জিডিপিতে স্বাস্থ্যবহির্ভূত সামাজিক সুরক্ষা খাতে ব্যয়ের হার বিবেচনায় দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিম এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে তলানিতে অবস্থান করছে বাংলাদেশ। এক্ষেত্রে বাংলাদেশের ওপরে অবস্থান করছে ইরান, তুরস্ক, শ্রীলংকা, ভারত, মালদ্বীপ, নেপাল, পাকিস্তান, আফগানিস্তান ও ভুটান। জাতিসংঘের এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের অর্থনৈতিক ও সামাজিক কমিশন (ইউএনএসক্যাপ) ও আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) এক সাম্প্রতিক প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে।
‘দ্য প্রোটেকশন উই ওয়ান্ট: সোস্যাল আউটলুক ফর এশিয়া অ্যান্ড দ্য প্যাসিফিক’ শীর্ষক প্রতিবেদনে চলমান কভিড-১৯ মহামারীর প্রেক্ষাপটে বিভিন্ন দেশে গৃহীত সামাজিক সুরক্ষা কার্যক্রমের কার্যকারিতা নিয়ে আলোচনা করা হয়। প্রতিবেদনে এশিয়ার দেশগুলোর জিডিপিতে স্বাস্থ্যবহির্ভূত সামাজিক সুরক্ষা ব্যয়ের হার নিয়ে একটি তুলনামূলক চিত্র তুলে ধরা হয়। এজন্য এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় দেশগুলোকে পূর্ব ও উত্তর-পূর্ব এশিয়া, উত্তর ও মধ্য এশিয়া, প্রশান্ত মহাসাগরীয়, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া এবং দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিম এশিয়া—এ পাঁচ অঞ্চলে ভাগ করা হয়।
প্রতিবেদনে তুরস্ককেও দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিম এশিয়া অঞ্চলের অন্তর্ভুক্ত হিসেবে দেখানো হয়েছে। এ অঞ্চলে জিডিপিতে স্বাস্থ্যবহির্ভূত সামাজিক সুরক্ষা ব্যয়ের হারের দিক থেকে শীর্ষে রয়েছে ইরান। দেশটিতে এ হার ১০ দশমিক ১ শতাংশ। দ্বিতীয় অবস্থানে থাকা তুরস্ক স্বাস্থ্যবহির্ভূত সামাজিক সুরক্ষা খাতে ব্যয় করে মোট জিডিপির ৯ দশমিক ৯ শতাংশ। শ্রীলংকায় এ হার ৫ দশমিক ২ শতাংশ। এছাড়া ভারতের জিডিপির ৩ দশমিক ২ শতাংশ, মালদ্বীপের ২ দশমিক ৯, নেপালের ২ দশমিক ১, পাকিস্তানের ১ দশমিক ৮, আফগানিস্তানের ১ দশমিক ৮ ও ভুটানের জিডিপির ১ শতাংশ স্বাস্থ্যবহির্ভূত সামাজিক সুরক্ষা খাতে ব্যয় করা হয়। এদিক থেকে সবচেয়ে পিছিয়ে থাকা বাংলাদেশে এ হার দশমিক ৭ শতাংশ।
নভেল করোনাভাইরাসের সংক্রমণজনিত মহামারী বৈশ্বিক দারিদ্র্য দূরীকরণ কার্যক্রমের অগ্রগতিকে অন্তত এক দশক পিছিয়ে দেয়ার পাশাপাশি বৈষম্যকেও বাড়িয়ে তুলেছে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়। এতে বলা হয়, কভিড-১৯ মহামারীতে এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের দেশগুলোয় দারিদ্র্যের প্রকোপ বাড়ছে। বাংলাদেশ ও শ্রীলংকায় পরিচালিত এক প্রাথমিক পর্যবেক্ষণে উঠে এসেছে, মহামারীতে আয়ভিত্তিক বণ্টনের প্রতিটি অংশেই জনগণের গড় আয় কমেছে। বিশেষ করে নারীরা আয়ের দিক থেকে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে মারাত্মক আকারে।
ইউএনএসক্যাপ ও আইএলও বলছে, দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিম এশিয়ার দেশগুলোয় সামাজিক সুরক্ষা বলয় থাকলেও দেশভেদে এর মাত্রায় ভিন্নতা রয়েছে। এ অঞ্চলের অনেক দেশেই সামাজিক সুরক্ষা খাতে ব্যয়ের হার মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) ২ শতাংশেরও নিচে।
এতে দেখা যায়, পূর্ব ও উত্তর-পূর্ব এশিয়ার জাপানের জিডিপিতে সামাজিক সুরক্ষায় সরকারি ব্যয়ের অংশ সবচেয়ে বেশি। দেশটির মোট জিডিপির ১৬ দশমিক ১ শতাংশ স্বাস্থ্যবহির্ভূত সামাজিক সুরক্ষা খাতে ব্যয় করা হয়। এর পরই রয়েছে উত্তর ও মধ্য এশিয়া অঞ্চলভুক্ত রাশিয়া। দেশটিতে এ হার ১৩ দশমিক ৪ শতাংশ। প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের নিউজিল্যান্ডে এ হার ১১ দশমিক ৫ শতাংশ।
প্রতিবেদনে ফলপ্রসূ সামাজিক সুরক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তোলার ওপর গুরুত্ব দিয়ে বলা হয়, অর্থনৈতিক আঘাত মোকাবেলার জন্য সামাজিক সুরক্ষায় ব্যয় বাড়ানো প্রয়োজন। আর্থসামাজিক উন্নয়ন সত্ত্বেও এশিয়া-প্যাসিফিক অঞ্চলের সামাজিক সুরক্ষা ব্যবস্থা দুর্বল। গুটিকয়েক দেশ ছাড়া এশিয়া-প্যাসিফিক অঞ্চলের অর্ধেক জনগোষ্ঠী কোনো সামাজিক সুরক্ষা বলয়ের আওতায় নেই। চলমান কভিড-১৯ মহামারী যথাযথ ও সমন্বিত সামাজিক সুরক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তোলার প্রয়োজনীয়তাকে আরো প্রকট করে তুলেছে।
আইএলওর রিজিওনাল ডিরেক্টর (এশিয়া ও এশিয়া প্যাসিফিক) শিহোকো আসাদা-মিয়াকাওয়ার বরাতে প্রতিবেদনে বলা হয়, কভিড-১৯ কর্মক্ষম নারী ও পুরুষ; বিশেষ করে যারা অনানুষ্ঠানিক খাতে কর্মরত, তাদের আশঙ্কাজনক অবস্থার দিকে ঠেলে দিয়েছে। আর্থসামাজিক অগ্রগতির স্থবিরতা কাটাতে সামাজিক সুরক্ষা ব্যবস্থায় সরকারি ব্যয় ও বিনিয়োগ বাড়ানোর গুরুত্বও মহামারীতে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বৈষম্য হ্রাস ও দারিদ্র্য নিরসনে সামাজিক নিরাপত্তার আওতা বাড়াতেই হবে। এ খাতে পর্যাপ্ত পরিমাণে বরাদ্দ দেয়াটা অত্যন্ত জরুরি। এ বাবদ বরাদ্দের হার এখনো মোট জিডিপির ২ শতাংশেরও নিচে। এটিকে অন্তত ৩-৪ শতাংশে উন্নীত করা প্রয়োজন। এছাড়া টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্য (এসডিজি) অনুযায়ী দারিদ্র্য নির্মূল করতে হলেও দরিদ্রদের সামাজিক সুরক্ষা নিশ্চিতকরণে মনোযোগ দেয়া জরুরি।