বিজ্ঞান
কমিউনিটির জন্য সময়টি সফলতার, উত্তেজনার ও নব উদ্যমের। কক্ষ তাপমাত্রায় (১৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস) সুপারকন্ডাক্টর
পাওয়া
গেছে। কক্ষ তাপমাত্রায় অতিপরিবাহী আবিষ্কার বিজ্ঞানীদের একটি স্বপ্ন বরাবরই। বলা যায়, সেই স্বপ্নের অনেকটা কাছে চলে এসেছেন তারা।
সুপারকন্ডাক্টর
বা অতিপরিবাহী কী? যেকোনো পরিবাহীর মধ্য দিয়ে যখন বিদ্যুৎ প্রবাহিত হয়, তখন পরিবহনের পথে ইলেকট্রন প্রবাহ বাধাগ্রস্ত হয়। এই বাধাকে রোধ বলে। কিন্তু অতিপরিবাহীতে এই রোধ শূন্য। একটি অতিপরিবাহী বলয়ে বিদ্যুত্প্রবাহ আবিষ্ট করে বছরের পর বছর সেই প্রবাহ ধরে রাখা সম্ভব! রোধশূন্যতার বৈশিষ্ট্যের কারণে সুপারকন্ডাক্টরের মধ্য দিয়ে একটা নির্দিষ্ট সীমা পর্যন্ত অতি উচ্চমাত্রার বিদ্যুত্প্রবাহ সম্ভব হয়। অতিপরিবাহীর বহুল ব্যবহারিক চাহিদা আছে। চীন বা জাপানে যে Maglev ট্রেনের নাম আমরা শুনি, অতিপরিবাহিতার বাস্তব প্রয়োগ সেখানে। আমাদের পরিচিত ব্যবহারের মধ্যে আরো আছে চিকিৎসা ও গবেষণায় ব্যবহৃত MRI ইমেজিং,
মোবাইল
ফোনের বেইস স্টেশনে ব্যবহৃত ফিল্টার, low-loss পাওয়ার কেবল ইত্যাদি। কিন্তু সমস্যা হলো, যত অতিপরিবাহী আবিষ্কৃত হয়েছে, তার প্রতিটিই কক্ষ তাপমাত্রা থেকে অনেক অনেক নিম্ন তাপমাত্রায় তার এই বৈশিষ্ট্য ধারণ করে। সেই তাপমাত্রাকে বলা হয় ক্রান্তি তাপমাত্রা (critical
temperature)। তাপমাত্রার বৃদ্ধি ঘটালে এই গুণ সে হারিয়ে ফেলে। ব্যবহারিক প্রয়োগকে বেশি বাস্তবসম্মত করতে হলে তাই কক্ষ তাপমাত্রা বা তার কাছাকাছিতে অতিপরিবাহিতায় সক্ষম সিস্টেম দরকার। সেই লক্ষ্যে পৌঁছানোর একটি ধাপ সম্পন্ন হয়েছে ১৪ অক্টোবর, নিউইয়র্কের Rochester
বিশ্ববিদ্যালয়ে। তবে সেখানে যাওয়ার আগে অতিপরিবাহিতার ইতিহাসটা আমরা একটু দেখে নিতে পারি।
১৯১১
সালে নেদারল্যান্ডসের বিজ্ঞানী H.K.
Onnes অতিপরিবাহিতা আবিষ্কার করেন। এর তিন বছর আগে তিনি হিলিয়াম গ্যাসকে তরলে পরিণত করার পদ্ধতি আয়ত্ত করে ফেলেছিলেন। হিলিয়াম গ্যাস তরলে পরিণত হয় শূন্য সেলসিয়াসের চেয়ে ২৬৯ ডিগ্রি নিম্ন তাপমাত্রায় (-২৬৯
সেলসিয়াস)। তার এই উদ্ভাবনের ফলে এত অত্যধিক নিম্ন তাপমাত্রায় গবেষণার সুযোগ সৃষ্টি হয়। ১৯১১-এর এপ্রিলে তিনি দেখতে পেলেন যে পারদের তারকে তরল হিলিয়াম তাপমাত্রায় নিয়ে গেলে তার মধ্যে আর কোনো রোধ অবশিষ্ট থাকে না। এই আবিষ্কারের মধ্য দিয়ে শুরু হলো পদার্থবিজ্ঞানের এক বিশেষ অধ্যায়। দুই বছরের মাথায় নোবেল পেলেন তিনি। এখন পর্যন্ত এই ফিল্ড ও সম্পৃক্ত গবেষণায় নোবেল পেয়েছেন মোট ১৭ জন বিজ্ঞানী।
অতিপরিবাহিতা
আবিষ্কারের ৭৫ বছর পরে আরেকটি বড় সাফল্য আসে ১৯৮৬ সালে। G.
Bednorz and K. Müller কপার-অক্সাইড সুপারকন্ডাক্টর
আবিষ্কার
করেন, যা কয়েকটি মৌলের সমন্বয়ে তৈরি। এর ধারাবাহিকতায় অল্প কয়েক বছরের মধ্যেই কপার-অক্সাইড পরিবারের অনেক অতিপরিবাহী পাওয়া যায়। এদের ক্রান্তি তাপমাত্রা তুলনামূলকভাবে অনেক বেশি (-১৪০
সেলসিয়াস)। চাপ প্রয়োগ করলে এই ক্রান্তি তাপমাত্রা আরো ৩০ ডিগ্রির মতো বৃদ্ধি পেতে পারে। এক বছর পরেই বিজ্ঞানীদ্বয় তাঁদের কাজের জন্য নোবেল জিতে নেন।
হরেক
রকম বৈশিষ্ট্যের অতিপরিবাহী তৈরি হয়েছে। জ্ঞান আহরণের উদ্দেশ্য তো আছেই, তার পাশাপাশি সবসময়ই বিজ্ঞানীদের একটা লক্ষ্য ছিল ক্রান্তি তাপমাত্রা কীভাবে কক্ষ তাপমাত্রার কাছাকাছি নিয়ে আসা যায়। কিন্তু প্রায় দেড় দশক ধরে এক্ষেত্রে কোনো ধরনের অগ্রগতি সম্ভব হচ্ছিল না।
অতঃপর
২০১৫ সালে Max
Planck Institute for Chemistry-তে কর্মরত A.P.
Drozdov, M.I. Eremets ও তাঁদের দল অতি উচ্চ চাপে তুলনামূলক উচ্চ তাপমাত্রায় (-৭০
সেলসিয়াস) সালফার ও হাইড্রোজেনবিশিষ্ট একটি সিস্টেমে অতিপরিবাহিতা প্রদর্শন করে হইচই ফেলে দেন। তার তিন বছর পর আমেরিকান গবেষকদের গবেষণায় হাইড্রোজেন ও ল্যান্থানাম-সংবলিত একটি সুপারকন্ডাক্টর পাওয়া যায় শূন্যের মাত্র ১৩ ডিগ্রি নিচে। এভাবেই বিজ্ঞানীদের নিরলস সাধনায় আমরা ধীরে ধীরে নিশ্চিতভাবেই কক্ষ তাপমাত্রার সুপারকন্ডাক্টরের দিকে এগিয়ে আসছিলাম।
গত
১৪ তারিখ নেচার জার্নালে প্রকাশিত হলো অতিপরিবাহী গবেষকদের সাম্প্রতিকতম কাজটি। রচেস্টার বিশ্ববিদ্যালয়ের R.
Dias ও গবেষক দল কক্ষ তাপমাত্রায় (১৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস) হাইড্রোজেন, সালফার আর কার্বন দিয়ে তৈরি অতিপরিবাহী আবিষ্কার করেছেন। বিজ্ঞানীদের শত বছরের প্রচেষ্টা প্রাথমিকভাবে সফলতার মুখ দেখছে। নিঃসন্দেহে খুব আনন্দের সময়। কিন্তু কক্ষ তাপমাত্রা পর্যন্ত পৌঁছতে পারলেও এ ধরনের অতিপরিবাহীর ব্যবহারিক প্রয়োগ অনিশ্চিত। কারণ এই তাপমাত্রায় অতিপরিবাহিতার জন্য এই সুপারকন্ডাক্টরকে অতি উচ্চ চাপে রাখতে হয়। দুটি হীরক খণ্ডের মধ্যে রেখে ২৬৭ গিগা প্যাসকেল চাপ প্রয়োগ করা হয়, যা সমুদ্রপৃষ্ঠের স্বাভাবিক বায়ুমণ্ডলীয় চাপের তুলনায় ২৬ লাখ গুণ বেশি! খুব অল্পসংখ্যক গবেষণাগারই এত উচ্চ চাপ তৈরিতে সক্ষম। আর দৈনন্দিন ব্যবহারের ক্ষেত্রে এই বিপুল চাপ কখনই বাস্তবসম্মত নয়। বিজ্ঞানীরা তা সত্ত্বেও আশাবাদী। তাপমাত্রার প্রতিবন্ধকতা তারা অতিক্রম করতে পেরেছেন। উচ্চ চাপের সমস্যাও তারা সমাধান করবেন হয়তো। সামনে অত্যন্ত উত্তেজনাকর সময় অপেক্ষা করছে, এতে অন্তত কোনো সন্দেহ নেই!
লেখক: অধ্যাপক, পদার্থবিজ্ঞান বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়