বিশ্লেষণ

শিক্ষার মান উন্নয়নে প্রয়োজন শিক্ষকদের প্রতিযোগিতা

ড. এ. কে. এনামুল হক

হঠাৎ করে খাবার টেবিলে বিরিয়ানি, কেক ও কোক দেখে অবাক। কেউ পাঠিয়েছে বলেই ধারণা। তাই জিজ্ঞেস করে জানলাম একটি ছেলে দিয়ে গেছে। কে সে? আমরা কেউ চিনি না, তবে সে আমার ছেলের পরিচিত। খাবার কি নিজে দিয়ে গেল? হ্যাঁ। তাকে বাসায় ডাকলে না? কভিড তাই বাসায় আসতে চায়নি, তবে এমনিতেও সে আসত না। কেন? সে অনেক কথা। বলো একটু। তার দেয়া খাবার মুখে তোলার আগে কারণ তো জানি! ও, সে একটা চাকরি পেয়েছে, তাই খাবার নিয়ে এসেছে। সবার জন্য কেন? সে চাকরি পেয়ে খুব খুশি, তাই এনেছে। তোমার জন্য? না সবার জন্য। আমার প্রশ্ন থামে না। ঔত্সুক্য বেড়ে যায়। বলো বাবা, কে সেই ছেলে?

বছর চারেক আগে একদিন আমি যাচ্ছিলাম রিকশা করে। বয়স্ক রিকশাওয়ালা আমাকে জাস্টিস মোর্শেদের বাসায় নামিয়ে দিলেন। টাকা দেয়ার সময় ইতস্তত করে জিজ্ঞেস করলেন, এখানে অনেক ছেলেমেয়ে পড়াশোনা করতে আসে। এটা কি স্কুল? না। এখানে গরিব ছাত্রদের শুক্রবারে অংক ও ইংরেজি শেখানো হয়। আপনি কী করেন? আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র, তবে এখানে ওদের পড়াই। আমার একটা ছেলে ক্লাস নাইনে পড়ে। পড়াশোনায় ভালো, তাকে কি দেয়া যাবে? বেতন কত? বেতন নেই। পাঠিয়ে দেবেন আগামী শুক্রবার। পরের শুক্রবার থেকে ছেলেটি আসতে লাগল। নিয়মিত। তারপর? সে এসএসসি পাস করল, জিপিএ ৪.৯। তারপর আমার কাছে এসে বলল, তার বাবার পক্ষে আর পড়াশোনা চালানো সম্ভব নয়, তাই সে চাকরি খুঁজছে। তখন আমি বলেছিলাম, তোমাকে আমি একটি সাইকেল কিনে দিই। তুমি যাও, কোনো পলিটেকনিক কলেজে ভর্তি হও। আর সেই সঙ্গে ডেলিভারি বয় হিসেবে কাজ করো সাইকেল দিয়ে। তোমারও পড়াশোনা হবে আর বাবাকে সাহায্যও করতে পারবে। গত তিনটি বছর সে তা-ই করেছে। মিরপুর থেকে পাস করেছে। গত মাসে সে চাকরির জন্য দেশের একটি নামকরা প্রতিষ্ঠানে ইন্টারভিউ দিয়েছিল। তারা তাকে বলেছে, তোমার মতো অংক জ্ঞান আমরা আর কারো কাছে পাইনি। এ পদের উপরের পদে আমরা কয়েক দিন ধরে লোক নিতে চাইছিলাম। ইন্টারভিউতে ভালো কাউকে পাইনি। আমরা তোমাকে সেই পদেই নিয়োগ দিচ্ছি। বেতন ৫০ হাজার টাকা। তার খুশি দেখার মতো। সে তাই বেতনের টাকা থেকে এই খাবার আমার জন্য এনেছে। কারণ তার মতে, সেই অংক পড়া, সাইকেল আর উপদেশই তাকে এ পর্যন্ত এনেছে। তাই আমি তার খাবার ফেরত দিইনি। 

গল্পটি বললাম। যেখানে আমরা জিপিএ নিয়ে রীতিমতো যুদ্ধ করছি। মুখস্থ করতে করতে মুখে ফেনা তুলে ফেলছি, সেখানে জাস্টিস মোর্শেদের নাতির নামের এই ছোট ফাউন্ডেশন তাদের আলোর পথ দেখিয়েছে। সেখানে নেই কোনো সিলেবাস। নেই কোনো পরীক্ষা। কেবল শেখা আর শেখা। শেখার আনন্দেই সেই ছেলেটি তিনটি বছর প্রতি শুক্রবার বই-খাতা নিয়ে চলে আসত। আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থায় এই পরিবর্তনটুকু কবে আসবে জানি না। তবে গল্পটি বলার লোভ সামলাতে পারলাম না। স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়গুলো কেবলই ডিগ্রি তৈরির কারখানা। প্রকৃত শিক্ষালাভের কোনো সুযোগ নেই। অথচ তা নিয়ে আমাদের গর্বের অন্ত নেই। 

দ্বিতীয় ঘটনা। কম্পিউটার সায়েন্সের এক ছাত্র। পাস করে চাকরি করছে। বিশ্ববিদ্যালয়ে থাকার সময় তার এক শিক্ষকের উদ্যোগে প্রোগ্রামিং শিখে নিয়মিত দেশে-বিদেশে প্রতিযোগিতা করেছে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শিক্ষা ব্যবস্থা এগুলোর কোনো স্বীকৃতি দেয় না। সরকারের আইসিটি মন্ত্রণালয় এই প্রতিযোগিতায় সহায়তা করে। তবে অর্থ মন্ত্রণালয় করে না। কী করে জানলাম? কারণ আইসিটি মন্ত্রণালয় সেরা প্রোগ্রামারদের যখন পুরস্কার দেয়, অর্থ মন্ত্রণালয় তাদের অল্প টাকার ৩০ শতাংশ কর হিসেবে কেটে রাখে। পুরস্কারপ্রাপ্ত কোনো ছাত্রই করদাতা নয় বা হয় না, কিন্তু এই কর কেন কাটতেই হবে? 


যা বলছিলাম। ছেলেটি হঠাৎ করে তার ই-মেইলে দেখতে পায় বিদেশী এক কোম্পানি তাকে ই-মেইলে জানিয়েছে যে তোমার প্রোগ্রামিং প্রতিযোগিতার র‍্যাংকিংয়ের ভিত্তিতে আমরা তোমাকে একটি প্রতিযোগিতায় ডাকছি। যোগ দিতে চাইলে দিতে পারো। সে প্রতিযোগিতায় অংশ নিল।

কিছুদিন পর কোম্পানিটি জানাল, তোমাকে আমরা চাকরি দিতে চাই। যদি আসতে চাও, তবে এই ফরমটি পূরণ করে দাও। অপ্রত্যাশিত প্রস্তাব—তাও কভিডের সময়! সে রাজি হলো ফরম পূরণ করতে। ফরম পূরণ করতে গিয়ে দেখল কোম্পানিটির চাকরি পৃথিবীব্যাপী। এত বড় কোম্পানি। দেখা যাক। তাকে বলতে হবে কোথায় কোথায় সে যেতে চায়। ফরম পূরণ করতে গিয়ে অবাক হলো কোথাও তাকে জিজ্ঞেস করেনি তার পড়াশোনা কতদূর। কিছুটা অবাক কিছুটা হতাশ। পড়াশোনার কোনো দামই কি নেই! কিছুদিন পর কোম্পানিটি জানাল, আমাদের ৫ ঘণ্টার সময় দাও। আমরা তোমার ইন্টারভিউ নেব। সাধারণত এই ইন্টারভিউটির সময় আমরা প্রার্থীকে আমাদের হেডকোয়ার্টারে আনি। কিন্তু যেহেতু কভিড, তাই আমরা অনলাইনে নেব। আমাদের বিশেষজ্ঞ দল, সংশ্লিষ্ট বিভাগ, সোস্যাল গ্রুপ, এইচআর বিভাগ ও সর্বশেষ উচ্চপর্যায়ের একটি টিম তোমার ইন্টারভিউ নেবে। 

নির্দিষ্ট দিনে একেক করে সবাই তার ইন্টারভিউ নিল। প্রায় ৫ ঘণ্টা সময়ের কখনই তাকে তারা ডিগ্রি নিয়ে প্রশ্ন করেনি। জিজ্ঞেস করেছে তুমি পড়াশোনা ছাড়া আর কী কী করো? সমাজের জন্য কিছু করো কিনা? মানুষের জন্য নিজে করেছ এমন উদাহরণ দাও। কী বই পড়েছ? কার গল্প ভালো লাগে? অবশ্যই তাকে প্রোগ্রামিং সম্পর্কে নানা প্রশ্ন জিজ্ঞেস করেছে। বলেছে এই প্রবলেমটি কী করে সমাধান করবে বলো? করে দেখাও ইত্যাদি। দেখেছে সে নিজে নানা প্রবলেম তৈরির চিন্তা করতে পারে কিনা। কখনো জিজ্ঞেস করেনি তোমার সিজিপিএ কত? কখনই জিজ্ঞেস করেনি তোমার বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম কী? একে একে বিভিন্ন পর্যায় অতিক্রম করে সব শেষের দল বলল, তোমাকে আমরা নিতে চাই। তবে কভিডের জন্য আমাদের অফিস এখনো বন্ধ। আগামী বছরের জন্য তৈরি তো? তার বেতন শুনে আমি অবাক। চাকরির শুরুতেই বিদেশেও এই বেতন জেনে অনেকে অবাক হবেন।

এ গল্পটি বললাম কারণ দেখতে পারছেন ক্রমে সারা বিশ্বে শিক্ষার অবস্থান কোথায় যাচ্ছে? মুখস্থ শিক্ষার মূল্য ক্রমে শূন্যের কোটায় নামছে। শিক্ষা মানে ডিগ্রি নয়। কিন্তু আমরা তা নিয়ে ভাবছি না। আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থায় আমূল পরিবর্তনের সময় এসেছে। পরীক্ষা পরীক্ষা পরীক্ষা থেকে শিক্ষার মূলমন্ত্রে ফেরত যেতে হবে। শিক্ষামন্ত্রী তো বিতর্ক করতেন কিন্তু এখনকার ছাত্রদের তর্ক-বিতর্কের সময়ই নেই। গানবাজনা সব বন্ধ। কেবল রয়েছে একটি বিষয়—পরীক্ষা। আমাদের সময় আমরা বন্যার্তদের জন্য ত্রাণ নিয়ে যেতাম। এখন ছাত্রছাত্রীরা পরীক্ষার বাইরে কিছুই চিন্তা করতে পারছে না। এক পরীক্ষার পর আরেক পরীক্ষা! 

তৃতীয় গল্পটি বলি। কভিডের সময় স্কুল বন্ধ। অনলাইনে ক্লাস চলছে। কিন্তু শিক্ষা অধিদপ্তর বলল, স্কুলকে পরীক্ষা নিয়েই তবে ছাত্রদের পরের ক্লাসে যাওয়ার ব্যবস্থা হবে। এক স্কুলের শিক্ষক ছাত্রদের জানালেন যে দুপুর ১২টায় পরীক্ষা হবে। আমি প্রশ্ন পাঠিয়ে দেব। তোমরা নিজেরা উত্তর লিখে ছবি তোলে আমাকে পাঠাবে। হঠাৎ করে রাত ১২টায় তিনি জানালেন পরীক্ষা এখনই শুরু হতে যাচ্ছে। দুপুর ১২টা আর রাত ১২টা গুলিয়ে ফেলেছেন তিনি! যারা তখনো জেগে ছিল, তারা তৈরি হলো। শিক্ষক প্রশ্ন পাঠালেন। ওরা পরীক্ষা দিল। পরীক্ষা দিয়ে একে অন্যের খোঁজ নিল। সবাই জানতে পারল কোনো ভালো ছাত্রই পরীক্ষা দিতে পারেনি। কারণ তারা ঘুমিয়ে পড়েছিল। বেজায় খুশি সবাই। এবার দেখা যাবে কে ফার্স্ট হয়? বুঝতেই পারছেন, প্রতিযোগিতা হয়ে গেছে অসুস্থ প্রতিযোগিতা। সব পর্যায়ে তা ছেয়ে গেছে। তাই দেখছেন নকলের উৎসব। শিক্ষার্থী, অভিভাবক, শিক্ষক সবাই এই অসুস্থ প্রতিযোগিতায় নেমেছেন। কারো মাথায় আসছে না, প্রতিযোগিতা হবে সুস্থ প্রতিযোগিতা। অন্যকে ঠকিয়ে নয়। মুখস্থ করার ফল এগুলো। শুরু হয়েছে শিক্ষায়তন থেকে, তবে ছড়িয়ে পড়েছে সর্বত্র। তারই ফলে দেখবেন ভুয়া পরীক্ষার ফল দিতে প্যাথলজিস্টের হাত কাঁপে না। মেডিকেলের ভর্তি পরীক্ষায় ডাক্তার জড়িত। ভালো মেশিনটিকে অচল করে দিতে প্রকৌশলীর অন্তরজ্বালা হয় না। খারাপ ছাত্রকে ফার্স্ট করতে শিক্ষকের মর্মপীড়া হয় না। স্পষ্ট মিথ্যা বলতে রাজনীতিকরা বিব্রত হন না। শুরুতেই যে ভুল, যে মিথ্যা দিয়ে আমাদের ভিতটি গড়ে তোলা হয়েছিল, সেখানেই পরিবর্তন আনতে হবে। 

পাশাপাশি আরেকটি গল্প বলি। দেশে অনেক নতুন কোর্স আমি চালু করেছি ইস্ট ওয়েস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ে। চালু করতে অনেক কষ্ট। কারণ অধিকাংশ ক্ষেত্রেই আমাদের যেতে হয় ইউজিসিতে। সেখানে নিয়মের অন্ত নেই। নিয়মের বেড়াজালে আমরাই হারিয়ে যাই। তাদের প্রশ্নের শেষ নেই। তাদের অবিশ্বাসের সীমা নেই। তারা সব জানে। আমরাই কিছু জানি না। এই অহংকার সবার মনে। যাহোক, কোর্সগুলোর নাম শুনলে ভালো লাগবে। আমরা চালু করেছি এনার্জি ইকোনমিকস, ল অ্যান্ড ইকোনমিকস, ব্লু ইকোনমিকস, ইকোনমিকস অব কম্পিটিশন ল ইত্যাদি। এনার্জি ইকোনমিকসের ক্লাস নিচ্ছি। ছাত্রদের উৎসাহের অন্ত নেই। আনন্দ নিয়ে তারা পড়ছে। আমার ক্লাস সাধারণত পরিপূর্ণ থাকে। ছাত্রদের চোখ-কান থাকে খাড়া, ভালো করে নোট না করলেই বিপদ! এই স্যার মুখস্থে বিশ্বাস করেন না! সঠিক ক্লাস নোট না থাকলেই পরীক্ষায় বিপত্তি ঘটতে পারে। হঠাৎ চোখ গেল নোটিস বোর্ডে। এক ছাত্র তার ক্লাস নোটটি টানিয়ে দিয়েছে। ক্লাস নোট? তাও সবার জন্য? সাধারণত ছাত্ররা তা নিজের কাছে রাখে। কারণ তা দিয়েই তারা বাজিমাত করে। কে এই ছাত্র। চিনতে পারলাম। অতি উৎসাহী কিছু ছাত্রের একজন। ভালো ছাত্র। নোটিসটির নিচে লেখা আছে—আমার ক্লাস নোটটি দিলাম, আসুন সুস্থ প্রতিযোগিতা করি।

শিক্ষার মান নিয়ে আমাদের চিন্তার অন্ত নেই। শিক্ষার মান ক্লাসরুমের এয়ারকন্ডিশন দিয়ে হয় না। শিক্ষার মান পুস্তকের গুণে হয় না। শিক্ষার মান পাঠক্রম তৈরি করে না। শিক্ষার মান ছাত্রদের গুণেও হয় না। শিক্ষার মান হয় শিক্ষকের গুণে। তাই শিক্ষকের মান বাড়ানোর জন্য প্রয়োজন শিক্ষকের মধ্যে প্রতিযোগিতা। আমরা করছি ঠিক তার উল্টোটি। বাড়িয়েছি শিক্ষার্থীদের ভেতরে প্রতিযোগিতা। আর শিক্ষকরা নাকে তেল দিয়ে শত বছরের জীর্ণ নোট দিয়ে ক্লাস নিচ্ছেন কিংবা কোচিং করে বেড়াচ্ছেন। আসুন শিক্ষকের প্রতিযোগিতা বাড়াই। শিক্ষার মান বাড়াতে এটাই জরুরি। শিক্ষককে বলতে হবে তিনি প্রতি বছর কী করেছেন? কী কাজটি তিনি নতুন করে করেছেন, যাতে তার জ্ঞান বৃদ্ধি পেয়েছে? স্কুল-কলেজ পর্যায়ে প্রয়োজন প্রশিক্ষণ। বাধ্যতামূলকভাবে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করতেই হবে। হবে প্রশিক্ষণ গ্রহণের প্রতিযোগিতা। একই প্রশিক্ষণ বারবার নয়। তাকে দেয়া হবে প্রশিক্ষণ ভাতা। বছরে অন্তত ৩০ দিন তাকে নানা প্রশিক্ষণে অংশগ্রহণ করতেই হবে। তাতে তার ক্লাসে পাঠদানে পরিবর্তন আসবে। বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের শিক্ষকদের জন্য লাগবে গবেষণা। থাকবে গবেষণা ভাতা। প্রতি বছর গবেষণা না থাকলে বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতার কোনো অর্থই হয় না। তাতে সব শিক্ষক জ্ঞানার্জনে ব্রতী হবেন। আর তাতেই হবে শিক্ষা জ্ঞানার্জনের একটি উপায়। শিক্ষকতা পেশায় টিকে থাকার একমাত্র উপায় প্রতিযোগিতা করা। 


ড. এ. কে. এনামুল হক: অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, ইস্ট ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটি; পরিচালক, এশিয়ান সেন্টার ফর ডেভেলপমেন্ট

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন