আরবদের তুর্কিবিরোধী ঐক্য

শাহাদাত হোসাইন স্বাধীন

সাম্প্রতিক সময়ে মধ্যপ্রাচ্যের ভূ-রাজনীতি ভূমিধস পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। একসময়ের বৈরী দেশ ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে গুরুত্বপূর্ণ আরব দেশ সংযুক্ত আরব আমিরাত ও বাহরাইন। একই পথে অগ্রসর হতে যাচ্ছে সুদান, ওমান ও মরক্কো। বিশেষত এই ধরনের রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত মধ্যপ্রাচ্যের সুন্নি দেশসমূহের ইরানভীতি থেকে নেওয়া মনে হলেও আদতে তুরস্কের উত্থান আরবদের মাথা ব্যথার কারণ হয়ে উঠছে। 

সংযুক্ত আরব আমিরাত ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করলে ইরান ও তুরস্ক কড়া ভাষায় সমালোচনা করে। আমিরাত তুরস্কের সমালোচনা জবাবে বলেছে, ‘তুরস্কই প্রথম মুসলিম দেশ যে ইসরায়েলকে স্বীকৃতি দিয়েছে। এছাড়া বর্তমানে কূটনৈতিক সম্পর্ক না থাকলেও অর্থনৈতিক সম্পর্ক রয়েছে দুই দেশের। প্রতিবছর ইসরাইল থেকে হাজার হাজার পর্যটক তুরস্ক ঘুরতে যায়।’ আদতে গত বছরে তুরস্ক ও ইসরায়েলের মধ্যে ৬ বিলিয়ন ডলারের বাণিজ্য হয়। ইসরায়েল তুরস্কের ১০ নম্বর রফতানি বাজার। আবার ইরানকে নিয়ে আমিরাতের উচ্চবাচ্য থাকলেও মার্কিন নিষেধাজ্ঞা সত্তে¡ও দুই দেশের মধ্যে বানিজ্য সম্পর্ক বিদ্যামান। এখনো আমিরাতে ৫ লাখ ইরানি কর্মরত। প্রায় ৮০০ ইরানি কোম্পানি দুবাইতে বানিজ্য করছে। হরমুজ প্রণালির নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ইরানের উত্তেজনার মধ্যে পারস্য উপসাগরীয় নিরাপত্তার জন্য ইরানে প্রতিনিধি পাঠিয়েছিল আমিরাত। আগ্রহী পাঠকরা খেয়াল করবেন  নিরাপদ দেশ হিসাবে আমিরাত বিশ্বে একটি ব্রান্ড। আমিরাতের দিকে ইরানের মিসাইল তাক হলেই সে ব্রান্ডিংয়ের রাতারাতি পতন হয়ে যাবে। ফলে ইসরায়েলের সঙ্গে ইরান বিষয়ে গোয়েন্দা তথ্য আদান প্রদানের কথা বললেও শেষ পর্যন্ত ইরানের সঙ্গে একটি ভারসাম্য সম্পর্ক রাখছে আমিরাতিরা। 

আরব রাষ্ট্রগুলো এখন ফার্সিয়ান আর রাশিয়ানের চেয়ে তুর্কিদের উত্থান নিয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে উঠেছে সম্প্রতি হয়ে যাওয়া আরব লীগের পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের সভা তারই ইঙ্গিত দেয়। এই ভার্চুয়াল সভায় আমিরাতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, আরব দেশসমূহে তুর্কি হস্তক্ষেপ এই অঞ্চলে খারাপ পরিস্থিতি তৈরি করবে। মিসরের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আরব অঞ্চলে তুর্কির অগ্রসরকে আরব জাতীয়তাবাদের জন্য হুমকি বলে মন্তব্য করেছেন। আরব লীগের মহাসচিব উত্তর ইরাক, সিরিয়া ও লিবিয়া তুরস্কের সামরিক হস্তক্ষেপ নিয়ে আশঙ্কার কথা জানান। ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট সম্প্রতি বলেছেন, লেবাননে তার দেশ হস্তক্ষেপ না করলে তুরস্ক, ইরান ও সৌদি আরব তা দখল করে নিবে। শুধু আরব দেশ নয় আফ্রিকার আলজেরিয়া, তিউনিশিয়া, সেনেগাল ও গ্যাবনে তুরস্ক প্রভাব তৈরি করছে। হর্ন অব আফ্রিকা নামে পরিচিত সোমালিয়ায় আমিরাতের সঙ্গে মুখোমুখি দাঁড়িয়ে নিজেদের অবস্থান তৈরী করেছে তুরস্ক। এখন তুর্কি সামরিক ঘাঁটি রয়েছে সোমালিয়ায়। এমনকি মধ্যপ্রাচ্যের নাভী কাতারেও তাদের ঘাঁটি রয়েছে। তুরস্কের সামরিক সক্ষমতা যে বাড়ছে তা দিনের মতো পরিষ্কার। তুরস্কের সেনাবাহিনী সিরিয়া ও লিবিয়ায় রাশিয়ান সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে লড়ছে। ভূমধ্যসাগরে সামরিক মহড়া দিচ্ছে। ন্যাটোর বৃহত্তম এই মিত্র মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরাইল থেকে ড্রোন না পেয়ে নিজস্ব প্রযুক্তিতেই তা বানাচ্ছে। তুরস্ককে সামরিক প্রযুক্তি ও ভূ-রাজনৈতিকভাবে মোকাবেলায় আরবরা পাশে টানছে ইসরায়েলকে। তুরস্ক যে ‘রাজনৈতিক ইসলাম’ মতাদর্শের সমর্থক তার বিরুদ্ধে ইসরায়েল ও অনেক আরব দেশের মতক্যৈ রয়েছে।

তুরস্কের উপর চাপিয়ে দেয়া ঐতিহাসিক লুজান চুক্তির অন্যতম শর্ত ছিল তুরস্ক নিজ অঞ্চল থেকেও প্রাকৃতিক সম্পদ আহরণ করতে পারবে না। ফলে বর্তমান সময়ে প্রতিবছর ৪১০০ কোটি ডলারের জ্বালানি ক্রয় করতে হয় তুরস্ককে। ২০২৩ সালে শেষ হচ্ছে ঐতিহাসিক লুজান চুক্তির মেয়াদ। এরপর কৃষ্ণ সাগর ও ভূমধ্যসাগরজুড়ে থাকা খনিজ সম্পদ আহরণে নজর দিতে চায় তুরস্ক। সম্প্রতি কৃষ্ণ সাগরে যে ৩২৯ বিলিয়ন ঘনমিটার গ্যাস প্রাপ্তির কথা বলা হচ্ছে তা দিয়ে তুরস্কের বার্ষিক ৭ শতাংশ প্রয়োজন মিটবে। জ্বালানি আমদানিনির্ভর একটা দেশের জন্য এটা কম প্রাপ্তির না। কৃষ্ণ সাগরে সন্ধান পাওয়া গ্যাস নিজস্ব প্রযুক্তিতে উত্তোলন ও বাজারে সরবরাহের সক্ষমতাও রাখে তুর্কিরা। এসব আঁচ  করতে পেরে পূর্ব ভূমধ্যসাগরে তুর্কি বিরোধী একটি আঞ্চলিক ফোরাম করার ব্যাপারে সম্মত হয়েছে মিসর, ফ্রান্স, আমিরাত, গ্রিস, গ্রিক সাইপ্রাস, ইতালি, ফিলিস্তিন ও জর্ডান। ফ্রান্স ও আমিরাত ভূমধ্যসাগরীয় দেশ না হয়েও এই ফোরাম নিয়ে সবচেয়ে বেশী আগ্রহ দেখাচ্ছে দেশ দুইটি। এর অন্যতম কারণ আফ্রিকা মহাদেশে তুরস্কের অগ্রসর  নিয়ে শঙ্কিত আরবরা। 

লুজান চুক্তির মাধ্যমেই তুরস্ক মুসলমানদের পবিত্র দুই মসজিদ মক্কা মদিনার উপর কর্তত্ব হারায়, যার ফলে মুসলিম বিশে^ তুরস্কের প্রভাব ক্ষীণ হয়ে যায়। লুজান চুক্তির অন্যতম শর্ত ছিল  চুক্তির ১০০ বছর আরব অঞ্চলে অগ্রসর হতে পারবে না তুরস্ক। কিন্তু নতুন অটোমান প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখা তুর্কি প্রেসিডেন্ট ইতিমধ্যে সিরিয়া, লিবিয়া, ইরাকের কুর্দিস্থানে তার উপস্থিতি জানান দিয়েছে। কাতারের ঘনিষ্ট মিত্র হয়ে উঠেছে এরদোয়ান সরকার। ফিলিস্তিনি কর্তপক্ষ ও রাজনৈতিক দলের আস্থাভাজন হয়ে উঠেছে আঙ্কারা। ফলে স্পষ্টত আরব অঞ্চলে ধীর পায়ে পূর্ণ প্রস্তুতি নিয়ে অগ্রসর হচ্ছে তুরস্ক। লুজান চুক্তির মেয়াদ শেষে আরব অঞ্চলে তুরস্কের অস্ত্রের ঝনঝনানি আরও বাড়ার আশঙ্কা রয়েছে আরব রাজ শাসকদের। ফলে তুরস্ককে মোকাবেলায় আরব দেশসমূহ ঐক্য গড়তে যাচ্ছে। তবে এই ঐক্য গড়া একেবারে সহজ নয়। ইতিমধ্যে কয়েকটি আরব রাষ্ট্রে সংকটের অংশীদার তুরস্ক। কিন্তু মিসর, অমিরাত, ইসরায়েল ঐক্যমত তুর্কি ঠেকাতে। সৌদি আরব অবশ্যই পাশে থাকছে। কিন্তু তুরস্ক-কাতার-ইরান ঐক্য তাদের বড় মাথার কারণ হয়ে থাকবে। সে ঐক্যের দিকে ঝুঁকছে পাকিস্তান ও মালেশিয়াও। যুক্তরাষ্ট্রের বন্ধু আরবদের বিরোধী ঐক্যে ঘি ঢালতে প্রস্তুত রাশিয়া ও চীন। ফলে শিয়া বিদ্বেষ দিয়ে সুন্নি দেশসমূহ ইরান মোকাবেলা করলেও এবার তুরস্ককে মোকাবেলায় আরব জাতীয়তাবাদকে কতটা শক্ত করে ধরতে পারবে তা প্রশ্ন থেকে যায়।

শিক্ষার্থী, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন