খুব বেশি নীতিমালা দিয়ে এমএফএস খাতকে জর্জরিত করা উচিত নয়

ড. কেএএস মুরশিদ বিআইডিএসের মহাপরিচালক। উচ্চশিক্ষা যুক্তরাজ্যের কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে। ১৯৮৫ সালে পিএইচডি অর্জন করেন খাদ্যনীতির ওপর অভিসন্দর্ভে। পরবর্তী সময়ে অবকাঠামো ও সেচ, অনানুষ্ঠানিক ও গ্রামীণ ঋণবাজার, কৃষিবাজার ও ভ্যালু চেইন অর্থায়ন, মানবসম্পদ উন্নয়ন ও নীতিগবেষণায় তার কাজের ক্ষেত্র বিস্তৃত হয়েছে। ইউরোপিয়ান জার্নাল অব ডেভেলপমেন্ট, জার্নাল অব এগ্রেরিয়ান চেঞ্জ, ইকোনমিক অ্যান্ড পলিটিক্যাল উইকলি এবং জার্নাল অব ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজসহ আন্তর্জাতিকভাবে সুপরিচিত বিভিন্ন জার্নালে তার গবেষণা প্রবন্ধ প্রকাশ হয়েছে। বাংলাদেশ, সাব-সাহারান আফ্রিকা, শ্রীলংকা, ইন্দোনেশিয়া, পাকিস্তান, মিয়ানমার, থাইল্যান্ড, ভিয়েতনাম, লাওস, কম্বোডিয়াসহ বিভিন্ন দেশে তার গবেষণার অভিজ্ঞতা রয়েছে। দেশে এমএফএসের বিকাশ ও চ্যালেঞ্জ নিয়ে তার সঙ্গে কথা হয় বণিক বার্তার। 

সাক্ষাৎকার নিয়েছেন এম এম মুসা

দেশে আর্থিক অন্তর্ভুক্তির ক্ষেত্রে মোবাইলভিত্তিক আর্থিক সেবা (এমএফএস) নতুন মাত্রা যোগ করেছে। এ সেবার বর্তমান অবস্থাকে আপনি কীভাবে দেখেন?

যেকোনো সেবাই প্রাথমিক পর্যায়ে খুব দ্রুত বিকশিত হয়। কিন্তু একটা পর্যায়ে উন্নীত হওয়ার পর এর গতি কমে আসে। বাংলাদেশে মোবাইলভিত্তিক আর্থিক সেবার সম্প্রসারণের হার (এক্সপেনশন রেট) এখন কমা শুরু হয়েছে। এমএফএসের গতানুগতিক বাজারটা হলো এক স্থান থেকে আরেক স্থানে টাকা পাঠানো। এটিকে আমরা বলতে পারি ডমিস্টিক রেমিট্যান্স (অভ্যন্তরীণ রেমিট্যান্স)। এখান থেকে যে আয় আসে, সেটি নির্ভর করে পরিমাণ ও টার্নওভারের ওপর। এখন পর্যন্ত এটিই হলো এমএফএস প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রধান ব্যবসা। নতুন প্রডাক্টস বাজারে না এলে এ মোমেন্টাম ধরে রাখা কষ্টকর হবে। অবশ্য প্রডাক্টে বৈচিত্র্য আনার চেষ্টা করা হচ্ছে। যেমন সরকারি কিছু সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিতে (সেফটি নেট) এমএফএস অন্তর্ভুক্ত হয়েছে; যা খুব ভালো বিষয়। আরো অনেক কিছুতে এ সেবা অন্তর্ভুক্ত হওয়া দরকার। কিন্তু ব্যক্তি খাত এখন পর্যন্ত এ বাজারে সেই অর্থে পিছিয়ে আছে, এমএফএসের সেবাগুলো গ্রহণ করছে খুব ধীরে; ছোট ছোট দু-একটা উদাহরণ ছাড়া। নতুন প্রডাক্ট বলতে বোঝাচ্ছি বিভিন্ন অনলাইন পেমেন্ট সিস্টেমে বিকাশ বা অন্য এমএফএস ব্যবহার করা। করোনার কারণে এমএফএসের লেনদেন বেড়েছে। এসব ক্ষেত্রে এমএফএস ব্যবহারে এগিয়ে না আসার কোনো কারণ দেখি না। কেননা পৃথিবীর সব জায়গায় মোবাইল দিয়ে পেমেন্টস হয়। চীনে ক্যাশও নিতে চায় না, ক্রেডিট কার্ডও খুব একটা চলে না, মোবাইল ফোনে সব পেমেন্ট হয়। কাজেই এমএফএস সেবা আরো সহজীকরণের দিকেই আমাদের যেতে হবে। তবে এখানে স্বচ্ছতা থাকা দরকার। সুনির্দিষ্ট একটা ইতিবাচক নীতি থাকা প্রয়োজন।  


বাংলাদেশের ক্ষেত্রে এমএফএস সেবার চ্যালেঞ্জগুলো কী? 

চ্যালেঞ্জের ক্ষেত্রে প্রথমেই আসে বাজারের বিষয়। এমএফএসের বাজার সম্প্রসারিত হচ্ছে বটে, কিন্তু সেটি পর্যাপ্ত বা জোরালো হারে বাড়ছে না। নতুন প্রডাক্ট অন্তর্ভুক্তির ক্ষেত্রে কিছু সমস্যা আছে। যেমন মার্চেন্টস পেমেন্টের ক্ষেত্রে মার্চেন্টরা মনে করেন ব্যয়ের পুরোটা দায় তারা কেন বহন করবেন। তারা মনে করেন, গ্রাহকদেরও ব্যয়ের ৫০ শতাংশ দায় নেয়া উচিত, যার জন্য তারা এমএফএসের ব্যাপারে ততটা আগ্রহী নন। এ রকম কিছু বাধা এখনো এমএফএস বাজারে রয়ে গেছে। অধিকতর সম্প্রসারণের জন্য এসব বাধা সমাধান করা জরুরি।  


অনেকেই বলেন যে বাংলাদেশে এমএফএস সেবার ব্যয় বেশি। আপনি কী মনে করেন?

অন্য দেশের সঙ্গে তুলনা করে ব্যয়ের বিষয়টি আমরা দেখিনি। একেক দেশে বাজারের অবস্থা একেক রকম। আরেকটি কথা হলো, যারা প্রথমে বাজারে প্রবেশ করে, তারা সুফলের ক্ষেত্রে একটু এগিয়ে থাকে। এটিই অর্থনীতির নিয়ম। কিন্তু পরে যা হয় তা হলো, প্রতিযোগিতার মধ্যে ঢুকে গেলে লাভের হার ধীরে ধীরে কমে আসে। মোবাইল ফোনের বাজারের ক্ষেত্রেও তেমনটি দেখেছি। এখানেও বোধহয় দেখা যাবে। আমরা  তো  দেখছি এমএফএস খাতে বিকাশ আগের মতো মার্কেট লিডার আর নয়, যতটা তারা প্রথম দিকে ছিল। একটা সময় তাদের বাজার অংশ (মার্কেট শেয়ার) ৮০-৮৫ শতাংশ ছিল। এখন কিছুটা কমে ৭০ শতাংশের নিচে নেমে এসেছে। আমার ধারণা, এটি আরো কমে যাবে। কারণ এখানে সবাই বিনিয়োগ করছে। যে যত বেশি বিনিয়োগ করবে তত বেশি রিটার্ন পাবে এবং তাদের বাজার অংশ ক্রমে বাড়বে। এ বাজারে প্রতিযোগিতার মাত্রা বাড়ছে। এখন কে কোন কৌশল অবলম্বন করে এগিয়ে যেতে পারবে, সেটি দেখার বিষয়। তবে সুযোগগুলো থাকা দরকার এবং এটিকে উৎসাহিত করা দরকার। 


এমএফএস নিয়ন্ত্রণ নীতিমালাকে কীভাবে দেখেন? 

শৃঙ্খলা বিধানে এমএফএসের জন্য একটা নীতিমালা দরকার ছিল। ২০১৮ সালে তা প্রণয়ন করা হয়েছে। কিন্তু কথা হলো, সেটি কতটা যথাযথ হয়েছে কিংবা এ খাতের জন্য আরো নীতিমালা দরকার কিনা। আমার ধারণা, খুব বেশি নীতিমালা দিয়ে এমএফএস খাতকে জর্জরিত করা উচিত নয়। এটি উদীয়মান একটি খাত। এখানে কিছুটা ছাড় দেয়া দরকার। প্রথমে এটিকে বিকাশের সুযোগ করে দিতে হবে। তার পরে দেখতে হবে নীতিমালা কতটা মজবুত করা যায়। কিন্তু অনেক সময় আমরা কোনো কিছু দানা বাঁধার আগেই নীতিমালা দিয়ে সেটিকে এমনভাবে বেঁধে ফেলি, পরে সেটি শ্বাসকষ্টে মারা যায়। সেটি যেন না হয়। এমএফএসকে উৎসাহিত করা প্রয়োজন, তবে সেটি করতে হবে সবার জন্য সমান ক্ষেত্র তৈরির মাধ্যমে।


এমএফএস প্রতিষ্ঠানের মালিকানার ক্ষেত্রে কিছু দেশে মোবাইল অপারেটর, ব্যাংক বা তৃতীয় পক্ষের একটি সংমিশ্রণ রয়েছে। আমরা এক্ষেত্রে ব্যাংকচালিত মডেলকেই গ্রহণ করেছি। আমরা কি সঠিক পথে আছি বলে মনে করেন?

অন্য দেশে যেসব মডেল আছে সেগুলো আমাদের চেয়ে ভালো কিনা, সেটি আমরা মূল্যায়ন করিনি। সেটি খতিয়ে দেখা যেতে পারে। আমরা এখানে ব্যাংকচালিত মডেলটিই গ্রহণ করেছি। মূল কথাটি হলো, কনফ্লিক্ট অব ইন্টারেস্ট থাকলে সেখানে ব্যাংক-চালিত মডেলই ভালো। এখন যদি মোবাইল অপারেটরকে এমএফএস সেবার লাইসেন্স দেয়া হয়, তাহলে তো সমস্যা হতে পারে। কারণ সে নিজে অপারেটর, গ্রাহক তার সিমকার্ড ব্যবহার করছে, তার ইনফ্রাস্ট্রাকচার ব্যবহার করছে। সে চাইলে অন্য কাউকে তার ইনফ্রাস্ট্রাকচারে ঢুকতে না-ও দিতে পারে। প্রতিযোগী কেউ যদি তার লাইনে ঢুকে তাহলে তাকে কম প্রাধান্য দিতে পারে, কলড্রপ করাতে পারে। কাজেই এখানে একটি কনফ্লিক্ট অব ইন্টারেস্টের প্রশ্ন রয়েই যায়। এখন অপারেটর চাইলে আরেকটি কোম্পানি করে এ ব্যবসার জন্য লাইসেন্স নিতে পারে, তাহলে তো আর কনফ্লিক্ট থাকে না। অবশ্য এক্ষেত্রে কোনো ব্যাংকের সঙ্গে চুক্তি করতে হবে। তাহলে জবাবদিহিটাও নিশ্চিত করা যায়।  বর্তমানে ১৬টি লাইসেন্স আছে। আরো বেশি ছিল। এখন কমে ১৬টি হয়েছে। এর মধ্যে কয়টা অপারেট করছে? দুটো-তিনটে ছাড়া আর সবার অবস্থা তো মার্জিনাল। কাজেই নতুন পার্টি উৎসাহিত করাটা আমার মনে হয় না আমাদের এখানে প্রাধিকার। আমাদের এখানে প্রাধিকার হলো, বর্তমানে যেগুলো আছে সেগুলো বিনিয়োগ করতে পারছে কিনা, খাতটিকে বিকশিত করতে পারছে কিনা, সেটি দেখা। আর না পারলে যারা পারবে বলে মনে হয় তাদের চিহ্নিত করে বাজারে নিয়ে আসার চেষ্টা করা। 


ব্যাংকে লেনদেনের ক্ষেত্রে এর নিশ্চয়তা-নিরাপত্তা খোদ ব্যাংকই দিচ্ছে।  এমএফএসের ক্ষেত্রে নিরাপত্তা ইস্যুটি কীভাবে সামলানো উচিত? 

এমএফএসে কী ধরনের নিরাপত্তার অভাব আছে? আমি যে টাকাটা রাখছি তার গ্যারান্টর কে? এই তো? যেহেতু এটি ব্যাংক-লেড মডেল, কাজেই টাকাটা কিন্তু ব্যাংকেই রাখা হয়। সেখানকার যে ফ্লোট মানি, সেটিই হলো এমএফএস প্রতিষ্ঠানের জন্য গুরুত্বপূর্ণ (ক্রিটিক্যাল)। বর্তমানে তাদের ব্যবসা থেকে যে লাভ হয়, তা থেকে তাদের ব্যয় পোষায় না। সে হিসাবে তাদের ব্যবসার আয় ব্যয়ের নিচে। তাদের মূল মুনাফাযোগ্যতা (প্রফিটাবিলিটি) নির্ভর করে ফ্লোট মানির ওপরই। এখন সুদহার কমলে তাদের ব্যবসার কী হবে, সেটি আমি জানি না। মনে হয় এটি তাদের দিক থেকে বড় ধরনের সমস্যা। শুধু ফ্লোট মানির কারণে তারা লাভের মুখ দেখেছে।   


এমএফএসে নিরাপত্তা জোরদারের জন্য কোন দিকগুলোয় মনোযোগ দেয়া উচিত বলে মনে করেন?

যেহেতু আমরা এমএফএসের টাকা ব্যাংকেই জমা করি পরোক্ষভাবে, সেহেতু ব্যাংক ডিপোজিট যেভাবে  নিশ্চিত করা হয়, একইভাবে এটিও করা উচিত। এটা নিয়ে আমার মনে হয় একটা অস্বচ্ছতা আছে। যদিও আমাদের খুব একটা খারাপ অভিজ্ঞতা এখনো হয়নি।  কিন্তু এখন অনেক সাধারণ মানুষেরই এমএফএস হিসাব রয়েছে। কাজেই তাদের জন্য ২-৪ হাজার টাকা খোয়া যাওয়াও বড় ক্ষতি, তাই নিরাপত্তার বিষয়টি নিশ্চিত করা প্রয়োজন। 

এখন আমাদের ডিজিটাল বাংলাদেশের যে ডিজাইন, সেখানে সিকিউরিটির বিষয়টি যেন গুরুত্ব কম পাচ্ছে। মনে হচ্ছে যেন এদিকে পর্যাপ্তভাবে নজর দেয়া হচ্ছে না এবং এক্ষেত্রে মনোযোগ না দিলে এক দিন আসবে, যখন আমাদের চোখ থেকে অনেক অশ্রু ঝরবে। 


মানি লন্ডারিংয়ে এমএফএস ব্যবহূত হয় বলে অভিযোগ আছে। এটাকে কীভাবে দেখেন? আদৌ এর ভিত্তি আছে কি?

যখন হুন্ডি হয়, তখন কি ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে হয় না? তাহলে ব্যাংককে ধরা হয় না কেন? কথা হলো, আমার একটি মোবাইল ফোন থাকলে আমি একজন ভালো লোককেও ফোন করতে পারি, আবার খারাপ লোককেও ফোন করতে পারি। বিপরীতক্রমে ভালো লোকও আমাকে ফোন করবে, খারাপ লোকও আমাকে ফোন করতে পারে। এটি তো মোবাইলের দোষ নয়। দোষ তো আমার। এমএফএসকেও আসলে সেভাবেই দেখতে হবে। কারণ এটি একটি মাধ্যম। একটি প্রযুক্তি। যেকোনো প্রযুক্তির অপব্যবহার করা যায়। যেহেতু এটি যোগাযোগকে সহজ করে দিয়েছে, সেহেতু এটি ভালো কাজকে যেমন সহজ করেছে, খারাপ কাজকেও হয়তো উৎসাহিত করতে পারে। সেক্ষেত্রে আমাদের নিয়ন্ত্রণ কাঠামোয় (রেগুলেটরি ব্যবস্থা) এসব বিষয় সংযোজন করতে হবে। আমাদের গবেষণায় এমএফসের মাধ্যমে যে আর্থিক অপরাধের তথ্য পেয়েছি তা খুব সামান্য। এটি উদ্বেগজনক কোনো পরিস্থিতি নয়। 

এমএফএস-বিষয়ক গবেষণায় আপনারা মূলত কোন কোন বিষয়ে নজর দিয়েছেন?

আমাদের মূল ফোকাস ছিল গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর ওপর। খানা-পরিবার পর্যায়ে এমএফএসের কী প্রভাব পড়েছে আমরা  সেটা  দেখার  চেষ্টা করেছি। আরো বিস্তারিত বললে আয়, ভোগ, শিক্ষা-স্বাস্থ্যের ওপর এমএফএসের প্রভাব আমরা দেখার চেষ্টা করেছি। আমাদের ফলাফল  থেকে দেখা যায়, এমএফএস ভোগ-সহায়ক (কমজাম্পশন-স্মুদি)। যেমন কোনো বন্যা বা প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময় বা কেউ কোনো কারণে অসুস্থ হয়ে পড়লে এসব ক্ষেত্রে আমরা দেখি যে এমএফএসের মাধ্যমে একটি আয়প্রবাহ সৃষ্টি (ইনকাম ফ্লো) হয়। তখন বিপদের মুখেও সেটি ভোগ স্থিতিশীল রাখতে সাহায্য করে। এটি একটি সুস্পষ্ট ও গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব, যা আমরা দেখেছি। সেদিক থেকে আমরা এমএফএসকে ভোগ ও আয়সহায়ক মাধ্যম হিসেবে পেয়েছি। ফলে আমার মনে হয় গ্রামীণ এলাকায় আয় বেড়েছে। শিক্ষা-স্বাস্থ্যের ওপরও মানুষের ব্যয় বৃদ্ধিতে সহায়তা করেছে এমএফএস। তারপর নারীদের ওপর এমএফএসের বড় ধরনের প্রভাব পেয়েছি, যা খুব ইতিবাচক।

দারিদ্র্যের ওপর সরাসরি প্রভাব পড়েছে কিনা, সেটি দেখার চেষ্টা করেছি; কিন্তু কোনো সরাসরি প্রভাব পাইনি। এটা আমাদের পদ্ধতির (মেথডলজি) কারণেও হতে পারে। প্যানেল ডাটা থাকলে হয়তো বিষয়টি আরো পরিষ্কার হতো। তার মানে এক্ষেত্রে অধিকতর অনুসন্ধান দরকার।


আপনাদের গবেষণায় আর্থিক অন্তর্ভুক্তিতে কোনো প্রভাব দেখেছেন কি?

সামষ্টিক অর্থনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে এমএফএসের কারণে আর্থিক অন্তর্ভুক্তি বেড়েছে, কিন্তু সেটি বড় আকার ধারণ করেনি। কারণ আমাদের দেশে ফিন্যান্সিয়াল ইনক্লুশনের যে মূল প্রভাব, সেটি এসেছে মাইক্রোক্রেডিট বা মাইক্রোফিন্যান্স থেকে। অব্যাহতভাবে মাইক্রোফিন্যান্স একটি ভূমিকা পালন করে আসছে। এমএফএস একটা তাত্পর্যপূর্ণ পর্যায়ে এসেছে বটে, কিন্তু প্রভাবক প্রভাব (ডমিন্যান্ট ইনফ্লুয়েন্স) এখনো মাইক্রোক্রেডিটের। কাজেই এটি বলা যাবে না মোবাইলভিত্তিক আর্থিক সেবার কারণে আর্থিক অন্তর্ভুক্তি সাংঘাতিকভাবে বেড়েছে। বেড়েছে এটা ঠিক, এটা ইতিবাচক। 


এমএফএস হিসাব কি বাড়ছে?

হ্যাঁ, এমএফএস হিসাব বাড়ছে। একটা সময় ছিল মানুষ এজেন্টনির্ভর বেশি ছিল। এখন এটি কমে এসেছে, যা খুব ভালো সংকেত। নতুন টেকনোলজি চালু হতে একটু সময় লাগে। এখন এমএফএস টেকনোলজির সঙ্গে মানুষ পরিচিত হয়েছে এবং এমএফএস হিসাব অনেক বেড়েছে। অ্যাপসও এসেছে এবং অনেকেই অ্যাপস ব্যবহার করছে। কিন্তু মূলত তারা অধিকতর শিক্ষিত ও তরুণ জনগোষ্ঠী। এই ট্রানজিশনে আরেকটু সময় লাগবে। তবে এজেন্টের ভূমিকা অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ। যেমন আমরা দেখেছি যে বিকাশের এজেন্টের সংখ্যা বেশি। তাদের পারফরম্যান্স ভালো। তারা এজেন্টদের যাচাই-বাছাই করে এবং ভালো করে ট্রেনিং দেয়। এজেন্ট নেটওয়ার্ক হিসেবে অন্যদের নেটওয়ার্কও বেশ বড়। কিন্তু বিকাশের এজেন্টদের লেনদেন যত বেশি, অন্যদের ততটা নয়।


এমএফএসের ভবিষ্যৎ কেমন দেখছেন?  

এমএফএসের প্রধান বিষয়টি হলো মবিলিটি। ফোন তো আমি ব্যবহার করছি। এখন আমি ফোনের মাধ্যমে যদি ব্যাংকিংটাও করতে পারি তাহলে এটি এমএফএসের জন্য চ্যালেঞ্জের হবে। অনেক ব্যাংকিং সেবা মোবাইলের মাধ্যমে পাওয়া যাচ্ছে। কিন্তু দিনের শেষে কে এগিয়ে যাবে তা নির্ভর করবে কার টেকনোলজি কত ভালো এবং কতটা গ্রাহকবান্ধব (ইউজার ফ্রেন্ডলি)। এটি টোটালি টেকনোলজি ডিপেন্ডেন্ট। এক্ষেত্রে টেকনোলজিকে নিরাপদ, সহজলভ্য ও স্পিডি হতে হবে। দেখতে হবে আমি টাকা পাঠালাম তা গেল কিনা, নিরাপদ কিনা এবং সব জায়গায় ব্যবহার করা যায় কিনা। 


এমএফএসকে ভবিষ্যতে এগিয়ে নিতে আপনার কী পরামর্শ থাকবে? কোন দিকগুলোয় এখন নজর দেয়া দরকার?

রেগুলেশন সবার জন্য সমান করা এবং সার্বিকভাবে খাতটিকে উৎসাহিত করা উচিত। তবে এখানে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, প্রযুক্তি ও ইনোভেশন। এ দুটি বিষয়কে প্রমোট করার জন্য যদি কিছু ইনসেনটিভ প্রয়োজন হয়, সেটি দেয়া দরকার। কারণ এখনো এটি একটি বিকাশমান ক্ষেত্র। তাদের বিকাশের সুযোগ দেয়াই থাকবে আমার সার্বিক সুপারিশ। সুনির্দিষ্টভাবে এটি পর্যালোচনা করা দরকার যে রেগুলেটরি সিস্টেমে এমন কোনো বাধা আছে কিনা, যেগুলো এর সম্প্রসারণ ব্যাহত করছে। আমার মনে হয় কিছু সমস্যা আছে। এমএফএস ব্যবহারকারী বেশির ভাগ নিম্নমধ্যবিত্ত ও গরিব। উচ্চবিত্তদের ব্যাংকিং সেবা ও ক্রেডিট কার্ড আছে। সুতরাং এদের দিকে নজর দেয়া উচিত। ব্যাংকের প্রডাক্টগুলো তারা ব্যবহার করে না, অ্যাপসও তারা ব্যবহার করবে না। বেসিক ফোনে যা করা যায় তারা তা-ই ব্যবহার করবে। কাজেই এ পরিস্থিতি তো হুট করে পরিবর্তন হবে না। সাবসিডি দেয়ার দরকার নেই। এ খাতকে যেন কোনোভাবে প্রতিহত করা না হয়, সেদিকে নজর দেয়া উচিত। এজন্য আলাদা একটি কর্তৃপক্ষ (অথরিটি) তৈরি করার বিষয়টি খুব গভীরভাবে ভাবা উচিত। আরেকটি বিষয় আমাদের চিন্তিত করছে, সেটি হলো নিরাপত্তার বিষয়। যেহেতু এসব প্রযুক্তির ঝুঁকি কতটুকু সব সময় আমরা তা বুঝতে পারি না। এ বিষয়টির দিকে বিশেষ মনোযোগ দেয়া উচিত।

[পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট (পিআরআই) পরিচালিত  বাংলাদেশ পলিসি অ্যাডভোকেসি ইনিশিয়েটিভের (পিএআই)অধীন প্রকাশিত]


শ্রুতলিখন: হুমায়ুন কবির  

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন