দীর্ঘদিন ধরে ‘অযৌক্তিক’ কর ছাড় পেয়ে আসছে জেমস বন্ডের নির্মাতারা

বণিক বার্তা অনলাইন

রানির শীর্ষ সিক্রেট এজেন্ট জেমস বন্ডকে প্রায় সব সিনেমাতেই সরকারি কর্মচারীদের ওপর নির্ভরশীল থাকতে দেখা যায়। এর মধ্যে মিস মানিপেনি, কিউ এমন কিছু উচ্চপদস্থ কর্মকর্তার নাম করা যায়। এই কর্মকর্তাদের আমতান্ত্রিক জটিলতায় প্রায়ই বিরক্ত হন, বিদ্রোহ করেন বন্ড।

কিন্তু বাস্তবেও জিরো জিরো সেভেন ফ্র্যাঞ্চাইজি ব্রিটিশ কর কর্মকর্তাদের ওপর ব্যাপকভাবে নির্ভরশীল। শুধু তা-ই নয়, ব্রিটিশ কর বিভাগ থেকে উল্লেখযোগ্য ছাড় পেয়ে থাকে এই সিনেমার নির্মাতারা।

অনুসন্ধানী থিঙ্কট্যাঙ্ক ট্যাক্সওয়াচের একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, জেমস বন্ড সিরিজ চলচ্চিত্র নির্মাতা লন্ডনভিত্তিক স্টুডিও ইওন প্রোডাকশন যুক্তরাজ্যে খুব একটা লাভ করতে পারেনি। তবে তারা কোটি কোটি পাউন্ড কর ছাড় পেয়েছে। 

প্রকাশ্যে আসা কিছু তথ্য থেকে জানা যাচ্ছে, ২০১৫ সালে মুক্তি পাওয়া জেমস বন্ড সিরিজের ২৪তম চলচ্চিত্র ‘স্পেক্ট্রা’ ৩ কোটি পাউন্ড কর ছাড় পেয়েছিল। আর মহামারীর কারণে মুক্তি এক বছর পিছিয়ে যাওয়া সিরিজের সর্বশেষ চলচ্চিত্র ‘নো টাইম টু ডাই’-কে ৪ দশমিক ৭ কোটি পাউন্ড কর ছাড় দেয়া হয়েছে। 

ব্রিটেনে ২০০৭ সালে সিনেমায় কর ছাড় সুবিধা চালু হওয়ার পর থেকে ইওন প্রোডাকশনের মোট কর ছাড় পাওয়ার পরিমাণ রেকর্ড ১২ কোটি পাউন্ডের কাছাকাছি হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। ফাঁস হওয়া ইমেইলে দেখা যাচ্ছে, ২০১২ সালে মুক্তি পাওয়া ‘স্কাইফল’ ২ দশমিক ৪ কোটি পাউন্ড এবং ট্যাক্সওয়াচের হিসাবে, ২০০৮ সালে মুক্তি পাওয়া ‘কোয়ান্টাম অব সোলাস’ ২ দশমিক ১ কোটি পাউন্ড কর ছাড় পেয়েছে।

জিরো জিরো সেভেন (০০৭) ব্লকবাস্টার সিরিজের ২৫তম চলচ্চিত্র ‘নো টাইম টু ডাই’ চলচ্চিত্রের মুক্তি পিছিয়ে গেছে। যুক্তরাজ্যে সিনেওয়ার্ল্ডের ১২৭টি প্রেক্ষাগৃহের সবগুলো সাময়িকভাবে বন্ধ করে দেয়ার পেছনে এটিকে বড় কারণ হিসেবে উল্লেখ করা হচ্ছে। তার মানে এসব প্রেক্ষগৃহের আয়ে জেমস বন্ড সিনেমার বড় অবদান আছে।

এ বিষয়ে ট্যাক্সওয়াচের পরিচালক জর্জ টার্নার বলেন, সারা দেশের চলচ্চিত্র ও প্রেক্ষাগৃহ বন্ধ হয়ে যাওয়া এবং সংস্কৃতিকর্মীদের সত্যিকারের কঠিন পরিস্থিতির মুখোমুখি হওয়ার সঙ্গে আপনাকে ভাবতে হবে যে এই ধরনের লাভজনক ফ্র্যাঞ্চাইজিকে কোটি কোটি পাউন্ড রাষ্ট্রীয় সহায়তা দেয়া জনগণের ট্যাক্সের টাকার সর্বোত্তম ব্যবহার কিনা। 

কোনো চলচ্চিত্রের জন্য কর ছাড় পেতে অব্যশই ব্রিটিশ ফিল্ম ইনস্টিটিউট থেকে ‘সাংস্কৃতিকভাবে ব্রিটিশ’ হিসেবে ছাড়পত্র নিতে হয়। তবে ১ হাজার ৬০০ কোটি ডলার আয় করা জিরো জিরো সেভেন-এর ফ্র্যাঞ্চাইজি ব্রান্ডগুলোর খুব কমই ব্রিটিশ। বন্ড সিরিজের চলচ্চিত্রগুলোর বেশিরভাগ অংশের শ্যুটিং বিদেশে করা হলেও লন্ডনের নিকটবর্তী পাইনউড স্টুডিওতে নির্মিত হয়। স্পেক্ট্রার সম্পাদনা ও পোস্ট প্রোডাকশনের কাজটি মধ্য লন্ডনের পাইনউড ও সোহোর মধ্যে ভাগাভাগি করে করা হয়েছিল। 

প্রযোজক হ্যারি সল্টজম্যান এবং অ্যালবার্ট আর ব্রোকলি লেখক ইয়ান ফ্লেমিংয়ের বন্ড উপন্যাসগুলোর স্বত্ব কিনে নেয়ার পর ইওন প্রোডাকশন নামে কোম্পানি গঠন করেন। সেটি ১৯৬১ সালের ঘটনা। এরপর থেকে বন্ড চলচ্চিত্রগুলো তারা নির্মাণ করে ঠিকই কিন্তু নিজেরা অর্থসংস্থান করে না, কোনো ব্যবসায়িক ঝুঁকি নেয় না এবং সিনেমা নির্মাণের পর কোনো স্বত্বও রাখে না।

ইওন প্রোডাকশন গঠনের পরের বছরই এই দুই প্রযোজকের স্ত্রী ডানা ও জ্যাকুলিন তাদের নামের প্রথম অংশ নিয়ে সুইজারল্যান্ডে ডানজাক নামে সংস্থা তৈরি করেন। দুই কোম্পানির মধ্যে চুক্তি হলো, ইওন প্রোডাকশন জিরো জিরো সেভেন নির্মাণ করে সেটি বিক্রি করবে ডানজাকের কাছে। পরে ডানজাক যুক্তরাষ্ট্রের ডেলওয়ারে স্থানান্তরিত হয়।

ফলে জেমস বন্ড সিনেমা প্রকৃতপক্ষে যুক্তরাজ্যের প্রোডাকশন হাউসে নির্মিত একটি যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক কোম্পানির সম্পদ। এ নিয়ে রাজনৈতিক বিতর্কও হয়েছে। ২০১৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে টরি এমপি মার্ক স্পেন্সার বলেন, বন্ড চলচ্চিত্রের মুনাফার কর এই দেশেই প্রদান করা উচিত, সারা বিশ্বে নয়। তবে ডানজাক এক বিবৃতিতে বলেছে, জেমস বন্ড থেকে  ইওন ও ডানজাকের সমস্ত আয় যুক্তরাজ্য কিংবা যুক্তরাষ্ট্রে করের আওতায়। আয়ের কোনো অংশই ট্যাক্স হ্যাভেনে যায়নি। 

ইওন তাদের ২০১৫ সালের হিসাবে উল্লেখ করেছে, একবার চলচ্চিত্রের প্রযোজনার কাজ শেষ হয়ে গেলে চলচ্চিত্রটি যুক্তরাজ্যের ফিল্ম ট্যাক্স রিলিফ থেকে প্রাপ্ত অনুদানের তুলনায় কম দামে প্রায় নির্মাণ ব্যয়ের সমান মূল্যে বিক্রি করা হয়। 

তবে এটা স্পষ্ট যে বন্ড চলচ্চিত্রগুলো খুবই লাভজনক। ২০১৪ সালে ফাঁস হওয়া ইমেইল অনুযায়ী, ধারণা করা হয় উত্তর কোরিয়ার এজেন্টরা সনি পিকচারস এন্টারটেইনমেন্ট হ্যাক করেছিল। তারা প্রকাশ করে, স্কাইফল বিশ্বজুড়ে ১১০ কোটি পাউন্ড আয় করে। এর মধ্যে এমজিএম ও সনি পরিবেশক হিসেবে ২৩ দশমিক ২ কোটি এবং ডানজাক ১০ দশমিক ৯ কোটি পাউন্ড আয় করে। এছাড়া স্পেক্ট্রা ডিভিডি ও ভিওডি বিক্রি থেকে প্রাপ্ত আয় বাদ দিয়ে বিশ্বজুড়ে ৮৮ কোটি পাউন্ড আয় করে। 

ডানজাকের দাবি, ১৯৬০-এর দশক থেকে তারা বন্ড সিরিজ নির্মাণের জন্য ইওন প্রোডাকশনকে বেছে নিয়েছে। এর ফলে যুক্তরাজ্যের চলচ্চিত্র শিল্পে ১০০ কোটি ডলারেরও বেশি বিনিয়োগ হয়েছে, কোটি কোটি মানুষের কর্মসংস্থান এবং বিশ্বের কাছে ব্রিটিশ প্রতিভা প্রদর্শিত হয়েছে। 

ট্যাক্সওয়াচের পরিচালক জর্জ টার্নার বলেন, রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার মধ্যে থেকেই ইওন বন্ড চলচ্চিত্র নির্মাণের তহবিল গোছাতে কার ছাড় সুবিধাকে ব্যবহার করে। আর ভর্তুকি প্রাপ্তিকে বৈধ করতে তারা যুক্তি দেখায়, জনগণের এই অর্থ যুক্তরাজ্যে কর্মসংস্থান তৈরিতে ব্যবহার করছে তারা।

সূত্র: দ্য গার্ডিয়ান

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন