ওহ! আফগানিস্তান, হায়! আফগানিস্তান

সাইফ বাপ্পী

আফগান বংশোদ্ভূত মার্কিন নাগরিক তানিয়া আমরির ছোটবেলা কেটেছে কাবুলে। তার মা পেশায় ছিলেন সাংবাদিক। আফগানিস্তানের মাটিতে কোনো নারী একসময় সাংবাদিকতার মতো পেশার সঙ্গে জড়িত ছিলেন, বর্তমান মার্কিন মুলুকে কথা বিশ্বাস করতে চায় না কেউই।

প্রকৃতপক্ষে তানিয়া আমরির মা যে সময় সাংবাদিকতা করেছেন, সে সময়কার আফগানিস্তানের দৃশ্যপট ছিল বর্তমানের সম্পূর্ণ বিপরীত। সত্তরের দশকের ওই সময়টিতে আফগানিস্তান ভ্রমণে গিয়েছিলেন মার্কিন কূটনৈতিক এলিজাবেথ গোল্ড। তার বরাত দিয়ে সিএনএন জানাচ্ছে, ওই সময়ে আফগান নাগরিকরা রাজনৈতিকভাবেও বেশ সচেতন ছিল। কাবুলের সড়কে সড়কে গণতন্ত্র নাগরিক অধিকার নিয়ে তুমুল বিতর্কে মেতে উঠত তরুণরা।

যুদ্ধ দারিদ্র্যপীড়িত আফগানিস্তানের শহরগুলোর বর্তমান চিত্রকে অর্ধশতাব্দী আগের দৃশ্যপটের সঙ্গে মেলানো যায় না কোনোভাবেই। মৌলবাদের বিষাক্ত আঁচড়ে জর্জরিত হওয়ার আগে দেশটির চেহারা ছিল একেবারেই অন্য রকম। অতিপ্রাচীন সভ্যতার উত্তরাধিকার দেশটি সাংস্কৃতিকভাবেও ছিল অত্যন্ত সমৃদ্ধ। বিশেষ করে পঞ্চাশ, ষাট সত্তরের দশকে দেশটি প্রগতির পথে এগিয়ে গিয়েছে ঈর্ষণীয় গতিতে। কিন্তু দেশটিতে গৃহযুদ্ধ শুরুর পর হঠাৎ করেই সবকিছু বদলে যেতে থাকে। বিদেশী হস্তক্ষেপ দেশটিকে ঠেলে দেয় ঘোর অন্ধকারের দিকে।

সুপ্রাচীন কাল থেকেই অনেক সমৃদ্ধ ইতিহাসের উত্তরাধিকার বয়ে চলেছে আফগানিস্তান। দেশটিতে মানুষের বসতির ইতিহাস ৫০ হাজার বছরেরও বেশি সময়ের পুরনো। দেশের ওপর দিয়ে চলে গিয়েছে প্রাচীন সিল্করোড নেটওয়ার্কের অধীন কয়েকটি সড়ক। পশম, স্বর্ণ, রেশম মসলার মতো প্রাচীন যুগের সবচেয়ে দামি পণ্যগুলোর আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের অন্যতম কেন্দ্র ছিল আফগানিস্তানে। ভারতবর্ষ থেকেও প্রচুর বৌদ্ধ হিন্দু তীর্থযাত্রী বসতি গেড়েছিলেন দেশটিতে। বসতি করেছিল অনেক ইহুদিও। প্রকৃতপক্ষে দেশটি হয়ে উঠেছিল অনেক সংস্কৃতির মিলনস্থল।

একসময় আফগানিস্তানকে বলা হতো এশিয়ার হূিপণ্ড। ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা সুউচ্চ পর্বতমালার দেশটিতে সমুদ্র উপকূল না থাকলেও নদী বা হ্রদের কমতি নেই কোনো। বিশেষ করে কাবুল উপত্যকার সৌন্দর্য ছিল জগদ্বিখ্যাত। পর্যটকদের কাছে গন্তব্য হিসেবেও অন্যতম ঈপ্সনীয় দেশ ছিল আফগানিস্তান। অন্যদিকে গত শতকের ষাট সত্তরের দশকে একের পর এক রাজনৈতিক সামাজিক সংস্কার দেশটিতে এনে দিয়েছিল আধুনিকতার স্পর্শ। সামাজিক পরিমণ্ডলে রাজনৈতিক সচেতনতা ছিল তুঙ্গে। রাষ্ট্রীয় কাঠামোয় অস্তিত্ব ছিল না কোনো লিঙ্গবৈষম্যের। সামাজিক কাঠামো থেকেও তা দূর হচ্ছিল একটু একটু করে। প্রত্যক্ষদর্শীদের অনেকেই দাবি করেন, নারীর ক্ষমতায়নের দিক থেকে ওই সময়ে যুক্তরাষ্ট্রকেও পেছনে ফেলে দিয়েছিল আফগানিস্তান।

অত্যন্ত দ্রুতগতিতে আধুনিক হয়ে উঠছিল আফগান শহরাঞ্চল। বিশেষ করে রাজধানী কাবুলে সমৃদ্ধি চূড়ায় উঠে দাঁড়ায়। শহরটি পরিচিতি পায় মধ্য এশিয়ার প্যারিস হিসেবে।

রাজতন্ত্র থেকে গণতন্ত্রে উত্তরণের পর পিডিপিএ সরকারের আমলে আফগান শিক্ষা ব্যবস্থায় আমূল সংস্কার করা হয়। বিভিন্ন স্থানে প্রকাশিত পরিসংখ্যান বলছে, গৃহযুদ্ধ শুরুর আগে ১৯৭৮ সালেও আফগানিস্তানে মোট চিকিৎসকের ৪০ শতাংশই ছিলেন নারী। কাবুল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের মধ্যে নারী ছিল ৬০ শতাংশ। বিভিন্ন আফগান শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নারী শিক্ষার্থীর সংখ্যা ছিল লাখ ৪০ হাজার। এছাড়া অন্যান্য বিভিন্ন শিক্ষা কার্যক্রমে যুক্ত থেকে লেখাপড়া করছিল আরো ৮০ হাজার।

তবে ষাট সত্তরের দশকে আফগানিস্তানে যে আধুনিকায়নের জোয়ার বয়ে যায়, তার ঢেউ সীমাবদ্ধ ছিল শুধু শহরগুলোতেই। গ্রামাঞ্চলে এর কোনো ছোঁয়াই লাগেনি। শিক্ষা কার্যক্রমের পুরোপুরি বাইরে থেকে যায় গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর বড় একটি অংশ। ফলে শহরাঞ্চল আধুনিক হয়ে উঠলেও গ্রামাঞ্চলের রক্ষণশীল কাঠামো থেকে যায় পুরোপুরি অটুট। ফলে ধর্মীয় গোঁড়ামি এর ধারাবাহিকতায় নারী নিপীড়নের বিষয়টিও সেখানকার গ্রামীণ সমাজ ব্যবস্থায় ছিল স্বাভাবিক ব্যাপার। শহরাঞ্চল যতটা এগিয়ে যাচ্ছিল, ততটাই পিছিয়ে পড়ছিল গ্রামীণ সমাজ। প্রকৃতপক্ষে বিদেশী হস্তক্ষেপের পাশাপাশি শহর গ্রামাঞ্চলের পার্থক্যের মধ্যেই নিহিত ছিল আফগানিস্তানের ভবিষ্যৎ সর্বনাশের বীজ। সেখানকার শিক্ষা ব্যবস্থা ছিল অনেকটা পুরনো মাদ্রাসানির্ভর। পরবর্তী সময়ে গ্রামাঞ্চল থেকে উঠে আসা মাদ্রাসা শিক্ষার্থীদের নিয়েই গড়ে তোলা হয় গোঁড়া জঙ্গি সংগঠনগুলো।

১৯৭৩ সালে এক সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে শেষ আফগান বাদশাহ জহির শাহকে উত্খাত করে রাজতন্ত্রের ইতি ঘটান তারই চাচাতো ভাই ভগ্নিপতি মোহাম্মদ দাউদ খান। ১৯৭৮ সালে আফগান সামরিক বাহিনী পিপলস ডেমোক্রেটিক পার্টি অব আফগানিস্তানের (পিডিপিএ) যৌথ আরেকটি অভ্যুত্থানে দাউদ খানকে ক্ষমতাচ্যুত হত্যা করা হয়। মস্কো সমর্থিত দল পিডিপিএর কর্তাব্যক্তিরা ওই ঘটনাকে বিপ্লব হিসেবে দাবি করলেও আদতে সেটিও ছিল সামরিক অভ্যুত্থান পুরোপুরি জনবিচ্ছিন্ন।

অভ্যুত্থানের পর রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে দাউদ খানের স্থলাভিষিক্ত হন জেনারেল আবদুল কাদির। এর দুই দিনের মাথায় পিডিপিএর নূর মোহাম্মদ তারাকির হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করেন তিনি। ক্ষমতাগ্রহণের পর পরই আফগানিস্তানের ব্যাপকমাত্রায় আধুনিকায়ন ভূমি সংস্কারের উদ্যোগ নেন নূর মোহাম্মদ তারাকি। জনবিচ্ছিন্নতার কারণে গ্রামাঞ্চলে তার এসব সংস্কার কার্যক্রম কোনো আবেদন তৈরি করতে পারেনি। উল্টো তা সনাতনী গ্রামীণ ক্ষমতাকাঠামোর চূড়ায় বসে থাকা মানুষগুলোকে ক্ষেপিয়ে তোলে। অন্যদিকে দল হিসেবে তেমন একটা সুসংগঠিতও ছিল না পিডিপিএ। খালকিস্ট পারচামাইট নামে দুই উপদলের দ্বন্দ্বে সাংগঠনিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়েছিল দলটি।

১৯৭৯ সালের সেপ্টেম্বরে দলের দ্বিতীয় শীর্ষব্যক্তি হাফিজুল্লাহ আমিনের নির্দেশে খুন করা হয় পিডিপিএর মহাসচিব নূর মোহাম্মদ তারাকিকে। বিষয়টি মস্কোর সঙ্গে কাবুলের সম্পর্ককে তিক্ত করে তোলে। এমন সময় এক অদূরদর্শী পদক্ষেপ নিয়ে বসেন সোভিয়েত নেতা লিওনিদ ব্রেজনেভ। আফগানিস্তানে সামরিক হস্তক্ষেপের সিদ্ধান্ত নেন তিনি। ১৯৭৯ সালের ডিসেম্বরে কাবুলে প্রবেশ করে রুশ সৈন্যরা। ২৭ ডিসেম্বর সোভিয়েত সৈন্যরা তাজবেগ প্রাসাদে ঢুকে পড়ে হাফিজুল্লাহ আমিনকে হত্যা করে। তার পরিবর্তে ক্ষমতায় বসানো হয় নূর মোহাম্মদ তারাকির খালকিস্টদের প্রতিদ্বন্দ্বী পারচামাইট অংশের বাবরাক কারমালকে।

ঘটনার প্রতিক্রিয়ায় সোভিয়েত ইউনিয়নের সরাসরি বিরোধিতা করে ওআইসি পশ্চিমা দেশগুলো। জাতিসংঘের অধিবেশনে জোর দাবি তোলা হয় আফগানিস্তান থেকে সোভিয়েত সৈন্য প্রত্যাহারের। অর্থায়ন সহযোগিতা দিয়ে আফগানিস্তানে রুশ আগ্রাসন ঠেকাতে উগ্রপন্থী ইসলামী জঙ্গি গ্রুপ গড়ে তোলার পথ বেছে নেয় যুক্তরাষ্ট্র যুক্তরাজ্যসহ পশ্চিমা দেশগুলো। পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জেনারেল জিয়াউল হকের একান্ত আগ্রহ সমর্থনে এবং আইএসআইয়ের তত্ত্বাবধানে গোঁড়া সুন্নি জঙ্গিদের প্রশিক্ষণ দেয়া হয় পাকিস্তানে, যারা পরবর্তী সময়ে পরিচিত হয় তালেবান নামে। শিয়া জঙ্গি গ্রুপ গড়ে তোলে ইরানও। পশ্চিমা মিডিয়ায় মহিমান্বিত করে তোলা হয় আফগান মুজাহিদিনদের।

আফগানিস্তানের জন্য এর পরবর্তী কয়েক দশকের গল্প অন্ধকারের দিকে পিছিয়ে যাওয়ার উপাখ্যান। মুজাহিদিনদের সঙ্গে আফগান সেনাবাহিনী সোভিয়েতদের লড়াইয়ে মৃত্যু হয় অন্তত সাড়ে লাখ মানুষের। উদ্বাস্তু হয় ৫০ লাখ মানুষ। ১৯৮৯ সালে সোভিয়েত সৈন্যরা আফগানিস্তান ত্যাগ করার পর আফগান সরকারের মুখোমুখি দাঁড়ায় জঙ্গিরা। দেশটি এগিয়ে যায় গৃহযুদ্ধ, ধ্বংস আর পশ্চাদমুখিতার অন্ধকারাচ্ছন্ন পথে।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন