স্পর্শের সংকটে ভুগছে মানুষ!

বণিক বার্তা অনলাইন

স্পর্শের শক্তিকে খাটো করে দেখার সুযোগ নেই। মুখে বলার চেয়ে স্পর্শে অনেক বেশি ত্বরিৎ ও কার্যকরভাবে অপরজনকে আবেগ জানানো যায়। আমরা কীভাবে অনুভব করি, কাকে পছন্দ বা অপছন্দ করি এবং আমরা কোন জিনিসটা কিনবো ইত্যাদি নানা বিষয়কে প্রভাবিত করতে পারে শুধু একটি স্পর্শ। করোনাপূর্ব সময় থেকেই অনেক মানুষ এই স্পর্শের সংকটে ভুগছিলেন। আর মহামারী হঠাৎ জেঁকে বসা মহামারী মানুষকে স্পর্শের কাঙ্গাল করে ‍তুলছে। 

হিসাব করলে দেখা যাবে, আমরা ৭ মাসের বেশি সময় ধরে হ্যান্ডশেক করি না, অনেক দিন পর দেখা হওয়া বন্ধুকে জড়িয়ে ধরি না। এছাড়া বাড়ির বাইরে প্রতিটি মানুষের সঙ্গে আমাদের দূরত্ব বজায় রাখতে বাধ্য করেছে মহামারীটি। 

এমনকি কয়েক মাস বা দীর্ঘসময় পর যখন আমরা আমাদের পরিবারের সদস্যদের দেখছি তখনো উভয়ের ঝুঁকি মোকাবেলায় অলিঙ্গন করা থেকে বিরত থাকছি। অনেক ক্ষেত্রে মহামারীটি আমাদের জীবনের শারীরিক যোগাযোগের গুরত্বকে অস্বীকার করেছে। এটার অনুপস্থিতিতেই কেবল আমরা এটার মূল্য অনুভব করতে পারছি। 

এটা ভাবাটা কি অযৌক্তিক হবে যে, মহামারীতে আমরা কেবল স্বাস্থ্য সংকটেই নয়, স্পর্শের সংকটেও ভুগছি? মহামারীর আগেও কিছু লোক স্পর্শ থেকে বঞ্চিত হয়েছে? এবং সমাজ কি আমাদের স্পর্শের জন্য পর্যাপ্ত সুযোগ দেয়? 

এই প্রশ্নগুলোর উত্তর খুঁজতে লন্ডনের গোল্ডস্মিথস বিশ্ববিদ্যালয়ের মাইকেল ব্যানিসির নেতৃত্বে মনোবিজ্ঞানীদের একটি দল অনলাইন জরিপ করেছেন। ২০২০ সালের জানুয়ারির শেষনাগাদ শুরু হওয়া এই জরিপে দুই মাস ধরে ১১২টি দেশের ৪০ হাজার মানুষ অংশ নেন।

ফলাফলগুলো যখন সামনে আসে তখন স্পর্শের ভিন্ন চিত্র প্রকাশ পায়। এটা বলার অপেক্ষা রাখে না যে মহামারীর আগেও আমরা স্পর্শের সংকটে ছিলাম এবং সকলের আরো বেশি স্পর্শের ক্ষুধা ছিল। 

বিশ্বের বেশিরভাগ স্থানে লকডাউন শুরুর আগেই প্রশ্নগুলো করা হয়েছিল। গবেষণার শেষ সপ্তাহটি যুক্তরাজ্য ও অন্য কয়েকটি দেশে লকডাউনের সঙ্গে মিলে গিয়েছিল। এই সপ্তাহটিতে তুলনামূলক বেশি মানুষ যথেষ্ট স্পর্শ পাচ্ছেন না বলে আক্ষেপ করেছেন। 

তবে লকডাউনে আরো কী কী ঘটেছে তা আবিষ্কারের জন্য আমরা আরো দুটি গবেষণার দিকে তাকাতে দিতে পারি। 

যুক্তরাষ্ট্রের মিয়ামির স্কুল অব মেডিসিন বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞানী টিফানি ফিল্ড এপ্রিল মাসে একটি অনলাইন গবেষণা করেন। তিনি দেখতে পান, মাসের শেষ দিকে ৬৮ শতাংশ মানুষ জানিয়েছেন যে, তারা নিম্ন থেকে উচ্চ মাত্রার স্পর্শ বঞ্চনার শিকার হচ্ছেন। জার্মানির মিউনিখের বুন্দেসওয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ের জৈব মনোবিজ্ঞানের অধ্যাপক মেরেল ফেয়ারহার্স্ট এপ্রিল মাসে পাঁচটি দেশে একটি গবেষণা পরিচালনা করেছিলেন। গবেষণটির প্রাথমিক ফলাফলে দেখা গেছে, এপ্রিল মাসে ৬১ শতাংশ মানুষ অপরিচিত ব্যক্তির এবং ৩৫ শতাংশ মানুষ পরিবারের সদস্যদের স্পর্শ মিস করেছেন। 

অবাক হওয়ার কিছু নেই যে যখন আমরা স্পর্শ থেকে বঞ্চিত হই তখন সেটা খুব মিস করি। মানবদেহে এমনকি আনন্দদায়ক স্পর্শ শনাক্তকরণের জন্য একটি বিশেষ ব্যবস্থা রয়েছে। ব্যথার জন্য খুব দ্রুত সাড়া দেয়া ত্বকের রিসেপটরগুলোর পাশাপাশি সি-ট্যাকটাইল অ্যাফারেন্ট ফাইবার নামে এক ধরনের রিসেপ্টর রয়েছে, যা ধীরে সাড়া দেয়।

যদি আমাদের ত্বকে প্রতি সেকেন্ডে ৩ সেন্টিমিটারের আদর্শ গতিতে টোকা (স্ট্রোক) দেয়া হয়, যা আপনি স্বাভাবিকভাবে কাউকে শান্ত করা বা সতর্ক করার চেষ্টা করতে গিয়ে দিয়ে থাকেন, তাহলে এটা স্নায়ুতন্ত্রের মাধ্যমে মস্তিষ্কে বার্তা পাঠায়। এরপর মস্তিষ্ক সেখানে একটি আনন্দদায়ক রাসায়নিক ককটেলকে উস্কে দেয়। এছাড়া সেখানে স্ট্রেস হরমোন কর্ডিসল হ্রাস পায় এবং সামাজিক বন্ধনে ভূমিকা পালন করা অক্সিটোসিন বৃদ্ধি পায়।

এখন কথা হলো এই স্পর্শ যদি মারাত্মক সংক্রমণ ঝুঁকির কারণ হয়ে দাঁড়ায় তাহলে এই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি সম্পর্কে নতুন করে কী ভাবা যেতে পারে? তাছাড়া আমরা জানি না, এই পরিস্থিতি কতোদিন স্থায়ী হবে।

মনোবিজ্ঞানী টিফানি ফিল্ড এপ্রিলেই পেয়েছিলেন, কিছু লোক যদি স্পর্শের জন্য বিকল্প অনুশীলনের চেষ্টা করে তবে সুস্থতা ও ঘুমের জন্য একই ধরনের উপকার পেতে পারে। ফেয়ারহার্স্ট এমন একটি অ্যাপ তৈরি করেছেন, যা নিখুঁত গতিতে কারো ত্বককে টোকার অনুভূতি পেতে প্রশিক্ষণ দেয়। তিনি বলেন, আমি যখন এটা চেষ্টা করেছি, তখন সেই গতিতে স্ক্রিনটি স্ট্রোক করে বেশ প্রশান্তি অনুভব হয়েছিল। তার গবেষণায় আরো প্রমাণিত হয়েছে, লোশন বা ক্রিম দিয়ে রূপচর্চা করা কিংবা ভালো ও প্রিয় খাবার খাওয়াও কিন্তু স্পর্শের মতো প্রভাব সৃষ্টি করতে পারে। 

তবে তিনি সতর্ক করেছেন দীর্ঘমেয়াদি ব্যায়ামের চেয়ে এই খাওয়া কিন্তু স্বল্পস্থায়ী প্রভাব রাখে। এই কথাটিও মনে রাখা গুরুত্বপূর্ণ যে, স্পর্শের গুণমানও এখানে প্রভাব ফেলে। তাই আমাদের স্পর্শ সম্পর্কে আরো সচেতন হওয়া এবং যত্ন নেয়ার উপায় হিসেবে পরিবার বা কাছের মানুষদের সচেতনভাবে স্পর্শ করা জরুরি। এই মহামারীর মধ্যেও স্পর্শে যেন বিরতি না হয়!

বিবিসি অবলম্বনে শিহাবুল ইসলাম

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন