তুমি হৃদয়েতে দাগ কেটেছো

সেলিম জাহান

মুঠোফোনটা ছেড়ে দিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললাম। চুপ করে জানালার বাইরে তাকালাম। মনটা কেমন যেন উদাস করা হয়ে গেল। কত বছর হয়ে গেল? তা বছর তিরিশেক তো হবেই। তিন দশক পরে কণ্ঠ শুনলাম হেলালের - কবিবন্ধু হেলাল হাফিজের। অথচ এমন একটা সময় ছিল যখন প্রতি সপ্তাহেই দেখা হত হেলালের সঙ্গে। দেখা হত আমাদের তীর্থস্থান শরীফ মিয়ার ক্যান্টিনে।

সময়টা সত্তুর দশকের প্রথম দিকটি। হেলালের হয়তো মনে নেই, আমার কিন্তু পরিষ্কার মনে আছে, হেলালের সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন হাসান ভাই - প্রয়াত কবি আবুল হাসান। ‘সাবধানে কথা কইও এর সঙ্গে’, পরিচয় করিয়ে দেয়ার কালে হেলালকে বলেছিলেন হাসান ভাই, ‘খাস জিলেট ব্লেড - উল্টা কথা কইলেই যুক্তি আর প্রমাণ দিয়া কাইট্টা দিবো তোমার কথা’। আমি অপ্রতিভ হাসি হেসেছিলাম হাসান ভাইয়ের কথায়। প্রথম পরিচয়ে এমন কথা বলে কেউ? হাসান ভাইয়ের আর বুদ্ধি-শুদ্ধি হল না? প্রথম দর্শনেই কিন্তু হেলালের চেহারা আমার মনে রেখাপাত করেছিল। বেশ পরিপাটি করে মাঝখানে সিঁথি করা একটু বাবরি হয়ে যাওয়া চুল, কচি ঘাসের মতো তার দাড়ি-গোঁফ, বড় বড় চোখ, সব মিলিয়ে হেলালকে আমার তরুন যিশুখৃষ্টের মতো লেগেছিলো। তবে হেলালের সঙ্গে বন্ধুত্ব হতে সময় লাগলো না। 

সকাল-দুপুর-বিকাল আড্ডা দেই শরীফ মিয়ার ক্যান্টিনে। যোগ দেয় প্রয়াত কবি রফিক নওশাদ, শাহনূর খান, সাজ্জাদ কাদির। হাসান ভাই তো আছেনই। কবিতা পড়া হয়, সাহিত্য নিয়ে তুমুল বিতর্ক চলে, চুটকি, রটনা, পরচর্চাও বাদ যায় না। মাঝে মাঝে আসেন রশীদ ভাই (লেখক রশীদ হায়দার), রফিক ভাই (কবি মোহাম্মদ রফিক), নরেন’দা (প্রয়াত নরেন বিশ্বাস)। আড্ডা আরও জমে ওঠে। আমাদের তর্ক-বিতর্ক আর চেঁচামেচিতে কান পাতা দায়। রমজান ভাইয়ের নিয়ে আসা চা কাপের পর কাপ উড়ে যায়। সিগারেটের ধোঁয়ায় ভরে যায় ঘর। ক্ষীণভাবে মনে পড়ে একদিন হেলালের সঙ্গে ঢাকা হলে (বর্তমানের শহীদুল্লাহ হল) গিয়াছিলাম হেলালের অগ্রজ দুলাল ভাইয়ের কক্ষে। হাসান ভাইয়ের সাবধান বাণী মিথ্যে প্রমাণিত হয়। আমি যুক্তি-তর্ক দিয়ে হেলালকে কাটি না, হেলালই তার কবিতার লাইন দিয়ে আমাকে কাটে - আমার হৃদয়ে দাগ কাটে। উনসত্তুরে লেখা হেলালের লাইন, ‘এখন যৌবন যার, মিছিলে য়াওয়ার তাঁর শ্রেষ্ঠ সময়, এখন যৌবন যার, যুদ্ধে যাওয়ার তার শ্রেষ্ঠ সময়’ ইতিমধ্যেই হেলালকে বিখ্যাত করেছে। তার কবিতা ‘নিষিদ্ধ সম্পাদকীয়’ লোকের মুখে মুখে। মাঝে মাঝে দুপুর বেলা শরীফ মিয়ায় এক টাকার বিরিয়ানী খেতে খেতে হেলাল তার সদ্য সমাপ্ত কোন কোন কবিতার লাইন আওড়ায়। আমি মুগ্ধ হই। ‘অস্ত্র সমর্পণ’ কবিতার শেষ চার লাইন শুনি, ‘ যদি কোনদিন আসে আবার দুর্দিন, যেদিন ফুরাবে প্রেম, অথবা হবে না প্রেম মানুষে মানুষে, ভেঙে সেই কালো কারাগার, আবার প্রণয় হবে মারণাস্ত্র তোমার আমার’। কেমন যেন লাগে যখন হেলাল পড়ে , ‘ইচ্ছে ছিল রাজা হবো, তোমাকে সম্রাজ্ঞী করে রাজ্য বাড়াবো, আজ দেখি রাজ্য আছে, রাজা আছে, ইচ্ছে আছে, শুধু তুমি অন্যঘরে’। সত্তুরের দশকের শেষার্ধে দেশের বাইরে চলে যাই উচ্চশিক্ষার্থে।


হেলালের সঙ্গে সংযাগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। মধ্য-আশির দশকে দেশে ফিরে এলে হেলালের সঙ্গে সংযুক্তি ঘটে তার মাধ্যমে নয়, তার কবিতার মাধ্যমে। এরশাদের স্বৈরশাসন চলছে তখন। তার বিরুদ্ধে আমার নানান লেখায় হেলাল হাফিজের কবিতা উঠে আসছে স্বাভাবিকভাবে। ‘নিউট্রন বোমা বোঝ, মানুষ বোঝ না’ , কিংবা ‘আমার কষ্টেরা বেশ ভালোই আছেন, মোটামুটি সুখেই আছেন। প্রিয় দেশবাসী, আপনারা কেমন আছেন? এ সব পংক্তির নামাবলি চাপিয়ে আমার বহু লেখা বেরোচ্ছে। 

তখন প্রতি বৃহস্পতিবারে সংবাদের সাহিত্য সাময়িকীতে আমার পাক্ষিক কলাম ‘কড়ি-কড়চা’ বেরোচ্ছে। একবার এক লেখায় আমি হেলালের কবিতা ‘যার যেমন জায়গা’ পুরোটা ব্যবহার করেছিলাম। কথ্যভাষায় লেখা কবিতাটির শেষ লাইনে একটি মারাত্মক গালি ছিল। সাহিত্য সাময়িকীর সম্পাদক হাসনাত ভাই (আবুল হাসনাত) একটু ইতস্তত: করছিলেন। শুনেছি, পরে সন্তোষদা’র (প্রয়াত সন্তোষ গুপ্ত) সুপারিশ ও বজলু ভাইয়ের (সংবাদ সম্পাদক প্রয়াত বজলুর রহমান) অনুমোদনে তা ছাপা হয়েছিল। হেলালের কবিতা আমি এতো বেশী ব্যবহার করতাম আমার লেখায় যে হেলাল একবার প্রয়াত জাতীয় অধ্যাপক কবীর চৌধুরীকে বলেছিলো যে, আমি তার কবিতাকে জনপ্রিয় করে দিচ্ছি। এমনই ছিল তার বন্ধু-প্রীতি।

এই ৭ই অক্টোবর হেলালের জন্মদিন। বয়সে সে আমার চেয়ে কিছুটা বড়, কিন্তু আমাদের নির্মল বন্ধুত্বের সম্পর্ক কখনো ‘আপনি-আজ্ঞে’ দিয়ে আচ্ছন্ন হয় নি। আজ যখন ফোন ছাড়ি, তখন হেলাল বলেছিল, ‘আমাদেরও তো যাওয়ার সময় হয়ে এলো। না, তোমার ও কথা আমি মানি না। কবি হেলাল হাফিজ, তুমি দীর্ঘজীবী হও এবং তোমার কবিতা দিয়ে আমার হৃদয়ে দাগ কাটতো থাকে - যেমনটি করেছো আমার যৌবনে।

লেখক: অর্থনীতিবিদ ও লেখক

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন