অর্থঋণ আদালতও খেলাপি ঋণ আদায় করতে পারছে না

নিজস্ব প্রতিবেদক

খেলাপি ঋণসংক্রান্ত মামলা দ্রুত নিষ্পত্তির জন্য চালু করা হয়েছিল অর্থঋণ আদালত। যদিও অর্থঋণ আদালতেই আটকে আছে ৬৪ হাজার ৮৩২ মামলা। আর এসব মামলায় ঝুলে গেছে লাখ ২৬ হাজার কোটি টাকার খেলাপি ঋণ। অর্থ মন্ত্রণালয়ের সরকারি প্রতিশ্রুতি সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটির সর্বশেষ বৈঠকে তথ্য তুলে ধরা হয়েছে।

অর্থ মন্ত্রণালয়ের তথ্য বলছে, ২০০৩ সালে অর্থঋণ আদালত গঠন হওয়ার পর এখন পর্যন্ত আদালতে মামলা হয়েছে লাখ ৯২ হাজার ১২১। এসব মামলায় জড়িত অর্থের পরিমাণ ছিল লাখ ৭৭ হাজার ৬৭১ কোটি টাকা। গত জুন পর্যন্ত লাখ ২৭ হাজার ২৮৯টি মামলার নিষ্পত্তি হয়েছে। নিষ্পত্তি হওয়া মামলায় জড়িত অর্থের পরিমাণ ছিল ৫১ হাজার ৫৫৮ কোটি টাকা। যদিও নিষ্পত্তীকৃত অর্থের অর্ধেক ঋণও আদায় করতে পারেনি ব্যাংকগুলো। এখন পর্যন্ত ব্যাংকের দাবির বিপরীতে মাত্র ১৮ হাজার ২৫৬ কোটি টাকা আদায় সম্ভব হয়েছে। অর্থাৎ এখন পর্যন্ত অর্থঋণ আদালতে দাবীকৃত মোট অর্থের মধ্যে আদায় করা গিয়েছে ১০ দশমিক ২৭ শতাংশ।

অর্থঋণ আদালতের দীর্ঘসূত্রতা খেলাপি ঋণ আদায়ে অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছে বলে এতদিন অভিযোগ করে আসছিলেন ব্যাংকাররা। আদালতের কার্যক্রমে গতি আনতে বাংলাদেশ ব্যাংকের মাধ্যমে আইন মন্ত্রণালয়ে কয়েক দফায় অনুরোধও জানানো হয়েছিল। যদিও গতি না এসে উল্টো অর্থঋণ আদালতের কার্যক্রমে স্থবিরতা নেমে আসছে বলে ব্যাংকাররা অভিযোগ তুলেছেন।

মামলা নিষ্পত্তিতে দীর্ঘসূত্রতা ব্যাংকার গ্রাহকদের হয়রানি বাড়াচ্ছে বলে জানান ব্যাংক এশিয়ার শীর্ষ নির্বাহী মো. আরফান আলী। তিনি বলেন, চাহিদার তুলনায় দেশে অর্থঋণ আদালতের সংখ্যা কম। একই সঙ্গে আদালতগুলোর বিচারক সংখ্যাও যথেষ্ট নয়। নানা কারণে অর্থঋণ আদালতের মামলাজট তৈরি হচ্ছে। খেলাপি ঋণ আদায়ে ব্যাংকারদের হয়রানি বাড়ছে। মামলা ঝুলে থাকায় গ্রাহকরাও আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। দেশের ব্যাংকিং খাতকে খেলাপি ঋণের সংস্কৃতি থেকে বের করে আনতে হলে দ্রুতগতিতে বিচার নিষ্পত্তি করতে হবে।

দেশের ফাস্টট্র্যাক আইন হিসেবে ২০০৩ সালে অর্থঋণ আদালতের যাত্রা। আইনের কার্যকারিতাকে দেশের অন্য সব আইনের ওপর প্রাধান্য দেয়া হয়েছে। খেলাপি ঋণের লাগাম টেনে দেশের আর্থিক খাতে শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য নিয়েই প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল অর্থঋণ আদালত। কিন্তু সময়ের বিবর্তনে ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণ না কমে উল্টো বহু গুণ বেড়েছে। মহামারী থেকে দেশের ঋণগ্রহীতাদের সুরক্ষা দিতে চলতি বছর ঋণখেলাপি হওয়ার পথ বন্ধ রাখা হয়েছে। তার পরও জুন শেষে দেশের ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৯৬ হাজার ১১৭ কোটি টাকা। একই সময়ে অবলোপন করা হয়েছে প্রায় ৪৫ হাজার কোটি টাকার খেলাপি ঋণ। অথচ এক দশক আগেও ২০০৯ সালে দেশের ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল মাত্র ২২ হাজার ৪৮১ কোটি টাকা।

অর্থঋণ আদালতে মামলা নিষ্পত্তির জন্য প্রায় সব ধাপেই সময়সীমা বেঁধে দেয়া হয়েছে। যদিও দেশের বিভিন্ন অর্থঋণ আদালতে এখনো ২০০৪ সালে দায়েরকৃত মামলাও চলছে। ২০০৪ সালে চট্টগ্রামের সালেহ গ্রুপের সালেহ কার্পেট মিল, সালেহ জুট মিল, সালেহ জরিনা রুলিং মিলসহ পাঁচটি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ২৫৮ কোটি টাকা খেলাপি ঋণ আদায়ে মামলা করেছিল রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী ব্যাংক। দীর্ঘ ১৬ বছরেও মামলার চূড়ান্ত নিষ্পত্তি হয়নি। আদালতে এখনো জারি হিসেবে মামলাটি চলমান রয়েছে। শুধু চট্টগ্রামের অর্থঋণ আদালতেই মামলা রয়েছে প্রায় পাঁচ হাজার। এসব মামলার অর্ধেকের বয়সই পাঁচ বছরের বেশি।

দ্রুততম সময়ে মামলা নিষ্পত্তির জন্য যে আদালতের প্রতিষ্ঠা, সে আদালতেই মামলা নিষ্পত্তিতে এত দীর্ঘসূত্রিতা কেন?এমন প্রশ্নের জবাবে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার শিহাব উদ্দিন খান বণিক বার্তাকে বলেন, অর্থঋণ আদালত দেশের ফাস্টট্র্যাক আইন। বিবেচনায় দ্রুততম সময়ের মধ্যেই অর্থঋণ আদালতের মামলা নিষ্পত্তি হওয়ার কথা। কিন্তু আদালতের দীর্ঘসূত্রতায় আইনজীবী হিসেবে আমরাও হতাশ। নানা কৌশলে অর্থঋণ আদালতের মামলা নিষ্পত্তি দীর্ঘায়িত করা হচ্ছে। অনেক ক্ষেত্রে মামলা চলাকালেই ব্যাংকের সঙ্গে ঋণখেলাপিদের সমঝোতা হয়ে যায়। কিছু ক্ষেত্রে ব্যাংকাররাই চান না মামলা নিষ্পত্তি হোক। খেলাপি হওয়া ঋণ বিতরণে অনিয়মের সঙ্গে ব্যাংকাররা জড়িত থাকেন। আবার অর্থঋণ আদালতে দায়েরকৃত মামলার বিরুদ্ধে হাইকোর্ট থেকে স্থগিতাদেশ দেয়া হচ্ছে। বড় ঋণখেলাপিদের মামলার নিষ্পত্তি ঠেকাতে বিভিন্ন প্রতিবন্ধকতাও তৈরি করা হচ্ছে। আদালত বিচারকের স্বল্পতাও অর্থঋণ আদালতকে দীর্ঘসূত্রতায় ঠেলে দিচ্ছে।

আইন অনুযায়ী দেশের সব জেলায় অর্থঋণ আদালত থাকার কথা। তবে সারা দেশে কেবল অর্থঋণ বিষয়ের ওপর বিচার করে ধরনের আদালতের সংখ্যা বর্তমানে ১১। যেসব জেলায় অর্থঋণ আদালত নেই, সেখানে যুগ্ম জেলা জজ আদালত একই সঙ্গে ফৌজদারি, দেওয়ানি অর্থঋণ মামলার বিচার পরিচালনা করেন। এতে অর্থঋণ আদালতের পাশাপাশি অন্য আদালতের বিচারকাজেও দীর্ঘসূত্রতা তৈরি হচ্ছে। ঋণখেলাপিদের কাছ থেকে অর্থ আদায়ে নেগোশিয়েবল ইনস্ট্রুমেন্ট অ্যাক্টের অধীনে চেক ডিজঅনার মামলা করছে ব্যাংকগুলো। এসব মামলা দায়ের করা হচ্ছে ফৌজদারি আদালতে। বিপুল খেলাপি ঋণ আদায়ে প্রতিনিয়ত ফৌজদারি আদালতে চেক ডিজঅনারের মামলা বাড়ছে। এতে খেলাপি ঋণ আদায়ের দেওয়ানি মামলাও ফৌজদারি মামলায় রূপান্তর হচ্ছে। ফলে খুন, ধর্ষণ, চুরি-ডাকাতির মতো জঘন্য সামাজিক অপরাধগুলোর বিচারপ্রক্রিয়াও দীর্ঘসূত্রতার মুখে পড়ছে।

বাংলাদেশের প্রথম একমাত্র লাইসেন্সপ্রাপ্ত বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তি (এডিআর) প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ ইন্টারন্যাশনাল আরবিট্রেশন সেন্টার (বিয়াক), যা আরবিট্রেশন মেডিয়েশনের মাধ্যমে বিরোধ নিষ্পত্তি করে থাকে। মামলাজট কমাতে সারা বিশ্বে আর্থিক বিরোধসংক্রান্ত মামলার ৯০ শতাংশই আদালতের বাইরে নিষ্পত্তি হচ্ছে বলে জানান বিয়াকের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মোহাম্মদ (রুমি) আলী। তিনি বণিক বার্তাকে বলেন, সারা বিশ্বে কমার্শিয়াল বিরোধের ৯০ শতাংশ নেগোশিয়েশন, মেডিয়েশন আরবিট্রেশনের মাধ্যমে নিষ্পত্তি হচ্ছে। কিন্তু আমাদের দেশে সব বিরোধই আদালতে চলে যাচ্ছে। আমাদের আরবিট্রেশন-সংক্রান্ত আইনের সীমাবদ্ধতা আছে। ইউরোপ-আমেরিকায় আরবিট্রেশনের দায়িত্ব পালনকারী প্রতিষ্ঠানগুলোকে সরকার অর্থ দেয়। কিন্তু আমাদের দেশের সরকার ধরনের কোনো সহায়তা দিচ্ছে না। বর্তমান পরিস্থিতিতে বিয়াকের মতো প্রতিষ্ঠান চালানো খুবই কঠিন। কারণ আমাদের কাছে কোনো মামলা আসছে না। আমরা চাই সরকার বিয়াকের মতো আরো পাঁচটি প্রতিষ্ঠানের লাইসেন্স দিক, একই সঙ্গে প্রতিষ্ঠানগুলোকে শক্তিশালী করে গড়ে ওঠার আইনি আর্থিক সহায়তা দেয়া হোক। তাহলে দেশের ব্যাংকিং খাতের খেলাপি ঋণ আদায়সহ আর্থিক বিরোধ দ্রুত নিষ্পত্তি হবে।

বেসরকারি খাতের এবি ব্যাংক লিমিটেডের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ (রুমি) আলী বলেন, দেশের ব্যাংকিং খাতের বিদ্যমান সংকট সমস্যাগুলোর সমাধান করা কঠিন কোনো কাজ নয়। এজন্য সব পক্ষের আন্তরিকতা থাকতে হবে। আমরা আইন খুব ভালো বানাতে পারি, কিন্তু আইনের বাস্তবায়ন ঘটাতে পারি না। কিছু চিহ্নিত ঋণখেলাপি ব্যাংক থেকে টাকা নিয়ে ফেরত দিচ্ছেন না। আবার অর্থঋণ আদালতসহ কোনো আদালতই তাদের বিরুদ্ধে কিছু করতে পারছেন না। সংস্কৃতির পরিবর্তন ঘটাতে না পারলে কোনো আইনই কার্যকর বলে প্রমাণিত হবে না।

অর্থঋণ আদালতগুলোর মধ্যে ঢাকার চারটি আদালতেই বিচারাধীন মামলার সংখ্যা ২৫ হাজার ৫৯১। এর মধ্যে অর্থঋণসংক্রান্ত মূল মামলা হাজার ৯৭৬টি। আর অর্থ জারি মামলার সংখ্যা ১৭ হাজার ২৮১ এবং মিস কেস ৩৩৪। বিপুল মামলার চাপে হিমশিম খাচ্ছেন ঢাকার অর্থঋণ আদালত। আবার দীর্ঘদিনেও নিষ্পত্তি হচ্ছে না এসব আদালতে দায়েরকৃত মামলা।

অর্থঋণ আদালতের মামলার দীর্ঘসূত্রতার বিষয়ে অ্যাটর্নি জেনারেল আবু মোহাম্মদ আমিন উদ্দিন বণিক বার্তাকে বলেন, আমি নিজেও বুঝি না কেন অর্থঋণ আদালতে মামলা নিষ্পত্তিতে এত দীর্ঘসূত্রতা হচ্ছে। অর্থঋণ আদালতে মামলা নিষ্পত্তিতে যদি সাধারণ আদালতের মতোই সময় লাগে, তাহলে আইনের স্বতন্ত্রতা থাকে না। অর্থঋণ আদালতের প্রতিটি ধারা ব্যাংকের পক্ষে। তার পরও ব্যাংকের খেলাপি ঋণ বেড়ে যাওয়া অর্থ আদায় না হওয়াটি দুঃখজনক। ব্যাংকগুলো অর্থঋণ আদালতে মামলা পরিচালনার জন্য যেসব আইনজীবী নিয়োগ দেন, তারা চাইলে দ্রুততম সময়ে মামলা নিষ্পত্তি করা সম্ভব।

সরকারের প্রধান আইন কর্মকর্তা বলেন, খেলাপি ঋণ কমাতে হলে ব্যাংকারদেরই সবার আগে সতর্ক হওয়া দরকার। ব্যাংকাররা যথাযথ রীতিনীতি মেনে ঋণ দিলে খেলাপি ঋণ এত বেশি হতো না। অনেক সময় ব্যাংকগুলো লাখ টাকার জামানতের ভ্যালুয়েশন লাখ টাকা দেখান। ফলে জামানতের সম্পদ নিলামে তুলে লাখ টাকাও বিক্রি করতে পারে না। পরিস্থিতি থেকে বেরোতে হলে ব্যাংকারদের সবার আগে সংশোধন হতে হবে।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন