হার্ড ইমিউনিটির মিথ্যা প্রতিশ্রুতি

বণিক বার্তা ডেস্ক

মে মাসে ব্রাজিলিয়ান শহর মানাউস কভিড-১৯-এর বড় আকারের প্রাদুর্ভাবের কারণে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ল। হাসপাতালগুলো রোগীর ভিড়ে উপচে পড়ল এবং জঙ্গলের আশপাশে গিয়ে নগর কর্তৃপক্ষকে কবর খুঁড়তে হলো। কিন্তু আগস্টের মধ্যে কিছু ব্যাপার বদলে গিয়েছিল। জুনের শুরুতে সামাজিক দূরত্বের বিধি শীতল করা সত্ত্বেও দুই মিলিয়ন লোকের শহরে অতিরিক্ত মৃত্যুর হার হ্রাস পেতে শুরু করল। প্রতিদিন ১২০টি মৃত্যু থেকে সেটি নেমে আসে প্রায় শূন্যের কোটায়।

সেপ্টেম্বরে গবেষকদের দুটি দল প্রিপ্রিন্টে পোস্ট করে বলে, মানাউসে গ্রীষ্মের শেষে অন্তত কিছু অংশে কভিড-১৯-এর সংক্রমণ শ্লথ হয়েছে, এর কারণ সে অঞ্চলের বড় একটি অংশ এরই মধ্যে ভাইরাসের সংস্পর্শে এসেছে এবং বর্তমানে ইমিউন হয়েছে। ব্রাজিলে ইউনিভার্সিটি অব সাও পাওলোর ইমিউনোলজিস্ট ইস্টার সাবিনো তার সহকর্মীরা মানাউসে ব্লাড ব্যাংক থেকে ছয় হাজারের বেশি নমুনার সার্স-কোভ--এর অ্যান্টিবডি পরীক্ষা করেছেন।

সাবিনো বলেন, আমরা দেখেছি বেশ উচ্চমাত্রায় মানুষজন সংক্রমিত হয়েছে। যেখানে প্রথম ঝড় শেষে সেটি পৌঁছে ৬৬ শতাংশে। তিনি বলেন, তার দল সিদ্ধান্তে পৌঁছেছে যে বৃহৎ আকারে সংক্রমণ মানে এখন যারা সংক্রমিত হওয়ার জন্য সংবেদনশীল তারা নতুন প্রাদুর্ভাব বজায় রাখার জন্য খুবই ছোট অংশ, যাকে ডাকা হয় হার্ড ইমিউনিটি নামে। ব্রাজিলের আরো একটি গবেষক দল একই সিদ্ধান্তে পৌঁছেছিল।

মানাউসের ধরনের প্রতিবেদন, সঙ্গে ইতালির বিভিন্ন অংশ যা মহামারীতে ব্যাপকভাবে আঘাত পেয়েছিল, তাদের নিয়ে করা তুলনামূলক আলোচনা হার্ড ইমিউনিটিতে পৌঁছার প্রস্তাবে উৎসাহিত করেছিল। পরিকল্পনা প্রস্তাব করেছিল, সমাজকে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরতে দেয়া হোক, আর যারা গুরুতর রোগের ঝুঁকিতে আছে তাদের রক্ষা করার ব্যবস্থা নেয়া হোক। এটা মূলত করোনাভাইরাস তার কাজ চালিয়ে যাওয়া অনুমতি দেবে, প্রস্তাবকারীরা বলেছিল।

কিন্তু এপিডেমিওলজিস্টরা বারবার ধারণাকে উড়িয়ে দিয়েছেন। ইমিউনোলজিস্ট ক্রিস্টিয়ান অ্যান্ডারসন বলেন, ভাইরাসের কাছে আত্মসমর্পণ সমর্থনযোগ্য কোনো পরিকল্পনা নয়। ধরনের উপায় অবলম্বন করার ফলে সমাজের স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসার গতি ছাড়াই মানব জীবনের এক মহাবিপর্যয়ের কারণ হতে পারে। তিনি বলেন, আমরা আগে কখনই সফলভাবে এটি করতে সক্ষম হইনি এবং এটি অগ্রহণযোগ্য অপ্রয়োজনীয়ভাবে মানুষকে মৃত্যু যন্ত্রণার দিকে চালিত করবে।

বিস্তৃত সমালোচনা সত্ত্বেও অনেক দেশের রাজনীতিবিদ নীতিনির্ধারকরা ধারণাতে অটল থাকেন। যেখানে সুইডেন, যুক্তরাজ্য যুক্তরাষ্ট্রও অন্তর্ভুক্ত আছে। সেপ্টেম্বরে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পও বিষয়ে ইতিবাচক কথা বলেন এবং তিনি সময় হার্ড ইমিউনিটি কথাটির অপপ্রয়োগও ঘটান। এমনকি আরো অনেক বিজ্ঞানীও এজেন্ডাকে উৎসাহিত করেন। অক্টোবরের শুরুতে উদারপন্থী থিংক ট্যাংক এবং বিজ্ঞানীদের ছোট একটি দল একটি নথি প্রকাশ করে, যাকে ডাকা হচ্ছে গ্রেট বারিংটন ঘোষণা নামে। সেখানে তারা কভিড-১৯-এর নিম্ন ঝুঁকির মানুষদের স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসার আহ্বান জানান, যা সার্স-কোভ-২কে অনুমতি দেবে পর্যাপ্ত পরিমাণে বিস্তৃত হয়ে হার্ড ইমিউনিটি নিয়ে আসতে। 

হার্ড ইমিউনিটি কী?

হার্ড ইমিউনিটি তখন ঘটে যখন ভাইরাস বিস্তৃত হতে পারে না, কারণ এটা সেসব মানুষের মোকাবেলা করতে থাকে যারা কিনা সংক্রমণ থেকে সুরক্ষিত। যখন জনসংখ্যার পর্যাপ্ত মানুষ আর সংবেদনশীল থাকবে না, তখন নতুন কোনো প্রাদুর্ভাবও আর সংঘটিত হবে না। এপিডেমিওলজিস্ট ক্যারোলিন বাককে বলেন, জনসংখ্যার সবাইকে ইমিউন হওয়ার প্রয়োজন নেই। আপনার কেবল যথেষ্ট মানুষকে ইমিউন করলেই চলবে।

সাধারণত হার্ড ইমিউনিটি আলোচিত হয় বিস্তৃত পরিসরের ভ্যাকসিনেশন প্রোগ্রামের কাঙ্ক্ষিত ফলের ক্ষেত্রে। উচ্চস্তরের ভ্যাকসিনেশন ইমিউনিটিকে প্ররোচিত করে, ফলে যারা ভ্যাকসিন গ্রহণ করেনি কিংবা ভ্যাকসিনের পর্যাপ্ত প্রতিক্রিয়া লাভ করেনি তারাও এর সুবিধা লাভ করবে। বাককে বলেন, অনেক মেডিকেল পেশাদার হার্ড ইমিউনিটি টার্মকে ঘৃণা করেন, বরং তারা হার্ড প্রটেকশন শব্দটি বলতেই বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন। কারণ এটি আসলে ভাইরাসের নিজের থেকে ইমিউনিটি দেয় না। এটা কেবল দুর্বল মানুষকে রোগজীবাণুর সংস্পর্শে আসার ঝুঁকিকে হ্রাস করে। জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা সাধারণত ভ্যাকসিনের অনুপস্থিতিতে হার্ড ইমিউনিটি নিয়ে কথা বলেন না। এপিডেমিওলজিস্ট মার্সেল সালাথে বলেন, আমি কিছুটা ধাঁধায় আছি যে এটাকে থামানোর আগে কতজন সংক্রমিত করতে হবে, সেটি বুঝাতে এখন ব্যবহূত হয়।

কীভাবে এটি অর্জন করতে হবে?

এপিডেমিওলজিস্টরা এখন অনুমান করতে পারেন যে হার্ড ইমিউনিটি কাজ শুরুর আগে জনসংখ্যার কত অংশকে ইমিউন করতে হবে। এটি নির্ভর করছে রিপ্রোডাকশন নাম্বার -এর ওপর, এর অর্থ একজন সংক্রমিত লোক কতজনকে সংক্রমিত করতে পারে সেটি। উদাহরণস্বরূপ হামের কথা বলা যায়, যেখানে -এর মান হচ্ছে ১২ থেকে ১৮। অর্থাৎ, হার্ড ইমিউনিটি পেতে হবে ৯২ থেকে ৯৪ শতাংশ জনগণকে। আর যে ভাইরাস কম সংক্রামক, সেক্ষেত্রে হার্ড ইমিউনিটি অর্জনের হারও নিম্ন হবে। তবে -এর মান বোঝায় যে সব জনগণ সংবেদনশীল। কিন্তু সেটি মহামারী এগিয়ে যাওয়ার সঙ্গে বদলে যায়। কারণ কিছু মানুষ সংক্রমিত হয়ে ইমিউনিটি লাভ করে।

তবে এত কিছুর পরও জনসংখ্যার মাঝে একবার হার্ড ইমিউনিটি অর্জিত হলেও বড় প্রাদুর্ভাবের সম্ভাবনা শেষ হয়ে যায় না। বিশেষ করে যেসব এলাকায় ভ্যাকসিনের হার কম সেখানে।

হার্ড ইমিউনিটি কাজ করে কিনা

অনেক গবেষক বলছেন, হার্ড ইমিউনিটির জন্য চাপ প্রয়োগ করা একটি বাজে ধারণা। অ্যান্ডারসন বলেন, সংক্রমণের মাধ্যমে হার্ড ইমিউনিটি অর্জনের যে চেষ্টা তা হাস্যকর। যুক্তরাষ্ট্রেই সম্ভবত এক থেকে দুই মিলিয়ন মানুষের মৃত্যু ঘটবে। মানাউসেও আগস্টে সংক্রমণের শ্লথ গতি দেখার পর তা আবার বাড়তে শুরু করেছে। এটি বলে যে মানাউসের জনগণের হার্ড ইমিউনিটি অর্জনের যে ধারণা তা ঠিক নয়।

মৃত্যু সমীকরণের একটি অংশ মাত্র। যেসব ব্যক্তি অসুস্থ হবে তারা মারাত্মক মেডিকেল অর্থনৈতিক ফলাফল ভোগ করতে পারে। অনেক মানুষ যারা ভাইরাস থেকে সেরে উঠেছে দীর্ঘমেয়াদি স্বাস্থ্য সমস্যার কথা বলেছে। মানাউসে ৫৮ হাজারের বেশি মানুষ সংক্রমিত হয়েছে, যা কিনা যন্ত্রণার একটি চিত্র তুলে ধরে।

মহামারীর শুরুতে বলা হয়েছিল, সুইডেন হার্ড ইমিউনিটি অর্জনের কৌশল অবলম্বন করেছে, যেখানে মানুষকে স্বাভাবিক জীবন যাপন করতে দিয়েছে। কিন্তু দেশটির স্বাস্থ্যমন্ত্রী লিনা আলেনগ্রেন বলেন ধারণা মূলত ভুল বোঝাবুঝি। হার্ড ইমিউনিটি সুইডেন বা অন্য কোনো দেশে ভাইরাসের সংক্রমণ কীভাবে বিস্তৃত হয় তার সম্ভাব্য পরিণতি। কিন্তু এটি আমাদের কৌশল ছিল না। এর পরও পার্শ্ববর্তী দেশ নরওয়েকে ধরলে সুইডেনের কৌশলে তেমন কোনো সফলতা পাওয়া যায় না। প্রতি এক লাখ মানুষে সুইডেনের মৃত্যুর সংখ্যা নরওয়ের দশ গুণ (প্রতি লাখে সুইডেনের ৫৮.১২ মৃত্যুর বিপরীতে নরওয়ের মৃত্যুর হার .২৩)  

নেচার থেকে সংক্ষেপে অনূদিত

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন