বাংলাদেশী কোম্পানির বিদেশে বিনিয়োগ

বাংলাদেশ ব্যাংক বলছে ৩০ কোটি, আন্তর্জাতিক তথ্য ৩০০ কোটি ডলার

বদরুল আলম

দেশীয় কোম্পানি বিদেশে বিনিয়োগ করলে তাকে বলা হয় ‘আউটওয়ার্ড ডিরেক্ট ইনভেস্টমেন্ট’। বাংলাদেশের কোনো প্রতিষ্ঠান বিদেশে বিনিয়োগ করতে চাইলে তাকে বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমোদন নিতে হয়। এ প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে আকিজ, ডিবিএল, স্কয়ার, এমজেএলসহ বেশকিছু শিল্প গ্রুপ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে আনুষ্ঠানিক বিনিয়োগ করেছে। এর বাইরে অনানুষ্ঠানিক পন্থায় দেশীয় উদ্যোক্তাদের বিদেশে বিপুল পরিমাণ বিনিয়োগ করার বিষয়টিও কারোরই অজানা নয়। অনানুষ্ঠানিকভাবে অনেক প্রতিষ্ঠানই বিদেশে বিনিয়োগ করেছে, যেগুলোর তথ্য সরকারি সংস্থার কাছে নেই। 

বাংলাদেশ ব্যাংক এখন পর্যন্ত বিদেশে বাংলাদেশীদের ৩০ কোটি ডলার বিনিয়োগের তথ্য দিলেও আন্তর্জাতিক তথ্য বলছে, প্রকৃতপক্ষে তা অন্তত ১০ গুণ বেশি। প্রতি বছরের মতো চলতি বছরের গত ৯ সেপ্টেম্বর ‘২০২০ ইনভেস্টমেন্ট ক্লাইমেট স্টেটমেন্ট’ শীর্ষক প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের ব্যুরো অব ইকোনমিক অ্যান্ড বিজনেস অ্যাফেয়ার্স। সেখানে দেখানো হয়েছে, দেশের বাইরে বাংলাদেশী উদ্যোক্তাদের আউটওয়ার্ড ডিরেক্ট ইনভেস্টমেন্টের পরিমাণ ২০১৮ সালের ডিসেম্বরেই ছিল ৩০৭ কোটি ৫০ লাখ ডলার। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি বিনিয়োগ গিয়েছে চীনে, যা মোট বিনিয়োগের ২১ দশমিক ৬৯ শতাংশ। দেশটিতে ৬৬ কোটি ৭০ লাখ ডলার বিনিয়োগ গিয়েছে বাংলাদেশ থেকে। চীনের পরে বিনিয়োগ প্রবাহ ছিল নেদারল্যান্ডসে। দেশটিতে ৬৪ কোটি ৯০ লাখ ডলার বিনিয়োগ করেছেন বাংলাদেশীরা, যা মোট বিনিয়োগের ২১ দশমিক ১১ শতাংশ। বিনিয়োগের তৃতীয় শীর্ষ গন্তব্য হলো দক্ষিণ কোরিয়া। দেশটিতে ৫৬ কোটি ৪০ লাখ ডলার বিনিয়োগ গিয়েছে বাংলাদেশ থেকে, যা মোট বিনিয়োগের ১৮ দশমিক ৩৪ শতাংশ। চতুর্থ ও পঞ্চম শীর্ষ গন্তব্য হিসেবে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র ও থাইল্যান্ডের নাম। দেশ দুটিতে বাংলাদেশীদের বিনিয়োগের পরিমাণ যথাক্রমে ৫১ কোটি ৩০ লাখ ও ৩০ কোটি ৬০ লাখ ডলার। 

শীর্ষ এ পাঁচটি দেশ ছাড়াও ইথিওপিয়া, সিঙ্গাপুর, সংযুক্ত আরব আমিরাত, মালয়েশিয়া, কাতার, যুক্তরাজ্য, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড ও হংকংয়ের মতো দেশগুলোতেও বাংলাদেশীদের বিনিয়োগ রয়েছে। বাংলাদেশ থেকে বিনিয়োগ গিয়েছে আফ্রিকায়ও।

আফ্রিকার দেশ ল্যান্ড লকড ইথিওপিয়ায় কোনো সমুদ্রবন্দর নেই। ঘাটতি রয়েছে দক্ষ শ্রমিকের। দেশটির মোট পোশাক রফতানির পরিমাণ বাংলাদেশের বড় কোনো একক কারখানার চেয়েও কম। তার পরও এমন একটি দেশে পোশাক কারখানা স্থাপন করেছে বাংলাদেশের দুলাল ব্রাদার্স লিমিটেড বা ডিবিএল গ্রুপ। বাংলাদেশের বাইরে ডিবিএল গ্রুপ আনুষ্ঠানিক বিনিয়োগটি বাস্তবায়নে বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমোদন পায় ২০১৫ সালে। 

ইথিওপিয়ায় ডিবিএল গ্রুপের বিনিয়োগটি ছিল দেশের বাইরে সরকার অনুমোদিত বিনিয়োগ। তবে দেশটিতে বাংলাদেশী বিনিয়োগকারীদের আরো বিনিয়োগ আছে বলে জানিয়েছেন বাংলাদেশী বিনিয়োগকারীসহ সেখানে কর্মরত বাংলাদেশের সরকারি কর্মকর্তারা। তবে এসব বিনিয়োগ অনানুষ্ঠানিক পথে বাস্তবায়ন হয়েছে।

মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের প্রতিবেদনে উঠে আসা বিনিয়োগ তথ্যের বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে ওই পরিসংখ্যান সম্পর্কে অবগত নন বলে জানিয়েছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা। তাই এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে অপারগতা প্রকাশ করেছেন তারা। তবে তারা এও বলছেন, বাংলাদেশে আসা বিদেশী বিনিয়োগ প্রবাহের বার্ষিক গড় সাকল্যে কমবেশি ৩ বিলিয়ন ডলার। সেখানে আউটওয়ার্ড ইনভেস্টমেন্টের পরিমাণ ৩ বিলিয়ন ডলারের বেশি, এমন তথ্য হতবাক হওয়ার মতো। 

নাম প্রকাশ না করার শর্তে বাংলাদেশ ব্যাংকের একজন কর্মকর্তা বণিক বার্তাকে বলেন, চলতি ২০২০ সালের জুন মাস পর্যন্ত বাংলাদেশের আউটওয়ার্ড ডিরেক্ট ইনভেস্টমেন্ট স্টক ৩০ কোটি ৬৯ লাখ ডলার। তবে অনানুষ্ঠানিকভাবে অনেক বাংলাদেশী বিদেশে বিনিয়োগ করেছেন বলে তথ্য আসে আমাদের কাছে।

গুঞ্জন যা-ই থাকুক বাংলাদেশ ব্যাংক বলছে, বাংলাদেশ থেকে অর্থ স্থানান্তর করে বাংলাদেশী উদ্যোক্তাদের জন্য বিদেশের মাটিতে বিনিয়োগের সুযোগ এখনো সীমিত। বিদেশী মুদ্রা বিনিময়সংক্রান্ত আইন এফইআরএ বা ফেরা অনুসরণ করে কেস-টু-কেস ভিত্তিতে বাংলাদেশের বাইরে বিনিয়োগের সুযোগ পাচ্ছেন বাংলাদেশী উদ্যোক্তারা। এখন পর্যন্ত আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দিয়ে দেশের বাইরে বিনিয়োগ করা প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে আছে ২০১৩ সালে মিয়ানমারে অনুমোদন পাওয়া এমজেএল। এরপর ২০১৭ সালে মালয়েশিয়ায় রবিন সিসোর্স নামে একটি কোম্পানি কিনে নিতে বিনিয়োগ করে আকিজ গ্রুপ। আবার আনুষ্ঠানিক অনুমোদন নিয়ে ২০১৮ কেনিয়ায় ওষুধ উৎপাদনের কারখানা নির্মাণ শুরু করে স্কয়ার।

মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের তথ্য সঠিক কি সঠিক নয়, এমন বিষয়ে মন্তব্য করতে চাননি সরকারি সংস্থা বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (বিএফআইইউ) কর্তাব্যক্তিরাও। তারা বলছেন, আনুষ্ঠানিকভাবে কেস টু কেস ভিত্তিতে অল্প কিছু প্রতিষ্ঠানকে বাংলাদেশ থেকে আউটওয়ার্ড ডিরেক্ট ইনভেস্টমেন্টের সুযোগ দেয়া হয়েছে। বাংলাদেশে ক্যাপিটাল অ্যাকাউন্ট এখনো কনভার্টেবল না। ফরেন এক্সচেঞ্জ রিজার্ভের ওপর চাপ পড়ার আশঙ্কা থেকেই সুযোগটি এখনো অবারিত না। তবে নীতিমালার মাধ্যমে দেশের বাইরে বিনিয়োগকে নীতিকাঠামো দেয়ার চেষ্টা চলছে। 

বিএফআইইউ প্রধান বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর আবু হেনা মোহা. রাজী হাসান বণিক বার্তাকে বলেন, দেশের বাইরে আনুষ্ঠানিক ও অনানুষ্ঠানিক বিনিয়োগ প্রবাহ নিয়ে একটি স্টাডি করার পরিকল্পনা আমাদের আছে। ইলিসিট ফ্লো অব ফান্ড নিয়ে ওয়ার্ল্ড ব্যাংকের কারিগরি সহায়তায় একটি স্টাডি হওয়ার কথা ছিল। তা পরে আর হয়ে ওঠেনি। আমরা এখন স্থানীয়ভাবে গবেষণা করে এমন প্রতিষ্ঠানের সহায়তায় বাংলাদেশী প্রতিষ্ঠানের বিদেশে বিনিয়োগ নিয়ে একটি স্টাডি করার কাজ চলছে। বর্তমানে একটি নীতিমালা তৈরির বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন।

আনুষ্ঠানিক পথে বাংলাদেশের বাইরে বিনিয়োগের আগ্রহ রয়েছে এমন প্রতিষ্ঠানও আছে অনেক। অনেক প্রতিষ্ঠান আছে যারা এক বা একাধিকবার আবেদন করেও দেশের বাইরে বিনিয়োগের অনুমোদন পায়নি। অনুমোদন পায়নি এমন প্রতিষ্ঠানের মধ্যে রয়েছে প্রাণ-আরএফএল গ্রুপ, হা-মীম গ্রুপ, নিটল-নিলয়, অনন্ত গ্রুপ ও এনার্জিপ্যাক।

এদিকে নাম প্রকাশ না করার শর্তে দেশের বাইরে বাংলাদেশীদের অনানুষ্ঠানিক বিনিয়োগের বিষয় অস্বীকার করেননি বাংলাদেশের ব্যবসায়ী সমাজের প্রতিনিধিরা। তবে এ বিষয়ে সুনির্দিষ্ট তথ্য দিতে অপারগতা জানিয়েছেন তারা। জানতে চাইলে ফেডারেশন অব বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (এফবিসিসিআই) সহসভাপতি মো. সিদ্দিকুর রহমান বণিক বার্তাকে বলেন, দেশীয় উদ্যোক্তাদের মাধ্যমে দেশের বাইরে অনানুষ্ঠানিক বিনিয়োগের কোনো তথ্য আমার কাছে নেই। তবে বাংলাদেশের বাইরে বিনিয়োগের সুযোগ উন্মুক্ত করা এখন সময়ের প্রয়োজন। 

বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিডা) নির্বাহী চেয়ারম্যান সিরাজুল ইসলাম বণিক বার্তাকে বলেন, বাংলাদেশের বাইরে বিনিয়োগ করার বিষয়টি পৃষ্ঠপোষকতা বিডার এখতিয়ারে নেই। তবে বাংলাদেশের বাইরে বিনিয়োগের সুযোগ করে দেয়ার বিষয়ে আলোচনা চলছে। এ-সংক্রান্ত কমিটির একাধিক সভাও অনুষ্ঠিত হয়েছে। সভায় আফ্রিকার দেশগুলোয় অব্যবহূত জমিতে কৃষি খাতে বাংলাদেশের বিনিয়োগের সম্ভাবনা নিয়ে আলোচনা হয়েছে।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন