হাওড়ের সাবমার্সিবল ও উড়ালসড়ক

আল আমিন

দেশের বৃহত্তম দুই হাওড় হাকালুকি ও টাঙ্গুয়ার হাওড় প্রাকৃতিক সম্পদের ভাণ্ডার হিসেবে পরিচিত। বাংলাদেশের বৃহত্তম মিঠা পানির জলাভূমি হিসেবে পরিচিত সিলেট ও মৌলভীবাজারের পাঁচটি উপজেলা নিয়ে বিস্তৃত হাকালুকি হাওড় প্রায় ২৩৮টি বিল ও ১০টি নদীর সমন্বয়ে গঠিত। হাকালুকি হাওড়ে শীতকালে অতিথি পাখির আগমন ও স্থানীয় প্রায় ১০০ প্রজাতির পাখির কলতান পরিবেশ ভ্রমণপিপাসুদের আহ্বানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। দেশের সিলেট, সুনামগঞ্জ, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ, নেত্রকোনা, কিশোরগঞ্জ ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া এ সাত জেলা নিয়েই মূলত হাওড় অঞ্চল গঠিত। এ সাতটি জেলার প্রায় নয় লাখ হেক্টর জমি নিয়ে হাওড় অঞ্চল গঠিত। যা দেশের মোট আয়তনের প্রায় এক-পঞ্চমাংশ। দেশে ছোট-বড় ৪১৪টি হাওড়, জলাশয় ও জলাভূমি রয়েছে। জলমহাল রয়েছে ২৮ হাজার। বিল রয়েছে ৬ হাজার ৩০০। প্রায় পাঁচ হাজার হাওড়-বাঁওড়, বিল-ঝিল নিয়ে গঠিত হাওড়াঞ্চল বাংলাদেশের অর্থনীতিতে বিরাট ভূমিকা রেখেছে। বাংলাদেশ আর্থসামাজিক ও সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপটে হাওড়ের রয়েছে বিশাল প্রভাব। তবে ইকো ট্যুরিজম ও কৃষিপণ্যের বিশেষ করে ধান ও মাছ চাষ ও গবাদি পশু পালনের অপার সম্ভাবনাময় হিসেবে পরিচিত থাকলেও তার শতভাগ কাজে লাগানো সম্ভব হয়নি। দেশের মোট চালের প্রায় ১৮ ভাগ এবং বোরো চালের প্রায় ২৩ শতাংশ উৎপাদন হয়ে থাকে হাওড় অঞ্চলে। পাশাপাশি দেশের গবাদি পশু ও মাছের বড় একটি অংশ সরবরাহ করা হয় এ সাত জেলায়।

জানা গেছে, হাওড় অঞ্চল হিসেবে পরিচিত জেলাগুলোর প্রায় অর্ধেকই হাওড়। দুর্গম এলাকা হওয়ার কারণে এসব অঞ্চলে রাস্তাঘাট, পর্যাপ্ত স্যানিটেশন ও স্কুল-কলেজের অভাব রয়েছে। অনুন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থার কারণে কৃষক তার উৎপাদিত পণ্যের ন্যায্যমূল্য পান না। প্রকৃতিগত বাধার কারণে উন্নয়নমূলক কাজও বাধাগ্রস্ত হয়। ফলে কয়েক দশক ধরেই জাতীয় দারিদ্র্য হারের চেয়ে এ অঞ্চলে বেশি হারে দরিদ্র লোকের বসবাস। এছাড়া শিক্ষার হার, সামাজিক অন্যান্য সূচকসহ সামগ্রিক অর্থনৈতিক বৈষম্যের মধ্যে রয়েছে এখানকার জনগণ। হাওড়াঞ্চলের সাধারণ মানুষ শতকরা ৮০ জন কৃষিকাজে নিয়োজিত। মাছ শিকারের পাশাপাশি এ এলাকার সাধারণ মানুষ বালি, পাথরে কাজ করে এবং বালি, পাথরের ব্যবসা করে তারা। বিভিন্ন নদী থেকে বালি-পাথর নৌকা করে নিয়ে ব্যবসা করছেন ব্যবসায়ীরা। এছাড়া কিছু কিছু গাড়ি সড়কপথে মালামাল পরিবহন করছে। ভলগেট, ইঞ্জিনচালিত বোর্ড বা নৌকায় ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় কয়লা, বালি, পাথর নেয়া হয়। খরচও বেশি হয়। সড়কপথে মালামাল পরিবহন করলে সরকার বিপুল পরিমাণ রাজস্ব পেত। প্রান্তিক হাওড় অঞ্চলে বিকল্প কর্মসংস্থান না থাকায় হাজার হাজার শ্রমজীবী মানুষ বছরের প্রায় বেশির ভাগ সময় সীমান্তের জাদুকাটা নদীতে বালি-পাথরের কাজে জীবিকা নির্বাহ করে।

হাওড় অঞ্চল হিসেবে দেশের সাতটি জেলায় বোরো আবাদ হয়েছে প্রায় নয় লাখ হেক্টরের বেশি জমি। হাওড় অঞ্চলের মোট জমির মধ্যে হাওড় অধ্যুষিত রয়েছে প্রায় ৪ লাখ ৪৫ হাজার হেক্টর জমি। এ অঞ্চলে আগাম বন্যা কিংবা পাহাড়ি ঢল নামার সম্ভাবনা থাকে কিংবা বাঁধ ভেঙে পানি জমিতে প্রবেশের সম্ভাবনা রয়েছে। তাই এ অঞ্চলের ধানগুলো ২৫ থেকে ৩০ দিনের মধ্যেই কেটে ফেলতে হয়। অঞ্চলের ধান কাটা, মত্স্য ও গবাদি পশু চাষ এবং বিপণন উপযোগী করে তুলতে প্রয়োজন ভালো অবকাঠামো। বিশেষ করে রাস্তাঘাট করতে এতদিন ভালো নজর দেয়া হয়নি। হাওড়ে যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নে বর্তমান সরকার কাজ শুরু করেছে। সুনামগঞ্জ ও নেত্রকোনার মধ্যে সড়ক যোগাযোগ সংযোগ করতে প্রকল্প হাতে নেয়া হচ্ছে। ছাতক থেকে মোহনগঞ্জ পর্যন্ত রেল সংযোগ করতে কাজ শুরু করা হয়েছে।

একসময় হাওড়াঞ্চলের মানুষের কাছে একটি কথা প্রচলিত ছিল ‘বর্ষায় নাউ আর শুকনায় পাও’। মানে বর্ষাকালে মানুষের একমাত্র যোগাযোগের মাধ্যম হলো নৌকা আর শুকনোর সময়ে ছিল এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় হেঁটে যাওয়াই ভরসা। কিন্তু এখন হাওড়াঞ্চলের দিন বদলে গেছে। হচ্ছে নতুন নতুন সাবমার্সিবল রাস্তা। দেশের হাওড়ের জেলার মধ্যে অন্যতম কিশোরগঞ্জ জেলা। এ জেলার নিকলী, মিঠামইন, অষ্টগ্রাম ও ইটনা উপজেলার প্রায় সবটুকুই হাওড়াঞ্চল। এর মধ্যে ইটনা, মিঠামইন ও অষ্টগ্রামের বুক দিয়ে যোগাযোগের জন্য সাবমার্সিবল রাস্তা নির্মিত হলো। মহামান্য রাষ্ট্রপতি আব্দুল হামিদ ২০১৬ সালের ৪ এপ্রিল আনুষ্ঠানিকভাবে ইটনা-মিঠামইন-অষ্টগ্রাম প্রকল্পের নির্মাণকাজের উদ্বোধন করেন। এ প্রকল্পের আওতায় সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তর ৮৭৪ দশমিক ৮ কোটি টাকা ব্যয়ে ২৮ দশমিক ৭৭০ কিলোমিটার হার্ডশোল্ডারসহ ফ্লেক্সিবল পেভমেন্ট নির্মাণ, ৫৯০ দশমিক ৪৭ মিটার দীর্ঘ তিনটি পিসি গার্ডার নির্মাণ, ১৯০ মিটার দীর্ঘ ১১টি আরসিসি গার্ডার ব্রিজ নির্মাণ ও ৭ দশমিক ৬০ মিটার দীর্ঘ ১১টি আরসিসি গার্ডার ব্রিজ নির্মাণ ও ৭ দশমিক ৬০ লাখ বর্গমিটার সিসি ব্লক দ্বারা স্লোপ প্রটেকশন কাজ সম্পন্ন করা হয়। আগে এ রাস্তা দিয়ে মানুষজন যোগাযোগ করত নৌকা দিয়ে। পাঁচ থেকে সাত ঘণ্টা সময় লাগত। 

এখন ওই এলাকার মানুষ দুই থেকে আড়াই ঘণ্টায় তাদের গন্তব্যস্থানে চলে যাচ্ছে। ওই অঞ্চলের মানুষ নৌপথ থেকে এখন সড়কপথে চলাচল করছে বেশি। সড়কপথ হওয়ায় শিক্ষা, স্বাস্থ্য, চিকিৎসারও সুবিধা হয়েছে। পাশাপাশি ওই এলাকায় দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে পণ্যবাহী গাড়িরও সরাসরি যোগাযোগ রয়েছে। এতে ওই যোগাযোগ মাধ্যমের পাশাপাশি এলাকার অর্থনৈতিক অবস্থার উন্নতি হয়েছে। হাওড়বাসীর স্বপ্নের সড়কটি নির্মাণের ফলে শুধু হাওড়বাসীর চলাচলের দুর্ভোগ দূর হয়েছে তা নয়, নতুন কর্মসংস্থানেরও সৃষ্টি হয়েছে। এছাড়া ইটনা-মিঠামইন-অষ্টগ্রাম সড়কটি এখন আকর্ষণীয় পর্যটনকেন্দ্র। এরই মধ্যে হাওড়ের নৈসর্গিক রূপ দেখতে দেশের নানা প্রান্ত থেকে এখানে ছুটে আসছে মানুষ। দেশের টাঙ্গুয়ার হাওড়, হাকালুকির হাওড়, তল্লার হাওড়, হাইল হাওড়সহ বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের হিসাব অনুসারে হাওড়ের সংখ্যা ৪২৩টি। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি হাওড় সুনামগঞ্জেই। ছোট-বড় মিলিয়ে ১৫৪টি হাওড় এ জেলায়। এর মধ্যে কিশোরগঞ্জে দৃষ্টিনন্দন হাওড়ে সড়ক। এক জেলায় দৃষ্টিনন্দন সাবমার্সিবল সড়ক করলে হবে না। সব জেলার হাওড়ের উন্নয়নে দৃষ্টিনন্দন সড়ক করা প্রয়োজন। 

হাওড়কেন্দ্রিক ইকো ট্যুরিজম, মাছ, ধান, রফতানিযোগ্য শামুক, ঝিনুক চাষসহ সমন্বিত উদ্যোগ বদলে দিতে পারে দেশের অর্থনীতির রূপ। এজন্য প্রয়োজন সুষ্ঠু পানিসম্পদ ব্যবস্থাপনা ও হাওড়কেন্দ্রিক ট্যুরিজমবান্ধব পরিকল্পনা নেয়া। সেজন্য প্রয়োজন পরিবেশবান্ধব রাস্তা ও অবকাঠামো। হাওড়ের বাঁধের স্থায়ী সমাধান করতে হবে। প্রতি বছর শত শত কোটি টাকায় বাঁধ নির্মাণ করা হয়। এটা নতুন করে ভাবতে হবে। হাওড়ের বিপুল পরিমাণ সম্পদ কাজে লাগাতে না পারা রাষ্ট্রীয় দুর্বলতা। উন্নয়নের নামে হাওড়ে পানির প্রবাহ বন্ধ করে যত্রতত্র রাস্তা তৈরি না করে একটি উন্নত অবকাঠামো নির্মাণের মাধ্যমে এ অঞ্চলের ইকো সিস্টেমকে রক্ষা করতে হবে। 

সুনামগঞ্জের দিরাই উপজেলার প্রায় ২০টি গ্রাম নিয়ে বরাম হাওড়। এ হাওড়ে প্রতি বছর বোরো ধানের ফলন ভালো হয়। প্রায় তিন হাজার হেক্টর জমি নিয়ে বরাম হাওড়। প্রতি বছর এ হাওড়ে সাত হাজার টন ধান উত্পন্ন হয়। এখানে ১০ থেকে ১৫ হাজার মানুষের যাতায়াত রয়েছে। এক হাওড় থেকে আরেক হাওড়ে যেতে যোগাযোগের জন্য নেই রাস্তাঘাট। বরাম হাওড়ের পাশের হাওড় ছায়ার হাওড়। সড়কপথ নেই। যেতে হয় নৌকায়। সময় লাগে এক-দেড় ঘণ্টা। যদি সড়কপথ হতো তাহলে ১০-১৫ মিনিট সময় লাগত। বোরো ধানের পাশাপাশি শুকনো মৌসুমে সবজিসহ নানা ধরনের ফসল চাষাবাদ করেন এখানকার কৃষকরা। তাদের উৎপাদিত ফসল বাজারজাত করতে অনেক কষ্ট হয়। কম দামে বিক্রিও করতে হয় তাদের। যোগাযোগ ব্যবস্থা ভালো থাকলে তারা জেলা শহরসহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় এসব বিক্রি করতে পারত। শুকনোর সময়ে ডুব বাঁধ (রাস্তা) ব্যবহার করা হয় সেটির অধিকাংশ ভাঙাচোরা। এক কিলোমিটার রাস্তায় তিন থেকে চারটি ভাঙনকবলিত থাকে। যান চলাচল নেই বললেই চলে। মাঝে মাঝে মোটরসাইকেল, ইজিবাইক, অটোরিকশা চলাচল করে। তবে মোটরসাইকেলটা একটু বেশি চলে। এছাড়া কোনো যানবাহন চলাচল করে না। ওই এলাকাসহ আশপাশের উপজেলার একই অবস্থা। যোগাযোগের ভালো কোনো রাস্তা নেই। উপজেলা সদর থেকে জেলা সদরে যেতে মেইন সড়ক ছাড়া আর কোনো যান চলাচলের সড়ক নেই। 

হাওড়ের রাজধানী খ্যাত সুনামগঞ্জ জেলার বিশ্বম্ভরপুর, তাহিরপুর, জামালগঞ্জ, জগন্নাথপুর, ছাতক, দোয়ারাবাজার, ধরমপাশাসহ সব উপজেলার সড়কগুলো অধিকাংশই বিটুমিন দ্বারা করা হয়েছে। এবারের তিন দফা বন্যায় এলজিইডির কয়েকশ কিলোমিটার সড়কে ক্ষতি হয়েছে। টাকার অংকে যা কয়েকশ কোটি টাকা। হাওড়ে ছয় মাস পানি আর ছয় মাস শুকনো মৌসুম থাকে। বর্ষাকালে বন্যার পানিতে সবগুলো সড়ক তলিয়ে যায়। সড়ক তলিয়ে গেলে দুই-একদিনের মাথায় সড়ক ভেঙে গর্ত হয়। মূলত হাওড়াঞ্চলের সড়কগুলো বিটুমিন দ্বারা কাজ করলে ভাঙবেই। সরকার যোগাযোগের উন্নয়নে প্রতি বছর বরাদ্দ দিচ্ছে কিন্তু মানুষের কাজে আসছে না। বরাদ্দকৃত টাকা গচ্চা যাচ্ছে। বিটুমিনের প্রধান শত্রু হলো পানি। আর হাওড়ের সবদিকে পানি থাকে ছয় মাস। বর্ষাকালে অতিবৃষ্টি আর পাহাড়ি ঢলে নদ-নদীর পানি বেড়ে জেলার অধিকাংশ সড়ক তলিয়ে যায়। এ সময় এ সড়কগুলো নরম হয়ে ভেঙে যায়। তবে একাধিক এলজিইডির প্রকৌশলীসহ বিটুমিন বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, বাংলাদেশে ইরানি বিটুমিন আসে। এগুলো বাংলাদেশের জন্য প্রযোজ্য নয়। এই বিটুমিনগুলো কম তাপমাত্রায় গলে যায়। বেশিদিন টেকসই না। এছাড়া বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের (বিপিসি) বিটুমিন দিয়ে সড়কে কাজ করলে পাঁচ বছরের মতো যাবে। চৈত্র মাসের রোদে যেকোনো বিটুমিন নরম হয়ে যায়। এর কারণে সহজে সড়কগুলো ভেঙে যায়। সব মিলিয়ে হাওড়াঞ্চলে বিটুমিনের সড়ক দিয়ে হবে না? হতে হবে টেকসই কংক্রিটের সড়ক। হাওরাঞ্চলের যোগাযোগ মাধ্যম উন্নত হলে দেশের অর্থনীতির উন্নতি হবে। মানুষ দুর্ভোগ থেকে মুক্তি পাবে। এদিকে হাওড়ে ঘেরা সুনামগঞ্জ ও নেত্রকোনা জেলা। পাশাপাশি জেলা হলেও তাদের মধ্যে নেই সরাসরি কোনো সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থা। শুধু তা-ই নয়, বর্ষায় হাওড় যখন প্রাণ পায়, তখন সুনামগঞ্জের এক উপজেলার সঙ্গে আরেক উপজেলাও হয়ে পড়ে বিচ্ছিন্ন। চারদিকে থই থই পানি থাকে। সড়ক না থাকায় হাওড়বাসী পায় না জরুরি চিকিৎসা সেবা। শিক্ষা, আর্থসামাজিক উন্নয়নও বাধাগ্রস্ত হয় সড়কের অভাবে।

হাওড়বাসীর কষ্ট দূর করতে স্থানীয় সরকারি, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে ‘হাওড় এলাকায় গ্রামীণ অবকাঠামো উন্নয়ন প্রকল্প: সুনামগঞ্জ জেলার দিরাই, ধরমপাশা, জামালগঞ্জ ও তাহিরপুর উপজেলা’র নামে একটি প্রকল্প পরিকল্পনা কমিশনে পাঠানো হয়েছে। এতে ব্যয় ধরা হয়েছে প্রায় সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকা। প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করবে স্থানীয় সরকার বিভাগ ও স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর। এতে সুনামগঞ্জে বর্ষার সময়ও জেলার প্রতিটি উপজেলার সঙ্গে যেমন সংযোগ স্থাপন সম্ভব হবে, তেমনি নেত্রকোনার সঙ্গেও সুনামগঞ্জের সরাসরি সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থা গড়ে উঠবে। প্রকল্পের আওতায় হাওড় এলাকায় ১৯০ কিলোমিটার সড়ক নির্মাণের প্রস্তাব দেয়া হয়েছে। তার মধ্যে অল সিজন সড়ক ১২৪ দশমিক ৭৮ কিলোমিটার। যেটি মূলত বাঁধ দিয়ে নির্মাণ করা সড়ক, যা সব মৌসুমে ব্যবহার করা যাবে। সাবমার্সিবল সড়ক (বর্ষায় তলিয়ে যাবে) ৫১ দশমিক ৭ কিলোমিটার এবং উড়ালসড়ক (যার নিচ দিয়ে পানি চলাচল করতে পারবে) ১৩ দশমিক ৪১ কিলোমিটার। 

এ উড়ালসড়ক বাস্তবায়ন হলে সুনামগঞ্জের অর্থনৈতিক অবস্থার উন্নতি হবে। এছাড়া তাহিরপুর উপজেলার বড়ছড়া শুল্ক স্টেশন দিয়ে ভারত থেকে কয়লা আমদানি হয়। আর এ কয়লা নৌপথে দেশের বিভিন্ন বাজারে যায়। সুনামগঞ্জের ডলুরা বর্ডার হাট, বোগলা রেঙ্গু বর্ডার হাট, লাউড়েরঘড় বর্ডার হাটসহ ভারতীয় সীমান্তে কয়েকটি বর্ডার হাট দিয়ে ভারত-বাংলাদেশের ব্যবসা-বাণিজ্য হচ্ছে। অথচ কিশোরগঞ্জের মতো সুনামগঞ্জ-নেত্রকোনাসহ হাওড়াঞ্চলের এলাকায় দৃষ্টিনন্দন সড়ক হলে পণ্য পরিবহনসহ যোগাযোগ মাধ্যমটা ভালো হতো। পাশাপাশি দেশের অর্থনীতি বাড়ত, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, চিকিৎসারও উন্নতি হতো। হাওড়াঞ্চলের মানুষের দাবি দৃষ্টিনন্দন নয়, তারা টেকসই রাস্তা চায়। যেন নৌপথের সময় বাঁচে। তাহলে বাণ্যিজিকভাবে হাওড়াঞ্চল এগিয়ে যাবে। পাশাপাশি হাওড়াঞ্চলের উৎপাদিত ফসলগুলো দেশের বাজারে ভালো ভূমিকা রাখবে। কৃষকরা তাদের উৎপাদিত ফসলের দামও বেশি পাবে। সব মিলিয়ে হাওড়াঞ্চল আর পিছিয়ে থাকবে না। দেশের উন্নয়নে হাওড়াঞ্চলের রাজস্বে অংশীদার হতে পারবে হাওড়বাসী।

খরচার হাওড়ের পাড়ে নিয়ামতপুর-ফতেহপুর সড়ক থেকে জেলা সদরের দৈর্ঘ্য ১৬ কিলোমিটার। দীর্ঘদিন ধরে সংস্কার না হওয়ায় দুলভারচর এলাকা থেকে রক্তি নদী ফেরিঘাট পর্যন্ত পাঁচ কিলোমিটার সড়কটি এখন ভরে গেছে অসংখ্য গর্তে। প্রতিদিন এ সড়ক দিয়ে বিশ্বম্ভরপুর ও তাহিরপুর উপজেলাসহ বিভিন্ন এলাকার লক্ষাধিক মানুষ চলাচল করে। এতে চরম ভোন্তির শিকার হচ্ছে চলাচলকারীরা। এ সড়ক দিয়ে ফতেপুর ইউনিয়নের সংগ্রামপুর, জিরাগ তাহিরপুর, সালমারা, হরিপুর, কচুখালী, কলাইয়া, ফতেপুর, নিয়ামতপুর ও তাহিরপুর উপজেলার আনোয়ারপুরসহ বিভিন্ন এলাকার লক্ষাধিক মানুষ আসা-যাওয়া করে প্রতিদিন। চলাচল করে লেগুনা, সিএনজি, ট্রাক, মোটরসাইকেল, রিকশা, অটোরিকশা। এর উপরে বড় কোনো যান চলাচল করে না এ সড়কে। পণ্যও পরিবহন করতে পারে না এ সড়কে। 

সড়কের অধিকাংশ ভাঙা থাকায় ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে স্থানীয়দের। রক্তি নদী ফেরিঘাট পর্যন্ত গিয়ে ছোট যানবাহনগুলো আটকে যায়। এদিকে এ সড়ক দিয়ে ইয়াকুব উল্লা উচ্চবিদ্যালয় ও ইসলামগঞ্জ ডিগ্রি কলেজসহ বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের যাওয়া-আসা করেন কয়েক হাজার শিক্ষার্থী। এছাড়া জেলার ছাতক, দোয়ারাবাজার, জগন্নাথপুর, দক্ষিণ সুনামগঞ্জসহ সবকটি উপজেলার সড়কের বেহাল অবস্থা। ভালো কোনো সড়কপথ নেই। সরকার হাওড়ের উন্নয়ন করতে হলে যোগাযোগ ব্যবস্থার ওপর গুরুত্ব দিতে হবে। হাওড় অঞ্চলের শিক্ষা ব্যবস্থাও পিছিয়ে রয়েছে। যোগাযোগ ব্যবস্থা ভালো হলে শিক্ষার হারও বাড়ত। শাল্লা, মধ্যনগর, জামালগঞ্জ, তাহিরপুরসহ বিভিন্ন উপজেলা ছয় মাসের অধিক পানিতে নিমজ্জিত থাকে। সে সময় তাদের একমাত্র ভরসা নৌকা। নৌকা দিয়ে তাদের হাট-বাজার থেকে শুরু করে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যেতে হয়। বর্ষার সময়ে খাল-বিল-নদীতে পানি থই থই। হাওড়ের প্রত্যন্ত অঞ্চল বর্ষার ভরা মৌসুমে সারাদিন প্রাণচাঞ্চল্যে ভরপুর থাকে এ নৌকাঘাটে। ভাটি অঞ্চলের সুনামগঞ্জ, ইটনা, অষ্টগ্রাম, নিকলী, বাজিতপুর, আজমিরীগঞ্জসহ ছাড়াও পার্শ্ববর্তী জেলার বিভিন্ন স্থানেও যাতায়াত করা হয় নৌকায়। কিন্তু এখন ভাটি অঞ্চলের উন্নয়ন হচ্ছে। ইটনা-মিঠামইন সড়ক হয়েছে। এখন সুনামগঞ্জ নেত্রকোনা ১৯০ কিলোমিটার উড়ন্ত সেতু হবে। এসব কাজ বাস্তবায়ন হলে হাওড়ের জীবনমানের পরিবর্তন আসবে। পাশাপাশি দেশের অর্থনীতির চাকাও সচল হবে। 

হাওড়ের জীবনমান উন্নয়ন করতে হলে আগে যোগাযোগ মাধ্যমের কাজ করতে হবে। বর্তমানে সুনামগঞ্জ, হবিগঞ্জের মানুষ সিলেট-মৌলভীবাজার হয়ে ঢাকায় যেতে হয়। এখন সুনামগঞ্জ-নেত্রকোনা উড়ালসেতু চালু হলে হাওড়ের জেলাগুলোর মানুষ সহজে নেত্রকোনো-ময়মনসিংহ হয়ে ঢাকা যেতে পারবে। সময় কম লাগবে। তখন আট ঘণ্টার জায়গা সাড়ে চার থেকে পাঁচ ঘণ্টায় যেতে পারবে। এছাড়া সুনামগঞ্জ থেকে মোহনগঞ্জ রেলপথের জন্য প্রস্তাব পাঠিয়েছিলেন পরিকল্পনামন্ত্রী এমএ মান্নান। সেই রেলপথও বাস্তবায়ন হলে হাওড়বাসী আর যোগাযোগে পিছিয়ে থাকবে না। সরকার দেশের সবচেয়ে বেশি রাজস্ব পাবে হাওড়াঞ্চল থেকে। হাওড়াঞ্চলের এখন মেডিকেল কলেজ হাসপাতালসহ বিভিন্ন কারিগরি স্থাপনা নির্মাণ করছে বর্তমান সরকার। শুধু স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও কারিগরি স্থাপনা করলে হবে না, যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন করতে হবে। তাহলে দেশের উন্নয়নের পাশাপাশি হাওড়ের উন্নয়ন হবে। 

অন্যদিকে হাওড়, জীববৈচিত্র্য, বিভিন্ন পর্যটন স্পট ও ভারতের মেঘালয়ের পাহাড়ঘেরা সৌন্দর্য পর্যটকদের কছে সবচেয়ে বড় আকর্ষণ হাওড়। টাঙ্গুয়ার আর শনির হাওড়ে বর্ষা কিংবা শীত দুই মৌসুমেই হাজারো পর্যটক ভিড় করে। এর মধ্যে টাঙ্গুয়ার হাওড় শীতে পরিযায়ী পাখির আবাসস্থল হিসেবে বেশ পরিচিত। স্থানীয় সচেতন মানুষের দাবি, বিপুল সম্ভাবনার পরও হাওড়াঞ্চলে পর্যটকদের জন্য সুযোগ-সুবিধা নেই। সিলেট বিভাগে সুনামগঞ্জ ছাড়াও মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ ও সিলেট জেলা প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরপুর। সেই সম্ভাবনার জায়গাটুকু কাজে লাগাতে হবে।


আল আমিন: সাংবাদিক

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন