দক্ষ মানবসম্পদ একটি দেশের অমূল্য সম্পদ। বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার প্রায় এক-তৃতীয়াংশ ১৮-৩৫ বছর বয়সী। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড। অর্থাৎ আমাদের দেশে বয়স্ক মানুষের চেয়ে কম বয়সীদের সংখ্যা বেশি হওয়ায় কর্মক্ষম লোক অধিক। যুব বয়সের নারী-পুরুষের উন্নয়ন ও ক্ষমতায়নের সঙ্গে ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ডের সুফল অর্জন ওতপ্রোতভাবে জড়িত। তাই জনসংখ্যার এ প্রতিশ্রুতিশীল ও উৎপাদনমুখী যুবগোষ্ঠীকে সুসংগঠিত, সুশৃঙ্খল ও দক্ষতা বৃদ্ধির মাধ্যমে দক্ষ মানবসম্পদে রূপান্তর করা জরুরি।
বাংলাদেশ সরকারের রূপকল্প ২০২১ ও ২০৪১ এবং জাতিসংঘ ঘোষিত টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের প্রক্রিয়ায় দেশের জনসংখ্যার সর্বাপেক্ষা সৃজনশীল ও উদ্যমী তরুণদের অংশগ্রহণ নিশ্চিতের বিকল্প নেই। এজন্য প্রয়োজন উন্নত শিক্ষা ও প্রশিক্ষণে ঋদ্ধ এক যুবসম্প্রদায়। দেশের যুব নারী-পুরুষদের সেভাবে গড়ে তোলা হলে তাদের সামগ্রিক উন্নয়ন ও ক্ষমতায়নের পথ হবে সুগম। ফলে তারা বাংলাদেশকে ডিজিটাল বাংলাদেশ, ২০২১ সাল নাগাদ মধ্যম আয়ের দেশ ও ২০৪১ সালে পৃথিবীর অন্যতম উন্নত দেশে উন্নীত করার লক্ষ্যে আত্মবিশ্বাস ও দক্ষতার সঙ্গে নিজেদের আত্মনিয়োগ করতে সক্ষম হবে।
বাংলাদেশের শ্রমবাজারের গতিপথ যেদিকে যাচ্ছে তাতে সেবা খাতের জন্য বিশেষায়িত প্রশিক্ষণ ও দক্ষতা বেশি দরকার হবে। শ্রমবাজার সম্প্রসারণের সঙ্গে সঙ্গে সামনের দিনগুলোতে দক্ষতার বিষয়টি বেশি প্রাধান্য পাবে। দক্ষতানির্ভর এবং বিশেষায়িত জ্ঞান নিয়ে তরুণরা তৈরি হলে ভালো মানের কর্মসংস্থানের অভাব হবে না। বাংলাদেশের ভেতরে ও দেশের বাইরে শ্রমবাজার একই ইঙ্গিত দিচ্ছে। যুবসম্প্রদায়কে দক্ষ করে গড়ে তুলতে সরকারি ও বেসরকারি বিভিন্ন পর্যায় থেকে নানা কৌশল প্রণয়নের পাশাপাশি বাস্তবায়ন করতে হবে। প্রণীত কৌশলগুলো সঠিকভাবে বাস্তবায়ন হলে শিল্প ও সেবা খাতের বিকাশ হবে, যা তরুণদের জন্য চাকরির বাজার বিস্তৃতিতে সহায়ক ভূমিকা পালন করবে।
আশার বিষয় হচ্ছে, বাংলাদেশে সরকারি ও বেসরকারি উভয় পর্যায়েই যুবসম্প্রদায়ের দক্ষতা বিকাশের জন্য প্রয়োজনীয় উদ্যোগ লক্ষণীয়। দেশের শ্রমবাজারের গতিপ্রকৃতি বিবেচনায় রেখে তরুণ জনগোষ্ঠীকে দক্ষ জনশক্তি হিসেবে গড়ে তোলার জন্য বাংলাদেশ সরকার জাতীয় দক্ষতা উন্নয়ন নীতি ২০১১ প্রণয়ন করে। সরকারের মন্ত্রণালয় ও বিভাগ, বেসরকারি ও এনজিও পরিচালিত কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ প্রদানকারী বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের মধ্যে সমন্বয় জোরদার করে এ নীতি বাস্তবায়নের জন্য ‘জাতীয় দক্ষতা উন্নয়ন কাউন্সিল’ গঠন করা হয়। এ কাউন্সিলের তত্ত্বাবধানে ২০১৪ সালে জাতীয় দক্ষতা উন্নয়ন কর্মপরিকল্পনা (পর্যায় ১) বাস্তবায়ন শুরু হয়। এটি প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের সঙ্গে সরকারের নয়টি মন্ত্রণালয় ও আটটি অধিদপ্তর যুক্ত ছিল। এটির মেয়াদ ২০১৫ সালের ডিসেম্বরে সমাপ্ত হয়। কর্মপরিকল্পনার দ্বিতীয় পর্যায় (২০১৭-২১) বাস্তবায়নের কাজ চলছে। যুবদের উন্নত মনন, মানবিকতা, আধুনিক ও দক্ষ প্রজন্মরূপে বিকশিত করার চেতনা নিয়ে সরকার জাতীয় যুবনীতি ২০১৭ প্রণয়ন করেছে। এছাড়া সরকারের যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয় যুবসম্প্রদায়ের দক্ষতা বৃদ্ধিতে বিভিন্ন কার্যক্রম পরিচালনা করছে।
তরুণদের দক্ষতা উন্নয়নে অসামান্য সাফল্যের স্বীকৃতিও পেয়েছে বাংলাদেশ। গত বছর তরুণদের দক্ষতা উন্নয়নে ভূমিকার স্বীকৃতি হিসেবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ‘চ্যাম্পিয়ন অব স্কিল ডেভেলপমেন্ট ফর ইয়ুথ’ সম্মাননায় ভূষিত করেছে জাতিসংঘের শিশুবিষয়ক তহবিল (ইউনিসেফ)।
সরকারের পাশাপাশি বিভিন্ন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানও যুব নারী-পুরুষের দক্ষতা বাড়ানোর লক্ষ্যে বিভিন্ন উদ্যোগ নিয়েছে। এক্ষেত্রে বাংলাদেশের মেধাবী শিক্ষার্থীদের বিকাশে এবং তাদের মাঝে তথ্যপ্রযুক্তি-বিষয়ক শিক্ষা প্রসারের লক্ষ্যে হুয়াওয়ে টেকনোলজিস (বাংলাদেশ) লিমিটেডের ‘সিডস ফর দ্য ফিউচার’ উদ্যোগটির কথা বিশেষভাবে বলা যায়। এ উদ্যোগের আওতায় শিক্ষার্থীরা বিশ্বের নতুন প্রযুক্তি যেমন—ফাইভজি, ক্লাউড ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা প্রভৃতি বিষয়ে জ্ঞানার্জনের সুযোগ পায় এবং প্রোগ্রামটিতে শিক্ষার্থীদের একাডেমিক ও খাত সংশ্লিষ্ট জ্ঞানের অসাম্য দূরীকরণের ওপর জোর দেয়া হয়। এ ধরনের উদ্যোগ নিঃসন্দেহে তরুণদের উদ্ভাবনী চিন্তার বিকাশে ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে।
যখন একটি বীজ খোলস ছেড়ে মাটি ফুঁড়ে বের হয় তখন এর পাতা ও ডালগুলো খুব নরম থাকে। কিন্তু সঠিক পরিচর্যা পেলে ধীরে ধীরে নরম এ ডাল ও পাতাগুলো শক্তিশালীভাবে বিকশিত হয়। কিছু বীজ নিজেদের মেলে ধরতে পারে, আর কিছু পারে না। আমাদের তরুণরাও বীজের মতো। তাদের যদি সঠিকভাবে পরিচর্যা করা হয় তবে তারা বিকশিত হবেই। তাই আমাদের সবার উচিত তাদের বিকাশের লক্ষ্যে কাজ করা। কারণ এ মেধাবী শিক্ষার্থীরাই ২০২১ সালের মধ্যে ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়তে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।
উদ্যোগটির বিশেষ একটি দিক হচ্ছে, এ প্রোগ্রামের আওতায় বাংলাদেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা চীনে অবস্থিত হুয়াওয়ের গবেষণা ও উন্নয়ন কেন্দ্রগুলোয় প্রশিক্ষণের সুযোগ পাচ্ছে। এর মধ্য দিয়ে তারা নতুন নতুন দক্ষতা অর্জন করতে পারছে, যার মাধ্যমে পরবর্তী সময়ে তারা স্থানীয় চাহিদা মেটাতে পারছে। বিগত বছরগুলোর মতো এ বছরও ‘সিডস ফর দ্য ফিউচার’-এর কার্যক্রম অনুষ্ঠিত হয়েছে। চলতি বছর এ প্রোগ্রামে অংশ নিয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (ঢাবি), বাংলাদেশ প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট), চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (চুয়েট), খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (কুয়েট) এবং রাজশাহী প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (রুয়েট) ইলেকট্রিক্যাল অ্যান্ড ইলেকট্রনিকস ইঞ্জিনিয়ারিং (ইইই) বিভাগ এবং কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং (সিএসই) বিভাগের শিক্ষার্থীরা। এ কার্যক্রমের মাধ্যমে নির্বাচিত শিক্ষার্থীরা নিঃসন্দেহে তাদের জ্ঞান ও দক্ষতায় নতুন মাত্রা যোগ করতে সক্ষম হয়েছেন।
এছাড়া উল্লেখ করা যেতে পারে সরকারি ও বেসরকারি অংশীদারিত্বে নারীদের তথ্যপ্রযুক্তি-বিষয়ক ক্ষমতায়নের লক্ষ্য গ্রহণ করা আরেকটি উদ্যোগের কথা। লার্নিং অ্যান্ড আর্নিং শীর্ষক সরকারের আইসিটি বিভাগের তিন বছর মেয়াদি এ উদ্যোগে হুয়াওয়ের মতো বেসরকারি খাতের প্রতিষ্ঠানও অংশগ্রহণ করেছে, যা নিঃসন্দেহে ইতিবাচক। নারীদের দক্ষতা বিকাশে বাংলাদেশের প্রত্যন্ত এলাকার স্কুল-কলেজ পড়ুয়া ২১ হাজারেরও বেশি শিক্ষার্থীকে বিনামূল্যে তথ্যপ্রযুক্তি-বিষয়ক প্রশিক্ষণ দিয়েছে আইসিটি ডিভিশন ও হুয়াওয়ে।
একটি দেশের তরুণ প্রজন্ম কতটুকু জ্ঞান অর্জন করছে এবং দক্ষ হয়ে বেড়ে উঠছে এটি সে দেশের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কেননা এ তরুণ প্রজন্মই আগামী দিনে দেশের উন্নয়নে অবদান রাখবে। তাই বাংলাদেশের উন্নয়নের লক্ষ্যে দেশের তরুণদের দক্ষতা বৃদ্ধিতে সবাইকে সম্মিলিতভাবে কাজ করতে হবে। আর এ সম্মিলিত পর্যায়ের কাজটি হতে হবে একই সঙ্গে যেমন সরকারি পর্যায় থেকে, তেমনি বেসরকারি পর্যায় থেকে। আর তবেই তা দেশের তরুণদের দক্ষ করে গড়ে তুলতে নতুন দিগন্ত উন্মোচন করবে।
ড. এ. কে. এম. আশিকুর রহমান: বাংলাদেশ প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) কম্পিউটার সায়েন্স ও ইঞ্জিনিয়ারিং (সিএসই) বিভাগের অধ্যাপক ও প্রধান