দ্রুতগতিতে কমছে খাদ্যশস্যের মজুদ

খাদ্যপণ্যের সন্তোষজনক মজুদ গড়ে তুলতে দ্রুত পদক্ষেপ নেয়া হোক

কভিড-১৯ মহামারীসৃষ্ট অনিশ্চয়তা মোকাবেলায় বিশ্বের অনেক দেশেই এখন খাদ্যের উৎপাদন মজুদ বাড়ানোর প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। বিশ্ববাজারে গমের শীর্ষ আমদানিকারক মিসর এপ্রিলের পর থেকে পণ্যটির আমদানি বাড়িয়েছে ৫০ শতাংশেরও বেশি হারে। খাদ্যশস্যের মজুদ রেকর্ড সর্বোচ্চ পরিমাণে নিয়ে এসেছে জর্ডান। এছাড়া খাদ্যশস্যের অন্যতম শীর্ষ ভোক্তা দেশ চীনও এখন আমদানি বাড়িয়ে চলেছে। আমদানি বাড়াচ্ছে পাকিস্তান, মরক্কোসহ আরো বেশ কয়েকটি দেশ। এর মধ্যে কোনো কোনো দেশ খাদ্যশস্যের মজুদ বাড়াতে এরই মধ্যে আগামী কয়েক মাসের জন্য আমদানি শুল্ক শূন্যে নামিয়ে আনার ঘোষণা দিয়েছে। বাংলাদেশের খাদ্য পরিস্থিতি এখনো দুশ্চিন্তার কারণ না হলেও মজুদ দ্রুতই কমছে। ১৪ সেপ্টেম্বরে এসে খাদ্যশস্যের মজুদ ১১ লাখ ৯৬ হাজার টনে নেমে এসেছে। চালের দাম ঊর্ধ্বমুখী। খাদ্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে এরই মধ্যে আমদানি শুল্ক হ্রাস করা হলেও তা কমেছে এমন কোনো তথ্য নেই। একদিকে মৌসুমে কৃষকদের কাছ থেকে সরাসরি ধান-চাল কেনার সরকারি উদ্যোগে নানা ধরনের অনিয়ম-অস্ব্বচ্ছতা, অন্যদিকে খাদ্য ঘাটতি পূরণে যথাসময়ে আন্তর্জাতিক বাজার থেকে চাল সংগ্রহের উদ্যোগ নেয়া হয়নি বলেই এখন সরকারি গুদামে খাদ্য মজুদ কমে এসেছে। বেসরকারি খাতে মজুদের পরিমাণ কত, তার পরিসংখ্যানও জানা যায় না। তাছাড়া খাদ্যশস্যের বাজার নিয়ন্ত্রণে রাখতেও সরকারের মজুদ শক্তিশালী রাখা প্রয়োজন।

করোনায় বৈশ্বিক খাদ্য বাজারে অস্থিরতা দেখা দেয়ার আভাস আগেই দিয়েছিল এফএও। সেটি এখন বাস্তব রূপ লাভ করতে যাচ্ছে। উদাহরণস্বরূপ, কাজাখস্তান এরই মধ্যে গমের আটা রফতানি বন্ধ করে দিয়েছে এবং শাকসবজি রফতানির ওপর সীমা আরোপ করেছে। বিশ্বের সবচেয়ে বড় গম রফতানিকারক রাশিয়া পণ্যটির রফতানিতে সীমা আরোপ করতে পারে। বৈশ্বিক চাল রফতানিতে শীর্ষ দেশ ভারত লকডাউনে চলে গেছে। ফলে ভারত থেকে পণ্যটির সরবরাহ চ্যানেল এখন থমকে দাঁড়িয়েছে। ভিয়েতনাম চাল রফতানি বন্ধ করে দিয়েছে। একই পথে হাঁটতে পারে থাইল্যান্ডও। রফতানি সীমাবদ্ধতার কারণে বাড়ছে চালের দাম। উল্লেখ্য, এর আগে ২০০৮ সালের খাদ্য সংকটকালে চালের মূল্য বেড়ে দাঁড়িয়েছিল টনপ্রতি হাজার ডলারের কাছাকাছি। সে সময় রফতানিতে সীমা আরোপ এবং আতঙ্কে ক্রয় প্রবণতা বৃদ্ধির কারণে আকাশচুম্বী হয়ে উঠেছিল পণ্যটির মূল্য। রাশিয়ার ভেজিটেবল অয়েল ইউনিয়নের পক্ষ থেকে এরই মধ্যে সূর্যমুখীর বীজ রফতানিতে সীমা আরোপের আহ্বান জানানো হয়েছে। পাম অয়েলের দ্বিতীয় শীর্ষ উৎপাদনকারী দেশ মালয়েশিয়ায় পণ্যটি উৎপাদনের গতিও এখন বেশ শ্লথ হয়ে এসেছে। বিপরীতে আমদানিকারক দেশগুলোয় খাদ্যপণ্যের চাহিদাও এখন বাড়তির দিকে। ইরাকে গঠিত এক ক্রাইসিস কমিটি দেশটিতে কৌশলগত খাদ্য মজুদ গড়ে তোলার সুপারিশ জানিয়েছে। এর ভিত্তিতে দেশটি এরই মধ্যে ১০ লাখ টন গম আড়াই লাখ টন চাল আমদানির প্রয়োজনীয়তার কথা ঘোষণা দিয়েছে। চাল আমদানিকারক দেশ ফিলিপাইনে মাত্র দুই মাসের চাল মজুদ আছে। চালের বাণিজ্য দীর্ঘ সময় ধরে স্থবির হয়ে থাকলে ফিলিপাইনসহ এশিয়া আফ্রিকার বেশ কয়েকটি দেশ নাজুক অবস্থায় পড়ার শঙ্কা রয়েছে। শীর্ষ আমদানিকারক ইন্দোনেশিয়াসহ এশিয়ার বড় আমদানিকারক দেশগুলোর হাতে জুন পর্যন্ত গমের মজুদ আছে। এখন প্রশ্ন হলো, পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের কী করণীয়?

অনেক সময় সঠিক সিদ্ধান্তের অভাবে জনস্বার্থ রক্ষা করা কঠিন হয়ে পড়ে। যেহেতু বছর বাংলাদেশসহ গোটা বিশ্বেই কম-বেশি প্রাকৃতিক দুর্যোগের আগ্রাসন বেশি, সেহেতু খাদ্যনিরাপত্তার বৃহত্তর স্বার্থে সরকারিভাবে আপত্কালীন খাদ্য মজুদ বাড়ানো উচিত। নইলে খাদ্যশস্যের বাজার সরকারের পক্ষে নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন হয়ে পড়তে পারে। পরিণামে সাধারণ ভোক্তাকে বেশি দামে চাল কিনে খেতে হবে। খাদ্য মজুদ যথেষ্ট থাকার পরও যদি সাধারণের তাতে প্রয়োজন অনুযায়ী গ্রহণ করার সুযোগ বা অধিকার না থাকে কিংবা সামর্থ্য না থাকে, তবে তাতে লাভ নেই। অর্থনীতির অন্যান্য সেক্টর বিপর্যস্ত হলে, কর্মসংস্থান কমে গেলে, মানুষের আয়-রোজগার বা ক্রয়ক্ষমতা কমে গেলে সাময়িকভাবে খাদ্য গ্রহণের সক্ষমতা কমে যাবে। তাই জনগণের সক্ষমতা বজায় রাখার নিশ্চয়তা বিধানের জন্য আনুষঙ্গিক বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করা অপরিহার্য। সক্ষমতা বজায় না থাকলে সরকারি সামাজিক সুরক্ষাবেষ্টনী জোরদারের পাশাপাশি ভর্তুকি, কাজের বিনিময়ে খাদ্য, ত্রাণ, সাহায্য ইত্যাদি কর্মসূচি সম্প্রসারণ করতে হবে। শিল্পায়ন, নগরায়ণ বা যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নের ফলে দেশে আবাদি জমির পরিমাণ কমছে। কৃষিতে শস্য নিবিড়তা তেমন একটা বাড়েনি, এখনো ২০০-এর কাছাকাছি। সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রীও আহ্বান জানিয়েছেন করোনা পরিস্থিতি বিবেচনায় দেশের সব জমি চাষাবাদের আওতায় আনার জন্য, যাতে খাদ্য উৎপাদন বাড়ানো যায়। করোনা প্রেক্ষাপটে এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ সুচিন্তিত দিকনির্দেশনা। কিন্তু এটি বাস্তবায়নে মাঠ পর্যায়ে তেমন উদ্যোগ লক্ষ করা যাচ্ছে না। শুধু তাই নয়, প্রধানমন্ত্রী খাদ্য মজুদ গড়ে তোলার নির্দেশনাও দিয়েছেন। কিন্তু সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের মধ্যে তেমন তোড়জোড় লক্ষ করা যাচ্ছে না। এটি আশঙ্কাজনক।

বড় বড় আমদানিকারকরকে দেশের বাড়তি চাহিদা বিবেচনায় নিয়ে প্রয়োজনীয় অবশিষ্ট গম আমদানি ত্বরান্বিত করা প্রয়োজন। মাংস, ভোজ্যতেল, ডাল, চিনি, গুঁড়ো দুধ, ফলমূল, পেঁয়াজ, রসুন, আদাসহ বিভিন্ন মসলায় বাংলাদেশ বহুলাংশে আমদানিনির্ভর। এসব খাদ্যপণ্যের নিরাপত্তা মজুদ গড়ে তুলতে এখনই পদক্ষেপ নেয়া প্রয়োজন। খাদ্যনিরাপত্তার সংজ্ঞানুযায়ী তখনই খাদ্যনিরাপত্তা বিরাজমান, যখন সবার কর্মক্ষম, স্বাস্থ্যকর উৎপাদনমুখী জীবনযাপনের জন্য সবসময় পর্যাপ্ত পরিমাণে নিরাপদ পুষ্টি মানসম্পন্ন খাদ্যের লভ্যতা প্রাপ্তির ক্ষমতা বিদ্যমান থাকে। সংজ্ঞানুযায়ী বৈশ্বিক খাদ্যনিরাপত্তা সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান সন্তোষজনক নয়। নভেল করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবে খাদ্য রফতানিকারক দেশগুলোর খাদ্যপণ্য রফতানিতে রক্ষণাত্মক মনোভাবের কারণে কমপক্ষে আগামী ছয় থেকে নয় মাসের জন্য খাদ্যপণ্যের সন্তোষজনক মজুদ গড়ে তুলতে দ্রুত পদক্ষেপ নিতে হবে।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন