উন্নয়ন ভাবনা

মাথাপিছু নমিনাল জিডিপিতে ভারতকে ছাড়িয়ে যাওয়া প্রসঙ্গে

ড. মইনুল ইসলাম

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য মোতাবেক ২০১৮-১৯ অর্থবছরে দেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার ৮ দশমিক ২ শতাংশে উপনীত হয়েছিল। ফলে বাংলাদেশের মাথাপিছু জিএনআই চূড়ান্ত হিসাবে গিয়ে দাঁড়িয়েছিল ১ হাজার ৯০৯ ডলারে। আমরা জানি যে বাংলাদেশের মাথাপিছু জিএনআই কয়েক বছর আগেই পাকিস্তানের মাথাপিছু জিএনআইকে ছাড়িয়ে গেছে। চলমান নভেল করোনাভাইরাস মহামারীর তাণ্ডবে ২০১৯-২০ অর্থবছরে বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার কমে ৫ দশমিক ২৪ শতাংশে গিয়ে দাঁড়াচ্ছে বলে প্রাক্কলন ঘোষিত হওয়ায় ২০২০ সালের ৩০ জুন বাংলাদেশের মাথাপিছু জিএনআই প্রাক্কলিত হয়েছে ২ হাজার ৬৪ ডলারে। বেশ কয়েক বছর আগেই বাংলাদেশ মানব উন্নয়নের নানা সূচকে পাকিস্তানকে ছাড়িয়ে গেছে। এগুলো নিঃসন্দেহে বাংলাদেশের জনগণের জন্য একটার পর একটা বিজয়গাথা। কারণ ১৯৪৭ থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত পাকিস্তানের ‘অভ্যন্তরীণ উপনিবেশ’ হিসেবে তদানীন্তন পূর্ব বাংলা-পূর্ব পাকিস্তানকে যেভাবে শোষণ, লুণ্ঠন, চরম বৈষম্যমূলক উন্নয়ন বরাদ্দ ও ব্যাংকঋণ বরাদ্দ এবং পুঁজি পাচারের অসহায় শিকারে পরিণত করা হয়েছিল, তার বিরুদ্ধেই প্রতিরোধ সংগ্রাম গড়ে তুলে ধাপে ধাপে ওই প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন ও অর্থনৈতিক স্বাধিকার অর্জনের সংগ্রামকে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে স্বাধীনতার সংগ্রামে রূপান্তর করেছিলাম আমরা। ওই স্বাধীনতার সংগ্রামকে নারকীয় গণহত্যা চালিয়ে স্তব্ধ করার জন্য পাকিস্তানি সামরিক জান্তা ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ ‘অপারেশন সার্চলাইট’ শুরু করার কারণেই সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল জাতি। আমরা কখনই ভুলব না যে পাকিস্তানের ২৪ বছরের এই নব্য ঔপনিবেশিক শাসন-শোষণের জিঞ্জির ছিন্ন করার জন্য বাঙালি জাতিকে মুক্তিযুদ্ধে ৩০ লাখ শহীদানের শাহাদত এবং দুই লাখ মা-বোনের সম্ভ্রম হারানোর মতো চড়া দাম চুকাতে হয়েছে। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর আমরা যে বিজয়ের গৌরবে স্বাধীন দেশের নাগরিক হিসেবে যাত্রা করেছি, তার একেকটি মাইলস্টোন অর্জিত হচ্ছে এই ঐতিহাসিক অর্জনগুলোর মাধ্যমে। পাকিস্তান স্ট্যাটিস্টিক্যাল সার্ভে মোতাবেক ১৯৬৮ সালে পশ্চিম পাকিস্তানের মাথাপিছু আয় ছিল ৯৯ দশমিক ৮০ ডলার, আর পূর্ব পাকিস্তানের মাথাপিছু আয় ছিল মাত্র ৪০ ডলার। তার মানে, পশ্চিম পাকিস্তানের মাথাপিছু আয় তখন পূর্ব পাকিস্তানের আড়াই গুণ বেশি ছিল। অর্থনৈতিক উন্নয়নের প্রতিযোগিতায় এখন যে আমরা পাকিস্তানকে চূড়ান্তভাবে হারিয়ে দিচ্ছি, সেটাই চোখে আঙুল দিয়ে বিশ্বকে দেখিয়ে দিচ্ছে পাকিস্তানের ঔপনিবেশিক জিঞ্জির বাংলাদেশকে কতখানি পঙ্গু করে রেখেছিল। ইনশাআল্লাহ, আর কোনোদিন পাকিস্তানের পেছনে পড়বে না বাংলাদেশ।

আইএমএফ কিন্তু বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর জিএনআইয়ের প্রাক্কলনকে মেনে নিতে নারাজ। তারা বিভিন্ন দেশের জিডিপি প্রাক্কলন নিয়মিতভাবে প্রকাশ করে তাদের ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক আউটলুকের মাধ্যমে। ওই প্রাক্কলনে বাংলাদেশের জিডিপি বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর প্রাক্কলনের চেয়ে বেশ কম দেখানো হয়। ১৪ অক্টোবর আইএমএফ ২০২০ পঞ্জিকাবর্ষের জন্য বিশ্বের অনেক দেশের প্রাক্কলিত জিডিপির পূর্বাভাস প্রকাশ করেছে, যেখানে চলমান নভেল করোনাভাইরাস মহামারীর কারণে বিভিন্ন দেশের অর্থনীতি কতখানি ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে চলেছে, তার হিসাব অন্তর্ভুক্ত হওয়ায় এই পূর্বাভাস সারা বিশ্বে প্রবল আলোড়ন ও আগ্রহের সৃষ্টি করেছে। আইএমএফের পূর্বাভাস দাবি করছে, দক্ষিণ এশিয়ায় মহামারীর কারণে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে চলেছে ভারতীয় অর্থনীতি। ২০২০ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত নাকি মহামারীর আঘাতে ভারতীয় অর্থনীতি ১০ দশমিক ৩ শতাংশ সংকুচিত হয়ে ভারতের মাথাপিছু জিডিপি ১ হাজার ৮৭৭ ডলারে নেমে যাবে ২০১৯ সালের ২ হাজার ১০০ ডলার থেকে। অন্যদিকে বাংলাদেশের অর্থনীতি মহামারীর আঘাতে ক্ষতিগ্রস্ত হলেও অতি দ্রুত ক্ষতি কাটিয়ে উঠে ২০২০ সালের ডিসেম্বর নাগাদ বাংলাদেশ নাকি প্রায় ৩ দশমিক ৮ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জন করতে সমর্থ হবে। আইএমএফের পূর্বাভাস মোতাবেক ২০২০ সালের ডিসেম্বরে বাংলাদেশের মাথাপিছু প্রাক্কলিত জিডিপি দাঁড়াবে ১ হাজার ৮৮৮ ডলারে। এর মানে আইএমএফ বলছে, ইতিহাসে প্রথমবারের মতো বাংলাদেশের মাথাপিছু নমিনাল জিডিপি ভারতের মাথাপিছু জিডিপিকে ছাড়িয়ে যাবে। এই পূর্বাভাস সারা বিশ্বে প্রবল ঝড় তুলেছে। কিন্তু এটা তো শুধু এক বছরের করোনা মহামারীর অভিঘাত নয়। পাঁচ বছর আগেও ভারতের মাথাপিছু জিডিপি বাংলাদেশের চেয়ে ৪০ শতাংশ বেশি ছিল। এরপর পাঁচ বছর ধরে বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার ধারাবাহিকভাবে ভারতের চেয়ে অনেক বেশি হয়েছে। এই ধারাবাহিকতায় ১০ দশমিক ৩ শতাংশ নেগেটিভ প্রবৃদ্ধির হার যখন ২০২০ সালে ভারতের নমিনাল জিডিপিকে ২ হাজার ১০০ ডলার থেকে টেনে ১ হাজার ৮৭৭ ডলারে নামিয়ে ফেলছে, তখন বাংলাদেশ যে ভারতকে টপকে যাচ্ছে তাতে অবাক হওয়ার কিছু নেই! সন্দেহ নেই, আগামী বছরগুলোয় বাংলাদেশ ও ভারতের মাথাপিছু জিডিপি প্রবৃদ্ধির প্রতিযোগিতা দক্ষিণ এশিয়ার পাশাপাশি সারা বিশ্বেরও ফোকাসের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হবে।

পাকিস্তানিরা বহুদিন থেকেই জানত, স্বাধীনতা-উত্তর ৪৯ বছরে উন্নয়নের প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রে বাংলাদেশ পাকিস্তানকে ছাড়িয়ে গেছে। আমি নিজে অবশ্য এটা নিয়ে অতি উচ্ছ্বসিত হব না, তবে আমাদের এই সাফল্য যেন আর কখনো হারিয়ে না ফেলি, সেটাই সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হবে মনে করছি। মনে রাখতে হবে পিপিপি (পারচেজিং পাওয়ার প্যারিটি) ভিত্তিতে এখনো ভারতের মাথাপিছু জিডিপি ৬ হাজার ২৮৪ পিপিপি ডলার, আর বাংলাদেশের মাথাপিছু জিডিপি ৫ হাজার ১৩৯ পিপিপি ডলার। ভারতের জনগণের জীবনযাত্রার মান বাংলাদেশের জনগণের জীবনযাত্রার মানের চেয়ে উঁচু। আর এই দুই দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন অনেক কাছাকাছি পর্যায়ে চলে এলেও পাকিস্তান এ ব্যাপারে ক্রমে পেছনে পড়ে যাচ্ছে। জাতিসংঘের ইউএনডিপি কর্তৃক প্রকাশিত মানব উন্নয়ন সূচকের অবস্থানে বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের অবস্থানের পার্থক্য বেড়েই চলেছে। সর্বশেষ ২০১৯ সালের কান্ট্রি র্যাংকিংয়ে বাংলাদেশের মানব উন্নয়ন সূচকের অবস্থান ছিল ১৩৬, আর পাকিস্তানের অবস্থান ছিল ১৪৭। ভারত এই র্যাংকিংয়ে এখনো বাংলাদেশের ওপরে অবস্থান করছে ১৩৪ নম্বরে। আগামী দুই-তিন বছরের মধ্যে এই সূচকে এগোতে হবে। বাংলাদেশের জনগণের গড় আয়ু ২০১৮ সালে ছিল ৭২ দশমিক ৪ বছর, আর পাকিস্তানের জনগণের গড় আয়ু ওই বছর ছিল ৬৬ দশমিক ৪ বছর, ভারতের ৬৮ দশমিক ৪ বছর। এর মানে, স্বাস্থ্যের বিচারেও বাংলাদেশ পাকিস্তান ও ভারতের চেয়ে ভালো করছে। সর্বশেষ হিসাবে বাংলাদেশের সাক্ষরতার হার ৭২ দশমিক ৪ শতাংশ, ভারতের ৭৩ শতাংশ আর পাকিস্তানের সাক্ষরতার হার মাত্র ৬০ শতাংশ। মানব উন্নয়নে পাকিস্তান খারাপ করার প্রধান কারণ হলো, ৬ লাখ ৫০ হাজারেরও বেশি কর্মকর্তা ও সিপাহী নিয়ে পাকিস্তানের বিপুল সশস্ত্র বাহিনী পুষতে হচ্ছে। প্রতিরক্ষা ব্যয়ের বোঝাটা পাকিস্তানের জন্য অসহনীয় হলেও ওই দেশটি তাদের প্রতিরক্ষা ব্যয় অদূরভবিষ্যতে কমাতে পারবে না ফলে শিক্ষা, স্বাস্থ্য কিংবা মানব উন্নয়নের জন্য অপরিহার্য অন্যান্য খাতে পাকিস্তানের সরকার তেমন একটা অগ্রাধিকার দিতে পারছে না। প্রতি বছর পাকিস্তান প্রতিরক্ষা খাতে ব্যয় করে ১২ বিলিয়ন ডলারেরও বেশি, অথচ বাংলাদেশের প্রতিরক্ষা ব্যয় এখনো সাড়ে ৩ বিলিয়ন ডলারের মতো। ভারতের বার্ষিক প্রতিরক্ষা ব্যয় প্রায় ৬২ বিলিয়ন ডলার। 

আরো অনেক গুরুত্বপূর্ণ সামষ্টিক, অর্থনৈতিক ও ডেমোগ্রাফিক সূচকে বাংলাদেশ পাকিস্তানকে পেছনে ফেলে দিলেও ভারত অনেক এগিয়ে রয়েছে। করোনা মহামারী আঘাত হানার আগে ২০১৮-১৯ অর্থবছরে বাংলাদেশের রফতানি আয় হয়েছিল ৪০ দশমিক ৩ বিলিয়ন ডলার, পাকিস্তানের ওই বছরের রফতানি আয় ছিল মাত্র ২৩ বিলিয়ন ডলার, আর ভারতের রফতানি আয় ৩১৩ বিলিয়ন ডলার। ২০২০ সালের ৮ অক্টোবর বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ দাঁড়িয়েছে ৪০ দশমিক ৪ বিলিয়ন ডলারে। পাকিস্তানের রিজার্ভ মাত্র ১৩ বিলিয়ন ডলার, আর ভারতের রিজার্ভ ৩৩০ বিলিয়ন ডলার। বাংলাদেশের ব্যালান্স অব পেমেন্টসের কারেন্ট অ্যাকাউন্টে গত দশ বছরের আট বছর উদ্বৃত্ত ছিল, অথচ ভারতের কারেন্ট অ্যাকাউন্টে মাঝে মাঝেই ঘাটতি হচ্ছে। অন্যদিকে গত ৪৯ বছরে একবারও পাকিস্তান ব্যালান্স অব পেমেন্টসের কারেন্ট অ্যাকাউন্টে ঘাটতি এড়াতে পারেনি। এর মানে, গণচীন, বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ, সৌদি আরব, কাতার, কুয়েত, সংযুক্ত আরব আমিরাত ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে খয়রাতি অনুদান কিংবা ‘সফট লোন’ সংগ্রহ করতে না পারলে পাকিস্তানি অর্থনীতি মুখ থুবড়ে পড়বে। মুদ্রার বৈদেশিক বিনিময় হারে বাংলাদেশ এখন পাকিস্তানকে অনেক পেছনে ফেলে দিয়েছে। বাংলাদেশের মুদ্রা ৮৫ টাকায় এখন ১ ডলার পাওয়া যায়, আর ওই ১ ডলার পেতে এখন পাকিস্তানে ১৫৮ রুপি লাগে। অথচ ২০০৯ সাল পর্যন্ত পাকিস্তানের রুপি বাংলাদেশের টাকার চেয়ে শক্তিশালী ছিল। ভারতের রুপিও ক্রমেই অবনমনের শিকার হচ্ছে। কয়েক বছর আগে ১ ডলার কিনতে ভারতীয়দের ৬৩ রুপি লাগত, এখন লাগে ৭৪ রুপি। বাংলাদেশের মোট অপরিশোধিত (outstanding) বৈদেশিক ঋণ এখন ৩৪ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলার, অথচ পাকিস্তানের মোট বৈদেশিক ঋণ ১০২ বিলিয়ন ডলার। পাকিস্তান ছয়বার বৈদেশিক ঋণের কিস্তি পরিশোধে অপারগতা ঘোষণা করেছে, অন্যদিকে বাংলাদেশ গত ৪৯ বছরে একবারও বৈদেশিক ঋণের কিস্তি পরিশোধে ব্যর্থ হয়নি। বাংলাদেশের জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার এখন ১ দশমিক ৩ শতাংশে নেমে গেছে, অথচ পাকিস্তানে তা আজও ২ দশমিক ১ শতাংশে রয়ে গেছে। ফলে পাকিস্তান জনসংখ্যার দিক থেকে ২০০১ সালের আদমশুমারিতেই বাংলাদেশকে টপকে গেছে। সর্বশেষ ২০১৯ সালে বাংলাদেশের প্রাক্কলিত জনসংখ্যা ছিল ১৬৫ দশমিক ৫ মিলিয়ন, আর পাকিস্তানের প্রাক্কলিত জনসংখ্যা ওই বছর ছিল ২০৫ মিলিয়ন। আরো গুরুত্বপূর্ণ হলো, বাংলাদেশের টোটাল ফার্টিলিটি রেট এখন কমে মাত্র ২ দশমিক ১-এ নেমে গেছে, অথচ পাকিস্তানে এ রেট এখনো ৩ দশমিক ৮ রয়ে গেছে। যেহেতু টোটাল ফার্টিলিটি রেট বা মোট প্রজনন হার একজন নারী সারা জীবনে কতজন সন্তান জন্ম দেন তার একটা পরিমাপক, তাই পাকিস্তানের জনসংখ্যা বাংলাদেশের চেয়ে ভবিষ্যতেও অনেক দ্রুতগতিতে বাড়তে থাকবে। বাংলাদেশ হয়তো আগামী ১০-১৫ বছরে একটা স্থিতিশীল জনসংখ্যায় পৌঁছে যাবে, যা পাকিস্তানের জন্যে অচিন্তনীয়। জনসংখ্যার প্রবৃদ্ধির দৌড়ে এখন বাংলাদেশ ও ভারতের অবস্থান খুবই কাছাকাছি।

মহান আল্লাহতায়ালাহকে অশেষ শোকরিয়া যে ১৯৭১ সালে বাঙালি জাতি পাঞ্জাবিদের ঔপনিবেশিক শোষণ ও লুণ্ঠন থেকে মুক্তি পেয়েছে। কিন্তু এ জাতির ‘অর্থনৈতিক মুক্তির সংগ্রাম’ সফল করার জন্য আমাদের সুকঠিন সংগ্রাম চালিয়ে যেতে হবে আরো বহুদিন। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির ক্ষেত্রে ভারতের সঙ্গে প্রতিযোগিতা আগামী বছরগুলোয় বাড়তেই থাকবে। এই প্রতিযোগিতায় জয়ী হতে হলে এখন প্রথম অগ্রাধিকার দিতে হবে জাতির উন্নয়নের যাত্রাপথের সবচেয়ে বড় বাধা দুর্নীতি, পুঁজি লুণ্ঠন এবং বিদেশে পুঁজি পাচারের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ সংগ্রামকে। রাষ্ট্রক্ষমতাকে অপব্যবহার করে লুটেরারা অবৈধ ধন-সম্পদের পাহাড় গড়ে তুলছে ৪৯ বছর ধরে, বিশেষত ১৯৭৫ সালে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করার পর। পলাতক পুঁজি (capital flight) সম্পর্কে গবেষণা পরিচালনাকারী সংস্থা গ্লোবাল ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেগ্রিটি জানাচ্ছে যে এখন প্রতি বছর বাংলাদেশ থেকে ৭ থেকে ৯ বিলিয়ন ডলার পুঁজি বিদেশে পাচার হয়ে যাচ্ছে। এ দেশের আমদানিকারক ব্যবসায়ীরা, গার্মেন্ট মালিকরা, রাজনীতিকরা, দুর্নীতিবাজ আমলা ও প্রকৌশলীরা এবং ব্যাংকের রাঘববোয়াল ঋণখেলাপিরা বেধড়ক লুণ্ঠনের মাধ্যমে অবৈধ ধন-সম্পদ আহরণ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, সুইজারল্যান্ড ও ইউরোপের অন্যান্য দেশে পুঁজি পাচার করে চলেছে। এরাই কানাডার টরন্টোতে বেগমপাড়া বানাচ্ছে, মালয়েশিয়ায় সেকেন্ড হোম কিনছে, ছেলেমেয়েদের বিদেশে অভিবাসী করার জন্য পাগল হয়ে গেছে। নভেল করোনাভাইরাস মহামারী অর্থনীতিকে বর্তমানে একটা বিপর্যয়ের গিরিখাদে নিক্ষেপ করেছে, যেখান থেকে মুক্তি পেতে জাতিকে আগামী এক-দেড় বছর কঠোর সাধনা চালিয়ে যেতে হবে। এই সংগ্রামেও আমরা ইনশাআল্লাহ পাকিস্তান ও ভারতের চেয়ে ভালো করছি। এখন সময়ের দাবি হলো, অর্থনৈতিক উন্নয়নের মহাসড়কে আবার দৃপ্ত পদক্ষেপে এগিয়ে যাওয়ার স্বার্থে জাতিকে দুর্নীতি, পুঁজি লুণ্ঠন ও পুঁজি পাচারের বিরুদ্ধে কঠোর প্রতিরোধ যুদ্ধ শুরু করতে হবে। 


ড. মইনুল ইসলাম: একুশে পদকপ্রাপ্ত অর্থনীতিবিদ 

অবসরপ্রাপ্ত প্রফেসর, অর্থনীতি বিভাগ

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন