যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচন

ফলাফল কার পক্ষে, কার বিপক্ষে যাবে

মাহমুদ রেজা চৌধুরী

অক্টোবরের ২২ তারিখে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের শেষ বিতর্ক অনুষ্ঠানটি হয়ে গেল যুক্তরাষ্ট্রের অঙ্গরাজ্য টেনিসির নেশভিলে। অনুষ্ঠানের মডারেটর ছিলেন এনবিসি টেলিভিশনের সাংবাদিক ক্রিস্টিন ওয়েলকার। সাংবাদিক ক্রিস্টিন যুক্তরাষ্ট্রের অন্যতম টেলিভিশন প্রচারমাধ্যম এনবিসিএর একজন শীর্ষ সাংবাদিক ও সংবাদ উপস্থাপক।

গত ৩০ বছরের ইতিহাস বলে, যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের দুই প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বীর মধ্যকার বিতর্ক পরিচালনায় প্রথম অশ্বেতাঙ্গ নারী ক্রিস্টিন। তিনি তার দায়িত্ব পালন করেছেন অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে। প্রশংসাও পেয়েছেন সংশ্লিষ্ট সব মহলের।

সিএনএন ও এমএসএনবিসির বিতর্কে জয়-পরাজয়ের তাত্ক্ষণিক জরিপে দেখা গেছে, ভাইস প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ডেমোক্রেটিক দলের প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী, প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের চেয়ে এই বিতর্কেও এগিয়ে আছেন। প্রথম বিতর্কেও জো বাইডেন এগিয়ে ছিলেন। শেষ বিতর্ক প্রতিযোগিতায় বাইডেন পেয়েছেন ৫৩ শতাংশের সমর্থন। সেখানে ডোনাল্ড ট্রাম্প পেয়েছেন ৩৯ শতাংশ।

তবে বলা বাহুল্য, এই শেষ বিতর্কে যে বিষয়গুলো শ্রোতা ও দর্শক লক্ষ করেছেন, সংক্ষেপে তার কয়েকটা এমন—

১. প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প তার আচরণে কিছুটা ভদ্রতা বজায় রেখেছেন এবার।

২. বরাবরের মতো এবারো ডোনাল্ড ট্রাম্প তার বক্তব্য উপস্থাপনে এবং তথ্য সরবরাহে মিথ্যাচারিতা করেছেন।

৩. ভাইস প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনকে তিনি ব্যক্তিগতভাবে আক্রমণ করে যেসব সমালোচনা করেছেন, বিশেষ করে জো বাইডেনের আর্থিক অবস্থা নিয়ে, যার কোনো তথ্য-প্রমাণ ট্রাম্প দিতে পারেননি।

৪. প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প বারবারই তার আলোচনায় বা বক্তব্যে জো বাইডেনকে বলছেন, আপনি ৪৭ বছর ক্ষমতায় ছিলেন, কী করেছেন? ৪৭ বছর জো বাইডেন প্রেসিডেন্ট ছিলেন না। সে কারণে এই ৪৭ সংখ্যার কোনো ভিত্তি আছে বলে মনে হয় না (ক্ষমতা ব্যবহার অর্থে)।

৫. এ বিতর্কেও প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প তার কোনো ব্যর্থতার কথা স্বীকার করেননি, বরং তার ব্যর্থতাকে বড় সফলতা হিসেবে দেখাতে চেষ্টা করেছেন।

৬. ডোনাল্ড ট্রাম্প বারবার বলছিলেন যে রাজনীতিবিদদের ব্যর্থতার কারণেই তাকে নাকি ক্ষমতায় আসতে হয়েছে। তিনি রাজনীতিবিদ নন। রাজনীতিবিদরা কেবল কথা বলেন, কাজ করেন না।

বিবেচনার বিষয় হলো, চার বছর ধরে ট্রাম্প রাজনীতি করছেন। ট্রাম্পের চারপাশে যারা তাকে ঘিরে আছেন, এমনকি তার ভাইস প্রেসিডেন্ট পেন্স, তিনিও একজন রাজনীতিবিদ। অতএব, রাজনীতিবিদদের সমালোচনায় ট্রাম্প যা-ই বলেন না কেন, সেটা অযৌক্তিক।

এসব কারণে বলা যেতে পারে যে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের শেষ বিতর্কে ডোনাল্ড ট্রাম্প তার বক্তব্য ও যুক্তি উপস্থাপনে ব্যতিক্রম কিছু দেখাননি। 

ডেমোক্র্যাট দলের প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী জো বাইডেন এবারো তার স্বভাবসুলভ সৌজন্য ব্যবহার এবং একজন অভিজ্ঞ পেশাদার রাজনীতিকের পরিচয়কে সুস্পষ্ট করেছেন শ্রোতা ও দর্শকের কাছে। এই দিকটিই হচ্ছে জো বাইডেনের পক্ষে বড় বিষয় অথবা বলা যেতে পারে জো বাইডেনের প্লাস পয়েন্ট।

৩ নভেম্বর যত কাছে আসছে, ততই আসন্ন নির্বাচন নিয়ে নানা কারণে নানা আশঙ্কা বাড়ছেই বলা যেতে পারে। যেমন কয়েকটি এখানে উল্লেখ করি—

ক) ফ্লোরিডা, পেনসিলভানিয়া, অ্যারিজোনা, আলাস্কা—এসব রাজ্যের অনেক ভোটার অভিযোগ করেছেন যে তাদের কাছে ই-মেইল আসছে, তারা যদি ট্রাম্পকে ভোট না দেন, তাহলে নাকি তাদের ‘দেখে’ নেয়া হবে। ভোটারদের আতঙ্কিত করছে এ ধরনের বার্তা। অভিযোগ আছে যে এ কাজগুলো করছে ডোনাল্ড ট্রাম্পের কিছু উগ্র সমর্থকগোষ্ঠী। নানা রকম প্রচারমাধ্যমে এরা নিজেদের কোথাও বলছে ‘প্রাউড বয়’, কোথাও এদেরকে বলা হয় ‘কাউ বয়’।

খ) যুক্তরাষ্ট্রের দুই প্রধান গোয়েন্দা বিভাগ ডিএনআই ও এফবিআই বলছে, এবারের নির্বাচনে ইরান ও রাশিয়া যুক্তরাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক নির্বাচনকে বিঘ্নিত অথবা ব্যাহত করার চেষ্টা করতে পারে। বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করছে ভোটারদের। যদিও এই দুই প্রধান বিভাগ তাদের অভিযোগের প্রশ্নে তেমন কোনো দৃষ্টান্ত কিংবা প্রমাণ দেখাতে পারেনি।

গ) প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের এক ধরনের ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণ সাধারণ ভোটারদের মধ্যেও ভয় বা ভীতির সৃষ্টি করছে। প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প নির্বাচনের ফল তার বিপক্ষে গেলে সহজে সেটা মেনে নেবেন বলে বা মেনে নিতে পারেন—এ রকম কোনো আচরণ কিংবা আভাস তার মধ্যে এখন দেখা যাচ্ছে না।

এ রকম আরো অনেক কারণে ২০১৬ সালের নির্বাচনে যে একটি স্বাভাবিক পরিস্থিতি ছিল, ২০২০ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে সেই অবস্থার ‘মেঠো চরিত্র’ বলা যেতে পারে একেবারেই বদলে যাবে ও যাচ্ছে। শঙ্কা ও আশঙ্কা সেখানেও।

যে কারণে ৩ নভেম্বর যত কাছে আসছে, ততই একটা ভয়-ভীতি, আশা-আশঙ্কা ‘বাড়ছে’। 

কী হতে পারে, কেমন হতে পারে—এখনো এ ব্যাপারে কুয়াশা কাটেনি। যা কিছু এখন পর্যন্ত বিভিন্ন প্রচারমাধ্যমে বলা হচ্ছে, সবটাই কিন্তু ‘ধারণার’ বশবর্তী হয়ে একটা পূর্বাভাস দেয়া। প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রতিটা ব্যাপার এত বেশি অনিশ্চিত এবং এত বেশি মারমুখী যে শেষ পর্যন্ত কীভাবে কী ঘটবে—এ ভাবনাটা অনেককেই তাড়া করে বেড়াচ্ছে। এছাড়া ২০১৬ নির্বাচনের অভিজ্ঞতাও অনেকেই ভুলে যায়নি। সেই নির্বাচনেও অনেক পূর্বাভাস কিংবা আশা পূরণ হয়নি অনেকেরই।

এ রকম একটা শঙ্কা ও আশঙ্কার মধ্যে অনেকেই আছি আমরা। আজকের লেখায় দৃষ্টিপাত করব প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ক্ষমতায় ফিরে এলে কী কী হতে পারে। অথবা জো বাইডেন ক্ষমতায় এলে তার সামনে কী কী চ্যালেঞ্জ আসতে পারে, সেটাকে প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন কীভাবে দেখবেন অথবা মোকাবেলা করতে পারেন তার ওপর। 

এটাও একটা আশঙ্কা থেকে বলা বা লেখা। সে রকম কিছু হতে পারে আবার না-ও হতে পারে। প্রথমে দেখি প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প পুনরায় ক্ষমতায় এলে কী কী ঘটার সম্ভাবনা আছে:

১. ট্রাম্পের উগ্র মনোভাব ও দৃষ্টিভঙ্গি শক্তিশালী হবে: নভেল করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে বের হওয়ার পর ডোনাল্ড ট্রাম্প যেভাবে তার নির্বাচনী বিভিন্ন জনসভায় এই মহারোগ সম্পর্কে দায়িত্বহীন কথাবার্তা বলছেন, বাস্তবতা হচ্ছে নভেল করোনাভাইরাসে এ পর্যন্ত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে মৃত্যু হয়েছে দুই লাখের ওপরে।

এর প্রতি প্রেসিডেন্টের বিন্দুমাত্র কোনো সহানুভূতি কিংবা তেমন কোনো মনোযোগ একেবারেই দেখা যায়নি; কিন্তু দেখা গেছে এ বিষয়ে যারা বিশেষজ্ঞ এবং যারা সংশ্লিষ্ট, তাদের প্রতি অবজ্ঞা প্রকাশ করা, তাদের অসম্মান করা। তাদের অভিমতকেও ‘বোকাদের’ মত বলে প্রচার করা। ডাক্তার ফাউচিকেও ডোনাল্ড ট্রাম্প যা নয় তা বলছেন।  

প্রকাশ্যে নভেল করোনাভাইরাস নিয়ে ঠাট্টা-মশকরা করা। দৃষ্টিকটু অঙ্গভঙ্গি করা এবং দেখানো।

প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ক্ষমতায় ফিরে এলে এই দৃষ্টিভঙ্গি করোনা রোগের প্রতি এটাকে প্রতিরোধ করার চেয়েও তার এক ধরনের চ্যালেঞ্জ এবং ব্যঙ্গাত্মক প্রচার বাড়বে। অবজ্ঞা অব্যাহত থাকবে। করোনা পরিস্থিতির ভয়াবহতা বাড়বে বৈ কমবে না।

২.  অর্থনীতি ঝুঁকিপূর্ণ হতে পারে: নভেল করোনাভাইরাসের কারণে অর্থনীতির যে বিপর্যয় ঘটছে, সেই বিপর্যয় আরো বেশি ঘনীভূত হতে পারে। প্রকারান্তরে যা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতিতে প্রভাব ফেলবে নেতিবাচকভাবে। এ ব্যাপারে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অন্যতম ট্রাম্প ক্যাবিনেটের সদস্য (ট্রেজারি সেক্রেটারি) মানিউচিন (Manuchin) তার একটি সাম্প্রতিক কথায় বলেছেন,

‘We are in a very different situation that we were beforehand.’ নিউইয়র্ক টাইমস ম্যাগাজিন এর ওপরে মন্তব্যে লিখেছে, ‘his voice tinged with frustration and resignation. He was comparing the present moment to the state of things six months earlier, when the magnitude of the coronavairus pandemic in the U.S had just become apparent.’ 

এখনকার অবস্থা তো আরো ভয়াবহ। এরই মধ্যে মৃতের সংখ্যা দুই লাখের বেশি অতিক্রান্ত। এ রকম একটি ভাইরাস নিয়ে একটি দেশের প্রেসিডেন্টের অবহেলা ও অবজ্ঞা পরিস্থিতি সামাল দিতে সফল হতে পারে বলে কোনো নিকট সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে না। ফলে অর্থনীতি আরো বেশি ঝুঁকিপূর্ণ হতে পারে। বেকারত্বের সংখ্যা বাড়তে পারে। কর্ম সুযোগ কমে যেতে পারে। কেবল অর্থনৈতিক কিছু ‘স্টিমুলাস’ প্রোগ্রাম নিয়ে কোনো অর্থনীতিকে ভালো রাখা যায় না।

৩. বর্ণবৈষম্য বাড়বে, প্রকটও হবে: মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের গণতন্ত্রের প্রকৃতি এবং চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যগুলো আরো বেশি চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হতে পারে। 

কারণ মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প অধিকাংশ নাগরিক ও বিশেষজ্ঞের মতে একজন প্রচণ্ড বর্ণবিদ্বেষী মানুষ। গণতান্ত্রিক মনের না কোনো অর্থেই।

৪. গণতন্ত্র চ্যালেঞ্জের মুখে পড়বে: এর প্রক্রিয়াও বলতে গেলে শুরু হয়েছে ২০১৬ থেকে। ট্রাম্প বিশেষ করে বিচার বিভাগের ওপর এবং তার অন্তরীণ ও বৈদেশিক নানা বিষয়ের গোপনীয়তা রক্ষার ব্যাপারে এবং সাবধানতার পদক্ষেপ গ্রহণ করার ব্যাপারে একক ইচ্ছা ও দৃষ্টিকে প্রাধান্য দিচ্ছেন। ডোনাল্ড ট্রাম্প রাষ্ট্র পরিচালনায়ও কোনো রকম গণতান্ত্রিক শিষ্টাচারকে সম্মান না করে এক ধরনের করপোরেট স্টাইলে রাষ্ট্র পরিচালনা করেছেন এবং ভবিষ্যতে তা-ই করতে চেষ্টা করবেন আরো বেশি।

এ ব্যাপারেও নিউইয়র্ক টাইমসের একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘over less than four years in office, Trump has churned through four national security advisers, four white house chief of staff, two secretaries of defence, two secretaries of state and two attorney general.’  

এসবও অনেক দৃষ্টান্ত বলা যেতে পারে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের ‘একক আধিপত্য’ বিস্তারের প্রচেষ্টার নমুনাস্বরূপ।

৫. স্বৈরতান্ত্রিক আচরণ বাড়বে: প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প পুনরায় ক্ষমতায় ফিরে এলে অনেকে আশঙ্কা করছেন যে এতদিনকার যুক্তরাষ্ট্রের ‘লেজিসলেটিভ’, ‘জুডিশিয়ারি’ ও ‘এক্সিকিউটিভ’ ব্রাঞ্চের মধ্যে যে একটা ভারসাম্য এবং পরস্পরের স্বাধীনতার প্রতি পরস্পরের যে সম্মান এখনো কিছু আছে, এই জায়গাগুলো ভবিষ্যতে আরো বেশি ঝুঁকিপূর্ণ হবে নিজ নিজ ক্ষেত্রের দায়িত্ব পালনে।

সেখানেও প্রেসিডেন্ট তার একক ‘ক্ষমতা’ আরো বৃদ্ধি করে এক ধরনের অটোক্র্যাসি বা ব্যক্তিতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত করার জন্য চেষ্টা বা উদ্যোগ নিতে পারেন। অনেকে ভাবছেন প্রেসিডেন্টের দায়িত্বকালীন সময়কেও—এখন যে দুবার প্রেসিডেন্ট হওয়ার সুযোগ আছে—ট্রাম্প চেষ্টা করতে পারেন ‘তিন টার্মে’ করা যায় কিনা। অনেকে এটাও ভাবছেন যে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প সংবিধান থেকে ‘ইমপিচমেন্ট’ বলতে প্রেসিডেন্টকে ইমপিচ করার পদ্ধতিকেও চ্যালেঞ্জ করতে চাইবেন হয়তোবা।

এক কথায় প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প পুনরায় ক্ষমতায় ফিরে এলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দীর্ঘদিনের গণতন্ত্রচর্চার সংস্কৃতি বদলে যাবে। গণতন্ত্র তখন আরো নগ্নভাবে করপোরেটতন্ত্রে পরিণত হতে পারে।

৬. ট্রাম্প মতবাদ বা ট্রাম্প ইজম সৃষ্টি হতে পারে: মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাজনীতিতে ব্যক্তি আদর্শ কিংবা চিন্তা এ পর্যন্ত ব্যক্তির নামে কোনো ভূমিকা রাখেনি। যেমন চীনে মাওবাদ, রাশিয়ায় লেলিন মতবাদ, ভারতে গান্ধীবাদ। এ রকম কিছু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাজনীতিতে এখন পর্যন্ত সৃষ্টি হয়নি। তবে প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প যদি ফের ক্ষমতায় আসেন তাহলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সনাতন গণতান্ত্রিক চর্চা ভিন্নভাবে প্রবাহিত হওয়ার সম্ভাবনা আছে। 

ট্রাম্প চিন্তা, যেটাকে অন্যভাবে বলা যায় যুক্তরাষ্ট্রে উগ্র জাতীয়তাবাদী চিন্তা, ক্রিয়াশীল হতে পারে। সেটা ট্রাম্প দর্শন হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের ভবিষ্যৎ রাজনীতিকে প্রভাবিত করতে পারে কিনা বলা যায় না।

খ) জো বাইডেন ক্ষমতায় এলে কী হতে পারে 

১. নভেল করোনাভাইরাস ও অর্থনীতি: এর মোকাবেলার প্রশ্নে জো বাইডেন ক্ষমতায় গেলে কিছু ‘জনমুখী’ পদক্ষেপ নিতে পারবেন বলে অনেকেই মনে করেন। সেটা চট করেই অর্থনীতির ওপর তেমন কোনো ইতিবাচক ফল না আনতে পারলেও এই দুর্যোগ সময়কে মোকাবেলার প্রশ্নে কিছু ইতিবাচক পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে। যেটা করতে ব্যর্থ হয়েছেন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। এ ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্রের ফরেন অ্যাফেয়ারস পত্রিকার সেপ্টেম্বর-অক্টোবর ইস্যুতে Ben Rhode লিখেছেন, ‘if elected president Joe Biden will inherit a United States that has abdicated it's leadership role in the world and lost its claim to moral authority. He will also take the reins of a country still in the throes of a pandemic, still reeling from the economic fallout of the novel coronavirus, and still deeply polarized. 

This wreckage will excess even president Barack Obama's inheritance of a financial crisis and two foundering wars.

Biden and his team will have to find some way to reshape U.S Foreign Policy and revive the United States sense of its purpose in the world.’

উল্লিখিত মন্তব্যে সহজভাবে বোঝা যাচ্ছে জো বাইডেন প্রেসিডেন্ট হয়ে এলে নভেল করোনাভাইরাস মোকাবেলা করা তার একমাত্র প্রধান চ্যালেঞ্জ হবে না, বরং এর সঙ্গে অর্থনীতির সার্বিক পরিস্থিতির উন্নতি এবং বহির্বিশ্বে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইমেজকে একটি সম্মানজনক অবস্থানে ফিরিয়ে আনতে অনেক বেশি কাজ করতে হবে। জো বাইডেন প্রেসিডেন্ট হলে তার কাজের ফল ইতিবাচক হওয়ার সম্ভাবনা বেশি।

২. গণতন্ত্রের সুরক্ষা: প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের চেয়েও জো বাইডেন ক্ষমতায় আসতে পারলে এ ব্যাপারে অনেক বেশি ইতিবাচক ভূমিকা রাখতে পারবেন। একটি বড় কারণ পরমতসহিষ্ণুতা, ভদ্রতা, সৌজন্য ব্যবহার; রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা, প্রশাসনিক অভিজ্ঞতা এবং অন্যকে শোনার ব্যাপারে জো বাইডেনের মন ও মানসিকতা ট্রাম্পের চেয়ে অনেক বেশি ইতিবাচক। যেটা গণতন্ত্রে বা গণতান্ত্রিক সংস্কৃতিচর্চায় বড় ভূমিকা রাখে। 

আরেকটি কথা উল্লেখ না করলেই নয় যে ডেমোক্রেটিক দলের ভাইস প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী সিনেটর কামালা হ্যারিসকে জো বাইডেনের ভাইস প্রেসিডেন্ট করার সিদ্ধান্ত সফল হলে যুক্তরাষ্ট্রের রাজনীতিতে একটি গুণগত পরিবর্তন আসতে পারে। সেই পরিবর্তনটা হবে যুক্তরাষ্ট্রের প্রশাসনে প্রথম একজন নারী ভাইস প্রেসিডেন্ট আসবেন। নানা অর্থে এই পরিবর্তন যুক্তরাষ্ট্রের রাজনীতি ও গণতন্ত্রের মাঠ চরিত্রকে বদলে দেবে এবং ভবিষ্যৎ যুক্তরাষ্ট্রের রাজনীতিতে মেয়েদের অধিকার ও ক্ষমতার পরিসর বাড়াবে। 

৩. অভিবাসীদের প্রতি সহনশীলতা: জো বাইডেন প্রেসিডেন্ট হলে এ বিষয়টাকেও উগ্র কিংবা শ্রেণী, বর্ণ বা ধর্মীয় কোনো দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে বিচার করবেন না, যেটা প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প শুরু থেকেই করে আসছেন। আমরা জানলাম ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রশাসনের অভিবাসী নীতির প্রতি অশ্রদ্ধা ও অবজ্ঞার কারণে প্রায় ৫০০ ‘শিশু’ তার অভিভাবকদের কাছ থেকে একেবারে ‘বিচ্ছিন্ন’ হয়ে গেছে অবৈধ অভিবাসীদের প্রতি ট্রাম্প প্রশাসনের এই অমানবিক ও কঠোর অবস্থানের কারণে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অভিবাসী নীতি চট করে পরিবর্তন করা সম্ভব নয়। এর অন্যতম একটি কারণ, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বিভিন্ন ক্ষেত্র ও উত্পাদন প্রক্রিয়ার সঙ্গে লাখ লাখ অবৈধ অভিবাসী যুক্ত। তাদের অবদান কম নয় কিন্তু।

৪. আইন-শৃঙ্খলা: জো বাইডেন ক্ষমতায় এলে এক্ষেত্রেও যে ট্রাম্প প্রশাসনের বর্ণবিদ্বেষ চিন্তার এক ধরনের  মনোবৃত্তির বিকাশ ঘটছে, এর প্রতিকার সম্ভব হবে।

অন্যতম কারণ জো বাইডেন বর্ণ বা ধর্মবিদ্বেষী নন। দেশের প্রতিরক্ষা বাহিনী ও অভ্যন্তরীণ শৃঙ্খলা রক্ষার বাহিনীর প্রতিও জো বাইডেনের পেশাগত এবং মনস্তাত্ত্বিক সম্মানজনক দৃষ্টিভঙ্গি আছে, সেটা সমাজ ও রাষ্ট্রের কল্যাণে অনেক ইতিবাচক ভূমিকা রাখতে পারবে।

৫. বহির্বিশ্ব নীতি: বর্তমান প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প তার চার বছরের শাসনামলে যুক্তরাষ্ট্রের সামগ্রিক ‘ইমেজ’-কে বিশ্বে যেভাবে ‘হেয়’ করেছেন, আস্থাহীনতায় নিয়ে গেছেন এবং বর্তমান প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প বহির্বিশ্বে তার শত্রু যতটা বাড়িয়েছেন, বন্ধু সে তুলনায় বাড়াতে পারেননি; যার একটি নেতিবাচক প্রভাব যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতি ও অর্থনীতিকেও আরো বেশি সংকটের মধ্যে নিয়ে যেতে পারে। যদি ক্ষমতার পরিবর্তন না হয়। বহির্বিশ্বে এখন যুক্তরাষ্ট্রের বন্ধু সংখ্যা কমছে বলা যায়।

কোনো দেশের প্রতি অতিরিক্ত শ্রেণী বা ক্ষমতার স্বার্থসংক্রান্ত আচরণ প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন করবেন না বলে অধিকাংশ নাগরিক বিশ্বাস করেন। 

প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের কোনো দেশ সম্পর্কে যখন যা খুশি বলা কিংবা করা তার একনায়কতন্ত্র চরিত্রকে বেশি প্রমাণ করে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে একটা অর্থনৈতিক সহযোগিতা পাওয়া বা সেটা ফিরিয়ে আনা, যুদ্ধ থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে বিরত রাখা একমাত্র প্রমাণ সহায়ক না যে এগুলো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে বহির্বিশ্বে তার অতীত ঐতিহ্য, বিশেষ করে তার প্রতি যে ইতিবাচক ইমেজ আছে, সেটা রক্ষা করতে পারার প্রশ্নে।

এ রকম আরো অনেক কারণ উল্লেখ করা যেতে পারে যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে পুনরায় ডোনাল্ড ট্রাম্প ক্ষমতায় ফিরে এলে কেবল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নয়, সারা বিশ্বের সামগ্রিক অবস্থা—রাজনৈতিক, ভৌগোলিক ও অর্থনীতি—দারুণভাবে চ্যালেঞ্জের এবং বিপদের সম্মুখীন হতে পারে। ডোনাল্ড ট্রাম্পের নীতি, ‘সবার আগে আমেরিকা’ অথবা ‘মেড ইন আমেরিকা’।

এই ধারণা বর্তমান গ্লোবাল অর্থনীতি বা সামাজিক সম্পর্কোন্নয়নে সহায়ক ভূমিকা রাখে না। উল্লিখিত বিষয়ের দুশ্চিন্তা জো বাইডেন ক্ষমতায় এলে কমার সম্ভাবনা আছে। তবে ব্যক্তিগতভাবে মনে করি যে আগামী ৩ নভেম্বর নির্বাচনে এবার যে-ই ক্ষমতায় আসেন না কেন, ২০১৬ থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিজস্ব অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক রাজনীতির প্রশ্নে যে নেতিবাচক পরিবর্তনগুলো হয়েছে, সেই কারণেও যুক্তরাষ্ট্রের সামনের দিনগুলো অনেকটা কুয়াশাচ্ছন্ন অবস্থা থেকে রাতারাতি পরিবর্তন হবে বলে মনে হয় না।

রাজনীতিতে ডোনাল্ড ট্রাম্প যে নেতিবাচকতা, উগ্রতা, বর্ণবৈষম্য, বিভেদ দেখিয়েছেন এবং অর্থনীতির ক্ষেত্রে যে সৌভাগ্যদের প্রতি সহনশীলতা, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প করেছেন বা দেখিয়েছেন, এর ফল যুক্তরাষ্ট্রের পুরো সমাজ ব্যবস্থাকে অনেক ক্ষেত্রেই অস্থিতিশীল করেছে এবং ভবিষ্যতে আরো বেশি করে দিতেও পারে। জো বাইডেন সেটাকে কতটা সামাল দিতে পারবেন, এ মুহূর্তে বলা কঠিন।

২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর থেকে পুরো ভূরাজনীতি বা বিশ্ব রাজনীতি একটু একটু করে বদলাচ্ছে। বদলে গেছেও। এটা বিশ্ব রাজনীতির বর্তমান অবস্থা। এই অবস্থা বিশ্ব রাজনীতিকে একবিংশ শতাব্দীর আর্থসামাজিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রকেও অনেক বেশি অস্থিতিশীল ও স্বৈরতান্ত্রিক করে তুলেছে। বিশ্বে এখন ‘গণতন্ত্র’ সংখ্যায় আছে যতটা, কাজে-কর্মে নেই ততটা।

আর ২০১৬ থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ ও বহির্বিশ্ব নীতির রাজনীতি বদলে গেছে এক ধরনের বর্ণ শ্রেষ্ঠত্বের দাবি নিয়ে। এটাও বদলে দিয়েছে বিশ্ব রাজনীতির গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির চর্চাকে। সময়টাই এখন দুঃসময় বলা যায়। কে জানে কী হয়।

উল্লিখিত কারণ ছাড়াও অনেক বিষয় বিবেচিত হচ্ছে এ বিষয়টা নিয়ে বিভিন্ন মহলে, যেটা প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের স্বপক্ষে নয়। যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন রাজনীতি বিশ্লেষক, রাজনৈতিক অবজারভার, শিক্ষক, বিজ্ঞ বিশেষজ্ঞ—এদের অধিকাংশই মনে করেন যে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের ফলাফল এবার ডেমোক্র্যাটদের পক্ষে হলে চট করেই তেমন কিছু পরিবর্তন না হলেও অনেকটাই মন্দের ভালো হতে পারে। ডোনাল্ড ট্রাম্পের বিকল্প জো বাইডেন; কিন্তু জো বাইডেনের বিকল্প প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প নন। 

৩ নভেম্বরের নির্বাচনের ফল যা-ই হোক, মোটা অক্ষরে নিকট আশঙ্কা

ক) ক্ষমতার পরিবর্তন হবে কিনা?

খ) হলেও সেটা শান্তিপূর্ণ হবে কি?

গ) যদি কোনো বড় ধরনের সিভিল বিশৃঙ্খলা হয়, সেটা কতটা ভয়াবহ হতে পারে। 

ঘ) মার্কিন ‘উচ্চ আদালত’ নির্বাচনের ফলাফল নিয়ে যদি কোনো সমাধান দিতে বাধ্য হন, সেটা কেমন হতে পারে। সেক্ষেত্রে কংগ্রেসের ভূমিকা কী হবে, কতটা বা কেমন হবে। 

ঙ) ২০২১-এর ২০ জানুয়ারি নতুন প্রেসিডেন্টের শপথ অনুষ্ঠান কেমন হবে। কে নেবেন ‘শপথ’!

এ রকম ভাবনার একটা দোদুল্যমান অবস্থানে আছি আমরা অনেকে। যেটাই হোক, সেটা যেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের গণতন্ত্রকে আরো বেশি শক্তিশালী করতে পারে। তা না পারলে বিশ্ব পরিস্থিতির ভয়াবহতা কেমন হবে, কতটা ‘ভয়াবহ’ হতে পারে, কল্পনা করা কঠিন।

প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প সম্প্রতি বলেছেন, জো বাইডেন প্রেসিডেন্ট হলে তার নাকি দেশ ছাড়তে হবে। কথাটা খুব হালকাভাবে দেখার অবকাশ নেই কিন্তু। ট্রাম্প নিজেও জানেন হোয়াইট হাউজ থেকে সরে গেলে তার ব্যক্তিগত অবস্থাটা কতটা ঝুঁকিপূর্ণ এবং অনিশ্চিত হতে পারে। তাই তখন তিনি দেশ ছাড়বেন কিনা, চিন্তার বিষয় আছে। সেটা প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের কারণে ছাড়বেন, নাকি নিজের শেষ ‘রক্ষা’র জন্য ছাড়বেন, সময় বলে দেবে।

আসন্ন মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের শেষ বিতর্ক প্রতিযোগিতায় নতুন কোনো মেরুকরণ হয়েছে বলে মনে হয় না। এখন পর্যন্ত অনেকের ধারণা এই, ডেমোক্রেটিক দল বিজয়ী হতে পারে।

অবশ্যই এটা খুব জোর দিয়ে বলা যাচ্ছে না। অনেকের মনে এ আশঙ্কাটা জোট বাঁধছে এই বলে যে সাধারণ ভোটার বা নাগরিকদের স্বতঃস্ফূর্ত সমর্থনটা ডোনাল্ড ট্রাম্প থেকে একটু একটু করে সরে আসছে বলে মনে হয়। প্রধান কারণ, ট্রাম্পের ঔদ্ধত্য আচরণ এবং ধারাবাহিক মিথ্যাচারিতা।

মিথ্যাচারণ করা এবং নানা রকম অপ্রীতিকর ও অশোভন বডি পলিটিকস ডোনাল্ড ট্রাম্পের এক ধরনের স্ট্যাট্রিজি। প্রতিপক্ষকে মানসিকভাবে অনেকটা হিংস্র বাঘের মতো ছিঁড়ে ফেলা। এর ফল খুব একটা শুভ হয় কি? আর যা-ই বলি না কেন, যুক্তরাষ্ট্রের গণতন্ত্রের বৈশিষ্ট্য এটা নয়। ট্রাম্প নিজেকে রাজনীতিবিদ না বললেও তিনি রাজনীতি নিয়ে যে নোংরা খেলা খেলছেন, তার পরিণতিতে যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ শৃঙ্খলা এবং বহির্বিশ্বে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সামাজিক ও সামরিক আস্থা নষ্ট করার বা হারানোর অনেক সম্ভাবনা আছে যদি ডোনাল্ড ট্রাম্প আবার ক্ষমতায় ফিরে আসেন।

তেমন কিছু ঘটলে ডেমোক্র্যাট দলের আগামী কংগ্রেস এবং সিনেটে সংখ্যাগরিষ্ঠ সংখ্যা অর্জন করতে হবে। ডোনাল্ড ট্রাম্পের ‘অটোক্র্যাসি’ এবং দুঃশাসনের মুক্তির নিয়মতান্ত্রিক আর কোনো পথ খোলা থাকবে বলে মনে হয় না। 

আরেকটি আশঙ্কা আছে, যেটাও না বলল নয়। এবার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ডোনাল্ড ট্রাম্প যদি পরাজিত হন তাহলেও যুক্তরাষ্ট্রের রাজনীতির মেঠো পথ ২০১৬ পর্যন্ত যেমন ছিল, সেটা পরিবর্তন হতে পারে। অথবা যদি ট্রাম্প বিজয়ী হন তাহলে যুক্তরাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক রাজনীতি বদলে যেতে পারে দ্রুত।

পাশাপাশি যদি ধরে নিই, ডেমোক্রেটিক দল প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে বিজয়ী হবে, সেক্ষেত্রেও জো বাইডেনকে প্রচুর ঝুঁকি ও সংকটের মুখে পড়তে হবে গত চার বছর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাজনীতির অভ্যন্তরীণ যে দিকদর্শন বদলেছে, সেটা সামাল দিতে।

এ রকম ঝুঁকি এবং সমস্যা কেবল অভ্যন্তরীণ সংকট মোকাবেলায়ই জো বাইডেনকে সমস্যার মুখোমুখি করবে না, যুক্তরাষ্ট্রের বহির্বিশ্ব নীতি ফরেন পলিসি নিয়েও বাইডেনকে সমস্যা সমাধানের নতুন দিগন্ত উন্মোচন করতে হতে পারে। 

২০১৬ সালের মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র গত চার বছরে কোথায়, কোথায় কতটা ‘ক্যান্সারে’ আক্রান্ত হয়েছে, এ মুহূর্তে সেটাও বলা কঠিন।

এই আলোচনায় আরো অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় বলা হয়নি, যেমন পরিবেশ সংকট আগামীতে কেমন হতে পারে; অবৈধ অভিবাসীদের ভাগ্যে কী ধরনের দুর্যোগ আসতে পারে; যুক্তরাষ্ট্রের আগামী অর্থনৈতিক ভবিষ্যত্ কতটা কোথায় ঝুঁকির মুখে পড়তে পারে; যুক্তরাষ্ট্রে ক্ষমতার ভারসাম্য বজায় রাখতে এর লেজিসলেটিভ, জুডিশিয়ারি ও এক্সিকিউটিভ বিভাগ নিজ নিজ পরিধির সার্বভৌমত্ব কতটা অক্ষুণ্ন রাখতে পারে।  

আগামী প্রেসিডেন্ট যেই হোন না কেন, তাকে এ সমস্যাগুলো নিয়ে নানা রকম জটিলতার মুখে পড়ার সম্ভাবনা আছে।

পৃথিবীর বিভিন্ন রাষ্ট্র তার অভ্যন্তরীণ আর্থসামাজিক ও বৈদেশিক সম্পর্কে প্রতিদিনই এখন নানা রকম সমস্যা ও সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। একদিকে বিশ্বে মুক্ত অর্থনীতির নামে অসম বাজার প্রতিযোগিতা, অন্যদিকে গণতন্ত্রের নামে ব্যক্তিতান্ত্রিকতা অথবা অটোক্র্যাসি শক্তিশালী হচ্ছে। ফলে উত্পাদনের অসম বণ্টন, দারিদ্র্য এবং নানা ধরনের বৈষম্য ও অভাবের সঙ্গে অপ্রতুল প্রাচুর্যের প্রতিদিনের লড়াই কেবল প্রতারণার পথে অগ্রসর হচ্ছে।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বে তার প্রভাব ও শক্তিকে বজায় রাখতে গেলে নতুন করে বিশ্ব সমাজ দর্শন সাজাতে হবে বলেও মনে হচ্ছে।

গুরুত্বপূর্ণ বিবেচনা: ২০২০ সালের মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের একটি গুরুত্বপূর্ণ বিবেচনা এটা নয় যে লড়াইটা কেবল ডেমোক্র্যাট ও রিপাবলিকান এই দুইয়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ। এর ব্যাপকতা আরেকটু বেশি।

২০২০ সালের মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে এক অর্থে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জনসাধারণকে নিজেদের সিদ্ধান্ত নিজেদেরই নিতে হবে, যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকরা আগামী যুক্তরাষ্ট্রকে সামনে কীভাবে দেখতে চান।

যুক্তরাষ্ট্র কি আগামীতে নর্থ কোরিয়ার ‘ডোনাল্ড ট্রাম্প’ এডিশন হবে, নাকি প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ফিরে এলে তিনি রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট পুতিনের রেপ্লিকা হবেন; নাকি চীনের আমৃত্যু প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং তার আরেক রূপ হবে; নাকি আব্রাহাম লিংকনের গণতন্ত্র থাকবে বা সেটা প্রতিষ্ঠিত হবে। মার্টিন লুথার কিংয়ের শান্তিপূর্ণ সামাজিক সহাবস্থানের দেশ হবে। ৩ নভেম্বর, ২০২০ যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে এ বিষয়গুলো মাথায় রেখেই দেশটির নাগরিকরা তাদের ভবিষ্যত্ বিনির্মাণ করবেন। সিদ্ধান্ত কেবল ভোটারদেরই নয়, এই রাষ্ট্রের প্রতিটা গণতান্ত্রিক ইনস্টিটিউশনের সমান দায়িত্ব এবং বিষয়টাকে অগ্রাধিকারে গুরুত্ব দেয়ার প্রশ্নে। 

যা-ই হোক, সাধারণ নাগরিক হিসেবে প্রত্যাশা কোনো পরিবর্তন সব মানুষের সুপরিবর্তনে শক্তি হিসেবে ভূমিকা রাখতে পারে যেন। শ্রেণী, বর্ণ, ধর্ম, বিদ্বেষ কিংবা অবজ্ঞা এবং অগণতান্ত্রিক কিছু যেন যুক্তরাষ্ট্রের রাজনীতির ভবিষ্যৎ নেতৃত্বকে প্রভাবিত না করে। 

যেকোনো ক্ষমতাকে জোর করে কিংবা অন্য কোনো কৌশলে ধরে রাখা যেতেও পারে। তার শেষ পরিণতি কতটা ভয়ংকর এবং ভয়াবহ হতে পারে, ইতিহাসে এ রকম বহু দৃষ্টান্ত আছে। ইতিহাসের নির্মম হিসাব বর্তমানের অংক দিয়ে বোঝা বড় কঠিন।

উল্লিখিত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে উপসংহারে বলা যেতে পারে, ২০২১ সালের শুরুতেই বোঝা যাবে অথবা অনুমান করা যেতে পারে যুক্তরাষ্ট্র যাবে কোন পথে আগামীতে। সেই পথ মানবসভ্যতার কোনো সুসম্ভাবনা কিংবা কোনো দুরাশা বাড়াবে কিনা। শুধু যুক্তরাষ্ট্রের একার নয়, যেহেতু অপ্রিয় হলেও এটা সত্য যে এখন পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রের সামাজিক, অর্থনৈতিক, বৈদেশিক নীতি এবং সামরিক শক্তি বিশ্ব ব্যবস্থাপনা বিশেষ করে এর আর্থসামাজিক ও রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে প্রভাব ফেলে, তাই যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন একটি গুরুত্বপূর্ণ বিশ্ব বিবেচনা।

২০২১ সালের নতুন প্রেসিডেন্ট এবং তার নেতৃত্ব অনেকটাই স্পষ্ট করে দেবে বিশ্ব রাজনীতি এবং যুক্তরাষ্ট্রের ভবিষ্যৎ রাজনীতি কার পক্ষে, কার বিপক্ষে যাবে।

মাহমুদ রেজা চৌধুরী: সমাজ ও রাষ্ট্রনীতি বিশ্লেষক

নিউইয়র্ক

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন