বিইসিএ চুক্তি সই হচ্ছে আজ

দ্বিতীয় স্নায়ুযুদ্ধের কৌশল আঁটছে ভারত-যুক্তরাষ্ট্র?

বণিক বার্তা ডেস্ক

মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাইক পম্পেও গতকালই এক সফরে ভারত এসে পৌঁছেছেন। মাইক পম্পেও মার্কিন প্রতিরক্ষামন্ত্রী মার্ক এসপারের আজই ভারতীয় পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শংকর প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ সিংয়ের সঙ্গে টু প্লাস টু সম্মেলনের আলোচনায় বসার কথা রয়েছে। এছাড়া তারা ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে এক সৌজন্য সাক্ষাৎ করতেও যেতে পারেন বলে দেশটির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক খসড়া সফরসূচি সূত্রে জানা গিয়েছে।

সফরসূচি অনুযায়ী, এর পরই শ্রীলংকা, মালদ্বীপ ইন্দোনেশিয়া সফরে যাবেন মাইক পম্পেও। দেশগুলোর প্রতিটিতেই আধিপত্য বিস্তার নিয়ে চীনের সঙ্গে ভারত যুক্তরাষ্ট্রের বড় ধরনের বিরোধ রয়েছে। পম্পেওর পাঁচদিনের এশিয়া সফর শেষ হচ্ছে ইন্দোনেশিয়ায়। দক্ষিণ চীন সাগরে বেইজিংয়ের উপস্থিতি জোরালো হয়ে ওঠায় যে কয়টি দেশ মারাত্মকভাবে শঙ্কিত হয়ে উঠেছে, তার মধ্যে ইন্দোনেশিয়াও অন্যতম।

বৈশ্বিক পরিমণ্ডলে চীনের ক্রমবর্ধমান প্রভাব যে ডোনাল্ড ট্রাম্পকে বিচলিত করে তুলেছে, তা এখন স্পষ্ট। কারণেই দেশটির বিরুদ্ধে শক্তিশালী জোট গড়ে তুলতে রীতিমতো মরিয়া হয়ে উঠেছে ট্রাম্প প্রশাসন। বিশেষ করে ভারতকে জোটে কাছে টানতে কোনো প্রয়াসেরই কোনো কমতি রাখছে না ওয়াশিংটন। বর্তমান পরিস্থিতিকে আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকরা তুলনা করছেন সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যকার স্নায়ুযুদ্ধের সঙ্গে। সুপারপাওয়ারগুলোর বৈরিতাকে অনেকেই আখ্যা দিচ্ছেন দ্বিতীয় স্নায়ুযুদ্ধ হিসেবে। 

মার্কিন প্রশাসনের দুই শীর্ষ কর্তাব্যক্তির চলমান সফরের মূল উদ্দেশ্যও যে চীনকে মোকাবেলা, সে বিষয়ে কোনো রাখঢাক নেই পম্পেওর। তার ভাষ্যমতে, ভারত সফর চলাকালে তিনি যে বৈঠকগুলোয় বসবেন, সেসব আলোচনার বিষয়বস্তু হবে সংশ্লিষ্ট দেশগুলো কীভাবে চীনা হুমকি মোকাবেলায় একসঙ্গে কাজ করতে পারে।

পম্পেও এসপারের সফর চলাকালে আজই ভারত যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে আঞ্চলিক ভূরাজনৈতিক গোয়েন্দা তথ্য ভাগাভাগি করা নিয়ে একটি চুক্তি হতে পারে। বেসিক এক্সচেঞ্জ অ্যান্ড কোঅপারেশন (বিইসিএ) শীর্ষক চুক্তিতে সইয়ের প্রতিদানে যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে অত্যাধুনিক মিসাইল প্রযুক্তি পাওয়ার প্রত্যাশা করছে ভারত।

এছাড়া ভারতের কাছে মার্কিন এফ-১৮ ফাইটার জেট বিক্রি নিয়েও মার্ক এসপার রাজনাথ সিংয়ের মধ্যে আলোচনা হতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

বর্তমানে হিমালয় অঞ্চলবর্তী সীমান্তে ভারত চীনের মধ্যে একধরনের সামরিক অচলাবস্থা বিরাজ করছে। আশঙ্কা রয়েছে, যেকোনো সময়ে সংঘাত বেঁধে যেতে পারে। এরই মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের কাছে শীতকালীন আবহাওয়ায় ব্যবহার উপযোগী যুদ্ধ উপকরণ চেয়ে পাঠিয়েছে ভারত।

কূটনৈতিক সামরিক দিক দিয়ে ভারত যুক্তরাষ্ট্র এখন আগের যেকোনো সময়ের তুলনায় অনেক বেশি ঘনিষ্ঠ। বিষয়টির গুরুত্ব যে চীন অনুধাবন করতে পারছে না, তা নয়। ইন্দো-মার্কিন জোটকে নিয়ে চীন আদতে কতটা উদ্বিগ্ন, সেটা বোঝা মুশকিল হয়ে পড়েছে দেশটির বাকসংযত কূটনীতির কারণে। তবে দেশটি যে নিজস্ব পরিকল্পনা থেকে একচুলও সরতে নারাজ, তা বেইজিংয়ের নিজ পরিকল্পনায় লক্ষ্যস্থির করে এগোনোর কৌশল থেকেই পরিষ্কার।

চীনের আগ্রাসী অর্থনৈতিক-কূটনৈতিক সামরিক কার্যকলাপই ভারত যুক্তরাষ্ট্রকে এক কাতারে নিয়ে এসেছে, সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। বিশ্বব্যাপী প্রভাব বাড়ানোর তাগিদ থেকে চীনকে ইউরেশিয়া অঞ্চলের অর্থনৈতিক হাব বানাতে চাইছেন শি জিনপিং। তার বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ (বিআরআই) কর্মসূচির মূল উদ্দেশ্যও এটাই। একই সঙ্গে চীনা মুদ্রার ডিজিটালাইজেশনের মাধ্যমে ডলারের কাছ থেকে শীর্ষ বৈশ্বিক রিজার্ভ মুদ্রার মর্যাদাও কেড়ে নিতে চাইছেন তিনি। বর্তমান সম্ভাব্য মিত্রদের জন্য পুনরুত্থান ঘটিয়েছেন চীনা সম্রাটদের আমলের জিমিফুঝাও বা জিমি পদ্ধতির।

ওই পদ্ধতিতে বিদেশী কোনো অঞ্চল জয়ের পর খবরদারি মেনে চলার শর্তে স্থানীয় রাজা বা প্রশাসকদের তাদের গদিতে বহাল রাখার সুযোগ দিত চীনা সম্রাটরা। পদ্ধতিতে বিদেশী শাসকরা ততক্ষণই প্রটোকলগত সুবিধা পেতেন, যতক্ষণ তারা চীনা সম্রাটদের লক্ষ্যপূরণের কাজে সহায়ক ভূমিকা রাখতেন। তবে বর্তমান যুগে আধিপত্য বিস্তারের জন্য আগ্রাসী সামরিক অভিযান যেকোনো দেশের জন্য বিপজ্জনক। কারণে আধিপত্য বিস্তারের জন্য সামরিক হস্তক্ষেপের বদলে চীনারা বেছে নিয়েছে চোখরাঙানি আর ঋণফাঁদকে।

তবে শক্তিশালী রাশিয়ার ক্ষেত্রে ধরনের পররাষ্ট্রনীতি প্রয়োগের সুযোগ নেই চীনের। বরং দেশটির সমর্থন পেতে হলে পারস্পরিক সহযোগিতা কূটনৈতিক ঘনিষ্ঠতার পথেই হাঁটতে হবে বেইজিংকে। সোভিয়েত যুগের মতো সেই রবরবা না থাকলেও ভ্লাদিমির পুতিনের অধীনে পুরনো প্রতাপ অনেকটাই ফিরে পেয়েছে মস্কো। বর্তমানে চীন রাশিয়ার মধ্যে সম্পর্ক আগের যেকোনো সময়ের তুলনায় অনেক বেশি ঘনিষ্ঠ। দুই দেশের মধ্যে যে মৈত্রী গড়ে উঠছে, আন্তর্জাতিক মহল সেটিকে এখন সিনো-রুশ মৈত্রী বলতেই বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করছে, যদিও -সংক্রান্ত আনুষ্ঠানিক কোনো ঘোষণা এখনো দেয়নি মস্কো বা বেইজিং। মৈত্রী যদি কোনোভাবে আনুষ্ঠানিক রূপ পায়, সেক্ষেত্রে দ্বিতীয় স্নায়ুযুদ্ধে দুই যুযুধান প্রতিপক্ষ হয়ে উঠবে সিনো-রুশ মৈত্রী এবং ভারত-যুক্তরাষ্ট্রের ইন্দো-প্যাসিফিক জোট অনেকটা প্রথম স্নায়ুযুদ্ধের ন্যাটো ওয়ারশ জোটের মতো।

রাশিয়া চীনের পক্ষ থেকে সিনো-রুশ মৈত্রীর আনুষ্ঠানিক রূপ পাওয়া নিয়ে এখন পর্যন্ত আনুষ্ঠানিক কোনো ঘোষণা না এলেও অদূরভবিষ্যতে যে এটিও এক বাস্তবতা হয়ে উঠতে যাচ্ছে, সে বিষয়ে ইঙ্গিত দিয়েছেন ভ্লাদিমির পুতিন স্বয়ং। সম্প্রতি তিনি বলেন, আমাদের (চীন রাশিয়া) দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কে পারস্পরিক সহযোগিতা বিশ্বাস এখন এমন এক পর্যায়ে পৌঁছেছে, এর কোনো আনুষ্ঠানিকতার প্রয়োজনই নেই। তবে তাত্ত্বিক দিক থেকে এটির কথা অবশ্যই ভাবা যেতে পারে।

তিনি আরো বলেন, দুই দেশের সামরিক বাহিনী এরই মধ্যে ঘনিষ্ঠভাবে একযোগে কাজ করতে শুরু করেছে। এবং সম্পর্ক সামনের দিনগুলোয় কোনদিকে এগোবে, তা সময়ই বলে দেবে। এখন পর্যন্ত আমরা ধরনের (সিনো-রুশ মৈত্রী) কোনো লক্ষ্য নির্ধারণ করিনি। কিন্তু এর সম্ভাবনা আমরা উড়িয়েও দিচ্ছি না। দেখা যাক, কী হয়।

তবে আজ অনুষ্ঠেয় টু প্লাস টু বৈঠকে যুক্তরাষ্ট্র ভারতের মধ্যে বিইসিএ চুক্তি সই হলে তা অনেক কিছু বদলে দিতে পারে। মূলত চুক্তির আওতাতেই দুই দেশ গোয়েন্দা তথ্য সামরিক সহযোগিতা বিনিময় করবে। এর আগে দুই দেশের মধ্যে সামরিক সরঞ্জাম তথ্যপ্রযুক্তিগত সহায়তা বিনিময়ের উদ্দেশ্যে লজিস্টিকস এক্সচেঞ্জ মেমোরেন্ডাম অব এগ্রিমেন্ট (এলইএমওএ) কমিউনিকেশনস কম্প্যাটিবিলিটি অ্যান্ড সিকিউরিটি এগ্রিমেন্ট (কমকাসা) শীর্ষক আরো দুটি চুক্তি সই করেছিল যুক্তরাষ্ট্র ভারত। তিন চুক্তি যুক্তরাষ্ট্রের সামনে ভারতের শীর্ষ অস্ত্র সরবরাহকারী হয়ে ওঠার পথ তৈরি করে দিয়েছে। 

কারণেই রাশিয়ার মতো যেসব দেশ এতদিন ভারতে অস্ত্র সরবরাহ করে এসেছে, সেসব দেশের মধ্যে এক ধরনের অস্বস্তি রয়েছে। তার পরও বিইসিএ চুক্তি সইয়ের অনুমতি দেয়ার মাধ্যমে নরেন্দ্র মোদি বুঝিয়ে দিয়েছেন, রাশিয়ার সঙ্গে এখন পর্যন্ত বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রাখলেও সিনো-রুশ ঘনিষ্ঠতা অঞ্চলের ভূরাজনীতিতে যে পরিবর্তন এনে দিতে পারে, সে বিষয়টি তিনি ভালোভাবেই বুঝতে পারছেন।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন