গুরুত্বারোপ

কভিড ভ্যাকসিন: শক্তিশালী কোল্ড চেইন ব্যবস্থা কেন গুরুত্বপূর্ণ

ড. ফারজানা মুনশী

ভ্যাকসিনের কার্যকারিতা ধরে রাখতে এটিকে একটি নির্ধারিত ধ্রুবক তাপমাত্রায় রাখার বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ।

ফেস মাস্ক, সামাজিক দূরত্ব, হাত ধোয়া ও লকডাউন কভিড-১৯ মহামারীর গতি কমানোর কয়েকটি উপায়। এ পদক্ষেপগুলোকে অনুসরণ করে, অনেক দেশ এর বিস্তারকে কমিয়ে আনতে সক্ষম হয়েছে। দুভার্গ্যবশত অনেক দেশে সংক্রমণ ও মৃত্যুর হার এখনো অনেক বেশি। 

লকডাউনের মাধ্যমে সংক্রমণের হার কমানো গেলেও অর্থনৈতিক কার্যক্রম শ্লথ হয়েছে, যা বড় বড় অর্থনীতিকে ঠেলে দিয়েছে মন্দার দিকে। তাই লকডাউন ও সামাজিক দূরত্ব পরিপালন, এমনকি সরকারগুলো যদি তা প্রয়োগ করতে সফলও হয়, তবুও সব ক্ষেত্রে কাজ করে না, বিশেষ করে ঘনবসতিপূর্ণ দরিদ্র দেশগুলোয়। 

আর একটি পন্থা হলো ভ্যাকসিনের মাধ্যমে মহামারীর সংক্রমণ কমানো। বিশ্বজুড়ে বিভিন্ন গবেষক দল কভিড-১৯ ভাইরাসকে প্রতিহত করতে টেকসই ও কার্যকর ভ্যাকসিন তৈরির জন্য কঠোর পরিশ্রমে নিয়োজিত। যতদূর জানা যায়, বিভিন্ন পর্যায়ের প্রায় ২৪০টি প্রতিষ্ঠান বা সংস্থা করোনা ভ্যাকসিন নিয়ে কাজ করছে, যার মধ্যে ৪০টি সংস্থা অগ্রবর্তী অবস্থায় রয়েছে। আগামী বছরের মাঝামাঝি ভ্যাকসিন আবিষ্কার ও এর প্রাপ্যতা নিয়ে বিজ্ঞানীরা আশাবাদী।

তবে এ ভ্যাকসিন উৎপাদন ও বণ্টন নিয়ে চ্যালেঞ্জ থাকবে। প্রথমত, টিকা দেয়ার পরিমাণ আর গতি দ্রুত করতে হবে, কেননা হার্ড ইমিউনিটি তৈরি করতে ৫০০ কোটি লোককে (বৈশ্বিক জনসংখ্যার ৬০ থেকে ৭০ শতাংশ) প্রাথমিকভাবে টিকা দিতে হবে। যদিও এখনো জানা যায়নি টিকা এক নাকি দুই ডোজের হবে। দুই ডোজের ভ্যাকসিন হলে প্রয়োজন পড়বে কমপক্ষে ১২ বিলিয়ন ডোজ উৎপাদনের। বিদ্যমান ভ্যাকসিন উৎপাদনক্ষমতার তুলনায় এটি দ্বিগুণেরও বেশি। এর জন্য অনেক বেশি লজিস্টিক সহায়তা ও কোল্ড চেইন ব্যবস্থার প্রয়োজন পড়বে।

উৎপাদন সীমাবদ্ধতার কারণে প্রাথমিকভাবে সম্ভবত ভ্যাকসিনের সরবরাহ সীমিত থাকবে, এর জন্য রাষ্ট্রভেদে বিতরণ ব্যবস্থাকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। বেশির ভাগ কম আয়ের দেশগুলো তুলনামূলকভাবে দুর্বল স্বাস্থ্য ব্যবস্থার ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। অনেক দেশ আর্থিক অসামর্থ্যের কারণে ভ্যাকসিন সংগ্রহ করতে নাও পারে এবং দেশগুলো ভ্যাকসিন গ্রহণ থেকে বাদ থেকে যাবে অথবা বিলম্বে ভ্যাকসিন পাবে।  

বৈশ্বিক মঙ্গলের জন্য বিশ্বের সব দেশের সব নাগরিককে টিকাদান কর্মসূচিতে অন্তর্ভুক্ত করা উচিত; কেননা ভ্যাকসিন জাতীয়তাবাদ মহামারীকে দীর্ঘায়িত করবে। টিকা উৎপাদন সক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য বিভিন্ন সহযোগীদের নিয়ে গঠিত আন্তর্জাতিক উদ্যোগ কোভ্যাক্স বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও), জিএভিআই (গ্লোবাল অ্যালায়েন্স ফর ভ্যাকসিনস অ্যান্ড ইমিউনাইজেশন) এবং অন্য ভ্যাকসিন প্রস্তুতকারকদের সঙ্গে কাজ করছে। ভ্যাকসিনের সর্বজনীন প্রাপ্তির জন্য একটি জটিল ও বলিষ্ঠ কোল্ড চেইন ব্যবস্থার প্রয়োজন পড়বে। ভ্যাকসিন জৈবিক পণ্য, যা তাপমাত্রা সংবেদনশীল এবং দূষণপ্রবণ। মান বজায় রাখতে উৎপাদনের শুরু থেকে ভ্যাকসিনের প্রয়োগ পর্যন্ত একটি নির্ধারিত ধ্রুবক তাপমাত্রায় রাখার বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ। কোল্ড চেইনের যেকোনো ধরনের ত্রুটির ফলে ভ্যাকসিন নষ্ট বা অকার্যকর হয় এবং তা ফেলে দিতে হয়। শক্তিশালী কোল্ড চেইনের অনুপস্থিতির ফলে ভ্যাকসিনের কার্যকারিতা ২৫ শতাংশেরও বেশি হ্রাস পায়। সমস্যাটি সব দেশেই রয়েছে, তবে বাংলাদেশসহ উন্নয়নশীল দেশগুলোতে লক্ষণীয়ভাবে বিদ্যমান। কোল্ড চেইন বজায় রাখার ক্ষেত্রে এ ধরনের দেশগুলোর অন্যতম সমস্যা হচ্ছে ফার্মাসিউটিক্যাল রেফ্রিজারেটরের স্বল্পতা ও মানহীনতা। অন্যান্য সমস্যার মধ্যে রয়েছে যাতায়াত বা পরিবহন ব্যবস্থা, প্রয়োজনীয় সরঞ্জামাদির স্বল্পতা, বিশেষ করে গ্রামীণ এলাকাগুলোতে ঘন ঘন বিদ্যুৎ বিভ্রাট এবং সর্বোপরি প্রশিক্ষিত কর্মীর অভাব। অনেক স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রে নেই কোল্ড চেইন ব্যবস্থাপনা, তাছাড়া শহর থেকে দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে ভ্যাকসিনগুলো গ্রামীণ এলাকাগুলোতে পৌঁছার ক্ষেত্রে কার্যকারিতা হারানোর উচ্চঝুঁকি রয়েছে। 

এখনো যেহেতু ভ্যাকসিন তৈরি করা হয়নি, তাই এর প্রশাসনিক প্রটোকল ও লজিস্টিকগুলো অজানাই রয়ে গেছে। সম্ভবত কভিড-১৯ ভ্যাকসিন সাধারণ ভ্যাকসিনের তুলনায় অনেক বেশি শীতল তাপমাত্রায় সংরক্ষণের দরকার হতে পারে। তাই স্থানীয় ফার্মেসি বা চিকিৎসকের চেম্বার এমনকি আঞ্চলিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলোতে  ভ্যাকসিনটি সুলভ হবে না। 

যেমন অ্যাস্ট্রাজেনেকা ভ্যাকসিনের ক্ষেত্রে ২ থেকে ৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রার প্রয়োজন হবে। অন্যদিকে মোদারনা/ফাইজার ভ্যাকসিনের ক্ষেত্রে সাব-জিরো কোল্ড চেইন শর্ত প্রয়োজন পড়বে। একেকটি ভ্যাকসিনের ক্ষেত্রে একেক রকম তাপমাত্রা বজায় রাখার বিষয়টি কঠিন এবং এর জন্য বিশেষায়িত ফ্রিজের প্রয়োজন পড়বে। 

কভিড-১৯ ভাইরাসটি যেহেতু দ্রুতগতিতে ছড়িয়ে পড়ছে, সেক্ষেত্রে দ্রুত ভ্যাকসিন সরবরাহ ও প্রয়োগের প্রয়োজন হবে। দ্রুতগতিতে গণটিকা প্রদানের জন্য দেশজুড়ে কোল্ড চেইন ব্যবস্থার আকার বাড়ানো দরকার। এর জন্য সরকার, পরিবেশক, স্বাস্থ্যসেবা কর্মী ও অন্য অংশীদারদের সমন্বয় প্রয়োজন।

উন্নত দেশগুলো কোল্ড চেইন ব্যবস্থার পরিধি বাড়ানোর লক্ষ্যে কাজ করছে। অন্যদিকে বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশগুলো ভ্যাকসিন সংরক্ষণ ও প্রয়োগের বিষয়গুলো নিয়ে  বাড়তি চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হবে। বাংলাদেশের বেশির ভাগ লোকেরই বসবাস গ্রামাঞ্চলে। তাছাড়া স্থানীয় স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলোতে কোনো কোল্ড চেইন ব্যবস্থা নেই। 

তাই টিকা নেয়ার জন্য তাদের জেলা শহরের স্বাস্থ্যকেন্দ্রে আসতে হবে, কিংবা গ্রামের স্বাস্থ্যকেন্দ্রে ভ্যাকসিনগুলো নিয়ে যেতে হবে, আর এভাবে ভ্যাকসিন নষ্ট হওয়ার পরিমাণ বেড়ে যাবে। একটি ভ্যাকসিন একজন মানুষের জীবন বাঁচাতে পারে, তাই ভ্যাকসিন নষ্ট হওয়ার পরিমাণ সর্বনিম্নে রাখার বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। অখণ্ড শক্তিশালী কোল্ড চেইন ব্যবস্থা ভ্যাকসিন নষ্টের হার কম রাখতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। এতে লাখো মানুষের জীবন বাঁচবে, সামাজিক দূরত্বের বিষয়গুলো শিথিল হবে এবং এর মাধ্যমে অর্থনৈতিক কার্যক্রম পূর্ণাঙ্গভাবে চালু করে অর্থনীতিকে মন্দা থেকে পুনরুদ্ধার করা সম্ভব হবে। 

কার্যকরী একটি ভ্যাকসিন অনুসন্ধানের বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ। তাই গবেষকরা এখন যেহেতু ভ্যাকসিন আবিষ্কারের কাজে নিয়োজিত রয়েছেন, এমন সময়ে শক্তিশালী একটি কোল্ড চেইন ব্যবস্থা গড়ে তোলার বিষয়টিও সমান গুরুত্বপূর্ণ। কেননা সঠিক তাপমাত্রায় সংরক্ষণের বিষয়টি নিশ্চিত করে ভ্যাকসিনগুলোকে দ্রুতভাবে বিশ্বব্যাপী বণ্টন ও মানুষের শরীরে প্রয়োগের প্রয়োজন রয়েছে। আমরা যদি এটি করতে ব্যর্থ হই তাহলে ভ্যাকসিন বণ্টনের ক্ষেত্রে অসমতার সৃষ্টি হবে।

বাংলাদেশে বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ ওষুধ ও ভ্যাকসিন শিল্প ও প্রচলিত শক্তিশালী কোল্ড চেইন ব্যবস্থা রয়েছে, কিন্তু দ্রুতগতিতে সংক্রমণ চিহ্নিত করে টিকা প্রদানের সক্ষমতা থেকে এখনো অনেক দূরে। বৃহত্তর স্কেলে কভিড-১৯ টিকাদানের জন্য একটি নতুন দ্রুত চিহ্নিতকরণ পদ্ধতির মূল্যায়ন, পুনর্বিন্যাস এবং উপলব্ধ কোল্ড চেইনের লজিস্টিক সম্পদ ও ব্যবস্থার প্রয়োজন হবে, যা আগে কখনই বিবেচনা করা হয়নি।

ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয় সম্প্রতি বার্মিংহাম ইউনিভার্সিটি, হিরিয়ট-ওয়াট ইউনিভার্সিটি ও বুয়েটের সঙ্গে যৌথভাবে বৃহত্তর স্কেলে কভিড-১৯ টিকা প্রদানবিষয়ক বাংলাদেশের কোল্ড চেইন কাঠামোর সক্ষমতা ও প্রস্তুতি মূল্যায়নে গবেষণা পরিচালনা করছে। 

ওই গবেষণা থেকে প্রাপ্ত ফলাফলগুলো ভ্যাকসিনের জন্য একটি শক্তিশালী কোল্ড চেইন ব্যবস্থা তৈরির সর্বোত্তম বিকল্পগুলোকে শনাক্ত এবং বৃহত্তর স্কেলে কভিড-১৯-এর টিকা প্রদানের জন্য কোল্ড চেইন ব্যবস্থা উন্নয়নের জন্য বিকল্প ব্যয়সাশ্রয়ী পদ্ধতি গ্রহণ করবে এবং নীতিনির্ধারক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানসহ (এমএফআই) মূল অংশীদারদের অবহিত করবে, যা ভবিষ্যতের জরুরি অবস্থা বা দুর্যোগ মোকাবেলার জন্য উপকারী হতে পারে। 


ড. ফারজানা মুনশী: ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের স্কুল অব হিউম্যানিটিজ অ্যান্ড সোস্যাল সায়েন্সের অর্থনীতি ও সামাজিক বিজ্ঞান বিভাগের প্রফেসর ও অ্যাক্টিং চেয়ার। 

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন