প্রথমবারের মতো কোনো সাবমেরিনের মালিক হলো মিয়ানমার নৌবাহিনী। আইএনএস সিন্ধুবীর নামে তিন হাজার টন ওজনের কিলো ক্লাস সাবমেরিনটির মালিক আগে ছিল ভারতীয় নৌবাহিনী। বৃহস্পতিবারই এটি মিয়ানমারের কাছে হস্তান্তর করা হয়। নতুন মালিকানায় সাবমেরিনটির নামকরণ হয়েছে ইউএমএস মিন ইয়ে থেইন খা থু।
১৯৮৮ সালে ভারতীয় নৌবহরে যুক্ত হয়েছিল সাবমেরিনটি। সম্প্রতি হিন্দুস্তান শিপইয়ার্ড লিমিটেড বিশাখাপত্তনমের ইয়ার্ডে ডুবোজাহাজটির সংস্কার করা হয়। সাবমেরিনটির আয়ু বেড়েছে ১০-১৫ বছর। সে হিসাবে বলা চলে, বর্মী নৌবহরের মালিকানায় সাবমেরিনটি চালু থাকবে ২০৩০ পর্যন্ত।
ভারতের পররাষ্ট্র সচিব হর্ষ বর্ধন শ্রিংলার ভাষ্যমতে, সাগার (সিকিউরিটি অ্যান্ড গ্রোথ ফর অল ইন দ্য রিজিয়ন) ও প্রতিবেশী দেশগুলোকে স্বয়ম্ভর করে তোলার নীতির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখেই মিয়ানমারকে সাবমেরিনটি বিক্রি করেছে তার দেশ।
কিন্তু হর্ষ বর্ধন শ্রিংলা যা-ই বলে থাকুন, ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চলে চীনের ক্রমবর্ধমান প্রতিপত্তিকে ঠেকানোর উদ্দেশ্য থেকেই যে মিয়ানমারকে সাবমেরিনটি দিয়েছে ভারত, সে বিষয়ে নিঃসন্দেহ বিশ্লেষকদের সবাই।
তারা বলছেন, বছর তিনেক আগে চীনের কাছ থেকে বাংলাদেশের দুটি সাবমেরিন ক্রয়ের ঘটনায় বঙ্গোপসাগরে বেইজিংয়ের আরো প্রভাবশালী হয়ে ওঠার আশঙ্কায় পড়ে যায় ভারত। টর্পেডো ও মাইন দিয়ে সুসজ্জিত ‘নবযাত্রা’ ও ‘জয়যাত্রা’ নামের মিং ক্লাস সাবমেরিন দুটি বাংলাদেশী নৌবাহিনীর শক্তি বাড়ালেও ভারতের মূল চিন্তার উৎস অন্য জায়গায়।
সাবমেরিন দুটি শত্রুপক্ষের যুদ্ধজাহাজ ও সাবমেরিনকে আক্রমণ বা মোকাবেলা করতে সক্ষম। শুধু ক্রয় নয়, সম্প্রতি কুতুবদিয়ার পেকুয়ায় সাবমেরিন ঘাঁটি নির্মাণের কাজও পেয়েছে চীন।
এ বিষয়গুলোই উদ্বিগ্ন করে তুলেছে ভারতকে। দেশটির আশঙ্কা, এর মধ্য দিয়ে বঙ্গোপসাগরে চীনের সক্রিয় উপস্থিতি বাড়ছে। ফলে চীনের কাছ থেকে বাংলাদেশের সাবমেরিন ক্রয়ের বিষয়টি সামনে আসার পর থেকেই এ নিয়ে বেশ নাখোশ প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে ভারত। দেশটির গণমাধ্যমগুলোকেও এ নিয়ে আঁকড়ে ধরছে নিত্যনতুন জুজু। এখনো এ নিয়ে নানা ধরনের বিশ্লেষণ সামনে নিয়ে আসছে ভারতীয় গণমাধ্যম, যা থেকে বিষয়টি নিয়ে দেশটির দুশ্চিন্তার মাত্রা সম্পর্কে কিছুটা আঁচ পাওয়া যায়।
দেশটির বেঙ্গালুরুভিত্তিক ইংরেজি ম্যাগাজিন স্বরাজ্যে সম্প্রতি এ নিয়ে বলা হয়, ‘যন্ত্রাংশ ও অস্ত্রের জন্য চীনের ওপর বাংলাদেশ নৌবাহিনীর এ নির্ভরশীলতা ভারতের পূর্ব উপকূলের গুরুত্বপূর্ণ নৌ স্থাপনা ও বিশাখাপত্তনমে উন্নয়নাধীন ভারতীয় নিউক্লিয়ার সাবমেরিন ঘাঁটির কাছাকাছি বেইজিংয়ের উপস্থিতি বাড়ানোর সুযোগ করে দেবে। অন্যদিকে ভবিষ্যতে বাংলাদেশ নৌবাহিনীর সাবমেরিন ঘাঁটি থেকে চীনা জাহাজ ও সাবমেরিনের রসদ ও জ্বালানি সংগ্রহের আশঙ্কাটিকেও উড়িয়ে দেয়া যাচ্ছে না।’
বাংলাদেশের সাবমেরিন ক্রয়ের পর মিয়ানমারও এ নিয়ে আগ্রহ দেখাতে থাকে। বিষয়টি আবারো ভাবতে বাধ্য করে ভারতকে। দেশটির আশঙ্কা ছিল, বাংলাদেশের দেখাদেখি মিয়ানমারও যদি চীন থেকে সাবমেরিন কেনার উদ্যোগ নেয়, তাহলে তা বঙ্গোপসাগরে চীনের উপস্থিতি আরো বিপজ্জনক মাত্রায় বাড়িয়ে তুলবে।
দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার ভূরাজনৈতিক প্রতিপত্তি বাড়ানোর তাগিদ থেকে মিয়ানমারের ওপর প্রভাব বৃদ্ধি নিয়ে আগে থেকেই একধরনের প্রতিযোগিতায় লিপ্ত ছিল ভারত ও চীন। দুই দেশই মিয়ানমারে বড় বড় কয়েকটি বন্দর উন্নয়নের কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। অন্যদিকে বাংলাদেশের সাবমেরিন ক্রয়ের পর ভারতও মিয়ানমারে সামরিক সরঞ্জামের সরবরাহ বাড়াতে থাকে। ২০১৭ সালেই মিয়ানমারকে লাইন অব ক্রেডিটের আওতায় টর্পেডো সরবরাহ করে ভারত।
চলতি মাসের শুরুতে হর্ষ বর্ধন শ্রিংলা ও ভারতীয় সেনাপ্রধান এমএম নারাভানে মিয়ানমার সফরে যান। ওই সময়ে তারা মিয়ানমারের স্টেট কাউন্সেলর অং সান সু চি ও সেনাপ্রধান জেনারেল মিন অং হ্লাইংয়ের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। এ সফর চলাকালে ভারতের পক্ষ থেকে ইয়াঙ্গুনে ৬০০ কোটি ডলারের একটি জ্বালানি তেল পরিশোধনাগার নির্মাণেরও প্রস্তাব দেয়া হয়।
চীন বর্তমানে ভারত মহাসাগর ও দক্ষিণ চীন সাগরের সংযোগস্থল মালাক্কা প্রণালিতে নিজের নৌশক্তি বাড়িয়ে চলেছে। দক্ষিণ আন্দামান দ্বীপপুঞ্জ থেকে এ প্রণালির দূরত্ব মাত্র ২০০ কিলোমিটার। এ হুমকি মোকাবেলার জন্য এরই মধ্যে সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন স্থানে যুদ্ধজাহাজ, যুদ্ধবিমান ও গোয়েন্দা উড়োজাহাজ মোতায়েন করে রেখেছে ভারত। এ অঞ্চলের ওপর নজরদারি বাড়াতে এরই মধ্যে সাবমেরিন অপটিক্যাল ফাইবার কেবল সংযোগও নির্মাণ করেছে ভারত।
এছাড়া পাকিস্তানের সঙ্গে অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে গাদার বন্দর উন্নয়নের মাধ্যমে ভারত মহাসাগরে নিজের উপস্থিতি আরো দৃশ্যমান করে তুলেছে চীন। জিবুতিতে এরই মধ্যে একটি সামরিক ঘাঁটিও স্থাপন করেছে দেশটি। পাশাপাশি শ্রীলংকার হাম্বানটোটা বন্দর ৯৯ বছরের জন্য ইজারা নেয়ার পাশাপাশি তাঞ্জানিয়া ও মিয়ানমারেও গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ করছে দেশটি। এর বাইরে মালদ্বীপেও ৫০ বছরের জন্য একটি দ্বীপ ইজারা নিয়েছে চীনা একটি বেসরকারি কোম্পানি। আশঙ্কা রয়েছে, এটিকেও সামরিক ক্রিয়াকলাপে ব্যবহার করা হতে পারে।
ভারত মহাসাগরে চীনের এ আগ্রাসী নীতির প্রয়োগ নয়াদিল্লিকে কূটনৈতিক মেরুকরণের দিক থেকে নতুন করে ভাবাতে বাধ্য করছে। অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্রও ভারতের সঙ্গে আনুষ্ঠানিক জোট গড়ে তুলতে আগ্রহী হয়ে উঠেছে। এরই পরিপ্রেক্ষিতে যুক্তরাষ্ট্র, ভারত, জাপান ও অস্ট্রেলিয়ার প্রায়মৃত চতুর্পক্ষীয় নিরাপত্তা ফোরাম কোয়াডকে পুনরুজ্জীবিত করে তুলেছে ওয়াশিংটন। নতুন এ মেরুকরণ সত্ত্বেও চীনের রক্ষণাত্মক অবস্থানে যাওয়ার কোনো লক্ষণই দেখা যাচ্ছে না। অন্যদিকে বাণিজ্য ও অর্থনৈতিক বাস্তবতা বিবেচনায় বলা যায়, বিশ্বের বৃহত্তম দুই ভোক্তাদেশের মধ্যেকার সরাসরি সংঘাত উভয়পক্ষের জন্যই মারাত্মক ক্ষতির কারণ হয়ে উঠতে পারে। সেক্ষেত্রে বঙ্গোপসাগর তথা গোটা ভারত মহাসাগরেই সামনের দিনগুলোয় সাবমেরিন কূটনীতি আরো জোরালো হয়ে উঠতে পারে।