ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পে করোনার প্রভাব

দক্ষিণ এশিয়ায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত বাংলাদেশ

নিজস্ব প্রতিবেদক

প্লাস্টিকের জুতা তৈরির ব্যবসায় দিন ভালোই যাচ্ছিল পুরান ঢাকার ব্যবসায়ী আবদুস সোবহানের। শ্যামপুরের বিসিক এলাকার একটি খুপরি ঘরে জনাদশেক শ্রমিক-বিপণনকর্মীকে নিয়ে ব্যবসা চালাচ্ছিলেন তিনি। বিপত্তি বাধে মহামারী দেখা দেয়ার পর সরকার ঘোষিত সাধারণ ছুটির মধ্যে। প্রথমে কারখানা বন্ধ। বন্ধের কারণে বিক্রিতে ভাটা পড়ে। বাধ্য হয়ে কারখানায় কর্মীর সংখ্যা অর্ধেকে নামিয়ে আনতে হয় আবদুস সোবহানকে। বর্তমানে কোনোমতে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান টিকিয়ে রেখেছেন তিনি।

নভেল করোনাভাইরাসের সংক্রমণ দেশের অতিক্ষুদ্র, ক্ষুদ্র মাঝারি (এমএসএমই) উদ্যোক্তাদের প্রায় সবাইকেই একই অবস্থায় ঠেলে দিয়েছে। ইন্টারন্যাশনাল ফাইন্যান্স করপোরেশনের (আইএফসি) গবেষণা জরিপ বলছে, মহামারীর প্রভাবে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বাংলাদেশের অতিক্ষুদ্র, ক্ষুদ্র মাঝারি উদ্যোক্তারা।

আইএফসির বিজনেস পালস সার্ভে: ইমপ্যাক্ট অব কভিড-১৯ অন এমএসএমই ইন বাংলাদেশ শীর্ষক প্রতিবেদনটি গত জুন থেকে আগস্টের  তথ্য-উপাত্তের আলোকে তৈরি করা হয়েছে। পাঁচ শতাধিক এমএসএমই প্রতিষ্ঠানে চালানো জরিপের ভিত্তিতে প্রতিবেদনটি তৈরি করে আইএফসি। গতকাল এক ভার্চুয়াল আলোচনা সভার মধ্য দিয়ে প্রতিবেদনটি প্রকাশ করা হয়।

আইএফসির প্রতিবেদনের তথ্যমতে, দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে এমএসএমই খাতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতির শিকার হয়েছেন বাংলাদেশের উদ্যোক্তারা। দেশে খাতসংশ্লিষ্ট প্রায় ৯৪ শতাংশ উদ্যোক্তা ক্ষতির শিকার হয়েছে। অন্যদিকে শ্রীলংকার ৯২ শতাংশ, আফগানিস্তানের ৮৮, ভারতের ৮৬, নেপালের ৮৩ পাকিস্তানের ৬৮ শতাংশ উদ্যোক্তা ক্ষতির শিকার হয়েছেন।

প্রতিবেদনের তথ্যমতে, বাংলাদেশে এমএসএমই খাতে মহামারীর কারণে চাকরি হারিয়েছেন ৩৭ শতাংশ কর্মী। বিক্রি কমেছে খাতসংশ্লিষ্ট ৯৪ শতাংশ ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের। অন্যদিকে খাতটির প্রায় ৭০ শতাংশ কর্মী এখনো অনিশ্চয়তার মধ্যে দিন পার করছেন।

এতে আরো জানানো হয়, করোনায় বাংলাদেশের এমএসএমই খাতে নারী পরিচালিত উদ্যোগগুলো সবচেয়ে বেশি সংকটে পড়েছে। নারীদের দ্বারা পরিচালিত ৩৭ শতাংশ এমএসএমই প্রতিষ্ঠান করোনায় পুরোপুরি বন্ধ হয়ে গেছে। অন্যদিকে পুরুষ পরিচালিত এমএসএমই প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়েছে ২১ শতাংশ।

জরিপকালে ৮০ শতাংশ এমএসএমই প্রতিষ্ঠান লোকসানের মধ্যে ছিল বলে প্রতিবেদনে তুলে ধরেছে আইএফসি। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশীয় প্রতিষ্ঠানগুলোতেই সবচেয়ে বেশি কর্মঘণ্টা কমেছে। বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠানগুলোয় করোনাকালে গড়ে ৪৪ দশমিক শতাংশ কর্মঘণ্টা কমেছে। সময়ে সবচেয়ে বেশি খারাপ অবস্থায় পড়ে পোশাক ফ্যাশন খাতের উদ্যোগগুলো। গত বছরের তুলনায় জরিপকালে এসব প্রতিষ্ঠানের বিক্রি কমেছে ৬৫ শতাংশ।

প্রতিবেদনটির বিষয়ে বিশ্বব্যাংকের বাংলাদেশ ভুটানে নিযুক্ত কান্ট্রি ডিরেক্টর মার্সি টেম্বন বলেন, বাংলাদেশের জিডিপিতে এমএসএমই খাতের অবদান ২৫ শতাংশ। খাতে কর্মসংস্থান হয়েছে দুই কোটি মানুষের। করোনার কারণে বাংলাদেশে খাতটি ভীষণভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। পরিপ্রেক্ষিতে খাতটির উদ্যোক্তা বিশেষ করে নারী উদ্যোক্তাদের জরুরি ভিত্তিতে সরকারি সহযোগিতা প্রয়োজন।

আইএফসির জরিপে এমএসএমই খাতের ব্যবসাগুলো আগামী ছয় মাস পর্যন্ত খারাপ অবস্থায় থাকতে পারে বলে আশঙ্কা করা হয়েছে। সময়টিতে প্রতিষ্ঠানগুলোর বিক্রিতে যেমন নেতিবাচক প্রবণতার আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছে, তেমনি আরো কর্মসংস্থান কমে যাওয়ার মতো ঘটনাও অব্যাহত থাকতে পারে বলে জানানো হয়েছে।

আইএফসি বাংলাদেশ, নেপাল ভুটানের কান্ট্রি ডিরেক্টর ওয়েন্ডি ওয়ার্নার বলছেন, করোনা পরিস্থিতির আগেও বাংলাদেশের এমএসএমই খাতের প্রতিষ্ঠানগুলো সংকটে ছিল। মহামারী তাদের চূড়ান্ত সংকটের মধ্যে ঠেলে দিয়েছে।

সংকট থেকে উত্তরণের জন্য উদ্যোক্তাদের সহজ শর্তে ঋণ, অর্থপ্রবাহ বৃদ্ধির মতো পদক্ষেপগুলো নেয়া জরুরি হয়ে পড়েছে বলে আইএফসির প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়। পাশাপাশি খাতটির উদ্যোক্তাদের নীতিগত সহায়তা দেয়ার কথাও বলা হয়েছে এতে। বাংলাদেশের এমএসএমই খাতের উদ্যোক্তাদের সহায়তার জন্য সাড়ে কোটি ডলার বিনিয়োগের কথাও জানিয়েছে আইএফসি।

প্রতিবেদনে দেখা যায়, মূল্যের দিক থেকে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন শ্রীলংকার ব্যবসায়ীরা। ২০১৯ সালের তুলনায় মূল্যের ৭৩ শতাংশ পতনের ধাক্কা সামলাতে হয়েছে দেশটির ব্যবসায়ীদের। বাংলাদেশের উদ্যোক্তাদের সামলাতে হয়েছে প্রায় ৫২ শতাংশ মূল্যপতনের ধাক্কা। এছাড়া আফগানিস্তানের এমএসএমই খাতে গড় মূল্যপতনের হার ৬১ শতাংশ। এর বাইরেও ভারতে ৫৭ শতাংশ হারে, নেপালের ৬৩ পাকিস্তানের ২৭ শতাংশ হারে মূল্যপতনের ধাক্কা সামলাতে হয়েছে ব্যবসায়ীদের।

সার্বিকভাবে দেশের এমএসএমই খাতে গড় মূল্যপতন ৫২ শতাংশ। খাতভিত্তিক বিভাজনে এর মধ্যে ফ্যাশন ক্লোদিং সংশ্লিষ্ট পণ্যের গড় মূল্য কমেছে ৬৫ শতাংশ। পাইকারি খুচরা পণ্য বিক্রয় খাতে গড় মূল্যপতনের হার ৪৪ শতাংশ। এছাড়া কৃষি মত্স্য আহরণ খাতে মূল্যপতনের হার ৩৪ শতাংশ, অন্যান্য খাতে ৫৬ শতাংশ।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন