প্রশিক্ষণ নেই প্রাথমিকের অর্ধেক শিক্ষকের

মানসম্পন্ন শিক্ষা নিশ্চিতে বরাদ্দ বৃদ্ধি ও শিক্ষক প্রশিক্ষণে জোর দেয়া হোক

জাতিসংঘের বিজ্ঞান, শিক্ষা সংস্কৃতিবিষয়ক সংস্থা ইউনেস্কোর গ্লোবাল এডুকেশন মনিটরিং (জিইএম) রিপোর্ট শীর্ষক এক গবেষণা প্রতিবেদনের তথ্য বলছে, দেশের প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পাঠদানরত শিক্ষকদের অর্ধেকই অপ্রশিক্ষিত। তথ্যমতে, বাংলাদেশের প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোয় পাঠদানরত শিক্ষকদের মধ্যে প্রশিক্ষিত রয়েছে মাত্র ৫০ শতাংশ। প্রতিবেশী অন্যান্য দেশের মধ্যে নেপালের প্রাথমিক শিক্ষকদের প্রশিক্ষণের হার ৯৭ শতাংশ, মালদ্বীপে ৯০, শ্রীলংকায় ৮৩, পাকিস্তানে ৭৮ ভারতে হার ৭০ শতাংশ। হিসেবেও প্রাথমিক শিক্ষকদের প্রশিক্ষণের দিক থেকে দক্ষিণ এশিয়ায় সবচেয়ে পিছিয়ে বাংলাদেশ। পিছিয়ে থাকার কারণ হিসেবে বিশেষজ্ঞরা চাহিদার সঙ্গে জোগানের সমন্বয়হীনতাকে চিহ্নিত করেছেন। প্রায় প্রতিটি সরকারই শিক্ষায় গুরুত্ব দিয়েছে। স্থাপিত হয়েছে নতুন নতুন বিদ্যালয়। কিন্তু সেসব বিদ্যালয়ে পাঠদানের জন্য যারা নিয়োজিত, সেই বিপুলসংখ্যক শিক্ষক-শিক্ষিকাকে প্রশিক্ষিত করার মতো সময় অবকাঠামো কোনোটিই তৈরি হয়নি। নিয়োগের পর পরই শিক্ষকদের পাঠিয়ে দেয়া হয় শ্রেণীকক্ষে। ফলে প্রাথমিক শিক্ষার ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীরা তাদের পাঠ্যক্রমের অনেক কিছু শিখতে পারে না। কোনোমতে পাস করে মাধ্যমিকে যায় তারা। বাংলাদেশে মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষকদের প্রশিক্ষণের ঘাটতি রয়েছে। মূলত শিক্ষা বিস্তার হলেও শিক্ষার্থীদের প্রকৃত সুশিক্ষিত করার অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছে শিক্ষকদের প্রশিক্ষণের অভাব।

জিডিপির অনুপাত হিসেবে শিক্ষায় সরকারের ব্যয় কয়েক বছর ধরে প্রায় শতাংশই থেকে গেছে, যা দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য অনেক দেশের তুলনায় কম। চলতি অর্থবছরেও শিক্ষা খাতে বরাদ্দ রাখা হয়েছে জিডিপির মাত্র দশমিক শূন্য শতাংশ। অথচ ইউনেস্কো দীর্ঘদিন ধরে শিক্ষা খাতে জিডিপির শতাংশ বরাদ্দের কথা বলে আসছে। বরাদ্দের বেশির ভাগই আবার ব্যয় হচ্ছে অবকাঠামোগত উন্নয়ন শিক্ষকদের বেতন-ভাতা বাবদ। প্রশিক্ষণের ব্যয় খুবই কম। জিডিপির শতাংশ শিক্ষা খাতে ব্যয় করে চীন (যুক্তরাষ্ট্র দশমিক শতাংশ, যুক্তরাজ্য দশমিক শতাংশ) চীনে প্রাথমিক শিক্ষা ব্যবস্থায় দুটি বিষয়ের ওপর সবচেয়ে গভীরভাবে নজর দেয়া হয়। এক. শিশুদের প্রাথমিক শিক্ষার মান পদ্ধতি; দুই. শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ প্রদান পদ্ধতি। দুটি বিষয়ের সমন্বয়ে তারা শিশুদের গড়ে তোলার নীতিমালা তৈরি করে, যেখানে জোর দেয়া হয় শিশুদের সৃজনশীলতা, খেলাধুলা, সমন্বিত শিখন পদ্ধতি, শিশুদের কর্মকাণ্ড শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ প্রদানের ওপর। চীনে রয়েছে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ প্রদানের সুদীর্ঘ ইতিহাস, যেটি প্রথম শুরু হয়েছিল ১৮৮৯ সালে নার্সারি স্কুলের শিক্ষকদের প্রশিক্ষণের মাধ্যমে। ১৮৯৫ সালের পর সরকার দৃঢ় সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে শিক্ষাব্যবস্থাকে বিদেশী কারিকুলামের আদলে ঢেলে সাজানোর। জাপান যেহেতু চীনের প্রতিবেশী রাষ্ট্র, সেক্ষেত্রে চীন জাপানকে রোল মডেল হিসেবে গ্রহণ করে জাপানের প্রাথমিক শিক্ষাব্যবস্থার আদলে তৈরি করল চীনের প্রাথমিক শিক্ষানীতি।

দক্ষিণ কোরিয়ার শিক্ষা উন্নয়ন পরিকল্পনার প্রথম পদক্ষেপ ছিল সর্বজনীন প্রাথমিক শিক্ষা এবং সে সার্বজনীনতা কেবল প্রবেশাধিকারে নয়, বরং শিক্ষার গুণগতমান বিষয়বস্তুর ক্ষেত্রেও সার্বজনীনতা নিশ্চিতকরণ। কোরিয়ান ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলিতে পাস হওয়া কোরিয়ান সংবিধানের ১৬ ধারায় প্রাথমিক শিক্ষাকে সর্বজনীনভাবে বাধ্যতামূলক অবৈতনিক ঘোষণা করা হয়। নিষিদ্ধ হয় সব ধরনের বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় এবং সরকার দেশের সবার জন্য প্রাথমিক শিক্ষার ব্যবস্থা সুনিশ্চিত করার দায়িত্ব নেয়। সর্বজনীন প্রাথমিক শিক্ষা নিশ্চিতকল্পে এক উচ্চাভিলাষী কর্মসূচি হাতে নেয়া হয়। সে কর্মসূচি অনুযায়ী প্রচুর শ্রেণীকক্ষ নির্মাণ করা হয়, নিয়োগ করা হয় প্রচুর শিক্ষক এবং ব্যবস্থা করা হয় তাদের পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণের। কোরিয়ার সরকার ইউনেস্কো, ইউএন কোরিয়া রিকনস্ট্রাকশন এজেন্সি মার্কিন সরকারের সহায়তায় দেশব্যাপী ব্যাপক শিক্ষক প্রশিক্ষণ কর্মসূচি হাতে নেয়। সে কর্মসূচির আওতায় কেবল ১৯৫৩ থেকে ১৯৫৫ সালের মধ্যে কর্মরত ৬০ হাজার শিক্ষকের মধ্যে সাড়ে আঠারো হাজার শিক্ষককে প্রশিক্ষণ দেয়। শিক্ষা মন্ত্রণালয় একদিকে যেমন ব্যাপক শিক্ষক উন্নয়ন প্রশিক্ষণ কর্মসূচি হাতে নেয়, তেমনি অন্যদিকে ধীরে ধীরে বাড়াতে থাকে শিক্ষকদের পেশাগত জীবনে প্রবেশের যোগ্যতা। তারই ফলে শিক্ষার গুণগত মানের ক্রমোন্নয়ন ঘটে।

শ্রীলংকায় শিক্ষকদের পেশাগত উন্নয়নের জন্য ইন-সার্ভিস প্রি-সার্ভিস দুই ধরনের সুযোগ রয়েছে। তারা বিশ্ববিদ্যালয় ন্যাশনাল কলেজ অব এডুকেশনের অধীনে শিক্ষক শিক্ষার ওপর প্রি-সার্ভিস কোর্সের ব্যবস্থা রেখেছে। এক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অধীনে অনার্স কলেজগুলোর অধীনে দুই বছরের কোর্সের আয়োজন করা হচ্ছে। যেখানে এক বছর মেয়াদি ইন্টার্নশিপের ব্যবস্থা রয়েছে। তারা প্রাথমিক শিক্ষাসংশ্লিষ্ট বিভিন্ন বিষয়ের পাশাপাশি বিদ্যালয় ব্যবস্থাপনাসংক্রান্ত বিষয়গুলোর ওপর প্রি-সার্ভিস প্রোগ্রামের ব্যবস্থা রেখেছে। এখান থেকে যারা পাস করছেন, তাদের প্রাথমিক মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দেয়ার বিধান রেখেছেন। বাংলাদেশেও বর্তমানে যেসব প্রতিষ্ঠান রয়েছে, তাদের মাধ্যমেই প্রি-সার্ভিস শিক্ষক শিক্ষা সম্পর্কিত অনার্স-ডিপ্লোমা কোর্স চালু করা যেতে পারে। সেক্ষেত্রে ৬৬টি পিটিআইয়ের মাধ্যমে কর্মকাণ্ড শুরু করা যায়। জাতীয় প্রাথমিক শিক্ষা একাডেমি সেক্ষেত্রে সার্বিক সমন্বয়ের ভূমিকা পালন করতে পারে। শুধু প্রয়োজন দক্ষ জনবল নিয়োগ করে দীর্ঘমেয়াদি কর্মপন্থা নির্ধারণ।

প্রাথমিক স্তরের শিক্ষার গুণগত মান উন্নয়নের লক্ষ্যে শিক্ষক প্রশিক্ষণের কোনো বিকল্প নেই। একটি গবেষণায় দেখা গেছে, কোনো ধরনের প্রশিক্ষণ ছাড়া শ্রেণীকক্ষে দাঁড়ানোটা অনেক ভয়ের। তাই শিক্ষকদের শ্রেণীকক্ষে পাঠানোর আগে তাদের শিক্ষণ বিজ্ঞানের বিষয়গুলোর ওপর প্রশিক্ষণ দেয়া জরুরি। একই সঙ্গে তাদের জন্য শিখন-শেখানো কার্যক্রমসংক্রান্ত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করাও যেতে পারে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে শিক্ষকতা পেশায় যোগদানের আগে বিষয়ে প্রশিক্ষণের সনদ নিতে হয়। শুধু প্রাথমিক নয়, শিক্ষার প্রতিটি ধাপেই শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ গ্রহণ অত্যাবশ্যক। নিয়োগের শর্ত হিসেবে ছয় মাসের প্রশিক্ষণ বাধ্যতামূলক করা প্রয়োজন। কেননা আমাদের দেশে বিশেষ করে প্রাথমিক শিক্ষায় বিষয়ভিত্তিক শিক্ষক নিয়োগ দেয়া হয় না। নিয়োগপ্রাপ্ত শিক্ষকরা ভিন্ন বিষয় নিয়ে পড়েছেন। শ্রেণীকক্ষে পাঠদানের জন্য এসব শিক্ষককে প্রশিক্ষণের আওতায় আনা জরুরি। এছাড়া প্রশিক্ষিত শিক্ষকদের জন্য ধারাবাহিক প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা প্রয়োজন। বিভিন্ন প্রফেশনালের জন্য দেশেই সফল অনেক প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট গড়ে উঠেছে। নির্বাহী প্রশাসনের প্রশিক্ষণের জন্য আছে বিপিএটিসি, বিচারপতি, পুলিশ সামরিক বাহিনীর সদস্যদের জন্যও রয়েছে সফল প্রশিক্ষণ কেন্দ্র। পিটিআইকে সফল এসব প্রশিক্ষণকেন্দ্রের আলোকে গড়ে তোলা প্রয়োজন।  

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন