ফড়িয়াদের দৌরাত্ম্যে সবজির বেশি দামেও ঠকছেন কৃষক

আবদুল কাদের, যশোর

এক মাস ধরে দেশের সবজির বাজার ঊর্ধ্বমুখী। বর্তমানে বাজারে অধিকাংশ সবজিই প্রতি কেজি ৬০-৭০ টাকার উপরে বিক্রি হচ্ছে। বন্যা ও অতিবৃষ্টিতে সবজিক্ষেত ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় দাম বেড়েছে বলে দাবি বিক্রেতাদের। যদিও ভিন্ন চিত্র দেখা গেছে দেশের অন্যতম বৃহৎ সবজি বাজার যশোরের সাতমাইল হাটে। এ হাটে কৃষকদের কাছ থেকে অর্ধেক দামে সবজি কিনে দ্বিগুণ দামে, ক্ষেত্রবিশেষে তিন গুণ দামেও বিক্রি করছেন বিক্রেতারা। এতে বাজারে সবজির দাম বেশি থাকলেও তাতে কৃষকদের কোনো উপকারই হচ্ছে না।

সরেজমিন বাজার ঘুরে দেখা গেছে, যশোরের শাকসবজির বাজার এতটাই চড়া যে, ক্রেতাদের নাভিশ্বাস উঠে যাচ্ছে। মাছ- মাংস কেনা তো দূরে থাক, সবজি কিনতে গিয়ে পকেট খালি হয়ে যাচ্ছে তাদের। বাজার ভর্তি শীতকালীন সবজি থাকলেও তাতে হাত দেয়া কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে ক্রেতাদের। ৬০-৭০ টাকার নিচে কোনো সবজি নেই যশোরের বাজারে।

সবজিচাষীদের অভিযোগ, খুচরা বাজারে সবজির আকাশ ছোঁয়া দাম থাকলেও পাইকারি বাজারে নামমাত্র দামে সবজি বিক্রি করতে হচ্ছে তাদের।

বাজারে শীতকালীন সবজির দাম বেশি হলেও কৃষকরা তাতে খুব বেশি একটা লাভবান হচ্ছেন না। মাঠ থেকে কম দামে তরকারি কিনে বাজারে বেশি দামে বিক্রি করেছেন ফড়িয়ারা। আবার বাজারে একটি সিন্ডিকেট রয়েছে, যারা ফড়িয়াদের সঙ্গে যোগসাজশ করে বাড়তি দামের এ মুনাফা লুটছেন।

গত বৃহস্পতিবার যশোরের বড় বাজারে খুচরায় লাউ মানভেদে ৪০-৬০, কেজিপ্রতি মুলা ৪৫ টাকা, পেঁপে ৪৫, কাঁচকলা ৬০, বেগুন ৮৫, শিম ১২০, টমেটো ৮৫, পটোল ৬০, করলা ১১০, ঢেঁড়স ৬০, ফুলকপি ১১০, গাজর ৮০, বরবটি ৮০ টাকা দরে বিক্রি হয়েছে। কিন্তু এসব সবজি সরবরাহ হয় দেশের অন্যতম বৃহৎ সবজি উৎপাদন এলাকা যশোরের সাতমাইল হাট থেকে। ওইদিন হাটে এসব সবজি বিক্রি হয়েছে অর্ধেক দামে। এদিন পাইকারি দরে লাউ মানভেদে ১৫-২০ টাকা, প্রতি কেজি মুলা ২৫, পেঁপে ২০, কাঁচকলা ২০, বেগুন ৪৫-৫০, শিম ৪০-৬০, টমেটো ৫০, পটোল ৪০, করলা ৬০, ফুলকপি ৬০, বরবটি ৪০ ও কাঁচামরিচ ১৫০ টাকায় বিক্রি হয়েছে।

ঢাকার পাইকারি সবজি বেপারি শাহআলম জানান, আগে ঢাকায় যেতে ট্রাক ভাড়া লাগত ১৩-১৪ হাজার টাকা, কিন্তু এখন ভাড়া নিচ্ছে ১৮-২০ হাজার টাকা। পরিবহন খরচ, শ্রমিকসহ আনুষঙ্গিক খরচ দিয়ে সবজির দাম বেড়ে যাচ্ছে। যশোর সদরের চূড়ামনকাঠি গ্রামের সবজিচাষী শহিদুল ইসলাম বলেন, প্রতিদিন সকালে শহর থেকে পাইকারি সবজি ব্যবসায়ীরা আসেন সবজি কিনতে। এখানকার ক্ষেত থেকে তারা ১ হাজার ৫০০ থেকে ১ হাজার ৮০০ টাকা মণ দরে শিম কিনে নিয়ে যান।

খোঁজখবর নিয়ে জানা যায়, যশোর শহরের কাঁচা সবজির বাজারে প্রতি কেজি শিম ১২০ টাকা দরে বিক্রি করা হয়। কিন্তু মাঠ থেকে ফড়িয়ারা এসব সবজি ৪৫-৫০ টাকা কেজি দরে কিনছেন।

যশোর বড় বাজারে সবজি কিনতে আসা শহরের বেজপাড়া এলাকার বাসিন্দা রফিকুল ইসলাম বলেন, বাজারে বিভিন্ন ধরনের সবজির কোনো ঘাটতি নেই। তার পরও সবজির দাম লাফিয়ে বাড়ছে। অবস্থা এমন যে সবজি কিনতে মাছ-মাংস কেনা সম্ভব হচ্ছে না।

যশোর আঞ্চলিক কৃষি অফিসের উপপরিচালক বাদল চন্দ্র বলেন, যশোরে সারা বছর সবজির আবাদ হয়। জেলায় গড়ে আট হাজার টনেরও বেশি সবজি উৎপাদন হয়। প্রতি হেক্টরে ২৩-২৫ টন করে সবজি উৎপাদন হয়। সম্প্রতি কৃষি বিভাগ সবজি উৎপাদনে যশোরকে প্রথম ঘোষণা করেছে।

যশোর আঞ্চলিক কৃষি অফিস সূত্রে জানা গেছে, চলতি বছর যশোরে বিভিন্ন ধরনের সবজি আবাদ হয়েছে ৩৩ হাজার ৭২০ হেক্টর জমিতে, যা থেকে উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৮ লাখ ৯০০ টন।

যশোর জেলায় মোট ৩৩ ধরনের সবজি উৎপাদন হয়। এর মধ্যে বেগুন হেক্টরপ্রতি উৎপাদন হয় ৩৩ দশমিক ৯৮ টন, পটোল ২৩ দশমিক ৩৭, বাঁধাকপি ৪৪ দশমিক ৯৮, ফুলকপি ৩১ দশমিক ৭৮, ওলকপি ৩৪ দশমিক ৯৫, মুলা ৩৪ দশমিক ৫৩, টমেটো ৩৪ দশমিক ৫৬ ও শিম ১৫ দশমিক ৬৪ টন।

যশোর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, জেলায় চলতি মৌসুমে সবজি চাষ হয়েছে ১৬ হাজার ৬৬০ হেক্টর জমিতে। বছরে দুইবার সবজি আবাদ হয়। এর মধ্যে যশোর সদরে ২ হাজার ৩১৫ হেক্টর, শার্শায় ১ হাজার ৬৯৫, ঝিকরগাছায় ২ হাজার ১০, চৌগাছায় ৪ হাজার ২৫০, কেশবপুরে ১ হাজার ১০, মণিরামপুরে ২ হাজার ২৫০, অভয়নগরে ৫৫০ ও বাঘারপাড়ায় ৮৮০ হেক্টর জমিতে সবজি চাষ হচ্ছে।

যশোর জেলা বিপণন কর্মকর্তা সুজাত হোসেন খান বলেন, আমরা নিয়মিত বাজার মনিটরিং করছি। মূলত স্থানীয় সবজি ব্যবসায়ী ও মধ্যস্বত্বভোগীদের কারণে চাষীরা সবজির ন্যায্যমূল্য পাচ্ছেন না।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন