সড়ক নিরাপত্তা

আইনের প্রয়োগ, পারস্পরিক সমন্বয় ও গৃহীত উদ্যোগের বাস্তবায়ন জরুরি

চলছে করোনা মহামারী। বৈশ্বিক দুর্যোগে বাংলাদেশও বির্পযস্ত। তবে করোনার চেয়ে দেশে অনেক ক্ষেত্রে ভয়ংকর হয়ে উঠছে সড়ক দুর্ঘটনা। প্রতিদিনই দেশের কোথাও না কোথাও ঘটছে দুর্ঘটনা; বড় হচ্ছে মৃত্যুর মিছিল। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্যানুযায়ী, বাংলাদেশে সড়ক দুর্ঘটনায় বার্ষিক মৃত্যুহার উচ্চ আয়ের দেশগুলোর দ্বিগুণ এবং বিশ্বের সর্বোচ্চ নৈপুণ্য দেখানো অর্থনীতিগুলোর চেয়ে পাঁচ গুণ বেশি। আঞ্চলিক গড় বিবেচনায়ও বাংলাদেশের সড়কে মৃত্যুহার বেশি। এমনই এক হতাশাজনক প্রেক্ষাপটে দেশে গতকাল পালিত হলো জাতীয় নিরাপদ সড়ক দিবস। দিবসটির এবারের প্রতিপাদ্য মুজিব বর্ষের শপথ, সড়ক করব নিরাপদ সময়োপযোগী প্রতিপাদ্য, এর বাস্তব রূপায়নই কাম্য।

সড়ক দুর্ঘটনা শুধু মানবিক নয়, অর্থনৈতিক সমস্যাও হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিগত বছরগুলোয় আমাদের দেশ চমকপ্রদ প্রবৃদ্ধি অর্জনে সমর্থ হয়েছে, উন্নয়ন হয়েছে মানুষের গড় জীবনমানের, ত্বরান্বিত হয়েছে সামষ্টিক সমৃদ্ধি। অথচ সড়কে উচ্চ মৃত্যুহার জখম দেশের ইতিবাচক অর্জনগুলো ম্লান করছে। গবেষণায় উঠে এসেছে, কর্মক্ষম বয়সের মানুষই বাংলাদেশে সড়ক দুর্ঘটনায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। অর্থনৈতিকভাবে উৎপাদনক্ষম জনগোষ্ঠীর ওপর সড়ক দুর্ঘটনার অসমানুপাতিক প্রভাব জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার দমিত করতে পারে বৈকি। তদুপরি রয়েছে জনস্বাস্থ্য সামগ্রিক কল্যাণে সড়ক দুর্ঘটনার বিরূপ প্রভাব। কাজেই অর্থনৈতিক স্থায়িত্বশীলতার স্বার্থেও সড়ক নিরাপত্তায় উন্নতি প্রয়োজন। কিন্তু বাস্তবতা হলো, বাংলাদেশে বর্তমানে সড়ক নিরাপত্তা পারফরম্যান্স কেবল দুর্বলই নয়, দিন দিন এটি অবনতিশীল। এক্ষেত্রে অদক্ষ চালক, ত্রুটিপূর্ণ যানবাহন, দুর্বল ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা, জনগণের অসচেতনতা, অনিয়ন্ত্রিত গতি, সড়ক নির্মাণে ত্রুটি এবং আইনের যথাযথ প্রয়োগ না হওয়াকেই কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা যায়। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে নিরাপদ সড়কের গুরুত্ব অনুধাবন করে জাতিসংঘ চলতি দশককে সড়ক নিরাপত্তা দশক হিসেবে ঘোষণা করেছে। সময়ে সড়ক দুর্ঘটনার সংখ্যা প্রাণহানি অর্ধেকে নামিয়ে আনার বিষয়ে সদস্য দেশগুলো একমতও হয়েছে। এটি টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রায়ও (এসডিজি) সংযোজিত হয়েছে। এরই মধ্যে উল্লেখযোগ্যসংখ্যক দেশে সড়ক নিরাপত্তায় দৃশ্যমান অগ্রগতি লক্ষ করা গেলেও বাংলাদেশে এর বিপরীত চিত্রই বিরাজমান। এখনো দেশে সড়কে দুর্ঘটনার হার ঊর্ধ্বমুখী। এক হিসাবে উঠে এসেছে, ৫০ শতাংশ দুর্ঘটনা হ্রাসের টার্গেট পরিপূরণ থেকে ২২ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধি বাড়াতে পারে। অর্থনৈতিক সুফল বিবেচনায়ও সড়ক দুর্ঘটনার প্রতিশ্রুত লক্ষ্য অর্জন জরুরি হয়ে পড়েছে।

উন্নত বিশ্বে সড়ক দুর্ঘটনা প্রতিরোধে যেসব পরিকল্পনা সিদ্ধান্ত নেয়া হয়, সেগুলো খুবই সুনির্দিষ্ট হয়। কিন্তু বাংলাদেশে পরিকল্পনা বাস্তবায়ন দায়সারা গোছের। কত বছরে কী পরিমাণ দুর্ঘটনা প্রাণহানি কমানো হবে, কীভাবে তা অর্জিত হবে, কারা তা সফল করবে, এটা স্পষ্ট করা দরকার। সড়ক নিরাপত্তা নিয়ে কাজ করার প্রতিষ্ঠানের ঘাটতি নেই। কম-বেশি ২০টি মন্ত্রণালয়, বিভাগ, অধিদপ্তর সংস্থা এক্ষেত্রে নিয়োজিত। অথচ পারস্পরিক সমন্বয়হীনতার কারণে এক্ষেত্রে সুফল মিলছে না। ধরনের সমন্বয়ীনতার দ্রুত অবসান জরুরি। ২০১৮ সালে শিক্ষার্থীরা নিরাপদ সড়কের দাবিতে আন্দোলনে নামার পর সরকার নতুন সড়ক পরিবহন আইন করে। আইনটি কার্যকর হয়েছে গত বছরের নভেম্বর। কিন্তু আইনটির বেশির ভাগ ধারার প্রয়োগ এখনো শুরু হয়নি। বলতে গেলে আইন প্রয়োগের শিথিলতা, সড়ক-মহাসড়কে যানবাহন চলাচলে বিশৃঙ্খলা, চালক-মালিকদের বেপরোয়া মনোভাব পুরো সড়ক ব্যবস্থাকে দিন দিন অনিরাপদ করে তুলছে।

সড়ক দুর্ঘটনা কমাতে সরকারের সদিচ্ছার অভাব নেই। সড়ক দুর্ঘটনা রোধে ২০১৮ সালে খোদ প্রধানমন্ত্রী ২০টি নির্দেশনা দিয়েছেন। এছাড়া সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা বিভিন্ন সময়ে সুপারিশ দিয়েছেন। কিন্তু সেগুলো এখনো আলোর মুখ দেখেনি। এটা হতাশাজনক। শুধু সড়ক ব্যবস্থাপনা নয়, সড়ক নির্মাণের ক্ষেত্রেও বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় বিশেষভাবে দেখা উচিত। নিরাপদ সড়ক তৈরির জন্য সুপরিকল্পিত নকশা এবং এক্ষেত্রে সর্বোচ্চ মান বজায় রেখে কাজ করাটা জরুরি। মহাসড়কগুলোয় ফিডার রোড দিয়ে কম গতির গাড়ি, মোটরবিহীন যানবাহন চলাচল বন্ধ করা দরকার, যাতে দুর্ঘটনা কমে। প্রয়োজনে কম গতির গাড়ির জন্য আলাদা লেন রাখা যেতে পারে। আর মহাসড়কের পাশে থাকা ছোট বাজার, মানুষজন রাস্তা পারাপার হয় এমন স্থানগুলোয় বিশেষ ব্যবস্থা নেয়ার বিষয়টি বিবেচনায় রাখতে হবে।

দুর্ঘটনাজনিত চিকিৎসার বিষয়টিতেও জোর দিতে হবে। সড়ক দুর্ঘটনায় সাধারণত অতিরিক্ত রক্তক্ষরণেই মৃত্যুবরণ করে বেশি। এসব ক্ষেত্রে দ্রুতগতির জরুরি স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে বিশেষ চিকিৎসক দল দরকার, যারা এসব ক্ষেত্রে দুর্ঘটনা ঘটলে দ্রুততার সঙ্গে গিয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে পারেন। এছাড়া দুর্ঘটনার খবর দ্রুত সেলফোনের মাধ্যমে স্থানীয় পুলিশকে জানানোর ব্যবস্থা করা যেতে পারে। এজন্য একটি নির্দিষ্ট ইউনিক টেলিফোন নম্বর থাকতে পারে। তবে ব্যবস্থার উন্নয়ন করতে গেলে সংশ্লিষ্টদের মধ্যে সমন্বয়টা বেশি প্রয়োজন। মনে রাখা চাই, কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে দেশকে এগিয়ে নিতে হলে নিরাপদ সড়কের বিষয়টি অবশ্যই বিশেষ গুরুত্বের সঙ্গে দেখতে হবে। এক্ষেত্রে আর অবহেলা কাম্য নয়। বিশ্বব্যাংক সড়ক নিরাপত্তা নৈপুণ্য উন্নয়নে বিনিয়োগ বৃদ্ধির ওপর জোরারাপ করেছে। উন্নয়নশীল দেশগুলোয় কাজটি করা খুব সহজ নয়। এক্ষেত্রে সরকারি-বেসরকারি অংশীদারিত্বে (পিপিপি) অর্থায়ন নিশ্চিত করা যেতে পারে। সঠিক পরিকল্পনা বিনিয়োগ বৃদ্ধির মাধ্যমে সরকার টেকসই সড়ক নিরাপত্তা নিশ্চিতে জুতসই পদক্ষেপ নেবে বলে প্রত্যাশা।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন