ঋণ বিতরণ কমেছে ব্র্যাক, গ্রামীণ ব্যাংক ও আশার

উদ্ভাবনশীল কর্মসূচি গ্রহণ করা হোক

নভেল করোনাভাইরাসের কারণে বিশ্ববাণিজ্যের পাশাপাশি দেশের ব্যবসা-বাণিজ্যেও নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। দেশের সার্বিক অর্থনীতির নেতিবাচক প্রভাবের ফলে ক্ষুদ্রঋণ প্রতিষ্ঠানের ঋণগ্রহীতাদের ব্যবসা-বাণিজ্য তথা স্বাভাবিক অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডও বাধাগ্রস্ত হয়েছে। গতকাল বণিক বার্তায় প্রকাশিত সংশ্লিষ্ট এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, করোনা সংক্রমণের তিন মাসে দেশের শীর্ষ তিন এনজিও ব্র্যাক, গ্রামীণ ব্যাংক আশার ঋণ বিতরণ কমেছে ৮০ শতাংশ। দেশে ক্ষুদ্রঋণের আওতায় রয়েছে প্রায় কোটি পরিবার। যারা এনজিও থেকে ঋণ গ্রহণ করে ক্ষুদ্র ব্যবসা করে কিস্তি দেয় এবং নিজেরা বেঁচে থাকে। উৎপাদন বন্ধ থাকায় থমকে গেছে গ্রামীণ অর্থনীতি। মানুষের আয় কমেছে কিন্তু ব্যয় বেড়ে গেছে বহুগুণ। আয়ের চেয়ে ব্যয় বেশি হওয়ার কারণ ভাইরাসজনিত। স্বাস্থ্য সুরক্ষায় ব্যয় বেশি হচ্ছে, যে ব্যয় আগে হতো না। প্রণোদনা প্যাকেজের আওতায় এনজিও খাতের জন্য হাজার কোটি টাকার ঋণসহায়তা ঘোষণা করেছে সরকার। ক্ষুদ্র মাঝারি উদ্যোক্তাদের মধ্যে অর্থ পৌঁছে দিতে এনজিওগুলোকে অর্থায়ন করা হবে। কিন্তু অর্থ বিতরণে ধীরগতি পরিলক্ষিত হচ্ছে। এনজিও খাতের বড় উৎস ব্যাংক ব্যবস্থা। কিন্তু করোনাকালীন সেখান থেকেও ঋণ পাওয়ার কোনো সম্ভাবনা এখনো দেখা যাচ্ছে না। তারল্য সরবরাহ নিশ্চিত না করা গেলে কর্মসংস্থান সংকুচিত হবে। গ্রামীণ অর্থনীতিও সচল হবে না। গ্রামীণ মানুষের আর্থিক নিশ্চয়তা দিচ্ছে ক্ষুদ্রঋণ। জিডিপিতে ক্ষুদ্রঋণের পরিমাণ ১২ দশমিক শতাংশ। প্রায় তিন লাখ মানুষের কর্মসংস্থান সৃষ্টি করছে এনজিও খাত। গ্রামীণ অর্থনীতি সচল করতে হলে, উৎপাদন বৃদ্ধি করতে হলে এনজিও ঋণ প্রয়োজন। ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা ঋণ গ্রহণ করে আবার কিস্তি দিয়ে ঋণ পরিশোধ করে পুনঃঋণ নেন। এনজিওর এসব ঋণ আদান-প্রদান বন্ধ থাকায় থমকে গেছে গ্রামীণ অর্থনীতি। করোনার কারণে এনজিও সংস্থাগুলো অর্থ সংকটে পড়েছে। দেশের শীর্ষ তিন বেসরকারি সংস্থার ঋণ বিতরণ আদায় কার্যক্রমে স্থবিরতা থাকলে সামনের দিনে মন্দ ঋণের পরিমাণ বৃদ্ধি পাওয়ার পাশাপাশি এনজিওগুলোর সম্প্রসারণমূলক কার্যক্রমে গতিহীনতা দেখা দিতে পারে। এছাড়া ঋণ না পাওয়ার কারণে গ্রামীণ অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়ানোর কার্যক্রম বিঘ্নিত হতে পারে।

করোনার কারণে যেসব খাত সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, তার মধ্যে ক্ষুদ্র মাঝারি শিল্প অন্যতম। সরকার তাদের জন্য স্বল্প সুদে ঋণসহায়তা প্রদানের উদ্যোগ নিয়েছে। কিন্তু ব্যাংকের মাধ্যমে অর্থ প্রদান করায় কাগজপত্রের অভাবে এমএসএমই ঋণ নিতে পারছেন না। গ্রামীণ ক্ষুদ্র মাঝারি উদ্যোগ সৃষ্টির পেছনে বড় অবদান রেখেছে এনজিওগুলো। বড় এনজিওগুলোর পাশাপাশি পিকেএসএফও অর্থায়নে সহায়তা করেছে। কিন্তু করোনার কারণে এমএসএমই প্রতিষ্ঠানগুলো ব্যাপক আকারে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। করোনার সময়ে তাদের উৎপাদন-বিক্রি বন্ধ থাকায় ক্ষতির মাত্রা আরো বেড়েছে। আগের ঋণের কিস্তি পরিশোধ করতে পারছেন না অধিকাংশ উদ্যোক্তা। এর মধ্যে নতুন করে ঋণ নিয়ে উৎপাদন সচল রাখার পরিকল্পনাও করছেন না তারা। আগের ঋণের কিস্তি ফেরত না আসায় নতুন করে ঋণও বিতরণ করতে পারছে না অনেক এনজিও। এক্ষেত্রে সরকার এনজিওগুলোকে সরাসরি ফান্ড দিতে পারে এমএসএমইদের ঋণ বিতরণে। দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে ব্যাংকের শাখা নেই, আছে এনজিও কার্যক্রম। ফলে তাদের মাধ্যমে ঋণ বিতরণ অনেক বেশি সাশ্রয়ী দ্রুত করা সম্ভব। করোনার মহামারীর সময় এনজিওগুলোর সহায়তায় সরকার গ্রামীণ অর্থনীতি চাঙ্গা করে তুলতে পারে। কারণ প্রত্যন্ত এলাকার মানুষদের নিয়ে কাজ করার সুদীর্ঘ ইতিহাস এনজিগুলোর রয়েছে। করোনার ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে এনজিওগুলোকে আরো সক্রিয় করতে সরকার উদ্যোগ নিতে পারে। গ্রামীণ অর্থনীতি চাঙ্গা করতে, বিশেষত এমএসএমই খাতকে পুনরুজ্জীবিত করতে এনজিওগুলো ব্যবহার করতে পারে সরকার। এতে অপচয় হওয়ার শঙ্কা কমে আসবে বৈকি। কারণ তাদের রয়েছে দক্ষ কর্মী বাহিনী। এক্ষেত্রে সুদ মওকুফসহ উদ্যোক্তাদের সহায়তা জোগাতে সরকারকে এগিয়ে আসতে হবে। এনজিওগুলোর ফান্ডের সমস্যার বিষয়টিও বিবেচনায় রাখতে হবে। কভিডকালে ঋণ বিতরণ আদায়ে নতুন পদক্ষেপ নিতে হবে। প্রথাগত কার্যক্রমের বাইরে নতুন ইনোভেটিভ কর্মসূচির মাধ্যমে ঋণ বিতরণ শুরু করতে হবে।

মহামারীর সময়কালে স্থানীয় পর্যায়ে তত্পর বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থাগুলোকে সরকারি নীতি-কৌশল কর্মপন্থার সঙ্গে যুক্ত করা হয়নি। অবস্থায় জাতীয় পর্যায়ে একটি নীতি-কৌশল গ্রহণ করে স্থানীয় পর্যায়ে তা দ্রুত বাস্তবায়ন করা দরকার। স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের স্থানীয় প্রশাসনকে বিষয়ে সচেতন কার্যকরভাবে যুক্ত করতে হবে। তৃণমূল পর্যায়ে তত্পর বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থাগুলো এসডিজি বাস্তবায়ন বিশেষ করে পিছিয়ে থাকা মানুষদের উন্নতিকল্পে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। তাই এদের এই দুর্যোগকালে টিকে থাকতে সরকারের পক্ষ থেকে আর্থিক প্রণোদনা নীতিসহায়তা জরুরি। বর্তমানে সীমিত পরিসরে কিছু গ্রাহকের চাহিদা পূরণ করা হচ্ছে। এখন বাকি সময় কী করা যাবে তা নির্ভর করছে পরিস্থিতির ওপর। এই সংকটকালে অর্থনীতি সচল রাখতে নিয়ন্ত্রক সংস্থা এমআরএ তথা সরকারকেও নীতিসহায়তা নিয়ে এগিয়ে আসতে হবে। নোবেল বিজয়ী দুই অর্থনীতিবিদ অভিজিৎ ব্যানার্জি এবং তার সহযোগী এস্তার দুফলো বর্তমান প্রেক্ষাপটে বৈশ্বিকভাবেই দরিদ্র নিম্নবিত্তদের হাতে নগদ অর্থ দেয়াকেই যথাযথ পদক্ষেপ বলে অভিমত দিয়েছেন। কিন্তু সমস্যা হলো, আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশে ধরনের কর্মসূচির স্বচ্ছতা বজায় রাখা এবং যথোপযুক্ত লোকদের হাতে তা পৌঁছানোর নিশ্চয়তা বিধান। অবশ্য সরকার চাইলে এবারো অন্যবারের মতো পিকেএসএফের সঙ্গে নিবন্ধিত বিশেষ কিছু এনজিওকে ব্যবহার করতে পারে। এতে সুফল মিলবে বৈকি। ২০০৭ সালে সিডরের পর ব্র্যাক, টিএমএমএস, আশা, ব্যুরোসহ ছয়টি সংস্থা দেশের দক্ষিণাঞ্চলে ক্ষুদ্র-মাঝারি উদ্যোক্তা এবং দরিদ্রদের সহায়তায় বিরাট ভূমিকা রেখেছিল। তদুপরি রয়েছে মাইক্রোক্রেডিট রেগুলেটরি অথরিটির (এমআরএ) নিয়ন্ত্রণাধীন হাজার হাজার ক্ষুদ্রঋণ প্রতিষ্ঠান। কিছুদিন আগেই দেখলাম ভারতীয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক আরবিআই তিনটি বিশেষায়িত ব্যাংকের মাধ্যমে ৫০ হাজার কোটি রুপি গ্রামাঞ্চলে কর্মরত সমবায় সমিতি এবং ক্ষুদ্রঋণ সংস্থার তারল্য বৃদ্ধির জন্য বরাদ্দ করেছে। সামগ্রিক ত্রাণ বিশেষ করে প্রণোদনা বিতরণে এনজিও, বিশেষ করে ক্ষুদ্রঋণ সংস্থাগুলোকে সম্পৃক্ত করতে না পারলে সত্যিকারের উপকার নিশ্চিত করা যাবে না। গ্রামীণ অর্থনীতিতে তারল্য প্রবাহ বৃদ্ধি এবং ক্ষুদ্র উদ্যোগ অর্থায়নে ক্ষুদ্রঋণ সংস্থার বিকল্প নেই।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন