কুয়েতে সরাসরি প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা

ছুটিতে এসে আটকা প্রবাসীদের ঘিরে সক্রিয় দালাল চক্র

মনজুরুল ইসলাম

দেড় মাসের ছুটি নিয়ে গত ফেব্রুয়ারিতে দেশে আসেন কুয়েত প্রবাসী সিহাবুল আলম। নভেল করোনাভাইরাস সংক্রমণ পরিস্থিতির কারণে বাংলাদেশ থেকে সরাসরি প্রবেশ নিষিদ্ধ থাকায় দীর্ঘ সময়েও কর্মস্থলে ফিরতে পারেননি তিনি। তবে ঢাকা থেকে সরাসরি প্রবেশ অনুমতি না থাকলেও বিকল্প উপায়ে কুয়েতে প্রবেশের উপায় পেয়েছেন প্রবাসী। আর উপায় বাতলে দিয়েছে একটি ট্রাভেল এজেন্সি। এজন্য প্রায় লাখ টাকার বিশেষ প্যাকেজও অফার করেছে তারা। যদিও বিগত সাত মাস বেকার থাকার পর অর্থ জোগাড় কোনোভাবেই সম্ভব হচ্ছে না সিহাবুল আলমের পক্ষে।

অর্থাভাবে সিহাবুলের কুয়েতে যাওয়া না হলেও থেমে নেই দালাল চক্রের কার্যক্রম। তাদের লক্ষ্য ছুটিতে এসে আটকে পড়া প্রায় ২৫ হাজার কুয়েত প্রবাসী। এরই মধ্যে অনেকের কুয়েতে প্রবেশের বৈধতা বা আকামার মেয়াদ শেষ হয়েছে। যাদের আকামার মেয়াদ এখনো বাকি আছে, তাদেরই মূলত দালাল চক্রের মাধ্যমে টার্গেট করছে কয়েকটি ট্রাভেল এজেন্সি।

গত আগস্ট থেকে সীমিত পরিসরে আন্তর্জাতিক ফ্লাইট চালুর সিদ্ধান্ত নেয় কুয়েত। কিন্তু করোনা পরিস্থিতির কারণে বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান, মিসর, নেপালসহ ৩৪ দেশের সঙ্গে সরাসরি আন্তর্জাতিক ফ্লাইট চলাচলে নিষেধাজ্ঞা জারি করে দেশটি। এমনকি এসব দেশ থেকে আসা নাগরিকদেরও সরাসরি প্রবেশের অনুমতি নেই। তবে প্রবেশ নিষিদ্ধ ৩৪ দেশ ব্যতীত অন্য যেকোনো দেশে গিয়ে ১৪ দিন অবস্থানের পর কুয়েতে প্রবেশের সুযোগ রয়েছে। যেসব প্রবাসীর আকামার মেয়াদ রয়েছে তারাই মূলত ট্রাভেল এজেন্সিগুলোর সঙ্গে চুক্তি করছেন তৃতীয় দেশ হয়ে কর্মস্থলে ফেরার।

বর্তমানে বাংলাদেশ থেকে কুয়েতে প্রবেশের জন্য সংযুক্ত আরব আমিরাতের ভ্রমণ ভিসার সুযোগ নিচ্ছেন ট্রাভেল এজেন্সিগুলো। তাদের মাধ্যমে দুবাই গিয়ে হোটেলে ১৪ দিন থাকার পর পিসিআর সনদ নিয়ে কুয়েতে প্রবেশ করছেন প্রবাসীরা। বাংলাদেশের মতো ভারত পাকিস্তানের নাগরিকরাও পন্থায় কুয়েতে যাচ্ছেন। তবে এজন্য কুয়েত প্রবাসী বাংলাদেশীদের খরচ হচ্ছে লাখ থেকে লাখ টাকা। মূলত কোনো উপায় না থাকায় এক প্রকার বাধ্য হয়েই ট্রাভেল এজেন্সিতে কন্ট্রাক্ট করে ঝুঁকি নিয়ে প্রবাসীরা কুয়েতে প্রবেশ করছেন। এর পরিপ্রেক্ষিতে দুবাই থেকে কুয়েতের টিকিটের মূল্যও বেড়ে গেছে। স্বাভাবিক সময়ে দুবাই-কুয়েত এয়ার টিকিটের মূল্য ৬০ থেকে সর্বোচ্চ ১২০ দিনার থাকলেও বর্তমানে সেটি বেড়ে ৭৫০ দিনার অতিক্রম করেছে। আবার দুবাইয়ে যাওয়ার পর যদি করোনা পজিটিভ হয় অথবা দুবাই কুয়েত সরকারের তাত্ক্ষণিক কোনো সিদ্ধান্তের কারণে যদি কুয়েতে প্রবেশ করতে না পারে, এক্ষেত্রে ট্রাভেল এজেন্সিগুলো কোনো ধরনের দায়ভার বহন করবে না জানিয়েই প্রবাসীদের সঙ্গে চুক্তি করছে।

জনশক্তি রফতানিকারক প্রতিষ্ঠানগুলোর সংগঠন বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ইন্টারন্যাশনাল রিক্রুটিং এজেন্সি (বায়রা) মহাসচিব শামীম আহমেদ চৌধুরী নোমান প্রসঙ্গে বণিক বার্তাকে বলেন, যাদের খুব বেশি জরুরি প্রয়োজন শুধু তারাই অতিরিক্ত টাকা দিয়ে পদ্ধতিতে কুয়েতে যাচ্ছেন। ছুটিতে এসে আটকে পড়া প্রবাসীদের অসহায়ত্বের সুযোগ নিয়ে কেউ কেউ অতিরিক্ত অর্থ হাতিয়ে নিচ্ছেন। সব মিলিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন প্রবাসীরাই। কারণ দীর্ঘদিন কাজ না থাকায় এমনিতেই অর্থাভাবে আছেন তারা। আবার কর্মক্ষেত্রে ফিরতে গিয়েও বিপুল অংকের অর্থ দেনা করতে হচ্ছে, যা হয়তো আগামী কয়েক মাসের বেতন দিয়েও শোধ করা সম্ভব হবে না। দেশের করোনা পরিস্থিতি যত দিন নিয়ন্ত্রণে না আসবে, ততদিন প্রবাসী কর্মীদের এমন অবস্থার মধ্য দিয়ে যেতে হবে।

দুবাই হয়ে কুয়েতে যেতে বাংলাদেশীদের জন্য অন্য দেশের তুলনায় খরচ তুলনামূলক অনেক বেশি এবং যাত্রীদের ঝুঁকি নিতে হয়। একই সঙ্গে দুবাই থেকে কুয়েতের টিকিটের মূল্য অন্য যেকোনো সময়ের তুলনায় অনেক বেশি।

কুয়েতের আকামাবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের হিসেবে, কভিড-১৯-এর কারণে ছুটিতে গিয়ে বাংলাদেশসহ বিভিন্ন দেশের লাখ ২৬ হাজার ৮৭১ প্রবাসী কর্মস্থলে ফিরতে পারছেন না। এর মধ্যে শুধু প্রবাসী বাংলাদেশীর সংখ্যা প্রায় ২৫ হাজার। পরিস্থিতিতে কুয়েতের বাংলাদেশ দূতাবাস দেশে আটকে পড়া কুয়েত প্রবাসী বাংলাদেশীদের বিশেষ সহায়তা প্রদানের লক্ষ্যে পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে।

কুয়েতের বাংলাদেশ দূতাবাস সম্প্রতি এক বিজ্ঞপ্তিতে জানায়, কুয়েত প্রবাসী বাংলাদেশী, যারা ছুটিতে বাংলাদেশে গিয়ে চলমান করোনা পরিস্থিতির কারণে বিমান চলাচল বন্ধ থাকায় নির্ধারিত সময়ে নিজ নিজ কর্মস্থলে ফিরতে পারছেন না, তাদের তালিকা তৈরির জন্য বাংলাদেশ দূতাবাস, কুয়েত অনলাইন নিবন্ধন পদ্ধতি চালু করেছে। বাংলাদেশে আটকে পড়া সব কুয়েত প্রবাসীকে দূতাবাসের ওয়েবসাইটের নিবন্ধন লিংকে প্রবেশ করে নির্ধারিত ফরম পূরণ করার জন্য অনুরোধ করা হচ্ছে।

জনশক্তি, কর্মসংস্থান প্রশিক্ষণ ব্যুরো (বিএমইটি) সূত্রে জানা গেছে, ১৯৭৬ থেকে পর্যন্ত বাংলাদেশ থেকে কুয়েতে যাওয়া মোট শ্রমিকের সংখ্যা লাখ ৩০ হাজার ৪৭৩। এর মধ্যে নারী শ্রমিক হাজার ১০৯ জন। ২০০৩ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত দেশটিতে প্রতি বছর গড়ে ৩০-৪০ হাজার বাংলাদেশী শ্রমিক যান। ২০০৬ সালে কুয়েতে শ্রমিক গিয়েছিলেন ৩৫ হাজার ৭৭৫ জন। এর পর থেকেই রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে কুয়েতে শ্রমিক পাঠানো বন্ধ হতে শুরু করে। ২০০৭ সালে দেশটিতে যান হাজার ২১২ জন, ২০০৮ সালে ৩১৯, ২০০৯ সালে ১০, ২০১০ সালে ৪৮ ২০১১ সালে ২৯ জন শ্রমিক। আর ২০১২ ২০১৩ সালে দেশটিতে যান মোট আটজন শ্রমিক।

তবে ২০১৪ সালে কুয়েতে আবারো শ্রমিক রফতানি শুরু হয়। ওই বছর বিএমইটির ছাড়পত্র নিয়ে দেশটিতে যান মোট হাজার ৯৪ জন বাংলাদেশী। ২০১৫ সালে কুয়েতে যান ১৭ হাজার ৪৭২ জন, ২০১৬ সালে ৩৯ হাজার ১৮৮, ২০১৭ সালে ৪৯ হাজার ৬০৪, ২০১৮ সালে ২৭ হাজার ৬৩৭ ২০১৯ সালে ১২ হাজার ২৯৯ জন। চলতি বছরের প্রথম দুই মাসে দেশটিতে গেছেন মোট হাজার ৫২৩ জন শ্রমিক।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন