ইউরোপের দ্বিতীয় ঝড় প্রথমটির চেয়ে বিপজ্জনক

বণিক বার্তা ডেস্ক

ইউরোপ আবারো কভিড-১৯-এর উত্থান দেখছে। প্রাদুর্ভাবের হটস্পটে পরিণত হয়েছে যুক্তরাজ্য, স্পেন ফ্রান্স। প্রতিটি দেশই প্রতিদিন হাজারো নতুন কেস শনাক্ত হওয়ার কথা জানাচ্ছে।

সংক্রমণের বর্তমান স্তর এখন মার্চ এপ্রিলের চেয়ে অনেক বেশি বিস্তৃত। বিশেষ করে গ্রীষ্মে উল্লেখযোগ্যভাবে বিধিনিষেধ শিথিল করার পর গতি অনেক বেড়ে যায়। কিন্তু এখন অনেক অঞ্চল নতুন করে ফের বিভিন্ন স্তরের বিধিনিষেধ আরোপ করছে, যদিও লকডাউনে যাওয়ার ব্যাপারে অনেক দেশ নতুন করে বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছে।

দ্বিতীয় ঝড়ের মাত্রা প্রথমটির চেয়ে উল্লেখযোগ্যভাবে তীব্র। প্রথম ঝড়ের সময় ৩১ মার্চ ফ্রান্সের নতুন কেসের সংখ্যা হাজার ছুঁয়েছিল। কিন্তু গত রোববার ২৬ হাজার ৬৭৫টি সংক্রমণ নিয়ে নতুন রেকর্ড গড়ে দেশটি। যা কিনা প্রথম ঝড়ের চূড়ার চেয়ে তিন গুণ বেশি।

স্পেন গত সপ্তাহে ৩০ হাজার সংক্রমণের কথা উল্লেখ করেছে, যেখানে কেবল মাদ্রিদ অঞ্চলে এককভাবে ২০ হাজার সংক্রমণের দেখা মিলেছে।

প্রথম ঝড়ে এপ্রিলের ১০ তারিখ যুক্তরাজ্য হাজার ৮৬০ কেসের চূড়া স্পর্শ করেছিল। অক্টোবরের তারিখ গিয়ে যেটি পৌঁছায় ১৭ হাজার ৫৪০-এ।

যদিও সংক্রমণের সংখ্যা টেস্ট করার ভিত্তিতে জানা যাচ্ছে। নয়তো প্রকৃত সংক্রমণ আমাদের অজানাই থেকে যাচ্ছে। কারণ, অনেকে উপসর্গহীন থাকছে, যেখানে টেস্ট করার সম্ভাবনাও কম।

ইম্পেরিয়াল কলেজ লন্ডনের গবেষকরা যুক্তরাজ্যে লাখ ৭৫ হাজার মানুষকে টেস্ট করেছেন, তাদের উপসর্গ থাকুক বা না থাকুক। সেখানে দেখা গেছে, ৮২৪ জন পজিটিভ, সেপ্টেম্বরের ১৮ থেকে অক্টোবরের ১৫ পর্যন্ত ৪৫ হাজার নতুন সংক্রমণ ছিল, সেটা অনুমান করার জন্য এটাকে ব্যবহার করা হয়েছে। এটা দেখায় যে সে সময়ে আনুষ্ঠানিকভাবে রিপোর্ট করা নতুন পজিটিভ সংখ্যার চেয়ে প্রকৃত সংখ্যা দ্বিগুণ বা তিন গুণ বেশি হবে।

গ্রীষ্মকালীন ইউরোপে নিষেধাজ্ঞার অবসাদ

গ্রীষ্ম হচ্ছে ছুটির মৌসুম ইউরোপিয়ান অর্থনীতির জন্য একটি সুবর্ণ সময়। তাই অনেক দেশ পর্যটন শিল্পকে চাঙ্গা করার জন্য অনেকগুলো বিধিনিষেধ তুলে নেয়। সেটা ছিল অনেক মানুষের জন্য স্বাধীনতা ফিরে পাওয়ার অনুভূতি। পাশাপাশি গ্রীষ্মের মাসগুলো শারীরিক দূরত্ব মেনে চলার তাগিদও কম অনুভব করেছিল। ইম্পেরিয়াল কলেজের একটি চলমান গবেষণায়ও এটি উঠে এসেছে। জরিপে গবেষকরা দেখেছেন যে অনেক ইউরোপিয়ান এপ্রিলের তুলনায় নিজেদের আচরণে অনেক বেশি শীতলতা নিয়ে এসেছে।

প্রকৃতপক্ষে, ইউরোপের দ্বিতীয় ঝড় নির্দেশ করে দৈনন্দিন জীবনে টানা কয়েক মাসের নিষেধাজ্ঞার পর নিষেধাজ্ঞাজনিত যে অবসাদ তৈরি হয় তাকে। পাশাপাশি অর্থনৈতিক ক্ষতির বিষয় তো রয়েছেই। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ইউরোপিয়ান ডিরেক্টর . হান্স ক্লুগে স্বীকার করে বলেন, নিস্পৃহ হতাশার মনোভাবে অবসাদের যে অভিজ্ঞতা তা খুবই সহজ স্বাভাবিক। তিনি ইউরোপিয়ান হর্তাকর্তাদের আহ্বান জানিয়েছেন জনগণের কথা শোনার জন্য এবং কভিড-১৯-এর সঙ্গে লড়াইয়ের জন্য অভিনব উপায় আবিষ্কারের জন্য।  

বিধিনিষেধ ফিরে এলেও এখনো কোনো জাতীয় লকডাউন নয়

সাম্প্রতিক সপ্তাহগুলোতে অনেক ইউরোপিয়ান নেতা ঘোষণা দেন যে তারা আঞ্চলিকভাবে বিধিনিষেধ আরোপ করতে যাচ্ছেন, কিন্তু এখনই কোনো জাতীয় লকডাউন নয়। ফরাসি সরকার নতুন করে অনেকগুলো নগর অঞ্চলে বিধিনিষেধ আরোপ করে। যেখানে রেস্টুরেন্ট ক্লাসরুমের উপস্থিতিও সীমায়িত করা হয়। পাশাপাশি বার জিমগুলো বন্ধ করে দেয়া হয়।

স্প্যানিশ প্রধানমন্ত্রী পেদ্রো সানচেজ মাদ্রিদে ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা জারি করেন। যা কিনা বিরোধীদের উৎসাহিত করে তোলে এবং বিরোধী ডানপন্থী রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের কাছ থেকে তার সরকারের ওপর সন্ত্রাসী সর্বগ্রাসী তকমা এনে দেয়।

ফ্রান্স স্পেনের মতোই রেকর্ডসংখ্যক সংক্রমণ নিয়েও যুক্তরাজ্য সরকার লকডাউন ফিরিয়ে আনার পরিকল্পনা করছে না। প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন

বেছে নিয়েছেন একটি ভারসাম্যপূর্ণ পদ্ধতি যেখানে সরকার ইংল্যান্ডজুড়ে তিন স্তরের সতর্কতা পদ্ধতি প্রয়োগ করেছেমাঝারি, উচ্চ অনেক উচ্চ। যার প্রয়োগ মূলত নির্ভর করছে প্রাদুর্ভাবের তীব্রতার ওপর।

ইউরোপে দ্বিতীয় ঝড়ের জরুরি অবস্থার আগে জার্মানি ভাইরাস দূর করার ক্ষেত্রে সফল পদ্ধতির কারণে রোল মডেলের ভূমিকায় চলে গিয়েছিল। কিন্তু নিজেদের সেই ভাবমূর্তি ধরে রাখা কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে, যেখানে গত কয়েকদিনে এপ্রিলের পর জার্মানি ফের দৈনিক সংক্রমণের চূড়ায় উঠেছিল। এদিকে সমৃদ্ধ রাত্রিকালীন উৎসবের জন্য পরিচিত জার্মানির রাজধানী বার্লিন, ১০ অক্টোবর ৭০ বছরে প্রথমবারের মতো কারফিউতে প্রবেশ করে।

সফলতার জন্য ইউরোপ ভিয়েতনামের দিকে তাকাতে পারে

ইউরোপের বিপরীতে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার অনেকগুলো অবিশ্বাস্য দক্ষতা দেখিয়েছে। প্রায় দুই সপ্তাহ ধরে জনসংখ্যার উচ্চমাত্রার ঘনত্বসহ ভিয়েতনাম, থাইল্যান্ড কম্বোডিয়া প্রতিদিন থেকে ৫টি সংক্রমণের কথা বলেছে। অবশ্য এটাও গুরুত্বপূর্ণ যে তারা হয়তো কেস মৃত্যুসংখ্যা কম গণনা করছে। কিন্তু তার পরও দেশগুলোর যে অপ্রতিরোধ্য সাফল্য তা এতটুকু মুছে যায় না।

ভিয়েতনামের সর্বমোট কেসের সংখ্যা হাজার ১১৩টি। যা কিনা ১০০ মিলিয়ন জনসংখ্যার একটি দেশের জন্য খুবই কম। স্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষের ব্যবহূত একটি কৌশল হচ্ছে টেস্টিং। যেখানে তারা মনোযোগ দিয়েছে উচ্চঝুঁকিসম্পন্ন ব্যক্তি, বিল্ডিং প্রতিবেশীদের ওপর যে জায়গায় নিশ্চিত কেস ছিল। স্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষ বিস্তৃত কন্টাক্ট ট্রেসিংও প্রয়োগ করেছিল এবং উপসর্গ থাকুক না থাকুক যারা ঝুঁকিতে আছে তাদের চিহ্নিত করেছে। দেশটিতে সংক্রমিত ব্যক্তি আন্তর্জাতিক ভ্রমণকারীর জন্য কোয়ারেন্টিন সুবিধাও রাখা হয়েছিল।

থাইল্যান্ডে স্বাস্থ্য খাতের স্বেচ্ছাসেবীরা উপদ্রুত অঞ্চলগুলোতে ভ্রমণ করেছে, সংক্রমিতদের বাছাই করেছে, যাদের উপসর্গ আছে তাদের মেডিকেল ক্লিনিকে পাঠায় টেস্টের জন্য। গুজব মিথ্যা তথ্যগুলোর বিরুদ্ধে লড়াই করেছে। তারা সাধারণ মানুষকে শিখিয়েছে কীভাবে সঠিক পন্থায় হাত ধুতে হয়, মাস্কের ওপর গুরুত্ব দিয়েছে এবং হ্যান্ড স্যানিটাইজার বিতরণ করেছে। পাশাপাশি থাই ডিপার্টমেন্ট অব ডিজিজ কন্ট্রোল প্রতিটি প্রদেশের হাসপাতালগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ করে নিশ্চিত করেছে যে স্টাফরা জানে কীভাবে কেস নিশ্চিত করতে হয়। ফলে সব মিলিয়ে থাইল্যান্ডে সংক্রমণের সংখ্যা হাজার ৫০০ তে স্থির থেকেছে।

দুর্বল মেডিকেল সিস্টেম থাকার পরও কম্বোডিয়ার মোটা সংক্রমণ ছিল কেবল ২৮৩টি। যেখানে কেউই মারা যায়নি। দেশটি কন্টাক্ট ট্রেসিংকে বিস্তৃতভাবে ব্যবহার করেছে। তারা হাজার ৮০০ কর্মীকে ব্যবহার করেছে, যাদের প্রস্তুত করা হয়েছিল বছরের শুরুতে। দেশটি মহামারীর শুরু থেকেই কঠোর লকডাউনে চলে গিয়েছিল। যেখানে তারা স্কুল বিনোদনের ভেন্যুগুলো বন্ধ করে দিয়েছিল। ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞাও সেখানে জারি করা হয়েছিল। দেশটির ৮০ শতাংশ জনগণ থাকে গ্রামে। ফলে কেবল উচ্চঘনত্বসম্পন্ন শহরগুলোতে মনোযোগ দিয়েই তারা সাফল্য পেয়েছে।

দ্য কনভারসেশন

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন