সামাজিক সুরক্ষায় বিনিয়োগ

সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিতে ব্যয় আরো বাড়াতে হবে

দারিদ্র্য, নাজুক জনগোষ্ঠী অনানুষ্ঠানিক কর্মসংস্থানের আধিক্য থাকা যেকোনো অর্থনীতিতে অন্তর্ভুক্তিমূলক প্রবৃদ্ধি নিশ্চিতে উন্নয়ন পরিকল্পনায় সামাজিক সুরক্ষাকে বিশেষ প্রাধিকার দেয়া হয়। স্বাধীনতার অব্যবহিত পরে দেশ যখন গণদারিদ্র্য, বঞ্চনা দুর্ভিক্ষে পর্যুদস্ত; স্বভাবতই দারিদ্র্য বিমোচন, পুনর্বাসন এবং মানুষের আয় কর্মসংস্থান সৃজনে বহুমুখী ব্যবস্থা নেয়া হয়। সামাজিক নিরাপত্তাবেষ্টনী কর্মসূচির আদলে নেয়া উল্লিখিত প্রাথমিক ব্যবস্থাগুলো ছিল মূলত অস্থায়ী এবং সেগুলো বাস্তবায়ন হয় সরকারি বেসরকারি সংস্থার মাধ্যমে। তার পর থেকে বাংলাদেশ মাথাপিছু আয় বৃদ্ধি, খাদ্যে স্বয়ম্ভরতা অর্জন দারিদ্র্য হ্রাসের দিক থেকে দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়েছে। এছাড়া দুর্গত জনগোষ্ঠীর চরম নাজুকতা সৃষ্টিকারী প্রথম দিককার প্রাকৃতিক দুর্যোগগুলো মোকাবেলায়ও দেশ সমর্থ হয়েছে পরীক্ষিত কিছু প্রক্রিয়ার উন্নয়ন ঘটাতে। এসব উল্লেখযোগ্য অগ্রগতির সুবাদে আগের চেয়ে মানুষের গড় জীবনমানে উল্লম্ফন ঘটলেও দরিদ্র পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর অরক্ষণীয়তার পুরোপুরি অবসান হয়নি। এর মধ্যে করোনার অভিঘাতে বিপুলসংখ্যক মানুষের জীবন-জীবিকা অনিশ্চয়তায় পড়েছে। কর্ম আয়ের পথ বন্ধ হয়েছে অনেকেরই। এতে বিগত দশকগুলোয় দারিদ্র্য বিমোচনে অর্জিত সাফল্য ম্লান হয়ে আবারো দারিদ্র্য বাড়ার শঙ্কা দেখা দিয়েছে। ব্র্যাক সিপিডির এক গবেষণা মতে, করোনা দুর্যোগে দেশে নতুন করে আরো অন্তত ছয় কোটি মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে নেমে গেছে। অবস্থায় সামাজিক সুরক্ষার প্রয়োজনীয়তা নতুন করে সামনে এসেছে। কিন্তু বাস্তবতা হলো ইউএনএসকাপ আইএলওর হিসাবে জিডিপিতে স্বাস্থ্যবহির্ভূত সামাজিক সুরক্ষা খাতে ব্যয়ের হার বিবেচনায় দক্ষিণ দক্ষিণ-পশ্চিম এশিয়ার মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান বেশ দুর্বল। এমনকি এক্ষেত্রে নেপাল, ভুটান, মালদ্বীপ আফগানিস্তানেরও নিচে আমাদের অবস্থান। এটা হতাশাজনক।

বিপরীতক্রমে, বেড়ে চলা অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির সঙ্গে দেশে অসমতাও ঊর্ধ্বমুখী। মুষ্টিমেয়ের হাতে এখন সম্পদ কেন্দ্রীভূত। অবস্থায় সম্পদ-আয় বণ্টনের মাধ্যমে পিছিয়ে থাকা ধনবানদের মধ্যকার ব্যবধান কমিয়ে আনতে সামাজিক সুরক্ষা পদক্ষেপগুলো একটি প্রভাবক ভূমিকা রাখতে পারে বৈকি। কাজেই অসমতা দারিদ্র্য দূরীকরণ উভয় বিবেচনায়ই সামাজিক খাতের আওতা বরাদ্দ বৃদ্ধির বিকল্প নেই। সরকার সামাজিক খাতে মোট বরাদ্দের পরিমাণ আগের চেয়ে বাড়িয়েছে। করোনার বিরূপ প্রভাব বিবেচনায় প্রত্যাশিতভাবেই চলতি অর্থবছরের বাজেটেও বরাদ্দের পাশাপাশি সামাজিক সুরক্ষার আওতা বাড়ানো হয়েছে। কিন্তু এখনো তা জিডিপির শতাংশের সামান্য বেশি মাত্র। সবচেয়ে বিস্ময়ের হলো, হিসাবের মধ্যে সরকারি পেনশনভোগীদের জন্য বরাদ্দ অর্থও অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। যদিও সরকারি চাকরির পর অবসরভোগীদের প্রায় শতভাগই দারিদ্র্যসীমার ওপরে বাস করেন। সেটি বাদ দিলে প্রকৃত প্রস্তাবে আমাদের সামাজিক সুরক্ষা ব্যয় নিতান্তই অকিঞ্চিত্কর অপর্যাপ্ত বলা চলে। সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় সামাজিক খাতে বরাদ্দ - শতাংশ উন্নীত করার কথা বলা হয়েছে। অথচ বাস্তবে তার প্রতিফলন ঘটেনি। অবস্থা চলতে থাকলে দারিদ্র্য নির্মূলে এসডিজির লক্ষ্য অর্জনও কঠিন হবে বৈকি।

নিম্ন বরাদ্দের পাশাপাশি বিদ্যমান সামাজিক সুরক্ষা ব্যবস্থার কার্যকারিতাও খুব একটা দৃশ্যমান নয়। একে তো পুরো ব্যবস্থাটি খণ্ডিত, সমন্বয়হীন। বিরাজমান ১৪০টি কর্মসূচি প্রায় ক্ষেত্রেই পারস্পরিকভাবে বিচ্ছিন্ন এবং অনেক ক্ষেত্রে অধিক্রমণের সমস্যাও প্রবল। এসব কর্মসূচি বাস্তবায়নে ২২টি মন্ত্রণালয় তথা সরকারি সংস্থা যুক্ত। একটির সঙ্গে আরেকটির সমন্বয় নেই। ফলে এসব কর্মসূচি থেকে প্রত্যাশিত সুফল মিলছে না। তদুপরি রয়েছে অপ্রতুল বরাদ্দের বেহাত হওয়ার ঘটনাও। কয়েক বছর আগে করা বিবিএসের খানা আয়-ব্যয় জরিপের তথ্য অনুযায়ী সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতায় ৭৫ শতাংশ সচ্ছল মানুষ সুবিধা পেয়েছে। এসব ক্ষেত্রে রাজনৈতিক প্রভাবের অভিযোগও নতুন নয়। এতে একদিকে সরকারি অর্থের অপচয় হচ্ছে, অন্যদিকে প্রকৃতার্থে যাদের সুবিধা পাওয়ার কথা তারা বঞ্চিত হচ্ছে। নিয়ম অনুযায়ী হতদরিদ্র পিছিয়ে পড়ারাই সামাজিক সুরক্ষা বা সুবিধা পাওয়ার কথা। অথচ অনিয়ম-দুর্নীতির কারণে এক্ষেত্রে ব্যত্যয় ঘটছে। সেদিক থেকে সামাজিক সুরক্ষার নীতিগত দিকটিই প্রশ্নবিদ্ধ বলা যায়। কাজেই কার্যকারিতা অনিয়ম রুখতে পুরো ব্যবস্থাটির পুনর্বিন্যাস জরুরি।

কভিড-১৯ মহামারী বিশেষত অনানুষ্ঠানিক খাতে কর্মরতদের আশঙ্কাজনক অবস্থার দিকে ঠেলে দিয়েছে। শিল্প-কারখানা, বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানসহ নানা দিকে কর্মক্ষেত্র সংকুচিত হওয়ায় বেড়েছে কর্মহীন মানুষের সংখ্যা। ফলে স্থবিরতা সৃষ্টি হয়েছে আর্থসামাজিক অগ্রগতিতে। স্থবিরতা কাটাতে সামাজিক সুরক্ষা ব্যবস্থায় সরকারি ব্যয় বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। শুধু ব্যয় বাড়ালে হবে না, ঝুঁকিতে থাকা জনগোষ্ঠী সংশ্লিষ্ট নীতিমালা অনুযায়ী সহযোগিতা পাচ্ছে কিনা তাও নিশ্চিত করা জরুরি। নীতিনির্ধারকদের অগ্রাধিকার নির্ধারণ করে দরিদ্র আর্থিকভাবে দুর্বলদের অর্থনৈতিক প্রভাব স্বল্প দীর্ঘমেয়াদে স্বচ্ছতার সঙ্গে কীভাবে মোকাবেলা করা যায়, সে ব্যবস্থা করতে হবে। সরকারের সামনে চ্যালেঞ্জ ব্যাপক, তাই ভবিষ্যতে ঘুরে দাঁড়ানোর জন্য গতানুগতিকতার ধারা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে দ্রুত। সামাজিক সুরক্ষাকে ভাবতে হবে দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগ হিসেবে। এর মাধ্যমে আশু অর্থনৈতিক উত্তরণ যেমন ঘটবে, তেমনি দূরকল্পী উন্নয়ন লক্ষ্যও অর্জন হবে বৈকি।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন