বিদেশীরা সবচেয়ে বেশি বিক্রি করেছেন ব্র্যাক ব্যাংকের শেয়ার

মেহেদী হাসান রাহাত

পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত বিভিন্ন খাতের শীর্ষস্থানীয় ভালো মৌলভিত্তির নির্বাচিত কিছু কোম্পানিতেই সাধারণত বিনিয়োগ করেন বিদেশীরা। কাঙ্ক্ষিত মূলধনি মুনাফা অর্জনের পাশাপাশি খাত কোম্পানিভিত্তিক বিভিন্ন ইস্যু বিদেশী বিনিয়োগকে প্রভাবিত করে। এছাড়া সামষ্টিক অর্থনীতির বিভিন্ন সূচকও এক্ষেত্রে বিবেচনায় নেন বিদেশীরা। এসব নির্দেশক বিবেচনায় নিয়েই বছর দুয়েক ধরে দেশের পুঁজিবাজারে বিদেশী বিনিয়োগকারীদের মধ্যে শেয়ার বিক্রির প্রবণতা বেড়েছে। এর ধারাবাহিকতায় চলতি বছরের প্রথম নয় মাসে বিদেশী বিনিয়োগকারীরা সবচেয়ে বেশি শেয়ার বিক্রি করেছেন ব্র্যাক ব্যাংকের। বিদেশীদের বিক্রির চাপে সময়ে ব্যাংকটির শেয়ার প্রায় ২৭ শতাংশ দর হারিয়েছে।

দেশের পুঁজিবাজারের আকার বিবেচনায় বিদেশী বিনিয়োগের পরিমাণ খুব বেশি নয়। তবে গত পাঁচ বছরে পুঁজিবাজারে বিদেশী বিনিয়োগের পরিমাণ তিন গুণ বেড়েছে। বর্তমানে বিদেশী বিনিয়োগের পরিমাণ মোট বাজার মূলধনের শতাংশ।

কোম্পানিভিত্তিক বিদেশী বিনিয়োগ পর্যালোচনায় দেখা যায়, চলতি বছরের সেপ্টেম্বর শেষে সবচেয়ে বেশি ৩৯ দশমিক ৭৩ শতাংশ বিদেশী বিনিয়োগ রয়েছে বিস্কুট কনফেকশনারি উৎপাদক অলিম্পিক লিমিটেডের শেয়ারে। গত বছরের ডিসেম্বরে কোম্পানিটিতে বিদেশীদের বিনিয়োগ ছিল ৪০ দশমিক শূন্য শতাংশ। আর দুই বছর আগে ২০১৭ সালের ডিসেম্বর শেষে কোম্পানিটিতে ৪৩ দশমিক ৩৩ শতাংশ বিদেশী বিনিয়োগ ছিল।

৩৯ দশমিক ৫৮ শতাংশ বিদেশী বিনিয়োগের ভিত্তিতে দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠান ডেল্টা ব্র্যাক হাউজিং লিমিটেড (ডিবিএইচ) গত বছরের ডিসেম্বর শেষে প্রতিষ্ঠানটিতে বিদেশী বিনিয়োগ ছিল ৪২ দশমিক শূন্য শতাংশ। আর ২০১৭ সাল শেষে ডিবিএইচে বিদেশীদের বিনিয়োগ ছিল ৪১ দশমিক ২৮ শতাংশ।

বিদেশী বিনিয়োগের ভিত্তিতে শীর্ষ কোম্পানির তালিকায় তৃতীয় অবস্থানে রয়েছে ব্র্যাক ব্যাংক লিমিটেড। বছরের সেপ্টেম্বর শেষে ব্যাংকটিতে বিদেশী বিনিয়োগের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৩৭ দশমিক ৪৫ শতাংশ। গত বছরের ডিসেম্বর শেষে ব্যাংকটিতে বিদেশী বিনিয়োগ ছিল ৪৩ দশমিক ৪৮ শতাংশ। অর্থাৎ নয় মাসে ব্র্যাক ব্যাংকের দশমিক শূন্য শতাংশ শেয়ার বিক্রি করেছেন বিদেশীরা। ২০১৭ সালের ডিসেম্বর শেষে ব্যাংকটির ৪০ দশমিক ৬৮ শতাংশ শেয়ারে বিনিয়োগ ছিল বিদেশীদের।

বিদেশী বিনিয়োগকারীদের ব্রোকারেজসহ বিভিন্ন ধরনের সেবা দিচ্ছে ইবিএল সিকিউরিটিজ। প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক বাংলাদেশ মার্চেন্ট ব্যাংকার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমবিএ) প্রেসিডেন্ট মো. ছায়েদুর রহমানের কাছে বিদেশী বিনিয়োগকারীদের মনস্তত্ত্ব সম্পর্কে জানতে চাইলে বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, বিদেশী বিনিয়োগকারীরা কিন্তু খাতভিত্তিক বাছাইকৃত হাতে গোনা কিছু কোম্পানিতে বিনিয়োগ করেন। বিনিয়োগ সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে তাদের স্বতন্ত্র দর্শন বিশ্লেষণ রয়েছে। কখনো খাতভিত্তিক কোনো ইস্যু যা ব্যবসাকে প্রভাবিত করে, সেটিকে বিবেচনায় নিয়ে তারা শেয়ার কেনাবেচা করেন। তবে অধিকাংশ ক্ষেত্রে খাতের চেয়ে যে কোম্পানিতে তারা বিনিয়োগ করছেন, সেটির ব্যবসায়িক অবস্থা পর্যালোচনা করেই সিদ্ধান্ত নেন।

ব্র্যাক ব্যাংকের উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেন, বছরের এপ্রিল থেকে সব ব্যাংকের জন্য ঋণ আমানতের সুদহার নয়-ছয় নির্ধারণ করে দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। এসএমই খাতে ব্র্যাক ব্যাংকের বেশি বিনিয়োগ থাকায় পরিবর্তিত সুদহারের কারণে ব্যাংকটির মুনাফা উল্লেখযোগ্য হারে কমবে এমন প্রক্ষেপণের ভিত্তিতে বিদেশীরা বছর উল্লেখযোগ্য হারে শেয়ার বিক্রি করেছেন। তাছাড়া বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ঋণমান সংস্থা যেমন মুডিসের রেটিংয়ে দেশের ব্যাংকগুলো বিনিয়োগের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ। এটিকেও বিদেশীরা বিবেচনায় নেন। তবে একদিকে বিদেশীরা যেমন শেয়ার বিক্রি করেছেন, অন্যদিকে তারা নতুন করে বিনিয়োগও করবেন। এরই মধ্যে বিদেশীরা বেশকিছু শেয়ারে নতুন বিনিয়োগ করেছেন। সামনের দিনগুলোতে এটি আরো বাড়বে বলে জানান তিনি।

ওষুধ খাতের কোম্পানি বেক্সিমকো ফার্মাসিউটিক্যালসে বছরের সেপ্টেম্বর শেষে বিদেশী বিনিয়োগ ছিল ৩৩ দশমিক ৬১ শতাংশ। ২০১৯ সালের ডিসেম্বর শেষে কোম্পানিটিতে বিদেশী বিনিয়োগ ছিল ৩৬ দশমিক ৭০ শতাংশ। আর ২০১৭ সালে বেক্সিমকো ফার্মাসিউটিক্যালসে বিদেশীদের ৪১ দশমিক ৯৫ শতাংশ বিনিয়োগ ছিল।

ওষুধ খাতের আরেক কোম্পানি রেনাটা লিমিটেডে বছরের সেপ্টেম্বর শেষে বিদেশীদের বিনিয়োগ দাঁড়িয়েছে ২২ দশমিক ৭৪ শতাংশে। গেল বছরের ডিসেম্বরে কোম্পানিটিতে বিদেশীদের বিনিয়োগ ছিল ২২ দশমিক ৬৭ শতাংশ। আর ২০১৭ সাল শেষে কোম্পানিটিতে বিদেশী বিনিয়োগ ছিল ২১ দশমিক ৭৮ শতাংশ।

বস্ত্র খাতের কোম্পানি এমএল ডায়িং লিমিটেডে বছরের সেপ্টেম্বর শেষে ২১ দশমিক ৮৯ শতাংশ বিদেশী বিনিয়োগ ছিল। গত বছরের ডিসেম্বরেও কোম্পানিটিতে বিদেশীদের বিনিয়োগের পরিমাণ অপরিবর্তিত ছিল

শরিয়াহভিত্তিক ইসলামী ব্যাংকে বছরের সেপ্টেম্বর শেষে বিদেশী বিনিয়োগের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ২০ দশমিক ৬৭ শতাংশে। গত বছরের ডিসেম্বরে ব্যাংকটিতে বিদেশী বিনিয়োগ ছিল ২৩ দশমিক ৫৭ শতাংশ। আর ২০১৭ সালের ডিসেম্বর শেষে এতে বিদেশী বিনিয়োগ ছিল ২৬ দশমিক ৪৬ শতাংশ।

বস্ত্র খাতের কোম্পানি শেফার্ড ইন্ডাস্ট্রিজে বছরের সেপ্টেম্বর শেষে বিদেশী বিনিয়োগ ছিল ১৮ দশমিক ৪০ শতাংশ। গত বছরের ডিসেম্বর শেষে কোম্পানিটিতে বিদেশী বিনিয়োগ ছিল ১৯ দশমিক ৫২ শতাংশ। আর ২০১৭ সালে কোম্পানিটিতে বিদেশী বিনিয়োগ ছিল ২৭ দশমিক ৩৪ শতাংশ।

বস্ত্র খাতের কোম্পানি ভিএফএস থ্রেড ডায়িং লিমিটেডে ১৮ দশমিক ৩০ শতাংশ বিদেশী বিনিয়োগ ছিল। গত বছরের ডিসেম্বরেও কোম্পানিটিতে বিদেশীদের বিনিয়োগের পরিমাণ অপরিবর্তিত ছিল।

ইস্পাত খাতের কোম্পানি বাংলাদেশ স্টিল রি-রোলিং মিলস (বিএসআরএম) লিমিটেডে বছরের সেপ্টেম্বর শেষে বিদেশী বিনিয়োগের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১৭ দশমিক শূন্য শতাংশ। গত বছরের ডিসেম্বরেও কোম্পানিটিতে বিদেশীদের বিনিয়োগের পরিমাণ অপরিবর্তিত ছিল। ২০১৭ সাল শেষে বিএসআরএমের ২৫ দশমিক ৯৪ শতাংশ শেয়ারে বিনিয়োগ ছিল বিদেশীদের।

জানতে চাইলে স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড বাংলাদেশের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) নাসের এজাজ বিজয় বণিক বার্তাকে বলেন, পুঁজিবাজার নিয়ে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে আস্থার যে সংকট ছিল, নতুন কমিশন দায়িত্ব নেয়ার পর তা অনেকাংশে দূর হয়েছে। বছরের এপ্রিল থেকে ঋণ আমানতের সুদহার নয়-ছয় নির্ধারণ করে দেয়ার কারণে যেসব ব্যাংকের এসএমই খাতে বেশি ঋণ ছিল স্বাভাবিকভাবেই তাদের আয় কমে গেছে। এর ওপর বাংলাদেশের অর্থনীতিতে কভিড-১৯-এর কী প্রভাব পড়ে সেটি নিয়েও শঙ্কা ছিল। সব মিলিয়ে এসব কারণেই বিদেশীরা ব্যাংকসহ অন্যান্য খাতের শেয়ার বিক্রি করেছেন।

তবে এখন পর্যন্ত বিশ্বের অন্যান্য দেশের তুলনায় বাংলাদেশের অর্থনীতি কভিড সংকট ভালোভাবে সামাল দিতে পেরেছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, সামনে সেকেন্ড ওয়েভ আসছে। প্রথম পর্যায়ের সংক্রমণের মতো যদি একইভাবে পরিস্থিতি সামাল দেয়া যায় তাহলে সামনে বাংলাদেশের সম্ভাবনা ভালো। অন্যান্য মার্কেটের চেয়ে বেশি রিটার্নের কারণেও বিদেশীরা বাংলাদেশের পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ করবেন। দেশের ব্যাংকিং খাতের জন্য আগামী বছর বেশ চ্যালেঞ্জিং হবে। যদি ব্যাংকগুলো ব্যয় নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে ভালোভাবে পরিস্থিতি সামাল দিতে পারে তাহলে খাতেরও ভালো সম্ভাবনা রয়েছে বলে জানান তিনি।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন