বিশ্বব্যাপী আখ ও সুগার বিটের উৎপাদন এবার বেড়েছে। এ কারণে ২০২০-২১ মৌসুমে বিশ্বব্যাপী এবার চিনির উৎপাদনও বাড়বে। ফলে বৈশ্বিক বাজারে এ মৌসুমে চিনির কিছুটা উদ্বৃত্ত থাকবে বলে মনে করছে নেদারল্যান্ডসের বহুজাতিক বিনিয়োগ ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান রাবো ব্যাংক। সম্প্রতি প্রতিষ্ঠানটি থেকে প্রকাশিত চিনির বাজারের প্রান্তিক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানানো হয়েছে। খবর ইকোনমিক টাইমস।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্রে আর কিছুদিনের মধ্যে আখ ও সুগার বিট সংগ্রহ শুরু হবে। অন্যদিকে অস্ট্রেলিয়া ও ব্রাজিলে এরই মধ্যে ফসল সংগ্রহ শুরু হয়েছে। ফসল আবাদের পরিমাণ বৃদ্ধি পাওয়ায় ব্যাংকটি তাদের ২০১৯-২০ মৌসুমে দেয়া প্রাক্কলন থেকে সরে এসেছে।
রাবো ব্যাংকের প্রান্তিক প্রতিবেদনে আরো বলা হয়েছে, ২০২০-২১ মৌসুমে চিনির আন্তর্জাতিক বাজার কিছুটা নিম্নমুখী থাকবে। কারণ এ সময়ে বৈশ্বিক বাজারে ব্রাজিল ইথানল উৎপাদনে জোর দিচ্ছে। অন্যদিকে ভারত আন্তর্জাতিক বাজারে চিনির সরবরাহ বাড়াবে।
এর আগের প্রাক্কলনে বলা হয়েছিল, ২০১৯-২০ উৎপাদন মৌসুমে (অক্টোবর-সেপ্টেম্বর) বিশ্বব্যাপী ১০ লাখ টনের মতো অপরিশোধিত চিনির ঘাটতি থাকতে পারে, যেখানে আগের মৌসুমে অপরিশোধিত চিনির ঘাটতির পরিমাণ ছিল ৪৩ লাখ টন। তবে ব্রাজিলে এবার আখ ও সুগার বিট আবাদে বাম্পার ফলন হওয়ায় উৎপাদন বেশি থাকবে। এছাড়া আগের মৌসুমে চিনির ব্যবহার ১ দশমিক ৫ শতাংশ কম থাকায় এ মৌসুমে পণ্যটির উদ্বৃত্ত থাকতে পারে।
এদিকে ২০২০-২১ মৌসুমকে কেন্দ্র করে আন্তর্জাতিক বাজারে চিনির ব্যবহার বাড়বে বলে মনে করছে রাবো ব্যাংক। এ কারণে বাড়তি উৎপাদন হলেও এ সময়ে বিশ্বব্যাপী খুবই অল্প পরিমাণ চিনি উদ্বৃত্ত থাকতে পারে। এ সময়ে উদ্বৃত্তের পরিমাণ দাঁড়াতে পারে দুই লাখ টনের মতো, যার অধিকাংশ আবার ভারত, থাইল্যান্ড, ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও নাফটাভুক্ত দেশগুলোর অতিরিক্ত সরবরাহের কারণে উদ্বৃত্ত থাকবে।
রাবো ব্যাংকের বিশ্লেষক চার্লস ক্লার্ক মনে বলেন, চলতি মৌসুমে চিনির উৎপাদন বাড়লেও এ সময়ে ব্যবহারের পরিমাণও আগের মৌসুমের তুলনায় বাড়বে। ফলে ব্যবহার ও উৎপাদন বৃদ্ধির মধ্যে ভারসাম্য এসে উদ্বৃত্তের পরিমাণ প্রত্যাশার তুলনায় কমে আসবে। কারণ করোনা মহামারীকে কেন্দ্র করে মানুষের খাদ্যাভ্যাসে যে পরিবর্তন এসেছে সেটি এ মৌসুমে আবার স্বাভাবিক হয়ে যেতে পারে।
এদিকে এবার অস্ট্রেলিয়ায় চিনির উৎপাদন বৃদ্ধির পূর্বাভাস দিয়ে রাবো ব্যাংক তাদের প্রতিবেদনে বলছে, দেশটিতে আখের মাড়াই এখন পুরোদমে চলছে। সেপ্টেম্বরের শেষ পর্যন্ত দেশটির ৬২ শতাংশ আখ কাটা হয়ে গেছে। সাপ্তাহিক হিসাবে দেশটিতে ১৫ লাখ টনের বেশি আখ মাড়াই করা হচ্ছে, যা আগে মৌসুমগুলোর তুলনায় অনেক বেশি।
এদিকে চলতি মৌসুমে ভারতে চিনির উৎপাদন ১৩ শতাংশ বাড়বে বলে জানিয়েছে দেশটির চিনি ব্যবসায়ীদের সংগঠন ইন্ডিয়ান সুগার মিলস অ্যাসোসিয়েশন (ইসমা)। সংগঠনটি বলছে, ২০২০-২১ মৌসুমে ভারতে ৩ কোটি ১০ লাখ টনের মতো চিনি উৎপাদিত হতে পারে। মূলত দেশটিতে এবার আখার আবাদ ভালো হওয়ায় চিনির উৎপাদন বৃদ্ধির প্রত্যাশা করছে সংগঠনটি।
এর আগে ২০১৯-২০ মৌসুমে ভারতে চিনি উৎপাদন হয়েছিল ২ কোটি ৭৪ লাখ ২০ হাজার টনের মতো। ফলে এ মৌসুমে দেশটিতে আগের উদ্বৃত্তের সঙ্গে এবার বাড়তি উৎপাদন যোগ হয়ে উদ্বৃত্তের পরিমাণ বেড়ে যাবে। এ কারণে চলতি মৌসুমে উদ্বৃত্ত কমাতে দেশটি আন্তর্জাতিক বাজারে ৬০ লাখ টন চিনি রফতানির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে।
ইসমা বলছে, এবার আখের আবাদ বৃদ্ধি পাওয়ায় আগের মৌসুমের তুলনায় চিনির উৎপাদন আরো বেশি হওয়ার কথা। কিন্তু এবার ইথানল উৎপাদনের পরিমাণ বাড়ানো হয়েছে। ফলে আগের উৎপাদনের বিপরীতে চিনি উৎপাদন কম হচ্ছে।
ভারতের সবচেয়ে বেশি চিনি উৎপাদন হয় উত্তর প্রদেশে। ইসমার আগাম প্রাক্কলন অনুযায়ী, রাজ্যটিতে এবার চিনি উৎপাদন কমে আসতে পারে। এ মৌসুমে রাজ্যটিতে চিনি উৎপাদনের লক্ষ্য ধরা হয়েছে ১ কোটি ২৪ লাখ ৫০ হাজার টন, যেখানে আগের মৌসুমে উৎপাদনের পরিমাণ ছিল ১ কোটি ২৬ লাখ ৩০ হাজার টন।
অন্যদিকে ভারতের দ্বিতীয় শীর্ষ চিনি উৎপাদন রাজ্য মহারাষ্ট্রে এবার উৎপাদন কিছুটা বাড়বে বলে মনে করছে ইসমা। সংগঠনটি বলছে, এ মৌসুমে রাজ্যটিতে চিনির উৎপাদন বেড়ে ১ কোটি আট লাখ টনে দাঁড়াতে পারে, যেখানে আগের মৌসুমে রাজ্যটিতে উৎপাদনের পরিমাণ ছিল ৬১ লাখ ৬০ হাজার টনের মতো।
এদিকে এ মৌসুমে ভারতের চিনি উৎপাদন বৃদ্ধিতে আন্তর্জাতিক বাজারে বড় প্রভাব ফেলতে পারে। বিশেষ করে অন্যতম শীর্ষ উৎপাদক ব্রাজিলের বাজার হারানোর শঙ্কা আরো বাড়বে। গত বছর দেশটি বৈশ্বিক বাজারে ভারতের অন্যায্য চিনি সরবরাহ বাড়ানোর কথা উল্লেখ করে আন্তর্জাতিক বাণিজ্য সংস্থার (ডব্লিউটিও) কাছে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ জানায়। উদ্বৃত্ত মজুদ কমাতে ভারত চিনি রফতানিতে ভর্তুকি সুবিধা দেয়ায় দেশটির রফতানি বেড়েছে। ফলে বৈশ্বিক বাজারে উদ্বৃত্ত সরবরাহে চিনির দাম দুই বছরে ২০ শতাংশের বেশি কমেছে বলে অভিযোগ ব্রাজিলের। যদিও গত বছরের শেষের দিকে বাজার কিছুটা চাঙ্গা হয়েছে।
রাবো ব্যাংক বলছে, চিনি রফতানিতে ভারতের ভর্তুকির ফলে প্রধান প্রধান উৎপাদক দেশ ক্ষুব্ধ হয়েছে, যা মীমাংসায় ডব্লিউটিও পর্যন্ত গড়িয়েছে। তবে এ বিষয়ে এখনো কোনো সমাধান না হওয়ার মধ্যেই ভারত আবারো উল্লেখযোগ্য পরিমাণে চিনি রফতানি করতে পারে, যা ইসমার লক্ষ্যমাত্রায়ও উঠে এসেছে।