মৃত্যুর সংখ্যা কেন আমাদের বিচলিত করে না

বণিক বার্তা ডেস্ক

নয় মাস আগে কভিড-১৯ মহামারী যখন শুরু হয় তখন মৃত্যুর সংখ্যা অকল্পনীয় ছিল। এর মাঝে গত সপ্তাহে কেবল যুক্তরাষ্ট্রেই মৃতের সংখ্যা পৌঁছে যায় দুই লাখে। অন্যদিকে বিশ্বব্যাপী মৃতের সংখ্যা ছাড়িয়েছে ১০ লাখের কোটা। এদিকে ভারতও এর মাঝে মৃত্যুর ক্ষেত্রে এক লাখের মাইলফলক পার করেছে।

যদিও স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আনুষ্ঠানিক মৃতের সম্ভাব্য সংখ্যা আরো বেশি, অনেক ক্ষেত্রে করোনাভাইরাসে মৃত্যুর সংখ্যা আনুষ্ঠানিকভাবে উল্লেখ করা হয়নি। তার পরও দুই লাখের মাইলফলক হূদয়বিদারক। এটি একটি ভয়ংকর প্রতীকী সংখ্যা, যা মানুষের চেতনাকে অসাড় করে দিতে যথেষ্ট। পাশাপাশি এটি মহামারীর আরো একটি উদ্বেগজনক স্তরকে চিহ্নিত করে।

তালিকাটি আমাদের হাতে আছে তার অর্থ হচ্ছে ফেব্রুয়ারির শেষের দিকে প্রথম আনুষ্ঠানিক মৃত্যুর ঘটনা সামনে আসার পর যুক্তরাষ্ট্রে প্রতি . মিনিটে গড়ে একজন করে মানুষ মারা যাচ্ছে। এটি একটি ছোট শহরকে মুছে ফেলার সমতুল্য, যেমন সল্ট লেক সিটি ইউটা কিংবা আকরন। অর্থাৎ ১৪৫০টি যাত্রী বোঝাই করা বিমান এরই মধ্যে আমরা হারিয়ে ফেলেছি। 

বিশেষজ্ঞদের একজন ডেভিড কেসলার বলেন, আপনি যদি এটা নিয়ে এভাবে ভাবেন যে ক্ল্যাসিক ৭৩৭ বিমানে ১৩৮ সিট আছে, তার মানে যুক্তরাষ্ট্রের মাটিতে প্রতিদিন আটটা বিমান বিধ্বস্ত হচ্ছে। এটা কি আপনি কল্পনায়ও ভাবতে পারেন?

যদিও সংখ্যাগুলো মানসিক সমস্যার চিত্রকে চিত্রিত করে, যেটা অজানা তা হলো কীভাবে এটি মানুষের সামষ্টিক স্বতন্ত্র মানসিকতায় প্রভাব ফেলে।

দুই লাখ মৃত্যু কি একটি গুরুত্বপূর্ণ অবস্থা, যা আমাদের ভেতরটা নাড়িয়ে দেয় এবং নতুন স্তরের জরুরি অবস্থা এবং ক্ষোভের সৃষ্টি করে? কিংবা এটি চালিত করে নাম্বারনেস নিষ্ক্রিয়তার দিকে?

শেষ পর্যন্ত আমাদের বায়োলজি আমাদের বিরুদ্ধে কাজ করে। গবেষকরা বলেন, আমাদের মস্তিষ্ক বড় সংখ্যার বোধের জন্য সক্রিয় নয়। আমরা অন্যান্য উদ্বেগের সমুদ্রের মধ্যে করোনাভাইরাসের মৃত্যুর বিরাট সংখ্যা হজম করার চেষ্টা করছি, যেখানে অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা, নাগরিক অশান্তি, দাবানল হ্যারিকেন, নির্বাচনজনিত চাপ, ভূরাজনৈতিক লড়াই এবং আমাদের কাজ করার, কেনাকাটার বাচ্চাদের পড়াশোনাসহ অনেক কিছুর নজিরবিহীন পরিবর্তন অন্তর্ভুক্ত।

প্রিন্সটন ইউনিভার্সিটির কগনিটিভ সাইকোলজিস্ট ইলকে ওয়েবার বলেন, গোটা দেশই বিষণ্ন। যদিও আপনি এরই মধ্যে অবসাদগ্রস্ত হন তবে লাখ সংখ্যাটি আপনার জন্য কেবল আরেকটি বিষয় মাত্র।

গবেষকরা বলেন, উত্তেজিত নিস্পৃহ না হয়েও ধরনের সংবাদ হজম করার এবং এর সঙ্গে মানিয়ে নেয়ার জন্য পথ খোলা আছে।

সহানুভূতির গণিত

বড় ট্র্যাজেডি মানে সব সময় অনেক বেশি সহানুভূতি প্রকাশ করা এমন নয়। এটা বরং পাল্টা উদাসীনতা নিয়ে আসতে পারে। মৃতের সংখ্যার আধিক্য অনেক মানুষের সহানুভূতি হ্রাস করার কারণ হতে পারে, বলেছেন মনোবিজ্ঞানী পল স্লোভিক। অবস্থাকে তিনি বলেছেন সাইকি নাম্বিং বা মানসিক অসাড়তা।

২০১৪ সালের গবেষণা নজর দিয়েছিল দাতব্য দানের দিকে। যেখানে স্লোভিক দেখেছেন, অভাবী লোকদের সংখ্যার সঙ্গে তাদের জন্য মানুষের উদ্বেগ বাড়েনি। তিনি বলেন, বিপদে থাকা একজন ব্যক্তির জন্য আমাদের অনুভূতি বেশ শক্তিশালী। কিন্তু যদি সেখানে দুটি মানুষ থাকে তবে আপনি দ্বিগুণ খারাপ অনুভব করবেন  না। তখন আপনার মনোযোগ মূলত দুই ভাগ হয়ে যাবে এবং সংশ্লিষ্টদের প্রতি আমাদের মানসিক সংযোগ আর তেমন থাকবে না।

স্লোভিকের মতে, আমাদের মস্তিষ্ক মানিয়ে নেয়ার উপায়ের সঙ্গে বিকশিত হয়েছিল। লক্ষ বছর আগে মানুষ দূরবর্তী অবস্থানে থাকা সমপ্রজাতির দুর্দশা বিপর্যয় সম্পর্কে অবগতও ছিল না। তখন মনোযোগ কেবল নিজের পরিবার সম্প্রদায়ের ওপর নিবদ্ধ ছিল।

পাশাপাশি বিশেষজ্ঞদের মতে, মহামারীর লম্বা সময়ের সঙ্গে যুক্ত; এর সমাপ্তি নিয়ে অনিশ্চয়তা মানুষের বোধকে নষ্ট করেছে। খুব স্বাভাবিকভাবেই অনেক মানুষের মস্তিষ্ক কভিড-১৯-এর মৃত্যুর সংখ্যা শোনায় অভ্যস্ত হয়ে পড়ে, তখন মৃত্যুর উচ্চ সংখ্যা আর সংবেদনশীলভাবে গৃহীত হয় না। মানুষের মৃত্যু কেবল টিভি বা সংবাদপত্রে প্রকাশিত একটি সংখ্যা হয়ে রয়ে যায়।

ওয়েবের বলেন, মানব প্রজাতি খুব ভালোভাবে মানিয়ে নিতে পারে। তিনি গবেষণা করেছেন ঝুঁকি অনিশ্চয়তার সময় মানুষের সিদ্ধান্ত গ্রহণের বিষয়টি নিয়ে। তার মতে, আপনি যদি যুদ্ধাবস্থার মাঝে থাকা মানুষদের সম্পর্কে ভাবেন, তাহলে দেখবেন যে বিষয়টি একসময় ভীতিকর ছিল তা তখন স্বাভাবিক হয়ে যায়। যখন কোনো কিছু পরিবর্তিত হয় তখন আমাদের মস্তিষ্কের নিউরন জ্বলে ওঠে, কিন্তু কিছু সময় পর তা থেমে যায়। আপনি যদি বাজে ঘ্রাণযুক্ত কোনো ঘরে থাকেন, তবে শেষ পর্যন্ত তার ওপর মনোযোগ দেয়া বন্ধ করে দেবেন।

ইউনিভার্সিটি অব পিটার্সবার্গের স্কুল অব কম্পিউটিং অ্যান্ড ইনফরমেশনের অ্যাসোসিয়েট প্রফেসর ইউ-রু-লিন বলেন, সংকটের মাঝামাঝি অবস্থায় থাকা আমাদের রুখে দিয়েছে শোক এবং এক ধরনের স্মৃতিগাথা তৈরি থেকে, যা আমাদের সহায়তা করতে পারত ভুক্তভোগীদের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার জন্য।

তার গবেষণায় লিন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে স্বল্পমেয়াদি ধাক্কা দেয়া ঘটনা কিংবা প্রাকৃতিক দুর্যোগগুলোয় মানুষের আবেগী প্রতিক্রিয়াগুলোকে নথিভুক্ত করেছেন। যেমন তারা প্যারিসে ২০১৫ সালের সন্ত্রাসী হামলা নিয়ে গবেষণা করেছেন। তিনি দেখেছেন, নির্দিষ্ট ঘটনার পর আবেগের প্রকাশ ঘটনার সঙ্গে মানিয়ে নিতে সাহায্য করে।

উদাসীনতার কোনো অজুহাত নেই

তাহলে ধরনের ভারী সংবাদকে আমরা কীভাবে বুঝাতে পারি? মনোবিদ মার্ডি হওরোউইটজ বলেন, যখন আমরা ধরনের মৃতের সংখ্যা দেখি, তা আমাদের ভীতির অনুভূতি দেয় এবং বিষণ্ন করে তোলে। গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হচ্ছে ব্যথা সহ্য করা এবং যুক্তিপূর্ণভাবে চিন্তা করা যে আমরা কীভাবে মানুষকে সাহায্য করতে পারি। ক্রোধ, অসহায়ত্ব হতাশার যে অনুভূতি তাকে স্বীকার করাও গুরুত্বপূর্ণ বলে অভিহিত করেন তিনি। তার মতে, চরম অবস্থার মাঝে আমাদের লড়াইয়ে টিকে থাকার চেষ্টা করতে হবে। এটা মানুষকে ভালো বোধ করতে এবং আমাদের সম্মিলিত লক্ষ্যগুলো পুনরুদ্ধার করতে সাহায্য করবে।

স্লোভিক বলেন, সহানুভূতি-সংক্রান্ত অবসাদ দূর করার সেরা উপায় হচ্ছে স্বতন্ত্র ব্যক্তির নাম, চেহারা পরিবার নিয়ে চিন্তা করা। কেউ যখন পর্যবেক্ষণ করবে যে পরিসংখ্যানগুলো আসলে জলজ্যান্ত মানুষ তখন চোখের পানি গড়িয়ে পড়বে।

অদ্ভুতভাবে তার গবেষণায় দেখা গেছে, মানুষ সেসব দরিদ্র শিশুদের অনুদান দিতে পছন্দ করে যখন তারা ছবি দেখে এবং তাদের পরিস্থিতি সম্পর্কে আরো বেশি জানতে পারে। বিষয়টি করোনাভাইরাসে ক্ষতিগ্রস্তদের জন্যও সত্য।

দ্য ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন