চালের জনপ্রতি ভোগের হিসাব নিয়ে তথ্যবিভ্রাট

খাদ্যসম্পর্কিত সঠিক নীতি প্রণয়নে প্রতিবন্ধক

কার্যকর পরিকল্পনা প্রণয়ন নীতিনির্ধারণে প্রয়োজন সঠিক পরিসংখ্যান। একটি বছরে একটি দেশে কতটুকু চাল বা অন্যান্য পণ্যের মজুদ প্রয়োজন, তা নির্ভর করে জনগণের ভোগের ওপর। আর এটি নিয়মিত হিসাব করে থাকে পরিসংখ্যান ব্যুরোর মতো প্রতিষ্ঠান। কিছু গবেষণা প্রতিষ্ঠানের জরিপের মাধ্যমে প্রাপ্ত তথ্য এক্ষেত্রে বিকল্প উৎস হিসেবে কাজ করে। একথা অনস্বীকার্য, খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিতের সঙ্গে ধান-চালের উৎপাদন মজুদের গুরুত্বপূর্ণ সম্পর্ক রয়েছে। চাহিদার চেয়ে উৎপাদন বেশি হলে রফতানি এবং কম হলে আমদানির উদ্যোগ নেয়া হয়। এমন প্রেক্ষাপট থেকে জনপ্রতি চালের পরিভোগের সঠিক তথ্যের গুরুত্ব অপরিসীম। কিন্তু গতকাল বণিক বার্তায় প্রকাশিত সংশ্লিষ্ট এক প্রতিবেদনে দেখা যাচ্ছে, জনপ্রতি চাল পরিভোগে বিবিএস, বিআইডিএস ইফপ্রির দেয়া তথ্যের মধ্যে বড় ধরনের পার্থক্য বিদ্যমান। বিবিএসের তথ্য সত্য হলে দেশে চাল উদ্বৃত্ত থাকার কথা কিন্তু বিআইডিএস ইফপ্রির তথ্য বিবেচনায় নিলে উদ্বৃত্ত নয়, বরং ঘাটতি থাকার কথা। একথা সত্য, বিবিএসের তথ্যকেই সর্বজনীনভাবে গ্রহণযোগ্য মনে করা হয় নানা কারণে। তাদের নিয়মিত জরিপ, জরিপে অন্তর্ভুক্ত খানার সংখ্যা, জনবল প্রভৃতি সংস্থাটিকে এগিয়ে রাখে। বিবিএসের জনপ্রতি চাল পরিভোগের তথ্য ২০১৬ সালের পর আর পাওয়া যায় না। সেক্ষেত্রে ইফপ্রি এগিয়ে, তাদের কাছ থেকে প্রাপ্ত তথ্য ২০১৮ সালের। চাল পরিভোগের মতো একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে বিবিএসের কাছে হালনাগাদ তথ্য-পরিসংখ্যান না থাকাটা হতাশার।

চাল উৎপাদন কিংবা ভোগের তথ্য নিয়ে প্রশ্ন উঠছে অনেক আগে থেকেই। কিন্তু এটি সংশোধন বা সঠিক তথ্য সংগ্রহে কারো আগ্রহ তেমন পরিলক্ষিত হচ্ছে না। অথচ বাজার তথ্যের সঙ্গে আমাদের প্রকাশিত সব তথ্যের মিল থাকা প্রয়োজন। তা না হলে নীতি প্রণয়নে, বিশেষ করে চাল আমদানি কিংবা রফতানির বিষয়ে সঠিক পদক্ষেপ নেয়া মুশকিল হয়ে পড়বে। চাল উৎপাদন ভোগের তথ্যের ক্ষেত্রে কোনো বিষয়ে পর্যালোচনার প্রয়োজন মনে করলে সেটি বিবেচনায় নিতে হবে। তা না হলে চাল আমদানির বিষয়ে কার্যকর পদক্ষেপ নেয়া সম্ভব হবে না। বাংলাদেশ চালে স্বয়ংসম্পূর্ণ বা বাড়তি উৎপাদন হয়েছে রফতানি করতে হবেএমন সিদ্ধান্ত সাধারণত জনপ্রতি চালের পরিভোগের ওপর নির্ভর করে নেয়া হয়। কিন্তু যে বছর চাল রফতানির সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে, সে বছরই চাল আমদানি করতে হয়েছে। ফলে এখান থেকে স্পষ্টত প্রতীয়মান হয়, আমাদের ভোগ উৎপাদন, এমনকি আমদানিতে তথ্যগত অসংগতি রয়েছে। এতে অপচয় হওয়ার পাশাপাশি শঙ্কা থাকে ঘাটতির।

বিআইডিএসের এক গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, সরকারি সংস্থাগুলো চাল উৎপাদন থেকে শতাংশ বাড়িয়ে দেখায়। তারা মাথাপিছু খাদ্যের যে ভোগ দেখায়, তাতেও ১৫ শতাংশ কমিয়ে দেখানো হয়। খাদ্য উৎপাদন ভোগ মিলিয়ে যে হিসাব দাঁড়ায়, তাতে কমপক্ষে ২০ শতাংশ চাল উৎপাদন ভোগের হিসাবে গরমিল রয়ে যায়। বিআইডিএস বলছে, সরকারের খাদ্য পরিধারণ মূল্যায়ন ইউনিট (এফপিএমইউ) বিবিএস মাথাপিছু চাল আটা ভোগের হিসাব কম দেখায়। আর এফপিএমইউর মাথাপিছু খাদ্য ভোগের হিসাব বাস্তবভিত্তিক গবেষণার আলোকে করা হয় না। অথচ তথ্যই নীতিনির্ধারক গবেষকরা সবসময় ব্যবহার করে চলেছেন। দেশের চালের বাজারের সামগ্রিক কোনো ধারণা সরকারের কাছে নেই। কারণে সরকার তাদের এই গবেষণা করতে বলেছে। চালের বাজার নিয়ে আরো বিস্তারিত পূর্ণাঙ্গ গবেষণা হওয়া প্রয়োজন। বাংলাদেশের পরিসংখ্যান সাম্প্রতিক সময়ে প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে বিভিন্ন মহল থেকে। বিশ্বব্যাংকের সূচকেও অবনমন ঘটেছে বাংলাদেশের পরিসংখ্যানের।

গবেষণায় আরো দেখা গেছে, ধান চাষের আবাদি জমির পরিমাণেও গরমিল রয়েছে। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর কৃষক তার নিজের জমির যে হিসাব দেন, তার ভিত্তিতে মোট চাষের জমির হিসাব করে। কিন্তু বিআইডিএসের গবেষণা দল কৃষকের দাবি করা চাষের জমি আমিন দিয়ে মাপজোখ করে দেখেছে, বেশির ভাগ ক্ষেত্রে জমির হিসাব কমপক্ষে শতাংশ বাড়িয়ে দেখানো হয়। আর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা কাগজে-কলমে জমির হিসাব আরো শতাংশ বেশি দেখান। ফলে উৎপাদনও বাড়িয়ে দেখানো হয়। খাদ্যসংক্রান্ত তথ্যবিভ্রাটের কারণে পরিকল্পনা প্রণয়ন থেকে শুরু করে বাজার নিয়ন্ত্রণ কোনোটিই সঠিকভাবে করা যাচ্ছে না। একদিকে ধান উৎপাদন বেশি দেখানো হচ্ছে, অন্যদিকে দাম বাড়ছে। কিন্তু অর্থনীতির স্বতঃসিদ্ধ নিয়ম অনুযায়ী চাহিদা কম থেকে জোগান বেশি থাকলে পণ্যের দাম কমার কথা। কিন্তু বাংলাদেশে এটি কাজ করছে না। এর একটি কারণ সঠিক পরিসংখ্যানের অভাব। গবেষণায় এটি প্রমাণিতও হয়েছে। ভবিষ্যতের খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিতের জন্য তাই খাদ্য তথ্যবিভ্রাট দূর করা জরুরি। জমি, উৎপাদন, আমদানি-রফতানি, পরিভোগ প্রভৃতির সঠিক সময়োপযোগী তথ্য-পরিসংখ্যান নিয়মিত হালনাগাদ থাকা আবশ্যক। এক্ষেত্রে প্রযুক্তির ব্যবহার জরিপের আওতা আরো বাড়ানো প্রয়োজন।

প্রমাণভিত্তিক, বাস্তবসম্মত সঠিক উন্নয়ন পরিকল্পনা এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য সঠিক পরিকল্পনা দরকার। সময়োচিত নির্ভরযোগ্য পরিসংখ্যান সংগ্রহ, সংকলন এবং প্রকাশনা নিশ্চিতকরণের লক্ষ্যে ভারতের আদলে দেশের পরিসংখ্যান ব্যুরোকে শক্তিশালী করা যেতে পারে। এক্ষেত্রে পরিসংখ্যান ব্যুরোতে বড় ধরনের সংস্কার প্রয়োজন। এর মূল উদ্দেশ্য হওয়া উচিত সঠিক, নির্ভরযোগ্য, আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন পরিসংখ্যান প্রণয়ন। লক্ষ্যে বিবিএস পরিচালিত প্রধান প্রধান জরিপসহ অন্যান্য পরিসংখ্যানগত কার্যক্রমের পরিচালনা পদ্ধতিকে যুগোপযোগী করা। দ্রুততম সময়ে তথ্য সংগ্রহ, সংকলন, প্রক্রিয়াকরণ বিশ্লেষণের মাধ্যমে যথাসময়ে তথ্য বা রিপোর্ট প্রকাশ করা। তথ্য সংগ্রহ থেকে রিপোর্ট প্রকাশ পর্যন্ত সামগ্রিক প্রক্রিয়া স্বয়ংক্রিয় করার লক্ষ্যে একটি আইসিটি পরিকল্পনা প্রণয়ন এবং সীমাবদ্ধ সম্পদের সর্বোত্তম ব্যবহারের মাধ্যমে সর্বাধিক পরিসংখ্যান প্রস্তুতের লক্ষ্যে জরিপের পরিবর্তে প্রশাসনিক উৎস থেকে নিয়মিত তথ্য সংগ্রহ করা। পরিসংখ্যান প্রণয়ন একটি টেকনিক্যাল বিষয়। কাজ সঠিকভাবে সম্পাদনের জন্য দক্ষ জনবল অপরিহার্য।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন