সারা বিশ্বেই সিংহভাগ বড় শিল্প-কারখানার শুরু হয়েছে ক্ষুদ্র বা অতিক্ষুদ্র থেকেই। সাধারণত বৃহৎ শিল্প একদিনে গড়ে ওঠে না। একসময়ের ক্ষুদ্র বা মাঝারি শিল্পই কালের পরিক্রমায় হয়ে ওঠে বৃহৎ শিল্প। কিন্তু এ উত্তরণের পথটা সহজ তো নয়ই, বরং অত্যন্ত দুরূহ। বাংলাদেশের ব্যবসায়িক পরিমণ্ডল এ পথকে আরো দুরূহ করে দিয়েছে। বিশ্বায়নের যুগে ব্যবসা-বাণিজ্যে প্রতিনিয়ত বহুমাত্রিক পরিবর্তন হচ্ছে। এ পরিবর্তনের সঙ্গে নিজেদের সক্ষমতাকে সময়োপযোগী করতে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পবান্ধব একটি ব্যবসায়িক পরিবেশ গড়ে তোলার কোনো বিকল্প নেই। কিন্তু পরিতাপের বিষয় যে প্রয়োজনীয় অবকাঠামোর অভাব, অর্থের অপ্রতুল জোগান, কঠোর নীতি ও বৈষম্যমূলক আচরণ ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের উন্নয়নকে কঠিন করে দিয়েছে। অনেক ক্ষেত্রেই ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের জন্য সরকারি দিকনির্দেশনা বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে প্রচণ্ড অনীহা চোখে পড়ে। ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প, বিশেষ করে নারী উদ্যোক্তাদের জন্য যে ঋণ সুবিধা দিতে সরকার বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোকে নির্দেশনা দিয়েছিল, তা খুব কম ক্ষেত্রেই বাস্তবায়ন হয়েছে। স্বাভাবিকভাবেই এসএমই খাতটি সব সময় ঝুঁকিতে থাকে। এ কারণে করোনায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এসএমই খাত। ইন্টারন্যাশনাল ফাইন্যান্স করপোরেশনের (আইএফসি) গবেষণা জরিপ বলছে, মহামারীর প্রভাবে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন বাংলাদেশের অতিক্ষুদ্র, ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তারা। ওইসিডির সাম্প্রতিক এক গবেষণায় দেখা যায়, কাঠামোগত দুর্বলতা এবং দ্রুত পুনরায় স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসার ক্ষেত্রে দুর্বলতা করোনা মহামারীতে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প খাতকে অনেক বেশি ঝুঁকির মধ্যে ফেলে দিয়েছে।
দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে এমএসএমই খাতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতির শিকার হয়েছেন বাংলাদেশের উদ্যোক্তারা। দেশে এ খাতসংশ্লিষ্ট প্রায় ৯৪ শতাংশ উদ্যোক্তা ক্ষতির শিকার হয়েছেন। মার্চের মাঝামাঝি থেকে অনেক কারখানায়ই কারিগরদের ছুটি দেয়া হয়েছে, তাই উৎপাদনও বন্ধ। কিন্তু কর্মচারীর বেতন, শোরুম ভাড়া ও অন্যান্য খরচ বন্ধ হয়নি। এর বাইরে বড় অংকের ব্যাংক সুদ গুনতে হচ্ছে মাঝারি শিল্পের উদ্যোক্তাদের। অক্টোবর থেকে জানুয়ারি এসব ব্যবসায় এমনিতেই বেচাকেনা মন্দা থাকে। এখন উৎসবগুলোয় বেচাকেনার মৌসুম সামনে থাকলেও উৎপাদন চালু রাখার যেমন উপায় নেই, তেমনি মৌসুমি উৎসবগুলো জমজমাট হবে কিনা, সেটাও অনিশ্চিত। বিশ্লেষকরা বলছেন, নভেল করোনাভাইরাসের কারণে বহুমাত্রিক ক্ষতির সম্মুখীন হতে পারেন এসএমই উদ্যোক্তারা। এ অবস্থায় সরকারের উচিত দেশের সম্ভাবনাময় ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প রক্ষায় বিশেষ উদ্যোগ নেয়া। তা না হলে এখন জিডিপিতে ২৫ শতাংশ অবদান রাখা এসএমই খাতকে সরকার ঘোষিত লক্ষ্যানুসারে ২০৪১ সালের মধ্যে ২৮ শতাংশে উন্নীত করার পরিকল্পনা বাস্তবায়ন কঠিন হয়ে পড়বে। একই সঙ্গে এসএমই খাতে ধস নামলে এমনিতেই কর্মসংস্থানের সংকট থাকা অর্থনীতিতে নতুন করে লাখ লাখ বেকারের চাপ সামলানোও চ্যালেঞ্জ হয়ে উঠবে। সরকার এসব ঝুঁকি বিবেচনা করে সময়োচিত বাস্তব পদক্ষেপ নেবে, সেটাই প্রত্যাশিত। সংকট থেকে উত্তরণের জন্য উদ্যোক্তাদের সহজ শর্তে ঋণ, অথপ্রবাহ বৃদ্ধির মতো পদক্ষেপগুলো নেয়া জরুরি হয়ে পড়েছে।
সময়োপযোগী যৌক্তিক কোনো পন্থা অবলম্বন করে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প খাতকে রক্ষা করার জন্য সরকার এগিয়ে আসতে পারে। সহজ শর্তে, বিনা সুদে বা খুব কম সুদে দ্রুত আপত্কালীন ঋণসহায়তা প্রদান এক্ষেত্রে কার্যকর হতে পারে। ভুললে চলবে না, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প খাত ধসে যাওয়া মানে কেবল কিছু উদ্যোক্তার বড় ধরনের ক্ষতির মধ্যে পড়ে যাওয়া নয়। বরং এ খাতে জড়িত বিপুলসংখ্যক শ্রমিকের জীবনের প্রশ্নটিও এর সঙ্গে জড়িত। সরকার ঘোষিত প্রণোদনার ২০ হাজার কোটি টাকা ছাড়ের বিষয়ে যেসব শর্তারোপ করা হয়েছে, তার অনেকগুলো কঠিন। দ্রুত সেগুলো শিথিল করা প্রয়োজন।
সরকারের নীতি সহায়তাগুলো দেয়া হচ্ছে ব্যাংকের ঋণের মাধ্যমে। দেশের অধিকাংশ ক্ষুদ্র শিল্পের কাগজপত্র নেই বললে চলে। কিন্তু বিপুল কর্মসংস্থানের উৎস তারা। এক্ষেত্রে করোনায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্তও হয়েছে তারা। অনেকের উদ্যোগ বন্ধ হয়ে গেছে। আগামী ছয় মাস তাদের জন্য খুবই সংকটজনক। করোনার দ্বিতীয় ঢেউ আঘাত হানলে ক্ষুদ্র শিল্প আরো ঝুঁকিতে পড়বে। মাঝারি শিল্পের জন্য ব্যাংকঋণ সহায়তা মিললেও ক্ষুদ্রদের সহসাই তা মিলবে না। এক্ষেত্রে সরকারকে নতুন করে পরিকল্পনা সাজাতে হবে। প্রয়োজনে কাগজপত্র ছাড়াও অর্থ সহায়তা দিতে হতে পারে ক্ষুদ্র শিল্পকে। ভারতসহ উন্নয়নশীল দেশে করোনায় ক্ষতিগ্রস্ত এসএমইকে ঋণ সহায়তা প্রদানের প্রক্রিয়া নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। তারা বিভিন্ন পথের অনুসন্ধান করছে, কেউ কেউ সরাসরি নগদ সহায়তা আবার কেউ কেউ ব্যাংকের ওপর নির্ভর করছে। আবার এ কথাও সত্য, অন্যান্য দেশের চেয়ে আমাদের ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প অধিক ভালনারেবল, যা এরই মধ্যে গবেষণায় উঠে এসেছে। আমাদের এসএমই অভ্যন্তরীণ চাহিদা ও জোগানতাড়িত। ফলে অভ্যন্তরীণ চাহিদা ঘুরে দাঁড়ালে তারাও ঘুরে দাঁড়াবে। অর্থনীতিতে নগদ অর্থের জোগান বাড়াতে বাংলাদেশ ব্যাংককেও অর্থ সরবরাহ বাড়ানোর উদ্যোগ নিতে হবে।
ছোটদের ঋণ বিতরণে আগ্রহের কারণ হিসেবে বেসরকারি বাণিজ্যিকগুলোর পক্ষ থেকে সংজ্ঞায়নগত অস্পষ্টতা, ক্রেডিট গ্যারান্টির অনিশ্চয়তা, কঠিন শর্ত ও ব্যাংকগুলোর উচ্চ পরিচালন ব্যয়, প্রতিষ্ঠানগুলোর ব্যাংক লেনদেনে সংযোগহীনতাসহ উল্লেখ করা হয়েছিল। রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর ক্ষেত্রেও এসব কারণ অনেকাংশে প্রযোজ্য। বাংলাদেশ ব্যাংক অবশ্য আইনগত অস্পষ্টতা দূর এবং ঋণের শর্ত নমনীয় করার উদ্যোগ নিয়েছে। তাতেও ছোটদের জন্য ঋণ বিতরণ কাঙ্ক্ষিত গতি পাচ্ছে না। এ অবস্থায় আর কী ধরনের প্রতিবন্ধকতা রয়েছে, সেগুলো চিহ্নিত করে ঋণ বিতরণ কার্যক্রমে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তত্ত্বাবধান বাড়াতে হবে। কভিড সংকটে ভারত, চীন কিংবা আমাদের সমপর্যায়ের দেশ, বিশেষত দক্ষিণ এশিয়া ও পূর্ব-এশিয়ার দেশগুলোও এমএসএমই খাতের দ্রুত পুনরুদ্ধারে প্রণোদনা প্যাকেজ বাস্তবায়ন করছে। উল্লিখিত দেশগুলো উদ্যোক্তাদের কাছে অর্থ পৌঁছে দেয়ার জন্য কী ধরনের উপায় ও কৌশল অবলম্বন করছে, সেগুলো পর্যালোচনা করা যেতে পারে। সেখান থেকে প্রাপ্ত উত্তম চর্চাগুলো অনুসরণ করা গেলে ঋণ বিতরণ কার্যক্রম যেমন ত্বরান্বিত হবে, তেমনি উদ্যোক্তারা তা কাজে লাগিয়ে যথাসম্ভব দ্রুত দেশের অর্থনীতির পুনরুজ্জীবনে সমর্থ হবে বৈকি।