সাতসতেরো

চিত্র—বিচিত্র!

মো. আব্দুল হামিদ

বডি স্প্রের বাজার এখন গোটা দুনিয়াতেই রমরমা। বিশেষত শীতপ্রধান দেশগুলোয় ওই বস্তু ছাড়া কল্পনাও করা যায় না। তাদের দেশে শীতের তীব্রতার কারণে দীর্ঘ সময় অনেকগুলো জামা-কাপড় পরে থাকতে হয়। আমাদের মতো কড়া রোদ তো দূরের কথা, মাঝেমধ্যে সূয্যি মামার সাক্ষাৎই মেলে না। তাছাড়া অনেকে সপ্তাহর পর সপ্তাহ গোসল করে না। ওয়াশিং মেশিনে কাপড় ধোয়ার সময়-সুযোগও মেলে না। এতে শরীর পোশাকে ঘামের তীব্র গন্ধ হয়। ফলে তারা বাইরে যাওয়ার আগে স্প্রে করে কাজ চালিয়ে নেয়। কারণেই মূলত এই পণ্যের উদ্ভব বিকাশ হয়েছিল।

কিন্তু দিন এখন বদলে গেছে। আধুনিক সব প্রযুক্তি মানুষের শারীরিক শ্রম লাঘব করেছে। বাসা-গাড়ি-অফিসে শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ যন্ত্র থাকায় একশ্রেণীর মানুষের গা আর ঘামছেই না। ফলে তাদের গায়ে ঘামের গন্ধও সৃষ্টি হচ্ছে না। কিন্তু গবেষণা বলছে, ওসব দেশের নারীদের একাংশ পুরুষ সঙ্গীর গায়ের ঘামের উত্কট গন্ধ উপভোগ (এমনকি বিশেষ টান অনুভব) করেন। তাহলে কী করা যায়? মার্কেটিংয়ের লোকেরা এই তথ্য জানার পরেও চুপ করে বসে থাকবে বলে আপনার মনে হয়? তারা নানা রকম ঘামের গন্ধযুক্ত বডি স্প্রে অফার করে এবং ক্রেতাদের পক্ষ থেকে লক্ষণীয় সাড়া পাওয়া যায়! তাই বডি স্প্রে শুধু গন্ধ দূর করার জন্য নয়; বরং গন্ধ আমদানির কাজেও ব্যবহূত হয়! বিষয়ে আরো জানতে সুনীলের ছবির দেশে কবিতার দেশে বইটি পড়তে পারেন।

রূপচর্চাসংক্রান্ত পণ্যের বিজ্ঞাপনগুলো এমনভাবে উপস্থাপন করা হয় যেন চামড়ার রঙ সাদা হওয়া মানেই সুন্দর আকর্ষণীয় হওয়া। তাই তাদের সেট করে দেয়া মানদণ্ডে নিজের ত্বক ফর্সা করার জন্য আমাদের দেশে কত চেষ্টাই না বিনিয়োগ করা হয়। কিন্তু এটা যে বড় ভ্রান্ত ধারণা তা বোঝার জন্য শীতপ্রধান দেশগুলোর সমুদ্রসৈকতে দৃষ্টি দেয়াই যথেষ্ট। সেগুলোতে ছুটির দিনে শত-সহস্র  নারী-পুরুষ রোদে শুয়ে সানবাথ করে! ভাবে শরীরের চামড়াগুলো পুড়ে একটু বাদামি রঙের হলে তারা কতই না আকর্ষণীয় হতো! পাশাপাশি তাদের চর্মরোগের মাত্রাও আমাদের চেয়ে বহুগুণ বেশি। ফলে চামড়া সাদা হওয়া মোটেই কাজের কথা নয়।

অবশ্য যার যেটা থাকে না, তার কাছে সেটাই পরম আরাধ্য বলে গণ্য হয়। আমাদের দেশে সিনেমা হলের অস্থিচর্মসার দর্শকেরা অত্যধিক স্বাস্থ্যসম্পন্ন নায়িকাদের নাচ-গান দেখে আপ্লুত হয়। অথচ মার্কিনিরা অধিকাংশ স্থূলতায় ভোগে; চারপাশে মোটা মানুষদের দেখতে দেখতে বড্ড ক্লান্ত। ফলে শরীরের হাড় গোনা যায় (স্লিম) এমন হলিউড নায়িকারাই তাদের কাছে দৃষ্টিনন্দন বলে প্রতীয়মান হয়। আমাদের দেশেও হলিউড-বলিউড নায়িকাদের আদলে ডায়েট করতে গিয়ে অনেকেই গ্যাস্ট্রিক-আলসারের রোগীতে পরিণত হচ্ছে। ফলে সত্যিকার অর্থে ঠিক কোনটা ভালো তা আজব এক রহস্য বটে

আচ্ছা বলুন তো, কোনো দৌড় প্রতিযোগিতায় ধনী-দরিদ্র সব পরিবারের সমবয়সী শিশুরা নির্বিচারে অংশগ্রহণ করলে তাতে কারা জয়ী হবে? ঘড়ি ধরে দিনের মধ্যে কয়েকবার ডিম-দুধ-সম্পূরক খাদ্য খাওয়া বেবিগুলো নাকি অপুষ্টিতে ভোগা বস্তিবাসী রিকশাওয়ালার সন্তানরা? নিশ্চয়ই নিয়মিত পুষ্টি ইনটেক করা শিশুরা প্রথম-দ্বিতীয় হবে, তাই না? কিন্তু বাস্তবে দেখেছি তিনবেলা ঠিকমতো খাবার না জোটা শিশুরাই ব্যাপক ব্যবধানে জয়ী হয়! তাহলে কি আমাদের ভুলভাল কথা শেখানো হয়?

আরেকটা বিষয় খুব লক্ষণীয়গ্রামের অশিক্ষিত, অসচেতন, অপুষ্টিতে ভোগা মায়েদের সন্তানেরা খুব একটা জটিলতা নিয়ে জন্মায় না। তাদের সিংহভাগই বিশেষ কোনো যত্নও পায় না, ঠিকমতো ডাক্তারের পরামর্শও মেলে না। তার পরও তাদের সুস্থ-সবল সন্তান জন্ম দেয়ার হার তুলনামূলকভাবে বেশি। অন্যদিকে শহুরে-ধনী-শিক্ষিত-সচেতন পরিবারে স্পেশাল চাইল্ডের সংখ্যা ক্রমেই বাড়ছে। ছোটবেলা পড়েছি প্রিভেনশন ইজ বেটার দ্যান কিউর। কিন্তু এক্ষেত্রে কেন যেন প্রিভেনশন নিয়ে খুব একটা আলোচনা হচ্ছে না। শুধু কিউর নিয়ে সবাই কথাবার্তা বলছে। ব্যাপারে (কারণ অনুসন্ধান প্রতিকার বিষয়ে) ব্যাপক গবেষণা হওয়া দরকার।

রাষ্ট্র সমাজ প্রত্যাশা করে লেখাপড়া জানা মানুষেরা সৎ নৈতিক হবে, নিয়মিত আয়কর দেবে, সব আইনকানুন মেনে চলবে। কিন্তু স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের (সাধারণ) শিক্ষার্থীদের কি এমন বিষয়গুলোতে পাঠদান করা হয়? তাহলে তারা সেগুলো শিখবে কোথা থেকে? পরিবার সামাজিক রীতি থেকে শেখাটাই যদি নিয়ম হয়, তবে শিক্ষিত লোকদের কাছে আমরা বিশেষ আচরণ প্রত্যাশা করি কীভাবে? সমাজে গড় মানুষের প্রবণতা যেমন; তারাও তো তেমনই হবে, তাই না? বিশেষ মানুষ প্রত্যাশা করলে তেমন বিষয়বস্তু শেখানো চর্চা হওয়াটা জরুরি। বাস্তবে কি সেটা হয়?

ষোলো বছর বয়সে সব কাজ করার উপযুক্ত হলেও অধিকাংশ শিক্ষিত লোকেরা একটা চাকরি না পাওয়া পর্যন্ত কিছু করতে পারে না। এমনকি লাখ লাখ মানুষ তার চেয়ে ভালো একাডেমিক ব্যাকগ্রাউন্ড নিয়ে বসে আছে, সেটা জানার পরেও। অথচ সেই মানুষটাকে বিদেশে পাঠান। দেখবেন সে আর চাকরি খুঁজবে না। যেনতেন একটা কাজ পেলেই জীবন ধন্য হবে। যে ছেলেটা বাড়িতে কখনো এক গ্লাস পানি ঢেলে খায়নি, সে বিদেশে গিয়ে অন্যের প্লেট-গ্লাস ধোয়ার কাজ পেয়েও খুশি হয়! আবার একদিন কাজের বুয়া না এলে যে গৃহকর্ত্রীর বাসায় সকালের নাশতা হতো না, সেই ভদ্রমহিলা বিদেশে গিয়ে নিজের বাসার সব কাজ তো করেই, পাশাপাশি ডিপার্টমেন্ট স্টোরের গুদামে কাজ পেলেও গর্ববোধ করে। তার পরও সেটা স্বপ্নের দেশ আর (তাদের দৃষ্টিতে) দেশের সবকিছুই খারাপ!

অনেক সময় দেখা যায়, ভার্সিটি ক্যাম্পাসে যার বিতর্ক শুনে প্রেমে পড়ে, বিয়ের পর তাকেই ঝগড়াটে মনে হয়। যে মেয়েটার গান শুনে তাকে জীবনসঙ্গী করতে মরিয়া হয়, বিয়ের পর সর্বপ্রথম তার গান গাওয়াটা বন্ধ করা হয়! নাচ-অভিনয়ের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। ঐশ্বরিয়া রাই বচ্চন পরিবারে গিয়ে যার চূড়ান্ত পরীক্ষা দিচ্ছেন। এখন যাকে কথায় কথায় আদর করে বাবু বলা হয়, দিন পরে সে যখন বাবুর বাপ হয় তখন অনেকের কাছেই তার সবকিছু ত্রুটিপূর্ণ মনে হয়! জীবন হয়তো এমনই, ফলে ক্ষণিকের অনুভবে বড় মূল্যায়ন করা ঠিক কতটা যৌক্তিক?

আবার অনেকে দক্ষতা জনপ্রিয়তাকে (গ্রহণযোগ্যতা) সমার্থক মনে করেন। বাস্তবে সেরা বা দক্ষ হওয়া আর জনপ্রিয় হওয়া কিন্তু মোটেই এক কথা নয়। অর্থাৎ জনপ্রিয় অধ্যাপক তার সাবজেক্টে গভীর জ্ঞান রাখেন তা নিশ্চিত করে বলা যাবে না। অথবা ইসলামের গভীর জ্ঞান রাখা বক্তাই প্রবলভাবে জনপ্রিয় হবেন, তাও ঠিক নয়। কিংবা ভালো খেলোয়াড় হলেই অনেক বেশি জনপ্রিয় হবেন, তেমনটাও সবসময় ঘটে না। 

আবার ভাবুন, অস্ট্রেলিয়া যখন বিশ্ব ক্রিকেটে প্রবল দাপটে খেলে একের পর এক বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন হচ্ছিল, তখনো গোটা দুনিয়ায় তাদের কয়জন সমর্থক ছিল? অথচ ওয়েস্ট ইন্ডিজ ১৯৮৩ সালের পরে একবারও ফাইনালে যেতে পারেনি, তার পরও গোটা দুনিয়ায় তাদের বিপুলসংখ্যক সমর্থক রয়েছে! আবার ফুটবলে জার্মানি বিশ্বকাপ জিতলেও বিশ্ববাসীর হূদয় স্পর্শ করতে পারে না। অথচ আর্জেন্টিনা সেই ১৯৮৬ সালে চ্যাম্পিয়ন হওয়ার সময় যে জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিল, আজও তার অনেকটাই বজায় রয়েছে! তাই জনপ্রিয়তাকে ইন্ডিকেটর ধরে তাদের মতামত গ্রহণ করার ব্যাপারে সতর্ক থাকা জরুরি।

আবার দেখুন, চীন ক্রমেই গোটা দুনিয়ায় বিস্তৃত হচ্ছে। বর্তমানে তারা বিশ্বের বৃহত্তম অর্থনীতি। কিন্তু তাদের প্রেসিডেন্টের নামও ঠিক কয়জন জানে? অথচ আমেরিকা এখন দুনিয়ার ঋণগ্রস্ত দেশগুলোর অন্যতম। তার পরও মার্কিন প্রেসিডেন্টের নাম জানে না, এমন লোক খুঁজে পাওয়া দুষ্কর! চীনের মূল হাতিয়ার ব্যবসা-বাণিজ্য হলেও তাদের তেমন কোনো ব্র্যান্ড নেই (আলিবাবা জ্যাক মা ছাড়া), যা বিশ্বব্যাপী গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে! পণ্য, ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠানসব ক্ষেত্রেই একথা সমভাবে প্রযোজ্য। অথচ আমেরিকার কোকা-কোলা, অ্যাপল, অ্যামাজন, গুগল, ফেসবুক, স্টিভ জবস, বিল গেটস, জেফ বেজোস, হার্ভার্ড, এমআইটি, নাসার মতো হাজারো ব্র্যান্ড বিশ্বব্যাপী নেতৃত্ব দিচ্ছে

পরিশেষে, কোনো বিষয়ে আমরা মোটের ওপর যে ধারণা পোষণ করি, সেটাকে অবলম্বন করেই মতামত দিই বা সিদ্ধান্ত গ্রহণ করি। সেই স্ক্যানারে প্রতিনিয়ত অন্যদের ভুলও ধরি। কিন্তু আপনি যা জানেন, যেভাবে জানেন, তা কতটা সঠিকএটি নিশ্চিত করে বলা মুশকিল। ক্রমে আমরা নিজেদের পছন্দ-আদর্শ-অনুভূতিকে সর্বোচ্চ আসনে বসাতে গিয়ে অন্যদের অনুভূতিকে যে আঘাত করছি, তা বোঝার ক্ষমতাও অনেকে হারিয়ে ফেলছি। তাই আমি যা জানি বা বুঝি তা- শেষ কথা নয়, এর বাইরেও বিশাল জগৎ আছে। এই বোধটা স্পষ্ট হওয়া দরকার।

আমার মতামত বা আদর্শ যেমন আমার কাছে সর্বোচ্চ মর্যাদাসম্পন্ন, ঠিক তেমনিভাবে গোটা দুনিয়ায় হাজারো মত-পথ রয়েছে, যার অনুসারীরা আমার মতোই সেগুলোর প্রতি ভালোবাসা বিশ্বাস লালন করেন। তাই সেগুলোর প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকা আমাদের একান্ত কর্তব্য। আর সত্যিই সেটা করতে পারলে (ভেতরে বাইরে) অস্থিরতা কমে আসবে। বড় অস্থির এই সময়ে বুঝি সেই চর্চাটা খুব খুব দরকার।

 

মো. আব্দুল হামিদ: শাহজালাল বিজ্ঞান প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবসায় প্রশাসন বিভাগের শিক্ষক মার্কেটিংয়ের সহজপাঠ বইয়ের লেখক

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন