আবাসিকে সংযোগ বন্ধ

জনপ্রিয় হচ্ছে ভবনে সমন্বিত গ্যাস সিলিন্ডার সংযোগ ব্যবস্থা

আবু তাহের

রাজধানীতে এক দশকেরও বেশি সময় ধরে আবাসিকে গ্যাস সংযোগ বন্ধ থাকায় বহুতল বাসা-বাড়ি কিংবা বাণিজ্যিক ভবনে বিকল্প জ্বালানি হিসেবে তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলপিজি) সিলিন্ডারের ব্যবহার বেড়েছে। তবে উঁচু ভবনে কিংবা বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানে এসব গ্যাস-সিলিন্ডারের ঝক্কি-ঝামেলা দূর করতে রেটিকুলেশন সিস্টেম চালু করেছে এলপিজি কোম্পানিগুলো। এরই মধ্যে জনপ্রিয়ও হয়ে উঠেছে সিলিন্ডারের মাধ্যমে গ্যাস সরবরাহের তুলনামূলক নতুন ব্যবস্থা।

রাজধানী ঢাকায় ২০১৩ সালের দিকে চালু হয় রেটিকুলেশন সিস্টেম। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, পাইপলাইনে সরবরাহ করা প্রাকৃতিক গ্যাসের বিকল্প হিসেবে এলপিজির নতুন পদ্ধতি গ্রাহককে নিরাপদ ঝামেলামুক্ত করেছে। বর্তমানে বসুন্ধরা, বেক্সিমকো, যমুনা, জি-গ্যাস, ল্যাফস গ্যাসসহ অন্তত সাত-আটটি এলপিজি কোম্পানি গ্রাহককে সেবা দিচ্ছে। রাজধানীতে পাইপলাইনের সংযোগ নেই এমন কয়েক হাজার ভবনে এরই মধ্যে ব্যবস্থা চালু হয়েছে। এর বাইরে দেশের বড় বড় বেশকিছু জেলা শহরে বহুতল ভবনগুলোতে রেটিকুলেশন সিস্টেম প্রতিস্থাপন করা হচ্ছে।

কোম্পানিগুলোর সূত্রে জানা গেছে, একটি ছয়তলা ভবনের ছোট আকারের ফ্ল্যাটগুলোতে ১৫ থেকে ২০ হাজার টাকা খরচ হয়। এলপিজি কোম্পানিগুলো নিজস্ব লোকবলের মাধ্যমে সিস্টেম প্রতিস্থাপন করে দিচ্ছেন। এছাড়া অনেক ভবনের কর্তৃপক্ষও নিজেরা এখন রেটিকুলেশন সিস্টেম তৈরি করছেন।

মূলত প্রতিটি ফ্ল্যাটে এককভাবে সিলিন্ডার ব্যবহার না করে একটি নির্দিষ্ট জায়গায় অনেকগুলো সিলিন্ডার বসিয়ে সেখান থেকে পাইপলাইনের মাধ্যমে গ্রাহককে জ্বালানি সরবরাহ করার ব্যবস্থাটিই রেটিকুলেশন সিস্টেম নামে পরিচিত। যেখানে একজন গ্রাহক ওই লাইনের মাধ্যমে ঠিক যে পরিমাণ গ্যাস ব্যবহার করছে, তার ওপর ভিত্তি করে বিল পরিশোধ করেন।

ব্যবহারকারীরা বলছেন, পদ্ধতিতে তারা নিরবচ্ছিন্ন এলপিজি ব্যবহার করতে পারছেন। একই সঙ্গে সিলিন্ডার পরিবর্তনের মতো ঝামেলা থেকে মুক্তি পেয়েছেন। তাছাড়া ছোট সিলিন্ডারের গ্যাস ফুরিয়ে যাওয়ার তাত্ক্ষণিক সমাধান হিসেবে পদ্ধতি বেশ সুফল বলে জানান তারা।

রেটিকুলেশন সিস্টেম ব্যবহার করে রাজধানীতে বড় আকারে গ্যাসের সংযোগ দেয়া হয় মিরপুরের রূপসী প্রো অ্যাকটিভ ভিলেজ-এ। সেখানে বড় ধরনের বুলেট ট্যাঙ্ক বসিয়ে প্রায় ৪০০ গ্রাহককে পদ্ধতিতে জ্বালানি সরবরাহ করা হচ্ছে। সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, একটি টিনশেডের নিচে বুলেট ট্যাঙ্ক বসিয়ে সাতটি আবাসিক ভবনে গ্যাস সংযোগ দেয়া হয়েছে। গ্রাহকরা পাইপলাইনের মাধ্যমেই নিজ নিজ বাসায় গ্যাস ব্যবহার করছেন। শুধু মিরপুরেই নয়, রাজধানীর ধানমন্ডি, গুলশান, উত্তরায় বিভিন্ন বহুতল ভবনে রেটিকুলেশন সিস্টেমে গ্যাস সরবরাহ করা হচ্ছে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বড় পরিসরে রেটিকুলেশন সিস্টেম ব্যবহার করে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) উত্তরা আবাসন প্রকল্পে অন্তত সাড়ে তিন হাজার ফ্ল্যাটে সংযোগ দেয়া হচ্ছে। এছাড়া রাজধানীতে বিভিন্ন সরকারি ভবনে পদ্ধতি ব্যবহার করে গ্যাস সংযোগ দেয়া হয়েছে।

রেটিকুলেশন সিস্টেম বিষয়ে জানতে চাইলে বসুন্ধরা এলপি গ্যাসের জেনারেল ম্যানেজার (সেলস) জাকারিয়া জালাল বণিক বার্তাকে বলেন, পদ্ধতি গ্রাহকের জন্য বেশকিছুটা সাশ্রয়ী। এককভাবে ১২ কেজির সিলিন্ডার ব্যবহার করলে যে খরচ হয়, সে তুলনায় রেটিকুলেশন সিস্টেমে বড় সিলিন্ডার (৪৫ কিংবা ৩৫ কেজি) ব্যবহার করলে তুলনামূলক খরচ কম হয়। এছাড়া বহুতল ভবনে সিলিন্ডার ওঠানো বা নামানোর ঝামেলার কারণেও অনেকে পদ্ধতি ব্যবহারে আগ্রহী হয়ে উঠছেন।

রাজধানীর ধানমন্ডিতে বহুতল একটি আবাসিক ভবনে পদ্ধতিতে গ্যাস ব্যবহার করছেন রবিউল ইসলাম। তিনি বলেন, গত আট মাস ধরে ব্যবহার করছি। মিটার অনুযায়ী যে বিল আসে সেটা দিতে হয়। পাইপলাইনের চেয়ে খরচ একটু বেশি হলেও সবসময় নিরবচ্ছিন্ন সংযোগ থাকে। তাছাড়া সিলিন্ডার বহনের মতো কোনো ঝামেলা নেই।

তবে শুধু আবাসিকেই নয়, বিভিন্ন ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানও এখনো গ্যাসের নতুন সংযোগের চিন্তা না করে রেটিকুলেশন সিস্টেম বেছে নিয়েছেন। ২০১৭ সাল থেকে পদ্ধতিতে এলপিজি ব্যবহার করছে রাজধানীর গুলশানে অবস্থিত শেফস টেবিল নামে একটি রেস্টুরেন্ট। সেখানকার একজন কর্মকর্তা জানান, পাইপলাইনের গ্যাস সংযোগ না পাওয়ায় পদ্ধতিতে গ্যাসের চাহিদা পূরণ বেশ নিরাপদ সহজলভ্য। প্রতিনিয়ত কোম্পানির কর্মীরা তদারক করেন। ফলে গ্যাস ফুরিয়ে যাওয়ার কোনো দুশ্চিন্তা নেই।

এলপিজি সরবরাহকারী অন্যতম প্রতিষ্ঠান জি গ্যাসের জেনারেল ম্যানেজার (সেলস অ্যান্ড মার্কেটিং) আবু সাঈদ রাজা বলেন, অত্যাধুনিক সুবিধা সংবলিত রেটিকুলেশন পদ্ধতি ব্যবহার করে এলপিজিতে আগ্রহী হচ্ছেন ভবন মালিকরা। এরই মধ্যে আমরা রাজধানীর অন্তত হাজার খানেক ফ্ল্যাটে সংযোগ দিয়েছি। গ্রাহক চাহিদাও আগের চেয়ে কয়েক গুণ বেড়ে গেছে। আবাসিক সংযোগ বন্ধ থাকায় রেটিকুলেশন নিয়ে প্রচারণা চালানো গেলে পদ্ধতি আরো জনপ্রিয় হয়ে উঠবে।

বিস্ফোরক পরিদপ্তর জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, গ্যাসের সংকটে পদ্ধতিতে বাসাবাড়িতে কিংবা বাণিজ্যিক ভবনে গ্যাস সরবরাহ বেশ নিরাপদ কার্যকরী। এখানে সিলিন্ডার বিস্ফোরণে ঝুঁকি এবং বহনের মতো ঝামেলা নেই।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক জ্বালানি বিশেষজ্ঞ বদরুল ইমাম বলেন, রেটিকুলেশন সিস্টেম গ্যাসের গ্রাহকদের জন্য আধুনিক সুবিধা সংবলিত একটি পদ্ধতি। পদ্ধতিতে গ্রাহকের গ্যাস ব্যবহারে যেমন ঝুঁকি কম থাকে, তেমনি সিলিন্ডার ব্যবহারের ঝামেলা দূর হয়েছে। পদ্ধতির প্রচার প্রসার ঘটলে বাসাবাড়িতে এলপিজি ব্যবহারে আরো উৎসাহিত হবেন গ্রাহকরা।

প্রসঙ্গত, গ্যাস মজুদ সরবরাহ সংকটে বিদ্যুৎ, জ্বালানি খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের জ্বালানি বিভাগ ২০০৯ সালে আবাসিকে গ্যাস সংযোগ বন্ধ করে দেয়। ২০১৩ ২০১৪ সালে মৌখিকভাবে অনুমতি দিলেও ২০১৮ সালে তা আবারো বন্ধ রাখার নির্দেশ দেয় জ্বালানি বিভাগ।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন