হাটবাজার: গ্রামীণ অর্থনীতির প্রাণ

বাবু কামরুজ্জামান

তখনো রাতের আড়মোড়া ভেঙে জেগে ওঠেনি গ্রাম। ভোরের কুয়াশা ভেদ করে তবু কলেবর বাড়ে হাটুরে মানুষের আনাগোনায়। বাড়ে জমায়েত, শুরু হয় নিলাম; হাঁকডাক হাতবদল আর গুঞ্জন। সেই গুঞ্জন আর ভিড়ের মাঝেই এক বিস্ময়কর মুখরতা। সে মুখরতায় শ্রমজীবী মানুষের কর্মচাঞ্চল্য। এই তো হাটবাজারের চিরায়ত রূপ। যেখানে সুরম্য অট্টালিকা; বড় বড় ভবন কিংবা সাজসজ্জার বালাই নেই; তবে অভাব নেই প্রাণস্পন্দনের। যেন আবহমান বাংলার অকৃত্রিম সৌন্দর্য হাতছানি দেয় হাটের পণ্য বেচাকেনার সরু অলিগলি ভেদ করে।

বিশ্বায়নের এ কালে যখন মুক্তবাজার অর্থনীতির বয়ান কিংবা তর্ক চলে মফস্বলের চায়ের দোকানে, তখন গ্রামীণ সংস্কৃতির অন্যতম ধারক-বাহক হাট শব্দটি চাপা পড়ে যায় বাজার শব্দের বাজারে। তাই কোনটা হাট আর কোনটা বাজার তা মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়। যদিও হাটের সঙ্গে গ্রামীণ জনপদের সংস্কৃতি, কৃষ্টি আচার কিংবা সভ্যতার বিকাশে যে এক বিরাট যোগাযোগ তা আরেকটু অন্দরে গিয়ে খুঁজলে বিস্তৃত পরিসর খুঁজে পাওয়া যায়। নগর সভ্যতার আধিপত্যে এখন পাড়া-মহল্লায় প্রতিদিন বাজার বসছে, সে বাজার প্রতিযোগিতার। কখনো জাতীয় কখনো আন্তর্জাতিক; শেয়ারবাজার থেকে মুদ্রাবাজার। এমন ভিন্ন বাজারে ক্রয়-বিক্রয়, মুনাফা আর প্রতিযোগিতাটা মুখ্য হয়ে উঠলেও একটা সময় হাট মানে ছিল তা কেবলই সাপ্তাহিক এবং পণ্য বেচাকেনার প্রতিযোগিতা ছাপিয়েও যেন উৎসব। সেখানে বাণিজ্য ছিল তবে তা হয়ে উঠত স্থানীয়দের মিলনমেলা। হাটকে স্থানভেদে গঞ্জও বলা হতো। 

হাটবাজারের গল্প বা উপাখ্যান পুস্তকে লিখিত না থাকলেও স্থানীয় লোকমুখে এখনো হাটের ইতিহাস ও ঐতিহ্য টিকে আছে। বিশেষ করে গ্রামীণ উন্নয়ন বা আঞ্চলিক উন্নয়নের সঙ্গে প্রত্যক্ষ যোগাযোগ গ্রামীণ হাটের। আবার অনেক অঞ্চলে শত শত বছরের পুরনো সেই হাটকে ঘিরে মানুষের জীবন-জীবিকা আবর্তিত হতে থাকে। যদিও সময়ের বিবর্তনে অনেক হাট বা গঞ্জ হারিয়েছে তার জৌলুস ঐতিহ্য; তবে এখনো এমন বহু পুরনো হাট আছে, যা ইতিহাস-ঐতিহ্যের সাক্ষী বহন করে চলছে। সংবাদ কর্মী হিসেবে এ হাটবাজার হয়ে ওঠে আমার সংবাদের বিষয়, যেখানে দেশের আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা হাটের সন্ধানে খুঁজে পাই ভিন্ন লোকাচার যেন প্রদোষে প্রাকৃতজনের কথা। পণ্যের হাতবদল ছাপিয়ে স্থানীয় আচার, ঐতিহ্য, সংকট আর সভ্যতারও নানা ছাপ দেখা মেলে সেখানে।

সময়ের সঙ্গে কোনো হাটের গুরুত্ব যেমন বেড়েছে; তেমনি পরিবহন ব্যবস্থা, যোগাযোগ ও অবকাঠামো সংকটের কারণে অনেক হাট আবার হারিয়েছে তার কদর। তবে দেশে এখনো বহু হাট আছে, যা বিশেষায়িত পণ্যকে উপস্থাপন করে। এ যেমন টাঙ্গাইল ও শাহজাদপুরে কাপড়ের হাট; যশোরের ফুলের হাট, পিরোজপুরের নৌকার হাট, বরিশালের ভাসমান বাজার ইত্যাদি। কালে কালে বেশির ভাগ হাটেরই গোড়াপত্তন হয়েছে নদ-নদীকে কেন্দ্র করে। যেমন এক সময় বণিকরা দূর-দূরান্ত থেকে এসে জাহাজ ভিড়াত বুড়িগঙ্গার সোয়ারী ঘাটে। কেবল নগরে নয় গ্রাম থেকে গ্রামে যোগাযোগের প্রধান মাধ্যম ছিল নৌকা। হাটুরের দল পণ্যের সওদা শেষে নৌকা করেই ফিরত ঘরে। এখনো দেশের অধিকাংশ হাট বসে নদীর কিনার ঘেঁষে। যদিও নদীমাতৃক বাংলাদেশে নৌপথের যোগাযোগ ক্রমেই ছোট হয়ে এসেছে।

এমন অনেক জেলা আছে কোনো একটি নির্দিষ্ট পণ্যের কারণেই সে জেলার খ্যাতি ছড়িয়ে আছে দেশে-বিদেশে। যেমন চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার বাড়তি পরিচয় বহন করে চলছে কানসাট আমের হাট। এ অঞ্চলের মানুষের প্রধান অর্থনৈতিক ফসল হয়ে উঠেছে আম। আম ব্যবসাকে কেন্দ্র করে কানসাট হাটের আশপাশে গড়ে উঠেছে অসংখ্য আড়ত। যেখানে হাজারো মানুষের কাজের সুযোগ তৈরি হয়েছে। আড়তদারদের মতে, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে কানসাট হাট আরো জমজমাট হয়ে উঠছে। কানসাট আম আড়ত সমিতির হিসেবে শুধু চাঁপাইনবাবগঞ্জে আমের বাজার দেড় থেকে ২ হাজার কোটি টাকা। মৌসুম চলাকালীন প্রতিদিন সেখানে আমের বাণিজ্য হয় অন্তত ২০ কোটি টাকার।

একটি নির্দিষ্ট পণ্য নিয়েই অনেক জেলায় এমন বিখ্যাত হাট গড়ে উঠেছে। তেমনই এক হাট এখনো সগৌরবে টিকে আছে টাঙ্গাইলের করোটিয়ায়। সপ্তাহের প্রতি মঙ্গলবার সারা দেশ থেকে আসা পাইকার ব্যাপারিরা রাতভর জমায়েত হন এ হাট ধরতে। হাট চলে পরদিন বুধবার দুপুর ১২টা পর্যন্ত। হাট কমিটির তথ্যমতে, হাটবারে এখানে লেনদেন হয় ২০০ থেকে ৩০০ কোটি টাকা পর্যন্ত। আর এ হাট থেকেই রাজস্ব আদায় হয় কোটি টাকা। 

করোটিয়া হাটের কোল ঘেঁষে যমুনার শাখা নদী লৌহজং। আর সেখান থেকে মাত্র পাঁচ কিলোমিটার দূরত্বের পথ পাথরাইল গ্রাম। আশপাশের প্রায় সব গ্রামেই মিলে তাঁতের খুটখাট আওয়াজ। হাটে যাওয়ার আগে পাথরাইল গ্রামের দু-চারটা কারখানায় ঢুঁ মারতেই দেখা মিলে জীর্ণ ভাঙাচোরা ঘরে কাজ করছেন স্থানীয় তাঁতিরা। টাঙ্গাইল শাড়ির সমৃদ্ধ ইতিহাস যারা বুনে চলছেন অনেকটা নিভৃতে। তাঁতের ওপর ভর করে তারা জীবনের স্বপ্ন বুনে যান যদিও তাদের ভাগ্যের উন্নয়ন হয় না খুব একটা।

স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, সেখানকার কারিগরদের দক্ষতা ও নৈপুণ্য অসামান্য। প্রাচীনকাল থেকেই বংশপরম্পরায় তাঁতিরা তৈরি করে চলছেন এসব কাপড়। ঐতিহ্যবাহী মসলিনের যাত্রা শুরু হয় এসব তাঁতির হাত ধরেই। সময়ের সঙ্গে মসলিন কাপড় হারিয়ে গেলেও উত্তরাধিকারের হাত ধরে এখনো টিকে আছে টাঙ্গাইল শাড়ি। বিখ্যাত পর্যটক ইবনে বতুতা ও হিউয়েন সাংয়ের ভ্রমণ কাহিনীতেও টাঙ্গাইলের বস্ত্র বা তাঁত শিল্পের কথা উঠে এসেছে। বলা যায়, এ জেলার ঐতিহ্যের ধারক-বাহক তাঁত শিল্প। এখানকার কৃষ্টি আর সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ। ‘নদীচর খালবিল গজারির বন, টাঙ্গাইল শাড়ি তার গর্বের ধন’—এমন প্রবাদও লোকমুখে প্রচারিত এ জেলাকে ঘিরে। স্থানীয় ব্যবসায়ী ও লোকজনের কণ্ঠে যদিও এখন হতাশার সুর, যন্ত্রের আধিপত্য আর কালের বিবর্তনে অনেকটাই হারিয়েছে সেখানকার তাঁতের জৌলুস।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর হিসাবে, টাঙ্গাইল জেলায় কেবল হাতে চালিত তাঁত কারখানা আছে ৩৫ হাজার। যেখানে কাজ করছে ৫০ হাজারের বেশি লোক। এ জেলার মোট ১২টি উপজেলার আটটিতেই কম-বেশি তাঁত কারখানা আছে। যদিও এর মধ্যে হাতে চালিত তাঁত কারখানা বন্ধও রয়েছে সাড়ে তিন হাজার। সময়ের সঙ্গে এখন আধিপত্য বিস্তার করছে পাওয়ার লুম বা যন্ত্রচালিত তাঁত। তাই হস্তচালিত তাঁত কারখানাগুলো লড়াই করেই টিকে আছে। স্থানীয় লোকজনের মতে, আদিপুরুষদের এ ঐতিহ্যবাহী শিল্প অনেকের বেঁচে থাকার বড় ভরসা।

কেবল টাঙ্গাইল শাড়ির হাট নয়, দক্ষিণের জেলা বরিশালের স্বরূপকাঠির ভাসমান হাটের রূপ-সৌন্দর্য এখন দেশী-বিদেশী পর্যটকদের মুখে মুখে ঘুরে ফেরে। নদীমাতৃক বাংলাদেশের অপূর্ব সৌন্দর্য এখনো অনেকটাই টিকে আছে দক্ষিণের এ জেলায়। ধান, নদী, খাল, বলা হয় এই তিনে বরিশাল। শ্রাবণের এক ভরা বর্ষার সকালে ট্রলারে যেতে যেতে দেখা মেলে সারি সারি সবুজের সমারোহ আর সন্ধ্যা নদীর প্রাণোচ্ছল রূপ। অপরূপ এ প্রকৃতির অন্তরালেই হয়তো জীবনানন্দ তার রূপসী বাংলা কিংবা ধানসিঁড়ির কাব্যিক রূপ খুঁজেছেন। মেঘনা, তেঁতুলিয়া, কীর্তনখোলাসহ অসংখ্য নদী থাকলেও মাত্র পাঁচ মাইল দৈর্ঘ্যের সুন্দর এক নদী সন্ধ্যা। তারই শাখা বেয়ে যেতে যেতেই চোখে পড়বে স্থানীয় মানুষের জীবনযাত্রা। শিল্পনির্ভরতা না থাকায় সেখানকার জনগোষ্ঠীর বড় অংশই কৃষিকাজে জড়িত। জালের মতো ছড়ানো-ছিটানো নদী আর খালের প্রাধান্য থাকায় এ অঞ্চলে চলাচলের প্রধান বাহন ছোট ছোট নৌকা। নদীবিধৌত এ অঞ্চলের মানুষের নিবিড় সখ্যও তাই জলের সঙ্গে। দৈনন্দিন কৃষিপণ্য, ফলমূল নিয়ে চাষীরা তা বিক্রি করেন ভাসমান বাজারে। স্বরূপকাঠির নামডাক আর বিশেষ পরিচিতি পেয়ারার জন্য। ভাসমান বাজারের দিকে যেতেই চোখে পড়বে বাগান থেকে চাষীরা পেয়ারা পারছেন, নেয়া হচ্ছে ডিঙ্গি নৌকায়। পেয়ারার মৌসুমে যা নিত্যদিনের ছবি।

পিরোজপুর জেলার অন্যতম পুরনো বাণিজ্যকেন্দ্র স্বরূপকাঠি। যদিও এ উপজেলার নাম পাল্টে এখন হয়েছে নেছারাবাদ। স্থানীয়রা জানান স্বরূপকাঠি উপজেলার প্রায় সব বাড়িতেই আছে নানা শাকসবজির বাগান। লোকমুখে জানা যায়, দেশের খাদ্যশস্য আর মত্স্য উৎপাদনের অন্যতম উৎস হওয়ায় বরিশালকে বলা হয় বাংলার ভেনিস। এক সময় বরিশালকে কেন্দ্র করে রমরমা বাণিজ্য হতো। ১৭৫৭ সালের পর ইংরেজ বণিকরাও জলপথে ছুটে আসত ব্যবসা করতে। 

শত বছরের পুরনো মৌসুমি ফল আর সবজির ভাসমান বাজার বসে আটঘর কুড়িয়ানায়। আটঘর খালের ছোট্ট মোহনায় ভোরবেলায় ছোট ছোট ডিঙি নৌকায় ডাঁটাশাক, কাঁকরোল, ডাব, কলাসহ নিজেদের উৎপাদিত ফলমূল ও শাকসবজি নিয়ে ছুটে আসেন কৃষকরা। নৌকায় ভাসতে ভাসতে চলে পণ্যের প্রদর্শনী, যা বিক্রি হয় পাইকারি দরে। দুপারে থাকা পাইকাররা দরদাম করে তা কিনে ট্রলার বোঝাই করে পাঠিয়ে দেন দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে। স্বরূপকাঠির নামের সঙ্গে মিল আছে পেয়ারার জাতের। খেতেও ভীষণ সুস্বাদু। যদিও তা বিক্রি হয় অনেকটা জলের দামে। কেননা এখনো গ্রামীণ অর্থনীতিতে বড় বাধা পর্যাপ্ত হিমাগার ও কৃষিপণ্যের বিপণন ও সংরক্ষণ ব্যবস্থাপনা। এছাড়া কৃষিপণ্যের আধুনিক প্রক্রিয়াজাতের সুযোগ না থাকায় পেয়ারা থেকে স্থানীয় পর্যায়ে জেলি বা রফতানির সম্ভাবনা থেকেও বঞ্চিত থাকেন চাষীরা। 

কৃষিনির্ভর বাংলাদেশে গ্রামীণ অর্থনীতিকে নিয়ন্ত্রণ করে ছোট মাঝারি কিংবা বড় হাটবাজারগুলো। কেননা গ্রামীণ হাটবাজারের হাত ধরেই উৎপাদনকারীর পণ্য পৌঁছায় ভোক্তার কাছে, যা হাত ঘুরে পৌঁছে যায় শহুরে বাজারগুলোতেও। যদিও মধ্যস্বত্বভোগীর দৌরাত্ম্যের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে পেরে ওঠেন না কৃষকরা।

ভাসমান পেয়ারার হাটের গল্প দেশে-বিদেশে ছড়িয়ে পড়লেও আরো বিচিত্র এক হাটের সন্ধান মেলে এ স্বরূপকাঠিতেই। দক্ষিণের জেলা বরিশাল শহর থেকে ৩৫ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে যেখানে পৌঁছাতে হয়। ‘ভাসমান কাঠের হাট’।

বহু পুরনো এ শহরের পাশ দিয়ে বয়ে চলা নদীতীরেই গড়ে উঠেছে দেশের সবচেয়ে বড় এ কাঠের মোকাম। সপ্তাহের প্রতি বৃহস্পতিবার হাট বসলেও মূলত এখানে কাঠের কেনাবেচা চলে আগের দিন। তবে হাট সপ্তাহের একদিন হলেও প্রতিদিনই ভোর থেকে এখানে বাজারও বসে। নদীতীরে প্রায় এক কিলোমিটার জায়গাজুড়ে বসা কাঠের বাজার দেখে বিস্ময় যেন কাটে না! জলের ওপর ভাসছে হরেক রকমের গাছ। নদীর কিনারেই চলছে তার মাপজোখ আর বেচাকেনা। এমন বৈচিত্র্য নিয়েই যুগ যুগ টিকে আছে এ জনপদ ও হাটের গল্প। স্বরূপকাঠি অঞ্চলকে অনেকটা জালের মতো জড়িয়ে রেখেছে সন্ধ্যা নদীর শাখা-প্রশাখা। স্থানীয়রা যাকে বলেন, ছোট ও বড় খাল। পিরোজপুর জেলায় বলেশ্বর, কালিগঙ্গা, মধুমতীসহ একাধিক নদী থাকলেও স্বরূপকাঠির জনজীবন ও ব্যবসা-বাণিজ্যের অন্যতম প্রধান নদী সন্ধ্যা।

স্থানীয় ব্যবসায়ী ও বিভিন্ন তথ্য থেকে জানা যায়, ১৯১৭ সাল থেকে এ অঞ্চলে শুরু হয় কাঠের বাণিজ্য। এক সময় সুন্দরবনের সুন্দরী কাঠকে কেন্দ্র করে এখানে কাঠ ব্যবসা শুরু হয়। সে সময় সুন্দরবন থেকে এখানে সুন্দরী গাছ, পাহাড়ি সেগুন, পশুর, কেওড়া, শিশুগাছসহ বিভিন্ন ধরনের গাছ নিয়ে আসতেন বাওয়ালিরা। এছাড়াও ভারতের আসাম রাজ্য থেকে শাল ও গর্জন কাঠের লট আনতেন কাঠ ব্যবসায়ীরা। নব্বইয়ের দশকে সুন্দরবনের গাছ বিক্রি বন্ধ করে দিলে সেখানে এখন রেইন্ট্রি, মেহগনি, আম এমন দেশীয় কাঠের বিপুল সরবরাহ।

এ কাঠ ব্যবসার সঙ্গে জড়িয়ে আছে হাজারো লোকের জীবন-জীবিকা। তবে ব্যবসা পরিচালনায় বাধাও কম নেই। ব্যবসায়ীরা গল্পে গল্পে জানান রাজনৈতিক প্রভাব, ব্যাংকিং সুবিধার স্বল্পতা, দালাল চক্রের আধিপত্য আর নদীপথে জলদস্যুর আক্রমণ এমন নানা বাধার কারণে শত বছরের ঐতিহ্যবাহী এ ব্যবসা এখন আগের মতো জমজমাট নেই। সঠিক হিসাব বা পরিসংখ্যান না থাকলেও ব্যবসায়ীদের মতে দৈনিক প্রায় কোটি টাকার কাঠ লেনদেন হয় এ হাটে।

নরসিংদী, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, চাঁদপুর, নেত্রকোনাসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে ব্যবসায়ীরা আসেন কাঠ কিনতে। আবার ট্রলার বা লঞ্চে করে তা পৌঁছেও দেন ব্যবসায়ীরা। গোটা স্বরূপকাঠিতে যেন ফুরফুরে এক জলভ্রমণের গল্প লুকিয়ে।

হাটবাজার যে একটি অঞ্চলের আর্থিক কর্মকাণ্ড ও উন্নয়নে কত বড় ভূমিকা রাখে তার অন্যতম সাক্ষ্য বহন করে চলছে খুলনার ঐতিহ্যবাহী বড় বাজার। আঁকাবাঁকা সরু দু-একটি গলি। আর মাথা উঁচু করে আছে জীর্ণশীর্ণ কিছু পুরনো ভবন, টিনের চালওয়ালা ঘর। ওপর থেকে তাকালে এর সঙ্গে দেখা মিলবে পাশেই ভৈরব নদের রূপ-সৌন্দর্যও। ছোট-বড় ট্রলার, নৌপথে মানুষের পারাপার। আর সরু রাস্তায় দিনভর মাল বোঝাইয়ের কাজে শ্রমিকদের মুখরতা। খুলনা বিভাগের সবচেয়ে বড় এবং প্রাচীন বাজার বড় বাজারের নিত্যদিনের ছবি এটি।

স্থানীয়দের মতে, অন্তত ২০০ বছর আগে এ বাজারের গোড়াপত্তন হয়। কালীবাড়ি ঘাট এলাকা থেকে লঞ্চ টার্মিনাল পর্যন্ত ভৈরব নদের ঠিক গা ঘেঁষে গড়ে উঠেছে এ বাজার। বাজারটিতে ছোট-বড় পাইকারি ও খুচরা দোকান আছে কয়েক হাজার। শুধু পাইকারি দোকান আছে অন্তত আড়াই থেকে তিন হাজার। চাল, ডাল, আটা ভোজ্যতেলসহ সবরকম ভোগ্যপণ্যের বিশাল এক কেন্দ্রবিন্দু এ বাজার। আড়তদার ও ব্যবসায়ীদের মতে, খাতুনগঞ্জের পরই এ বাজারের অবস্থান।

দক্ষিণাঞ্চলের সব পাইকার ও ব্যবসায়ীরা এ বাজার থেকে মাল কিনলেও আধুনিকায়ন এবং একাধিক বাজার গড়ে ওঠায় বড় বাজারের ঐতিহ্য আগের মতো নেই বলে জানান স্থানীয় ব্যবসায়ীরা।

নানা ইতিহাস থেকে জানা যায়, উনিশ শতকের শেষদিকে নীল কুঠিয়াল চার্লস এ বাজার প্রতিষ্ঠা করেন। তার নামানুসারে এর নাম হয় চার্লিগঞ্জ বা সাহেবের হাট। পরে যা হয় বড় বাজার। 

জলে আর সমতলের হাটের ঐতিহ্যের সঙ্গে আরো ভিন্ন মাত্রা যোগ করে পাহাড়ি জনপদের হাটগুলো। সে এক ভিন্ন চিত্র। মাথার ওপর গাঢ় নীলাভ আকাশ, রৌদ্রছায়ার লুকোচুরি খেলা, সবুজ অরণ্যের পরতে পরতে নৈসর্গিক সৌন্দর্যের হাতছানি আর মেঘমল্লারের গল্প। বছর দুয়েক আগে নভেম্বরের এক সকালে বান্দরবানের এমন চিরায়ত দৃশ্য গায়ে মেখে খুঁজে ফিরি সেখানকার হাটবাজারের গল্প। 

দেশের সবচেয়ে কম জনবসতিসম্পন্ন এ জেলায় চাকমা, মারমা, ম্রোসহ ১১টি নৃগোষ্ঠীর বসবাস একসঙ্গে। যাদের সংস্কৃতি, ভাষা হয়তো আলাদা তবে জীবনযাপনের ক্ষেত্রে তাদের গল্পটা যেন মিশে আছে এক সুতোয়। তাই বলা হয় সম্প্রীতির বান্দরবান। ছবির মতো এ জেলার চারপাশ ঘিরে রেখেছে বান্দরবানের প্রধান নদী সাঙ্গু।

এখানকার প্রধান কৃষি ফসল শাকসবজি, আদা, হলুদ, জুমের ফসল ও বনজ সম্পদ। এছাড়াও বন এবং ঝরনা থেকে অনেকেই সংগ্রহ করেন বিভিন্ন শাকসবজি। তবে কৃষিজাত পণ্যের সংরক্ষণ ব্যবস্থা না থাকায় তাদের বেচাবিক্রিটাও সারতে হয় নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যেই, যা মূলত হাটবারগুলোতেই হয়ে থাকে। তাই সপ্তাহের রবি ও বুধবার পাহাড়ি রাস্তার ঢাল বেয়ে কেউ গাড়িতে কেউবা মাথায় করে মৌসুমি ফল ও কৃষিপণ্য নিয়ে ছুটে যান বান্দরবান হাটে।

এখানকার নারীদের বলা যায় সব্যসাচী। নানা সংগ্রাম করে বেঁচে থাকার গল্প তো আছেই, খেতখামার থেকে শুরু করে বাজারঘাট সবখানেই সক্রিয় অংশগ্রহণ তাদের। ক্যামেরার সামনে কথা বলতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন না অনেকেই। তবে অনেক অনুরোধের পর সেদিন কথা হয়েছিল স্থানীয় মারমা নারী ম্যাথুই প্রোর সঙ্গে। যিনি মাথায় ফলের বোঝা নিয়ে যাচ্ছিলেন বান্দরবান হাটে তা বিক্রি করতে। গল্পে গল্পে জানা যায়, কী অবিরাম সংগ্রাম করে তাদের বেঁচে থাকতে হয়। পিচঢালা পথ হয়তো আছে তবে তা মসৃণ নয়। সেখানে বেশির ভাগ লোকই চলাচল করেন পায়ে হেঁটে।

বান্দরবান শহরের মাঝখানে মধ্যমপাড়া নামের এলাকায় ভোর থেকে বসে হাট। যার নাম মারমা বাজার। খোলা জায়গা না থাকায় সপ্তাহের রবি ও বুধবার রাস্তার ওপরই বসে হাট। রাসায়নিকমুক্ত বৈচিত্র্যপূর্ণ তাজা খাবারের জন্য এ বাজার জনপ্রিয় সব শ্রেণীর লোকেদের কাছেই।

হাটবারে নানা ধর্মের, নানা বর্ণের মানুষের এ আয়োজন অনেকটা যেন উত্সবের আমেজ। মারমা বাজারে জুম, বনাঞ্চল, ঝরনা থেকে সংগ্রহ করা এমন শতাধিক আদিবাসী তরিতরকারি বিক্রি হয়। জুমের এসব টাটকা শাকসবজি কিনতে অনেক বাঙালিরও পছন্দ মারমা বাজার। কেবল বিচিত্র শাকসবজি নয়, বন্য প্রাণীর মাংস, হরেক রকম শুঁটকি, কচ্ছপ, কাঁকড়া এমন অনেক কিছুরই সরবরাহ ঘটে মারমা বাজারে।

সময়ের সঙ্গে হাটের যে রূপান্তর ঘটেছে তার নজির মিলেছে দেশের বহু হাটবাজারে। তবে উত্তরের জেলা নওগাঁর প্রত্যন্ত এলাকার কাঁটাবাড়ি হাটের গল্পটা বেশ আলাদা। আদিকাল থেকেই বৈচিত্র্যে ভরপুর নওগাঁ জেলা কৃষিকাজের জন্য প্রসিদ্ধ। দেশের সিংহভাগ চালের জোগান আসে ধানচাষনির্ভর এ জেলা থেকে।

এখানকার পুরুষদের সঙ্গে অনেক নারীরাও অংশ নেন কৃষিকাজে। বিশেষ করে সাঁওতাল জনগোষ্ঠীর অধিকাংশ নারী শ্রমিক হিসেবে কৃষিকাজে যুক্ত। জীবন আর জীবিকার প্রয়োজনে কৃষির এমন ভারী কাজও তারা শিখেছেন সুনিপুণভাবে। 

রাখালিয়া বাঁশির সুর, মেঠোপথ আর তপ্ত রোদে রাখালের গরু নিয়ে ঘরে ফেরা—গ্রামীণ জনজীবনের এমন অনবদ্য রূপ অবলোকন করতে করতে গ্রীষ্মের এক তপ্ত দুপুরে পৌঁছে যাই নওগাঁর পত্নতীলা উপজেলার কাঁটাবাড়ি হাটের সন্ধানে। 

নওগাঁ শহর থেকে প্রায় ৫০ কিলোমিটার দূরের প্রত্যন্ত এ হাটে হাজারো লোকের ভিড় ছিল না; কোনো চাকচিক্য নেই। একেবারে অকৃত্রিম পরিবেশে বিশাল বটগাছতলায় বসা এক হাট যেন গ্রামীণ জনজীবনের প্রতিচ্ছবি। যেখানে দোকান বলতে ছোট ছোট টিনের চালা, বেশির ভাগই মাটিতেই পণ্যের পসরা নিয়ে বসেন। সপ্তাহের প্রতি শুক্রবার ও সোমবার বিকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত বসা গ্রামীণ এ হাটে স্থানীয় লোকেরা আসেন দৈনন্দিন নিত্যপণ্যের কেনাকাটা সারতে। তবে শাকসবজির দাম শুনে চমকে যেতে হয়। পচনশীল শাকসবজি পটোল, ঝিঙে, বেগুন, করোলার মতো সবজি বিক্রি হয় ১০ থেকে সর্বোচ্চ ২০ টাকায়। আবার কোনো কোনো সবজি ৫ টাকা কেজিতেও হয় বেচাকেনা।

হাটের একটু পাশেই বয়ে চলা আত্রাই নদী। এ নদীর সঙ্গে জড়িয়ে আছে কাঁটাবাড়ি হাটের জন্মের ইতিহাস। স্থানীয় লোকজন জানালেন, নদীপথের যোগাযোগ সহজ হওয়ায় একসময় এখানে ব্রিটিশরা আসতেন ধান চালের বাণিজ্য করতে। তখন বেশ জমজমাট আর বড় আকারে বসত কাঁটাবাড়ি হাট। তবে সময়ের সঙ্গে এখন যেমন নদীর রূপ পাল্টেছে, তেমনি হাটও সংকুচিত হয়ে এসেছে। যোগাযোগ ও অবকাঠামোগত সুযোগ-সুবিধার কারণে এভাবেই দেশের ঐতিহ্যবাহী অনেক হাট হারিয়েছে তার রূপ-জৌলুস।

তবে প্রত্যন্ত গ্রামীণ জনজীবনে হাটবার মানেই খানিকটা উত্সব, মিলনমেলা বা আড্ডার সুযোগ। দৈনন্দিন সদাইপাতি শেষে সন্ধ্যার দিকে সরগরম থাকে মোয়া-মুড়কি, গরম গরম তেলে ভাজা জিলাপি বা পেঁয়াজির দোকানগুলোও। আবার হাট করে বাড়ি ফিরতে ফিরতে রাত নেমে এলে কুপির আলোয় দূর থেকে দেখা যায়, ঘরে ফিরছে হাটুরের দল। বাড়ির ছোট ছেলেপুলেদের অপেক্ষা থাকত হাট করে বাবা ঘরে ফিরলে মিলবে জিলাপি, সন্দেশ, বাতাসা কিংবা মোয়া-মুড়কি। সেসব আনন্দঘন সুখস্মৃতি এখনো কারো কারো শৈশবের স্মৃতিতে সমুজ্জ্বল। শহুরে বাজারে তার অস্তিত্ব মেলা ভার! হাটবাজারের এমন বিচিত্র ভ্রমণ ডায়েরি একজন সংবাদকর্মীর সংক্ষিপ্ত পরিভ্রমণ হলেও বাংলার অপরূপ প্রকৃতি আর স্থানীয় লোকাচার জানার ক্ষেত্রে তা বড় পাথেয় হয়ে গেঁথে আছে মন ও মননে।


বাবু কামরুজ্জামান: সাংবাদিক


এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন