থাইল্যান্ডে পূর্ণ রাজতন্ত্র ফেরাতে চান বিশ্বের সবচেয়ে ধনী রাজা?

বণিক বার্তা ডেস্ক

২০১৪ সালের কথা। আকস্মিকভাবেই রাজকীয় সব সম্মান মর্যাদা হারিয়ে ফেললেন তত্কালীন থাই যুবরাজ মহা ভাজিরালংকর্ণের তৃতীয় স্ত্রী যুবরানী শ্রীরশ্মি সুয়াদি। দুর্নীতির ধোঁয়াশাপূর্ণ অভিযোগ মাথায় নিয়ে কারাগারে বন্দি হলেন তার পিতা-মাতা ভাই। থাই পুলিশের জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তার পদ হারালেন তার চাচা। বিবাহবিচ্ছেদের মাধ্যমে থাই রাজপরিবার থেকে একপ্রকার ছুড়েই ফেলে দেয়া হলো তাকে। এরপর এল তার খোরপোশের প্রশ্ন।

শ্রীরশ্মি সুয়াদির সান্ত্বনা ছিল দুটি। প্রথমত, তার সন্তান দীপাংকর রশ্মিজ্যোতিই হতে যাচ্ছেন পিতার উত্তরাধিকারী। দ্বিতীয়ত, বিবাহবিচ্ছেদকালীন খোরপোশ হিসেবে তার যে প্রাপ্য নির্ধারণ করা হয়েছে, সে অংকটাও বিশালপ্রায় ৬০ লাখ ডলারের সমপরিমাণ (বর্তমান বিনিময় হার অনুযায়ী বাংলাদেশী টাকায় প্রায় ৫০ কোটি ৯০ লাখ)

অর্থের পরিমাণ বিশাল হলেও ভাজিরালংকর্ণের কাছে তা কিছুই না। কারণ থাই রাজপরিবারের বড় কোনো অংকের অর্থের প্রয়োজন দেখা দিলে, সে ব্যয় নির্বাহের জন্য রাজপরিবারের মালিকানাধীন আলাদা একটি সংস্থাই রয়েছে। সাবেক স্ত্রীর খোরপোশ পরিশোধের জন্য ওই সংস্থার সম্পদ কাজে লাগালেন ভাজিরালংকর্ণ। ক্রাউন প্রপার্টি ব্যুরো নামে সংস্থাটি আসলে গোপন এক হোল্ডিং কোম্পানি (অধিকাংশ শেয়ার মালিকানার ভিত্তিতে যে কোম্পানি অন্য কোনো কোম্পানির পর্ষদকে নিয়ন্ত্রণ করে। এক্ষেত্রে নিয়ন্ত্রণাধীন কোম্পানিকে বলা হয় সাবসিডিয়ারি কোম্পানি) কোম্পানির সাবসিডিয়ারিগুলোর প্রতিটিই আবার থাইল্যান্ডের স্বনামধন্য ব্লু-চিপ কোম্পানি (যেসব কোম্পানির শেয়ারে বিনিয়োগ দীর্ঘমেয়াদে লাভজনক, এসব কোম্পানির সম্পদের মান ভালো হয়ে থাকে এবং কোম্পানিগুলো ভালো খারাপ উভয় সময়েই লাভজনকভাবে ব্যবসা চালিয়ে যেতে সক্ষম) হিসেবে পরিচিত। আবার ব্যাংককের কেন্দ্রে সবচেয়ে দামি ভালো জমিগুলোও ছিল ব্যুরোর মালিকানায়ই। ভাজিরালংকর্ণের তৃতীয় স্ত্রীকে প্রদেয় খোরপোশের অর্থও গোপন ওই কোম্পানির পক্ষ থেকেই পরিশোধ করে দেয়া হয়।

এর দুই বছর পর ২০১৬ সালে সিংহাসনে বসেন ভাজিরালংকর্ণ। সিংহাসনে বসেই তার প্রথম কাজ হলো ক্রাউন প্রপার্টি ব্যুরোর অধীন সম্পদগুলোকে নিজের নামে করে নেয়া। এর ফলে রাতারাতি বিশ্বের সবচেয়ে ধনী রাজকীয় শাসকে পরিণত হয়ে যান মহা ভাজিরালংকর্ণ। তার মালিকানাধীন সম্পদের পরিমাণ দাঁড়াল সৌদি বাদশা, ব্রুনাইয়ের সুলতান ব্রিটিশ রাজপরিবারের মালিকানাধীন সম্পদের মোট পরিমাণের চেয়েও বেশি।

রক্ষণশীলভাবে হিসাব করার পরও দেখা যাচ্ছে, ভাজিরালংকর্ণের মোট সম্পত্তির মূল্যায়ন করলে এর পরিমাণ দাঁড়ায় হাজার কোটি ডলারেরও বেশি। বর্তমানে থাইল্যান্ডে পূর্ণ গণতন্ত্রের দাবিতে যে আন্দোলন চলছে, সে আন্দোলন গতি পাওয়ার অন্যতম কারণ হলো থাই রাজার বিপুল পরিমাণ সম্পদ নিজের মালিকানায় নিয়ে নেয়া।

ক্রাউন প্রপার্টি ব্যুরোর অধীন সম্পদ নিজের ব্যক্তিগত মালিকানায় নিয়ে আসার মাধ্যমে ভাজিরালংকর্ণ নিজেকে শুধু বিশ্বের সবচেয়ে ধনী রাজা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেননি, একই সঙ্গে তিনি জনগণের মধ্যে নতুন এক সন্দেহের বীজ বুনে দিয়েছেন, রাজা হয়তো থাইল্যান্ডকে সাংবিধানিক রাজতন্ত্র থেকে পূর্ণ রাজতন্ত্রে ফিরিয়ে নিতে চাইছেন। পরবর্তী সময়ে রাজার বিভিন্ন পদক্ষেপ আচরণ সন্দেহকে আরো জোরালো করে তোলে।

বয়োজ্যেষ্ঠ উপদেষ্টাদের হামাগুড়ি দেয়ানো, রাজদরবারের কোনো সদস্যের ওপর অসন্তুষ্ট হলে তার মাথা ন্যাড়া করে দেয়া বা নিজ সন্তানদের উত্তরাধিকার বঞ্চিত করার মতো অনেক আচরণই তিনি দেখিয়েছেন, যা পুরনো আমলের স্বেচ্ছাচারী রাজাদের কথাই মনে করিয়ে দেয়। থাই জনগণের জন্য সবচেয়ে আশঙ্কার বিষয় হলো, ভাজিরালংকর্ণ ধীরে ধীরে নিজের ক্ষমতাকে আরো সুসংহত করেছেন। সেনাবাহিনীর সর্বোচ্চ নেতৃত্বকে রাজা হিসেবে আলংকারিকভাবে নয়, প্রকৃত অর্থেই নিজের কুক্ষিগত করে ফেলেছেন তিনি। সংবিধানে বেশকিছু পরিবর্তন আনার নির্দেশ দিয়েছেন তিনি। এমনকি পুরনো আমলের পূর্ণ রাজতন্ত্রের দিনগুলো নিয়ে জনসম্মুখেই হাহুতাশ করতে দেখা গিয়েছে তাকে। সবচেয়ে ভয়াবহ ব্যাপার, তার আমলেই থাইল্যান্ডের লেস ম্যাজেস্টে (রাজা রাজপরিবার বা শাসকদের সমালোচনা-বিরোধিতা ঠেকাতে প্রণীত স্বৈরাচারমূলক আইন) আইনের সবচেয়ে কঠোর ব্যাপকমাত্রার প্রয়োগ শুরু হয়। আইনের ফলে দেশটিতে রাজার সামান্যতম সমালোচনাও যে কাউকে ঠেলে দিতে পারে ১৫ বছরের জেলবাসের দিকে। থাইল্যান্ডে রাজার অবস্থান এখন দেশটির সংবিধানেরও ওপরে।

১৯৩২ সালে এক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে থাইল্যান্ডে পূর্ণ রাজতন্ত্রের বিলোপ ঘটানো হয়। ওই সময়ে রাজাকে উচ্ছেদ না করা হলেও রাজতন্ত্রকে সাংবিধানিক রূপ দেয়া হয়। ভাজিরালংকর্ণের আমলে প্রথম সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে ওই অভ্যুত্থানের স্মারক ভাস্কর্যগুলোও গায়েব হওয়া শুরু হয়। এরই মধ্যে বেশ কয়েকটি ভাস্কর্যের কোনো অস্তিত্বও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।

স্বাভাবিকভাবেই বিষয়গুলোকে মেনে নিতে পারছে না থাই জনগণ। তারা মনে করছে, ক্রাউন প্রপার্টি ব্যুরোর অধীন সম্পদগুলোকে নিজের মালিকানায় নিয়ে আসার মাধ্যমেই ভাজিরালংকর্ণের পূর্ণ রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার পথে এগিয়ে যাওয়া শুরু হয়। থাইল্যান্ডের বাসিন্দারা মনে করছে, এর মাধ্যমে শুরুতেই নিজের অর্থনৈতিক ক্ষমতাকে সুসংহত করে নিয়েছেন ভাজিরালংকর্ণ। ফলে বিষয়টি নিয়ে আপত্তি তুলেছেন গণতন্ত্রপন্থী থাই আন্দোলনকারীরা। চলমান আন্দোলনে থাই রাজপরিবারের অর্থায়ন সম্পদ ব্যবস্থাপনায় স্বচ্ছতার দাবি তুলেছেন তারা। একই সঙ্গে দাবি উঠেছে রাজপরিবারের বিপুল ক্ষমতাকে সীমিত করে আনারও।

এর আগে ভাজিরালংকর্ণের পিতা রাজা ভূমিবলকেও ২০১১ সালে বিশ্বের সবচেয়ে ধনী রাজকীয় শাসকের খেতাব দিয়েছিল ফোর্বস ম্যাগাজিন। যদিও রাজপরিবারগুলোর মধ্যে সম্পদ মালিকানার দিক থেকে পঞ্চম অবস্থানে রয়েছে থাই রাজপরিবার। এমএসএন মানির পরিমাণে দেখা যায়, মোট লাখ ৭০ হাজার কোটি ডলারের মালিকানা নিয়ে বিশ্বের শীর্ষ ধনী রাজপরিবার হিসেবে নিজের অবস্থান ধরে রেখেছে সৌদি রাজপরিবার।

মালিকানা হারালেও বর্তমানে ভাজিরালংকর্ণের সম্পত্তির অধিকাংশেরই দেখভাল করছে ক্রাউন প্রপার্টি ব্যুরো। সংস্থাটির তত্ত্বাবধানে থাকা ভাজিরালংকর্ণের শুধু জমির পরিমাণই সাড়ে হাজার হেক্টরের (১৬ হাজার ২১০ একর) বেশি। ৪০ হাজারেরও বেশি ব্যক্তি বা সংস্থা এখন চুক্তির ভিত্তিতে গোটা থাইল্যান্ডে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা এসব জমি ব্যবহার করছে। এর মধ্যে শুধু ব্যাংককেই রয়েছে হাজার ৩২৮ হেক্টর জমি।

ভাজিরালংকর্ণের পিতা রাজা ভূমিবলের জীবনী কিং ভূমিবল, লাইফস ওয়ার্ক সূত্রে জানা যাচ্ছে, শুধু ব্যাংককেই ক্রাউন প্রপার্টি ব্যুরোর পরিচালনাধীন ভূসম্পত্তির মূল্য হাজার ৩০০ কোটি ডলারের সমপরিমাণ।

রাজার ব্যক্তিগত সচিব এয়ার চিফ মার্শাল সাতিতপং সুকভিমল ২০১৭ সাল থেকে ক্রাউন প্রপার্টি ব্যুরোর চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করছেন। এর আগ পর্যন্ত সংস্থাটির চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করতেন থাই অর্থমন্ত্রীরা। বিভিন্ন সময়ে দেয়া ঘোষণা সূত্রে জানা যাচ্ছে, রাজা ব্যুরোর নিয়ন্ত্রণ নিজের হাতে নেয়ার পর থেকে নানা উন্নয়নের মাধ্যমে সংস্থাটির অধীন জমিগুলোর সম্পদমূল্য বেড়েছে ৪৭০ কোটি ডলারের সমপরিমাণ।

সাম্প্রতিক বছরগুলোয় ক্রাউন প্রপার্টি রিয়েল এস্টেটে বিনিয়োগ নিয়ে প্রচুর ডেভেলপারকে এগিয়ে আসতে দেখা গিয়েছে। গত বছরও শপিং মল অপারেটর সেন্ট্রাল পাত্তানা পিসিএল হোটেল ব্যবস্থাপনা প্রতিষ্ঠান দুসিত থানি ১২০ কোটি ডলারের নতুন প্রকল্পে বিনিয়োগের ঘোষণা দিয়েছে। প্রকল্পের অধীনে ৬৭ বছরের ইজারার ভিত্তিতে দশমিক ৬৮ হেক্টর জমির ওপর দুসিত সেন্ট্রাল পার্ক নামে একটি আবাসন, রিটেইল প্রতিষ্ঠান অফিস কমপ্লেক্স গড়ে তোলা হবে। ২০২৪ সালে এটির নির্মাণকাজ শেষ হওয়ার কথা রয়েছে। ২০১৮ এমন আরেকটি প্রকল্পের অধীনে ৩৫০ কোটি ডলারের আরেকটি বিনিয়োগের ঘোষণা দেয়া টিসিসি গ্রুপ ফ্রেজার প্রপার্টি লিমিটেড।

ভাজিরালংকর্ণ যখন ব্যুরোর অধীন যাবতীয় সম্পদ নিজের নামে করে নেন, সে সময় তিনি সিয়াম সিমেন্ট গ্রুপ সিয়াম কমার্শিয়াল ব্যাংকের মতো লাভজনক কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের ৯০০ কোটি ডলার মূল্যের শেয়ারেরও মালিক হয়ে যান। এর মধ্যে থাইল্যান্ডের দ্বিতীয় বৃহত্তম ঋণদাতা প্রতিষ্ঠান সিয়াম কমার্শিয়াল ব্যাংকে রাজার শেয়ার মালিকানা ২৩ শতাংশ। অন্যদিকে দেশটির বৃহত্তম শিল্প কনগ্লোমারেট সিয়াম সিমেন্ট গ্রুপে রাজার শেয়ার মালিকানা ৩৩ দশমিক শতাংশ। উভয় প্রতিষ্ঠানই গত শতকে এক রাজকীয় ডিক্রির অধীনে গড়ে তোলা হয়েছিল।

ভাজিরালংকর্ণের রাজমুকুটে বসানো ৫৪৫ দশমিক ৬৭ ক্যারেটের গোল্ডেন জুবিলি হীরাটি মূল্যায়িত করা হয়েছে কোটি ২০ লাখ ডলার। ১৯৯৬ সালে রাজত্বের অর্ধশতবার্ষিকী উপলক্ষে ভাজিরালংকর্ণের পিতা রাজা ভূমিবলকে হীরাটি উপহার হিসেবে দেয়া হয়েছিল। অভিষেকের দিন পাঁচটি রাজকীয় উপহার পেয়েছিলেন ভাজিরালংকর্ণ। এর মধ্যে একটি ছিল নানা রত্ন কলকাতা থেকে আনানো একটি হীরা দিয়ে সজ্জিত এক রাজমুকুট। স্বর্ণনির্মিত মুকুটটির ওজন ১৬ পাউন্ড ( কেজি ৩০০ গ্রাম প্রায়) এছাড়া তার হাতের রাজদণ্ডটিও স্বর্ণের এনামেল দিয়ে মোড়ানো। রাজদণ্ডটি হীরাসহ বেশকিছু রত্নে খচিত। এসব রত্নের প্রতিটিই ঐতিহাসিক সাংস্কৃতিক কারণে অমূল্য হিসেবে বিবেচিত।

ভাজিরালংকর্ণের মালিকানাধীন জমিতে এরই মধ্যে অনেকগুলো বড় বড় শপিং মল গড়ে তোলা হয়েছে, যেগুলোর ভাড়া চুক্তি ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব পালন করছে ক্রাউন প্রপার্টি ব্যুরো। এর মধ্যে শুধু সিয়াম প্যারাগন শপিং সেন্টার, সিয়াম ডিসকভারি সিয়াম সেন্টার নামে তিনটি বিপণি বিতানে প্রতিদিন প্রায় লাখ ক্রেতার সমাগম ঘটে। ক্রাউন প্রপার্টি ব্যুরো শপিং মলগুলো পরিচালনা না করলেও এখান থেকে প্রতি বছর অজ্ঞাত পরিমাণ অর্থ ভাড়া হিসেবে আদায় করে থাকে।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন