ডিজিটাল বাংলাদেশ: কতো দূর এগোলো মানুষ

রাব্বী আহমেদ

‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ শব্দবন্ধের সঙ্গে যখন প্রথম পরিচয় তখন মাত্র কৈশোর পেরিয়ে তারুণ্যের প্রথম পর্বে পদার্পণ করছি। হঠাত করেই দেশের পত্র-পত্রিকা, মিডিয়া, বিজ্ঞাপন কিংবা জনমুখে ডিজিটাল শব্দের ব্যবহার বেড়ে গেলো। ওই সময়ে মানুষের মস্তিষ্কে তা এমন অভিঘাত তুলেছিলো যে শহর কিংবা মফস্বলে বিভিন্ন দোকানপাটের নামের সঙ্গে ডিজিটাল শব্দটি যুক্ত হওয়া শুরু হলো। ‘মায়ের দোয়া ফুচকা’ হয়ে গেলো ‘ডিজিটাল ফুচকা শপ’, ‘আল্লাহর দান বিরিয়ানি’ হয়ে গেলো ‘ডিজিটাল বিরিয়ানি হাউজ’ এমন অজস্র উদাহরণ রয়েছে। এমনকি ‘এখানে ডিজিটাল পদ্ধতিতে মুসলমানি করানো হয়’ এমন পোস্টারও চোখে পড়েছে। অনুভব করি, ডিজিটাল শব্দটির এই দারুণ অভিঘাত নেহায়েত ফেলে দেয়ার মতো নয়। যে কোন কিছুর সঙ্গে ডিজিটাল যুক্ত হলেই মানুষ একে পজিটিভ হিসেবেই ধরে নিতো। মনে পড়ে, ওই সময়ে একাদশ শ্রেণিতে  বাংলা উপস্থিত বক্তৃতায় আমার ভাগ্যে পড়েছিলো ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’। জীবনের প্রথম ও শেষ মঞ্চ প্রতিযোগিতায় ওই বয়সে এই বিষয় নিয়ে ঠিক কী বলেছিলাম এতকাল পর তা আর স্মরণে নেই। 

এরপর পেরিয়েছে বহুদিন। কর্মজীবনে ব্র্যাকে কাজ করতে এসে নতুন ভাবে তখন অনুভব করতে শিখেছি প্রযুক্তির ব্যবহারকে। হাতে কলমে শিখছি প্রযুক্তির বিবিধ ব্যবহার। ভাগ্যক্রমে যে ফ্লোরে আমার অফিস সেখানে একই সঙ্গে কাজ করে ব্র্যাক টেকনোলজিও। বাংলাদেশের প্রযুক্তিগত উন্নয়ন নিয়ে যারা বিভিন্ন ভাবে কাজ করে যাচ্ছে। তথ্য ও প্রযুক্তির উৎকর্ষতা ব্যবহার করে আসলে কতো কিছুই যে করা সম্ভব এ নিয়ে মাঝে মাঝে টুকরো আলাপ ঘটে ব্র্যাক টেকনলোজির সহকর্মীদের সঙ্গে। উভয় টিমই যেহেতু কাজ করছে মানুষের সামগ্রিক উন্নয়ন নিয়ে ফলে আমাদের কাজের মধ্যে অনেক সাদৃশ্য রয়েছে। এই মার্চের শেষের দিকে যখন হঠাৎ করে কভিড মহামারীর কারণে ব্র্যাক ‘ওয়ার্ক ফ্রম হোম’ করার সিদ্ধান্ত নিলো তখন যেন নতুন এক বাস্তবতার মুখোমুখি হলাম। তুমুল ব্যস্ত একটা অর্গানাইজেশন কিভাবে শুধুমাত্র প্রযুক্তি ব্যবহার করে ‘ওয়ার্ক ফ্রম হোম’ মোডালিটি সামাল দেবে তা ভেবে চিন্তিত হচ্ছিলাম। আজ ঠিক ছয়মাস পরে এসে যখন এই লেখা লিখছি তখন ব্র্যাকের কার্যক্রম আস্তে আস্তে স্বাভাবিক হতে শুরু করেছে, অফিস খুলেছে স্বাস্থ্যবিধি মেনে। 

অফিস নামক একটা স্পেসে সশরীরে উপস্থিত না থেকেও যে অনেক কাজ করা যায় করোনা তা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিলো। সেই সঙ্গে ব্র্যাক প্রতিষ্ঠা করলো এক অনন্য উদাহরণের। এই কয়েক মাসে করোনা আমাদের ভীষণভাবে উপলদ্ধি করতে শেখালো প্রযুক্তিগত দিক থেকে দক্ষ হয়ে ওঠা কী দারুণ ভাবে অপরিহার্য হয়ে উঠেছে। আমরা দেখেছি করোনাকালীন সময়ে জুম, গুগল মিট, হ্যাং আউট, স্কাইপ ব্যবহার করে কিভাবে গুরুত্বপূর্ণ ওয়েবিনার, আলোচনা কিংবা ক্লাস রুমের কাজ সম্পন্ন হয়েছে। দীর্ঘদিন বন্ধ থাকার পর হঠাত করেই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোও অনলাইনে পাঠদান দেয়ার সিদ্ধান্ত নিলো।  সমস্যাটা হলো তখন যখন সমাজের একটা বিশেষ শ্রেণী প্রযুক্তিগত সহায়তা থেকে দূরে থাকার কারণে বাদ পড়ে গেলো। তৈরি হলো নতুন এক ধরণের ‘টেকনোবৈষম্য’। গত মে মাসে শিক্ষার ওপর করোনার প্রভাব শীর্ষক এক গবেষণায় যুক্ত থাকার সুবাদে কথা বলতে হয়েছে শহর, গ্রাম ও মফস্বলের বিভিন্ন শিক্ষক এবং শিক্ষা কর্মকর্তার সঙ্গে। অধিকাংশই বলেছেন, প্রযুক্তিগত সহায়তা না থাকার কারণে অনেক শিক্ষার্থীই ক্লাসে অংশ নিতে পারছে না। আবার, অনলাইনে ক্লাস নিতে গেলে যে বিশেষ দক্ষতা প্রয়োজন তাও অনেকের নেই। আবার একদম দুর্গম এলাকায় বিদ্যুৎ বিভ্রাট, প্রযুক্তির অপ্রতুলতা ও নেটওয়ার্কজনিত ঝামেলার কারণে অনেকেই অনলাইন ক্লাস থেকে বাদ পড়ে যাচ্ছে। অন্যদিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মধ্যে এ নিয়ে মিশ্র অভিজ্ঞতা দেখেছি। করোনার সময়ে হল বন্ধ থাকায় অনেক শিক্ষার্থীকেই প্রত্যন্ত গ্রামে চলে যেতে হয়েছে যেখানেও একই সমস্যা বিরাজমান। আবার যাদের স্মার্টফোন কেনার সামর্থ্য নেই তারাও অনলাইন ক্লাসে যুক্ত হতে পারছে না। 

কিছুদিন আগে ইনফর্মাল সেক্টরে কাজ করা নারী এবং ক্ষুদ্র, মাঝারি ও কুটিরশিল্প (এসএমই) নারী উদ্যোক্তাদের ওপর করোনার প্রভাব শীর্ষক ব্র্যাকের আরেক গবেষণায় যুক্ত থাকার সুবাদেও কথা বলতে হয়েছে বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রান্তের নারী উদ্যোক্তাদের সঙ্গে। সেখানে দেখেছি, যাদের প্রযুক্তিগত জ্ঞান ভালো তাদের ব্যবসার ক্ষতির পরিমাণ কম। আর যাদের প্রযুক্তিগত জ্ঞান কম কিংবা সে সুবিধাও নেই তারা বিভিন্নভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তবে, এই গবেষণা করতে গিয়ে যে অভিজ্ঞতা হয়েছে তা এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে। প্রথমত, সরকারের কাছে কোন ডিজিটাল ডাটাবেইজ নেই যার মাধ্যমে ট্রান্সজেন্ডার, যৌনকর্মী, নারী শ্রমিক, প্রান্তিক জনগোষ্ঠী কিংবা উদ্যোক্তাদের কাছে পৌঁছানো যায়। প্রশ্ন জাগে, সরকারের পক্ষ থেকে বিভিন্ন প্রণোদনা ও আর্থিক সহায়তার কথা বলা হলেও ডাটাবেইজ ছাড়া তা কিভাবে সঠিক জায়গায় পৌঁছানো হয়েছে।  অন্যদিকে, এই কাজে তথ্য সংগ্রহের জন্য সরকারের দুটো অর্গানাইজেশনের সঙ্গে বারবার মেইলের মাধ্যমে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তা সম্ভবপর হয় নি। সরকারের এক গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে থাকা এক কর্মকর্তার মেইলের উত্তর এসেছে প্রায় এক মাস পরে যখন গবেষণা কাজ প্রায় শেষ। আরেকজন সরকারি কর্মকর্তা বলছেন, তারা মেইল চেক করেন না। সময় পান না। তাঁর এই উত্তর শুনে কিছুটা থমকেই যাই।  যেখানে মেইলের মাধ্যমে তাবৎ দুনিয়ার মানুষের সঙ্গে করোনাকালীন সময়ে মানুষ যোগাযোগ করেছে, পেশাগত কাজ সম্পন্ন করেছে সেখানে কিভাবে সরকারের একটা গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা এ কথা বলেন তা বোধগম্য হয় না। 

কথিত ডিজিটাল বাংলাদেশে গুগলের সকল ফিচারের সঠিক ব্যবহার কতোটা হচ্ছে তা নতুন করে খতিয়ে দেখা প্রয়োজন। দেশের অনেক পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়েই নেই শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের কোন প্রাতিষ্ঠানিক মেইল আইডি। জাতীয় তথ্যবাতায়ন সহ অন্য অনেক সরকারি ওয়েবসাইটে ঢুকলে চোখে পড়ে অপর্যাপ্ত তথ্য আর চরম তথ্য বিশৃঙ্খলার দৃশ্য। গত বছর ব্র্যাকের ন্যাশলনাল পালস সার্ভের রিপোর্টে উঠে এসেছে পর্যাপ্ত তথ্য প্রাপ্তির অভাবই সরকারি বিবিধ সেবা পাওয়ার অন্যতম প্রধান অন্তরায়। করোনার সময়ে সরকারি বিভিন্ন অফিস এক নাগাড়ে বন্ধ ছিলো অনেকদিন। যে কারণে অনেক সাধারণ মানুষেরই ভোগান্তির সীমা ছিলো না। অথচ, টেকনোলজির সাহায্য নিয়ে অনেক গুরুত্বপূর্ণ অফিস খোলা রাখা যেতো যেমনটা করেছে ব্র্যাক। সম্প্রতি পেশাগত কারণে অনলাইনে ট্রেইনিং দিতে গিয়ে দারুণ এক অভিজ্ঞতা হলো। সমাজের পিছিয়ে পড়া প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর বিভিন্ন সমস্যা ও চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা এবং তাদের বিবিধ চাহিদাকে সরকারের কাছে পৌঁছে দিতে এলএনওবি (লিভিং নো ওয়ান বিহাইন্ড) নামের একটা প্ল্যাটফর্ম কাজ করছে। এই প্ল্যাটফর্মটি ব্র্যাকসহ দেশের নয়টি আন্তজার্তিক এনজিওর সমন্বয়ে গঠিত। করোনাকালীন সময়, সরকারি খাদ্য ও ত্রান সহায়তা এবং স্বাস্থ্য সেবার ওপর এইসব প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর মূল্যায়নকে কমিউনিটি স্কোরকার্ডের মাধ্যমে তুলে আনার লক্ষ্যে দেশের আটটি বিভাগের ৬৪টি জেলার এফজিডি (ফোকাস গ্রুপ ডিসকাসন) পরিচালনাকারীদের ট্রেইনিং দিতে হয়েছে। প্রতি সেশনেই বিভিন্ন জেলা থেকে গড়ে ত্রিশ থেকে চল্লিশজন পরিচালনাকারী অংশ নিয়েছেন। অনলাইনে ট্রেইনিং নেয়ার নেয়ার পূর্ব অভিজ্ঞতা না থাকলেও দেখলাম অল্পকিছু টেকনিকাল ঝামেলা ব্যতিত বেশ ভালো ভাবেই ট্রেইনিং পরিচালনা করা গিয়েছে। অংশগ্রহণকারীরাও ছিলেন স্বপ্রতিভ। গত বছর ন্যাশনাল পালস সার্ভে করতে গিয়ে একটানা নয় দিনে ফরিদপুর, বরিশাল, বগুড়া ও ময়মনসিংহ ছুটতে হয়েছিল সার্ভেকারিদের ট্রেইনিং দেয়ার লক্ষ্যে। সে এক দারুণ কষ্টকর অভিজ্ঞতা। দু’টোর তুলনা করে দেখলাম, কিছু বিষয় লক্ষ্য রেখে যদি অনলাইনেই ট্রেইনিং নেয়া যায় সেক্ষেত্রে অর্থ, সময়, লজিস্টিক ও যাতায়াতের ঝামেলা সবই দূর করা সম্ভব। অনেকেই এক্ষেত্রে প্রশ্ন তুলতে পারে অনলাইনে ট্রেইনিং নেয়া বা ক্লাস নেয়াটা কতোটা সফল। হ্যাঁ, যৌক্তির প্রশ্ন বটে কিন্তু পুরোটাই নির্ভর করে অংশগ্রহণকারী ও ট্রেইনারের ওপর। দুই পক্ষই যদি সচেতন ও মনোযোগি হয় তবে তা নিশ্চয়ই সম্ভব এবং ভালোভাবেই সম্ভব।  আবার এক্ষেত্রে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে যুক্ত হওয়া মানুষদের প্রযুক্তি নিয়ে সঠিক অরিয়েন্টেশন ও নেটওয়ার্কের দিকে নজর দেওয়াও জরুরি। অনলাইন ট্রেইনিং-এ যেহেতু অপর পক্ষকে পুরোপুরি মনিটর করার সুযোগ থাকে না তাই এক্ষেত্রে সামান্য রিস্ক থেকে যায়। তবে, সেগুলো মেজর কোন চ্যালেঞ্জ নয়। সঠিক অরিয়েন্টেশন ও গাইডলাইনের মাধ্যমে তার সমাধানও আছে। যেমনটা অনলাইন ক্লাসের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। নেটিজেনদের শেয়ার করা অনেক ভিডিওতে দেখেছি অনলাইন ক্লাসে শিক্ষার্থীরা যুক্ত হয়ে  নিজের ব্যক্তিগত কাজ করে থাকে কিংবা নেটফ্লিক্সে মুভি দেখে। কথাসাহিত্যিক শাহাদুজ্জামান তার প্রযুক্তিবিষয়ক এক লেখায় লিখেছিলেন, একটা টেকনোলজি অ্যাডাপ্ট করা যতো সহজ একটা আইডোলজি ধারণ করা ততোটা সহজ নয়। টেকনোলজির চর্চার পাশপাশি তাই আইডোলিজি চর্চাটাও অত্যন্ত জরুরি। প্রযুক্তির অপব্যবহার নিয়ে নতুন করে কিছুই বলার নেই। ব্র্যাকেরই আরেক গবেষণায় উঠে এসেছে করোনাকালীন সময়ে প্রায় ১৯ দশমিক ৩৫ শতাংশ শিক্ষার্থীরা ফেসবুক ও ভিডিওগেমে আসক্তি হয়ে পড়েছে। আবার করোনার ওই দুঃসময়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার করে গুজব ছড়ানোর মাধ্যমে ইনফোডেমিক বা তথ্যের মহামারি হতেও আমরা দেখেছি যা জনমনে বিভ্রান্তি ও ভীতির সঞ্চার করেছে। ঠিক এখানেই আইডোলজির আর টেকনোলজির সমন্বয়হীনতা চোখে পড়েছে। 

ডিজিটাল বাংলাদেশ গঠনে সরকারের গঠিত বিভিন্ন উদ্যোগ যেমন প্রশংসার দাবি রাখে সেই সঙ্গে সমালোচনার মাধ্যমে পলিসিগ্যাপগুলোকেও অনুধাবন করা জরুরি। শুধু উদ্যোগ নিয়ে টাকা বরাদ্দ করলেই হবে না, সে টাকার সঠিক ব্যবহারও করতে হবে। অনলাইন মিটিং-এ খাতা, কলম, খাবার খরচের বিল বাবদ জনগণের টাকা হাতিয়ে নিলে ডিজিটাল বাংলাদেশ গঠনের যে মূল্য লক্ষ্য তা শুধু বিচ্যুতই নয়, কক্ষচ্যুতও হতে হবে। মনে রাখা জরুরি, করোনা পরবর্তী বিশ্বে টিকে রাখার জন্য অবশ্যই প্রযুক্তিগত দিক থেকে দক্ষ হতে হবে সেই সঙ্গে উন্নয়নের বিভিন্ন ইন্ডিকেটরের সঙ্গে যুক্ত করতে হবে টেকনোলজিকেও। সোস্যাল সেইফটিনেটেও প্রযুক্তিকে যুক্ত করতে হবে। অন্য সকল অনুষঙ্গকে ঠিক রেখে প্রযুক্তির চোখ দিয়েও দেখতে হবে মানুষের উন্নয়নকে। তবেই হয়তো অনুভব করা যাবে মানুষের সামগ্রিক উন্নয়নকে। বোঝা যাবে, কতদূর এগোলো মানুষ। 

লেখক: গবেষক, অ্যাডভোকেসি ফর সোস্যাল চেঞ্জ, ব্র্যাক

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন