয়েছে। পরিবর্তনটি অবশ্য শুধু এলসিএস কাজের সাথে জড়িত থাকার সুবাদে নয়, প্রকল্প এলাকায় বন্যা নিয়ন্ত্রণ ও কৃষি সম্প্রসারণের সাফল্য স্থানীয় দরিদ্র মানুষের অর্থনৈতিক উন্নয়নে ভূমিকা রেখেছে।

আগেই বলা হয়েছে, গত তিন দশকে এলসিএস নিয়োজনের প্রক্রিয়াটি প্রাতিষ্ঠানিক চর্চায় বিভিন্নভাবে পরিবর্তিত হয়েছে। সত্তরের দশকে আমরা ‘এক ফসলি’ থেকে সেচ সম্প্রসারণের মাধ্যমে ‘দুই ফসলি’-তে যাওয়ার চেষ্টা ব্যাপকভাবে শুরু করি। বোরো ধানের সম্প্রসারণের সাথে সাথে আমাদের গ্রামীণ শ্রমিকরাও অধিকতর হারে কৃষি খাতে নিয়োজিত হওয়ার সুযোগ পেলেন। কৃষির বহুমুখীকরণের বাস্তবতায় কৃষিজমিতে এখন সারা বছরই কমবেশি কাজের সুযোগ থাকে। অর্থাৎ কৃষি শ্রমের চাহিদা বেড়েছে অনেক গুণ। শ্রমের চাহিদার সঙ্গে সঙ্গে কৃষির ‘পিক’ মৌসুমে শ্রমিকের মজুরিও সাধারণ সময়ের তুলনায় ‘বাড়তি’ থাকে। এ বাস্তবতায় এলসিএসের কাজের সময়ের সাথে যদি ‘ধানের’ কাজের সময় সাংঘর্ষিক হয়, তাহলে স্বাভাবিকভাবেই শ্রমিক কৃষিতেই নিজেদের নিয়োজিত করেন। এলসিএসের নির্ধারিত মজুরি ‘পিক’ কৃষি মৌসুমের এ মজুরির হারের চেয়ে বেশ কম। শুকনো মৌসুমে বিশেষ করে আমন ধান তোলা ও প্রক্রিয়াজাত করা, বোরো ধান লাগানো—এসব কাজের সময়ে এলসিএসের মাটির কাজ করার মতো যথেষ্ট শ্রমিকের অভাব দেখা দেয়। এ বাস্তবতা সরকারি সংস্থাগুলোকে স্থানীয় জনগণকে কর্মী হিসেবে সম্পৃক্ত করে নির্মাণকাজ চালানোর ক্ষেত্রে নিরুৎসাহিত করে। সরকারি সংস্থাগুলোর অভিজ্ঞতা হলো কৃষির ‘পিক’ মৌসুমে শ্রমিক না পাওয়া, গ্রামীণ অর্থনীতিতে ইতিবাচক পরিবর্তন আসায় ‘মাটির কাজের’ মতো কষ্টসাধ্য ও সামাজিকভাবে ‘তেমন সম্মানজনক নয়’ কাজে অংশগ্রহণের জন্য শ্রমিক যথেষ্ট না পাওয়া, স্থানীয় মানুষ ‘কন্ট্রাক্টর’-এর ভাড়া করা শ্রমিকদের মতো দক্ষ ও মনোযোগী না হওয়া।

মাঠ পর্যায়ের গবেষণায় দেখা গেছে, সরকারি সংস্থাগুলো এলসিএসের সঙ্গে চুক্তিপত্র করে কার্যাদেশ দিতে দিতে প্রায়ই মার্চ-এপ্রিল এমনকি মে মাস পর্যন্ত সময় নিয়ে ফেলে। বৃষ্টি তখন সমাগত, মাটির কাজ শুরু করে শেষ করার জন্য ভালো সময় না। কার্যাদেশটি তারা আগস্টের মধ্যে সম্পন্ন করতে পারলে অক্টোবরের শুকনো সময় থেকে টানা ছয়-সাত মাস এলসিএস দিয়ে মাটির কাজ করানো সম্ভব। সময়ের এ বিস্তারে কৃষির ‘পিক’ মৌসুমের সময়টুকুকে অন্তর্ভুক্ত করলেও বাকি সময়ে কাজ শেষ করা যায়। গত তিন দশকে এলজিইডি ও পানি উন্নয়ন বোর্ডের মতো মূলত ‘প্রকৌশলী’নির্ভর সংস্থাগুলো এলসিএস সদস্যদের বিভিন্নমুখী জীবিকাসংক্রান্ত প্রশিক্ষণ, স্বাস্থ্য-পুষ্টি জ্ঞান নিয়ে কাজ করেছে। ফলে সংস্থাগুলোর কাজের ধারায়ও বিভিন্ন সামাজিক সম্পৃক্তির বিষয়টিকে গুরুত্ব দেয়ার প্রবণতা তৈরি হয়েছে। কৌতূহলোদ্দীপক হলো, সাধারণত সরকারি অর্থে পরিচালিত প্রকল্পগুলোতে এলসিএসের অংশগ্রহণ রাখা হয় না। সংস্থাগুলোর ক্ষেত্রে ‘কন্ট্রাক্টর’-দের মাধ্যমে উন্নয়ন সহযোগীদের আগ্রহেই মূলত এখন পর্যন্ত এলসিএসের ব্যবস্থাটি তাদের অর্থায়নকৃত প্রকল্পগুলোতেই দেখা যায়। করোনাকালে বাংলাদেশে কর্মচ্যুতির অভিজ্ঞতা, দারিদ্র্য বেড়ে যাওয়া, ভবিষ্যৎ কর্মনিয়োজনের অনিশ্চয়তার বিষয়গুলো মাথায় রেখে বলা যায়, যদিও এলসিসের কাজগুলো সেই অর্থে ‘ডিসেন্ট কাজ’-এর মধ্যে পড়ে না। তার পরও আগামী কয়েক বছর দরিদ্র স্থানীয় মানুষের স্বল্পকালীন কর্মসংস্থানে ‘সরকারি কাজের’ এ ব্যবস্থা কাজে লাগবে বলেই ধারণা করা যায়।

গ্রামীণ রাস্তাগুলো রক্ষণাবেক্ষণের ক্ষেত্রে এলজিইডি একটি কার্যকর ব্যবস্থাপনা জারি রেখেছে। প্রতি ইউনিয়নে ১০ জন দরিদ্র নারীর সমন্বয়ে এলসিএস গঠন করে তাদের প্রশিক্ষণ দিয়ে এলাকার রাস্তাগুলো রক্ষণাবেক্ষণ ও ছোটখাটো বা তাত্ক্ষণিক (যেমন বৃষ্টির পানিতে গর্ত হলে) মেরামতে তাদের নিয়োজিত করা হয়। এ নিযুক্তি একটি লম্বা সময়ের জন্য, সাধারণত তিন-পাঁচ বছরের জন্য হয়। তাদের বেতন হয় মাসিক ভিত্তিতে। তাদের নিজেদের ব্যাংক হিসাবে বেতন জমা হয়। এখানেও বেতনের প্রায় ২৫-৩০ শতাংশ তাদের ব্যাংক হিসাবেই সঞ্চয় হিসেবে জমা রাখা হয়, যেটি তারা কাজের মেয়াদের শেষে তুলতে পারবেন। একটু লম্বা সময়ের জন্য নিয়োগটি হওয়ায় নারীদের জন্য এটি বেশ ভালো ব্যবস্থাপনা হিসেবে বিবেচিত হয়। বিশেষ করে মেয়াদপূর্তিতে ৩৫-৭০ হাজার টাকা পর্যন্ত তারা সঞ্চয় হিসেবে পেয়ে থাকেন। যা পরে কোনো আয়মুখী কাজে তারা বিনিয়োগ করতে পারেন। ঝড়-জলের এ দেশে গ্রামীণ মাটির রাস্তাগুলো রক্ষণাবেক্ষণেও ব্যবস্থাটি অত্যন্ত কার্যকর।

বাঁধ রক্ষণাবেক্ষণ, বাঁধের পাড়ে ঘাস লাগানো, বিভিন্ন স্থাপনার রক্ষণাবেক্ষণসহ (যেখানে খুব বেশি দক্ষতার প্রয়োজন হয় না) বিভিন্ন ধরনের সরকারি কাজে নিয়মিত ভিত্তিতে স্থানীয় দরিদ্র মানুষের অংশগ্রহণের সুযোগ নিশ্চিত করা সরকারের অগ্রাধিকারের মধ্যেই পড়বে বলে আমরা আশা করি। এক্ষেত্রে পরিকল্পনা কমিশনের পরিবীক্ষণ কার্যকর হবে বলে মনে করি।


শরমিন্দ নীলোর্মি: সহযোগী অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন